যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-১৫

0
800

যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব ১৬

খাতা দেখে বের হতে হতে রুমির দেরি হয়ে গেল। সামনে সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষা, এই পরীক্ষার উপর নির্ভর করবে কারা কারা প্রফে বসতে পারবে। কলেজের লাইব্রেরিতে তাই ভীর লেগে আছে, সবার মাথার উপর পরীক্ষার চাপ। কলেজ ছুটি হয়ে গেলেও স্টুডেন্টদের আনাগোনা কমেনি। যারা হলে থাকে, তারা লাইব্রেরি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত এখানে পড়ে, অন্য যারা বাইরে থাকে, তারাও যতক্ষণ সম্ভব গ্রুপ স্ট্যাডিতে সময় দেয়।

এই জমজমাট মহলে রুমি খেয়ালই করেনি কখন ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘর পেরিয়েছি। তড়িঘড়ি করে বের হয় রাস্তায়। মেইনরোড থেকে খানিকটা গলির ভেতরে কলেজ। মেইনরোড ভিআইপি রোড হওয়ায় রিকশা চলতে দেয় না। অন্য সময় গলির ভেতরে রিকশা পেলে ভেতর দিয়ে গলির ভেতর দিয়ে রাস্তার অন্য পাশে ওঠে, যেখানে রিকশা চলতে আর বাঁধা নেই। কিন্তু আজ গলিতে রিকশা নেই। গলির ভেতর দিকে হাঁটতে ইচ্ছে করছে না, রিকশা না পেলে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে, তারচেয়ে মেইনরোডে উঠে রাস্তার ঐ পাড়ে গিয়ে রিকশা নেওয়া ভালো মনে হলো। মাসের শেষে উবার ডাকা সম্ভব না।

দ্রুত পা চালায় রুমি, বাসায় ফিরতে দেরি হলে অযথা একটা চাপে পড়তে হয়। কলেজ ছুটি হওয়ার আধা ঘণ্টার ভেতর বাসায় না ঢুকলে জেরার মুখে পড়া লাগে। মায়ের মনে হয় অযথাই দেরি করে,না হয় আড্ডা দেয়। মাকে বুঝাতে পারে না এটা এখন চাকরি, এখানে কলিগ আছে, তাদের সাথে একটা পোষাকি সম্পর্ক আছে। কিন্তু রোজ রোজ আড্ডা দেওয়ার কেউ নেই। রুমির মাঝেমাঝে মনে হয় স্বাধীন হয়েও আসলে ও স্বাধীন কই!
আবার ঠান্ডা মাথায় ভাবলে এটাও বুঝতে পারে যে সে বাসায় ফিরলে তবেই আম্মা রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পান। বয়স হয়েছে, এখন সংসারের কাজ সামলে ছোট একটা বাচ্চাকে সারাক্ষণ রাখা ওনার জন্য সহজ না। তবে ভালো দিক হলো এখন রুমির আব্বা সানোয়ার সাহেবও নাতনির ভালোই দেখাশোনা করেন।

রাস্তায় আজ প্রাইভেট কার ছাড়া অন্য গাড়ি নেই বললেই চলে। পরিবহন ধর্মঘট চলছে, খালি রিকশাও নেই বললেই চলে, দুই একটা যা পায়, কেউ যেতে রাজি নয়, ভরদুপুরে সবার খাওয়ার তাড়া আছে। রুমি ইতি উতি তাকিয়ে রিকশার খোঁজ করতে করতে থাকে, হঠাৎ একটা বাইক পাশে এসে থামে। হেলমেট খুলে হাসান প্রশ্ন করে, “রুমি আপা, রিকশা পাচ্ছেন না?”

হাসানও বোধহয় আজ দেরিতেই বের হয়েছে, তবে রুমির সাথে দেখা হয়নি। হাসানের ক্লাস আজ লাস্ট পিরিয়ডে ছিল। হয়তো ক্লাস শেষে এখন বের হয়েছে।। রুমি ভেবেছিল কলেজের সবাই চলে গিয়েছে।

“না, হাসান ভাই। ভরদুপুরে রাস্তা ফাঁকা প্রায়। তবে পেয়ে যাব, একটু অপেক্ষা করি।”

“আজ রাস্তায় গাড়ি কম, রিকশার ডিমান্ড বেশি। রুমি আপা, সমস্যা না থাকলে বাইকে বসেন, আমি নামিয়ে দেই। আপনি বের হওয়ার সময় খেয়াল করেছি কলেজের গেটে রিকশা পাননি, তখন গেটেই বলতাম, পরে ভাবলাম কলেজের সামনে আপনি বিব্রত হতে পারেন।”

হাসানের এই বিচার বিবেচনাবোধটুকু রুমির ভালো লাগে। কথাবার্তা আর আচার আচরণে বেশ মার্জিত হাসান। তাছাড়া হাসান এতকিছু খেয়াল করেছে ভেবে ভালোই লাগে। রুমির ইচ্ছে করছে বাইকে উঠতে, একে তো হাঁটার শক্তি পাচ্ছে না, তারউপর সময়মতো বাসায় যাওয়ার তাড়া। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো সবকিছু করা যায় না।

“হাসান ভাই, ধন্যবাদ বলার জন্য। কিন্তু রিকশা পেয়ে যাব। একটু দাঁড়াই।”

“আসেন তো আপা। কেউ দেখবে না, সবাই আগেই বের হয়ে গিয়েছে। আপনার এত আনইজি লাগার কিছু নেই।” মিষ্টি করে হাসে হাসান। ছেলেমানুষের হাসিও যে এত সুন্দর হতে পারে আগে কখনো খেয়াল করা হয়নি রুমির, একটু মুগ্ধ চোখেই তাকিয়ে আছে বোধহয়, মনে হতেই দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়।

ইতস্তত করে বাইকে বসে রুমি। মোটরসাইকেলে ওঠার অভিজ্ঞতা তেমন নেই, একটু ভয়ে ভয়ে স্ট্যান্ড আঁকড়ে ধরে। “শক্ত করে ধরেছেন তো? টান দিলে পড়ে যাবেন কিন্তু।”

হাসান যখন বাইক টান দেয়, এক অদ্ভুত ইচ্ছে হঠাৎ জেগে ওঠে রুমির মনে। মনে হয় আজ এখনি ও বাসায় ফিরো না যাক। রোজ তো সেই আটপৌরে জীবন, আজ কী এই চমৎকার বাতাসে ভাসতে ভাসতে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যেতে পারে না!

না পারে না, বাস্তবতা বারবার ওকে স্বপ্ন থেকে টেনে নিয়ে আসে। বাসায় ফিরতে হবে, ছোট্ট মেয়েটা অপেক্ষায় আছে, ওর কাছে পৌঁছাতে হবে।
রুমির আবার বিয়ে, নতুন জীবনসঙ্গীর কথা সবাই বললেও তিতলির কথা ভেবে রুমি আগায় না। ওর একটাই ভয়, দ্বিতীয় বিয়ের পর যদি তিতলির জীবনটা আরও কঠিন হয়ে যায়! তাছাড়া এমনি তার কোন সমস্যা হয় না, ব্যস্ততায় একাকিত্বের অনুভূতিও তেমন আসে না। শুধু ইদানীং হাসানের আশেপাশে থাকলে কেমন জানি একটা খালি খালি অনুভূতি হয়। এক অজানা আকর্ষণে না চাইলেও জড়িয়ে যায়। মনকে তো বেঁধে রাখা যায় না, নিজের মতো সে দৌঁড়াতে থাকে।

হিমেলের সাথে রুমির বিয়ে পারিবারিক ভাবেই
হয়েছিল, এই ধরনের কোন অনুভূতি তাই শুরুতে হয়নি। বিয়ের পর ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই সংসার সন্তান হয়েছে, কিন্তু সেখানে সে সুখী ছিল। হিমেল প্রতারণা করছে জানার আগে পর্যন্ত হিমেলকে ভালোবাসে না এই কথাটা একবারও মনে হয়নি। মান অভিমান ঝগড়া সব সংসারেরই অংশ মনে হয়েছিল। হিমেলের দ্বৈত জীবনের সত্য যখন সামনে আসে তখন সব অনুভূতি তেতো এক ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল। প্রেম প্রেম অনুভূতি কী তা আসলে কখনোই তাই বোঝা হয়ে ওঠেনি। এখনো হবে না জানে রুমি। হাসানের মতো ছেলের নিশ্চয়ই প্রেমিকা আছে, না থাকলেও সে এক সন্তানের মা রুমির দ্বিতীয় স্বামী নিশ্চয়ই হতে চাইবে না। কথাগুলো মনে হতেই রুমির ভালোলাগার রেশ কেটে যায়।

রুমি বাসার কাছাকাছি এসে বাইক থামায় হাসান। বাসার গেট পর্যন্ত যায় না, হয়তো বুঝতে পেরেছে, গেটে নামালে বিল্ডিং এ অযথাই একটা আলোচনা হবে।তাই একটু আগেই রুমিকে নামিয়ে দেয়। রুমির হাসানের এই ছোটছোট দিকগুলোই ভালো লাগে, অনেক কিছুই বলার আগে বুঝে নেয়। রুমি নিজেই একটু নামিয়ে দিতে বলবে ভেবেছিল, কিন্তু বাসা পর্যন্ত এসে উপরে উঠতে না বলা অভদ্রতা হয়ে যায়। তাই কিভাবে বলবে তাই নিয়ে বিব্রত ছিল। কিন্তু হাসান নিজেই বাইক থামিয়ে বলে, “গলিতে আর ঢুকলাম না। চলে যেতে পারবেন না? আমি এখান থেকেই বাসার দিকে যাব।”

“না না কী বলেন। এতদূর এসেছেন। এই ভরদুপুরে না খেয়ে গেলে হবে না, বাসায় চলেন। দুটো ডালভাত খাবেন।”

“খাবো যখন পোলাও কোরমা খাব। ডালভাত তো রোজ খাই। একদিন দাওয়াত নিয়েই আসব। আজ আসি।”

বাইক স্টার্ট দেয় হাসান। আন্তরিক ভাবেই ধন্যবাদ দিয়ে সামনে আগায় রুমি। মনের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here