যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-১৭

0
824

#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব১৭

মরিয়মের ইদানীং শরীর খুব খারাপ লাগে, সবে মাত্র এগারো সপ্তাহ চলছে। এত তাড়াতাড়ি ছুটি নিতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু দীর্ঘ বিরতির পর দ্বিতীয় প্রেগন্যান্সি, বেশি বয়সের সন্তান, এ সময়ে তাই ছোটো-ছোটো অস্বস্তিকর লক্ষ্মণও হেলাফেলা করা উচিত না। অনেক ভেবে মরিয়ম সিদ্ধান্ত নেয় দুদিন ছুটি নিবে ক্যাজুয়াল লিভ থেকে। বাসায় থেকে রেস্ট নিবে, রুমনকে সময় দিবে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য রুমনকে আর আগের মতো সময় দিতে পারে না, রুমনও কী কিছু বুঝেছে কিনা কে জানে, আগের মতো আর মরিয়ম বাসায় আসলে পেছন পেছন ঘুরে না। আড়াল থেকে মাকে দেখে। বমি, মাথা ঘোরা এসব সমস্যার জন্য মরিয়মের শরীর বেশ খারাপ লাগে, বাসায় থাকলেও শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তবে মরিয়মের ভালো লাগে যে এই সময়টা শাশুড়ি রুমনকে দেখে রাখেন। মরিয়ম মাঝেমাঝে রুমনের ক্লাসের কাজে সাহায্য করতে গেলেও শাশুড়ি মা করতে দেন না। তিনি একটা সুস্থ বাচ্চা র জন্য এত চিন্তা করেন বুঝে মরিয়ম। কিন্তু রুমনের এক্টিভিটিগুলো আগের মতো চর্চা করা হচ্ছে না, ওর বিকাশের জন্য ডাক্তার বেশকিছু নিয়ম চার্ট করে দিয়েছিলেন, এখন সেসব অনিয়মিত হয়ে গিয়েছে। শাশুড়ি এসব এতটা বোঝেন না, করোনায় স্কুলও বন্ধ। একটা স্পেশাল স্কুলে পড়ে রুমন, অনলাইন আসলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চাদের জন্য অতটা সহায়ক হয় না। শিহাব সাহেব ব্যবসায়ীক কাজে এত ব্যস্ত থাকে যে নিয়ম করে সব দেখা সম্ভব না। মরিয়ম দেখে যে রুমনের এখন সময় কাটে ড্রয়িং করে। এই একটা জিনিস রুমনকে শান্ত করে ধরে রাখে।

অবশ্য রুমন এমনিতেও নিজের জগতে শান্ত চুপচাপ থাকে, যতক্ষণ না কোন কিছু তাকে বিরক্ত করছে। রুমনের অটিজমের ধরনটা “এসপারজার সিন্ড্রোম” নামে পরিচিত। এই ধরনের অটিজমে বাচ্চার বুদ্ধিবৃত্তিতে কোন সমস্যা থাকে না, কথাও মোটামুটি সবই বলতে পারে। তবে একই কথার পুনরাবৃত্তি করে ততক্ষণ, যতক্ষণ তার মনমতো না হয়। তবে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আছে, যেমন নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, হৈচৈ অনেক সময় রুমনকে অস্থির করে তুলে। সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে হঠাৎ মিশতে পারে না, ওরাও রুমনের সাথে সহজ হয় না। ফলে রুমন নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কোন কাজে বারবার বাধা পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আর এই সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ যোগ্য, যদিও সহজ নয়, দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধরে আস্তে আস্তে সব শেখাতে হয়। তবে সময়ের সাথে সঠিক যত্ন পেলে এই সিন্ড্রোমের বাচ্চারা বড় হতে হতে আচরণে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যায়, আর দশজনের মতো দৈনন্দিন কাজগুলো করতে পারে। পড়ালেখায় ভালো ফলাফল করতে পারে, যে বিষয়ে দক্ষতা আছে যেমন, গান, ছবি আঁকা এই সব বিষয়ে ভীষণ পারদর্শিতা দেখায়। মরিয়ম আর শিহাবও আশা রাখে একসময় রুমন আর দশজনের মতো নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।

“মরিয়ম, তোমার চেহারা কেমন ফ্যাকাশে লাগে কেন? শরীর খারাপ লাগে? কয়দিন ছুটি নিতে বলি, কথা শুনো না।”

“নেব আম্মা। আগামী দুইদিন ছুটি নেব। রুমনকেও সময় দেওয়া হয় না। ছেলেটা একা একা থাকে।”

“একা কই, শিহাব থাকে সকালে। আর আমি তো আছি। তোমার ননদ আসে ফাঁকে ফাঁকে। আর ও তো সারাদিন ছবিই আঁকে, বাইরে তো যায় না, বাসাতেই আছে।”

“হ্যাঁ অনেকদিন হলো রুমনকে পার্কে নেওয়া হচ্ছে না। ডাক্তার বলেছিল ওকে বাইরের শান্ত পরিবেশে নিতে। দেখি শুক্রবার নিয়ে যাব।”

“তোমার এখন এগুলো মাথায় নেওয়ার দরকার নাই। বাচ্চা হবে সাবধানে থাকো। এইসব গাছপালার ভেতর গেলে খারাপ বাতাস লাগে। আগে বাবু সুস্থ ভাবে হোক তারপর দেখা যাবে।”

“আম্মা বাতাস লাগা কুসংস্কার। আর বাবু হতে এখন ছয়মাসের বেশি সময় আছে। সামনে শরীর ভারি হলে বের হতে পারব না।”

“মরিয়ম প্রথম বাচ্চার সময় আমি কিছু আটকাই নাই, যা মন চায় করছো। বাচ্চা পেটে নিয়ে রাতে নাইট ডিউটি করছো, ভরসন্ধ্যায় ঘর থেকে বাইর হইছো। এইবার আমি এসব সহ্য করবো না।”

মরিয়ম বোঝে যে শাশুড়ি রেগে যাচ্ছে। নাতি নাতনির স্বপ্ন যে ওনার মনে ভীষণ চাপ ফেলেছে তা বুঝতে পারছে। হঠাৎ মরিয়মের ভয় লাগে, শাশুড়ির এই অবসেশন রুমনের জন্য কতটা ভালো হবে!

“আম্মা, রুমনের অটিজমের সাথে খারাপ বাতাসের সম্পর্ক নেই। ও মানুষের সাথে মিশতে পারে না, এছাড়া কিন্তু ওর আর কোন সমস্যা নেই। আমরা সাহায্য করলে ও এটাও কাটিয়ে উঠবে। এখন হঠাৎ নতুন মানুষের আগমনে ওকে অবহেলা করা যাবে না। রুমন আমার প্রথম সন্তান। দুই বাচ্চাই আমার কাছে সমান, ওদের আলাদা করে দেখবেন না।”

মরিয়মের শাশুড়ি মনে মনে বিরক্ত হোন। বৌমাকে তিনি ভালোবাসেন, কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে এই জেদ ওনার ভালো লাগে না। দুই কলম ডাক্তারি পড়ে সারাক্ষণ জ্ঞান দেয়। এইজন্য তার বোন বলেছিলেন বেশি শিক্ষিত মেয়ে আনতে না, অবাধ্য হয়। তখন না বুঝলেও এখন তিনি একমত। আরেকটা নাতি নাতনির জন্য কতদিন ধরে মরিয়মকে চেষ্টা করতে বলেছেন, কিন্তু মরিয়ম কানে নেয়নি। শেষে তিনি রাগ করে বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর নরম হয়েছে। এখন এই নাতি বা নাতনি সুস্থ ভাবে দুনিয়ায় আসুক, এই তিনি চান, অথচ মরিয়ম এখনো রুমন রুমন করে অস্থির। তিনি ঠিক করেন মরিয়মকে চাপ না দিয়ে আস্তে আস্তে মন বাচ্চার দিকে ঘুরাবেন, বেশি চাপ দিলে মরিয়ম বেঁকে যেতে পারে। “মরিয়ম রুমন আমারও নাতি। আমি কোন অংশে আমার মেয়ের ঘরের নাতি নাতনির চেয়ে কম আদর করি বলে মনে হয়? তাহলে আরেকজন আসলে রুমনের আদর কমবে এমন ভাবলে কেন? আমরা না হয় আগের দিনের মানুষ, কিন্তু তোমাদের শিক্ষা থাকলে আমাদের দুনিয়া দেখার জ্ঞান আছে। মাঝেমাঝে মুরুব্বিদের কথা শুনলে ছোট হবা না।”

মরিয়ম শাশুড়ির হাত ধরে ফেলে, “আম্মা, মনে কষ্ট নিয়েন না। রুমনকে নিয়ে কথা হলে আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। মাফ করে দেন। আচ্ছা আপনি যেভাবে বলবেন তাই হবে।”

“আচ্ছা, মনে থাকলে হয়। আর তুমি ঘুমাও একটু। রুমন উঠে গেলে ঘুমাতে পারবে না।”

শাশুড়ি উঠে যান, মরিয়ম আস্তে আস্তে ঘুমন্ত রুমনের পাশে গিয়ে বসে। আগে রুমনের ঘুম কম হতো।কিন্তু ইদানীং রোজ বিকেলে রুমনকে ঘুমাতে দেখে মরিয়ম। ও ফেরার আগেই শাহেদ রুমনকে খাইয়ে দিয়ে যায়। মরিয়মের বাসায় আসতে তিনটা বাজে, ও আসলে কিছুক্ষণ রুমনে জেগে থাকতে দেখে, ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে দেখে রুমন ঘুম। এই নিয়মিত ঘুম কি ভালো লক্ষণ কিনা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে হবে ভাবে। আনমনে উঠে রুমনের ঔষধের বক্সের দিকে যায় মরিয়ম। ইদানীং শরীর খারাপ থাকায় ঔষধের দিকে মন দেওয়া হয় না। অবশ্য এখন তেমন কোন ঔষধ চলছে না। আগো খিঁচুনি হতো, তার জন্য ঔষধ চলেছিল। কিছু ঔষধ দিয়েছিলেন ডাক্তার কিছুদিন আগে, যখন রুমন রাগ করে নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিল। সেই ঔষধের ডোজও আস্তে আস্তে কমিয়ে বন্ধ করা হবে। বক্স খুলে মরিয়ম অবাক হয়, ঘুমের ঔষধের পাতার কয়েকটা ওষুধ নেই, একটা হাফ ট্যাবলেট খোলা স্লিপে চাপ দিয়ে রাখা। রুমনকে কী দুপুরে ঘুমের ঔষধ হাফ করে দেওয়া হচ্ছে!! শিহাব আসলে জিজ্ঞেস করবে ভাবে মরিয়ম। মনটা খচখচ করে ওঠে, ছেলেকে কী অবহেলা করছে মরিয়ম!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here