যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-২৮

0
1807

যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব ২৮

(পিচ্চি পর্ব, ঈদের সময় ব্যস্ততায় বড় লেখা হয়নি)

হাসপাতালের বারান্দায় বসে একমনে তসবি গুনছেন মরিয়মের শাশুড়ি মা। শিহাব কখনোই মাকে কড়া কিছু বলতে পারে না। তাছাড়া কখনো বলার প্রয়োজনও হয়নি, সবসময়ই মাকে ভীষণ বুঝদার একজন মানুষ মনে হয়েছে। অথচ মরিয়মের দ্বিতীয় প্রেগন্যান্সির কথা জানার পর থেকেই মা কেমন অবুঝের মতো আচরণ করছেন। রুমনকে নিয়ে যে ওনার মনে এত কষ্ট ছিল তা শিহাব কখনো বুঝতেই পারেনি। সবসময় এত আদর দিয়েছেন নাতিকে, রুমনের অটিজম ওনার আদরের অন্তরায় ছিল না কখনো। অথচ এই আট মাসে রুমন আর তার দাদির মাঝে স্পষ্ট একটা দূরত্ব চলে এসেছে। রুমন বোকা নয়, ও সব কিছু বোঝে, বরং বেশ ভালোভাবেই বোঝে, তাই দাদির কাছ থেকে ধীরে ধীরে পাওয়া অবহেলাটা অনুভব করে নিজেই সরে গিয়েছে। হাসপাতালেও রুমন তাই শিহাবের গা ঘেঁষে আছে। শিহাবের বোন দুলাভাইও চলে এসেছেন। মরিয়মের মা বাবা ঝগড়ার ঘটনা কিছুই জানে না, ওনারা ভেবেছেন হঠাৎ সময়ের আগে মরিয়মের পানি ভেঙে গিয়েছে, এমনিতেও মরিয়মের প্রেগন্যান্সি, রিস্ক প্রেগন্যান্সি ছিল। শিহাব এই মুহূর্তে হাসপাতালে আর কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি চায় না, তাই ওনাদের কিছু বলেনি। মরিয়মকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে, ইমার্জেন্সি সি সেকশন করতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে হাসপাতালে উপস্থিত সবার মনে শুধু মরিয়মের সুস্থতার দোয়া। মা সুস্থ থাকুক, আর সুস্থ একটা বাবু এই দুনিয়ায় আসুক, এই কামনায় আল্লাহকে ডেকে চলছে সবাই।

****
ভোর ছয়টা না বাজতে রুমির ঘুম ভেঙে যায়। একমুহূর্তের জন্য মনে পড়ে না ও কোথায় আছে, দু মিনিট পর মাথাটা পরিষ্কার হয়। পাশে তাকিয়ে তিতলি আর রাকিনের ঘুমন্ত মুখটা চোখে পড়ে। কী সুন্দর নিষ্পাপ দুটো মুখ যেন, আটপৌরে সাংসারিক জীবনের খুব সাধারণ মায়াময় দৃশ্য। স্বামী, সন্তান নিয়ে সহজ সরল জীবন, যেমনটা সব মেয়ে চায়। কিন্তু সবসময় সহজ কিছু আর সহজ হয়ে ধরা দেয় না। একটা সময় এই দৃশ্যে শুধু হিমেল ছিল, তারপর সে প্রাক্তন হলো। বিচ্ছেদের বহুদিন পরও হঠাৎ হঠাৎ সকালে ঘুম ভাঙলে পাশের বালিশটায় রুমি হিমেলের মুখটা মিস করতো। হিমেলের সাথে তো সে সারাটা জীবন কাটাতে চেয়েছিল, হিমেল যদি পরকীয়ায় না জড়াতো, খুব সহজ একটা জীবনই রুমি আর তিতলি পেতে পারতো। এই যে আবার নতুন করে সবকিছুতে অভ্যস্ত হওয়ার পরীক্ষায় রুমিকে নামতে হতো না। হাসান বা রাকিন কারও নামই জড়াতো না তার জীবনে।

ভাবতে ভাবতে রুমির মনে পড়ে ছুটি নেওয়া দরকার, অন্তত দুইদিন ছুটি নেবে সে। রাকিন ছুটি না নিলে না নিবে, কিন্তু আপাতত রুমি কয়েকদিন হাসানের মুখোমুখি হতে চায় না। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে ফোন অফ, আর অন করা হয়নি। চার্জ শেষ হয়ে ফোনটা বন্ধ হয়ে ছিল। চার্জারটা ব্যাগেই আছে। চার্জার লাগিয়ে ফোনটা অন করতেই একের পর এক নোটিফিকেশন আসতে থাকে রুমির। সাতটা ম্যাসেজ হাসানের নাম্বার থেকেই এসেছে। রুমি না পড়েই ম্যাসেজগুলো ডিলিট করে, তারপর ফোন, ম্যাসেনজার, ফেসবুক সবখানেই ব্লক করে দেয় হাসানকে। যার জীবন থেকে সরে গিয়েছে, তাকে একবারেই ধুয়েমুছে ফেলা দরকার। তুষের আগুনের মতো না হয় তা যেকোনো সময় জ্বলে উঠতে পারে।
প্রতারণা করাটা রুমির রক্তে কখনোই ছিল না, এখনো নেই। রাকিনকে ভালোবাসতে পারুক না পারুক, তাকে ধোঁকা কোনদিন দিবে না। এমন কী রাকিন যদি স্বাভাবিক ভাবে স্বামীর অধিকার চায় তাতেও সে না করবে না, অবশ্যই তার সাথে জোরজবরদস্তি করার অধিকার কারও নেই, কিন্তু রাকিন তার প্রাপ্যটুকু চাইলে সে ফিরিয়ে দিবে না।

নাস্তার টেবিলে রাকিনের কাছে ফোন আসে শিহাবের। তিতলিকে সাথে নিয়েই রাকিন আর রুমি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়।

“ভাইয়া কাল রাতের ঘটনা, আর আপনি এখন ফোন দিলেন। আমাদের রাতেই জানালেন না কেন?”

“তোমরা নিজেরাও কত ঝামেলার মাঝে ছিলে। তাই ফোন দিয়ে বিরক্ত করিনি।”

“এটা কোন কথা ভাইয়া, আমাদের জন্য কাল আপনাদের এত ঝামেলা গেল। আর আমরা এত স্বার্থপর যে ফোন দিলে বিরক্ত হবো। আপু কেমন আছে ভাইয়া? বাবুকে NICU তে রেখেছে? ”

রুমিকে দেখে বিরক্ত হচ্ছিলেন শিহাবের আম্মা। কেন জানি মরিয়মের সাথে রুমির বন্ধুত্ব ওনার পছন্দ না। এখন হাসপাতালে রুমিকে দেখে বিরক্ত চাপা দিতে পারেন না।

“রুমি না তুমি? দুই দিন পরপর এক কাহিনি করো, আর মরিয়মকে এসবের মাঝে জড়াও। এই তোমার কাহিনির জন্য কাল সারাদিন মরিয়ম বাইরে ছিল। নিজের ছেলের কথা আর কী বলবো, কোনদিন বৌকে ভালোমন্দ বুঝ দেওয়ার সাহস তার হয়নি। কিন্তু বৌমার নিজেরও কোন দায়দায়িত্ব নেই। এই শরীরে না হলে সারাদিন বাইরে থাকে! আমার কোন কথাই শোনে না। এখন নাতিটাকে না হারিয়ে ফেলি।”

শিহাব কাল থেকে চুপ থাকলেও এখন আম্মার কথায় নিজেকে আর আটকাতে পারে না,”আম্মা, ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিচ্ছিলো মরিয়ম, ওর প্রেশার এত হাই ছিল। আর কে দিয়েছে ওকে এত চাপ? তুমি দিয়েছ। যখন থেকে ও প্রেগন্যান্ট হয়েছে, তখন থেকে ওকে বাচ্চা নিয়ে মানসিক চাপের ভেতর রেখেছ। কাল রাতেও আমরা সুস্থ ভাবেই বাসায় ফিরে এসেছিলাম। তুমিই রাগ দেখনো শুরু করলে, রুমনকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলা শুরু করলে, তোমার কথার আঘাতেই মরিয়মের শরীর খারাপ করেছে সাথেসাথে। বাবু বাঁচবে কিনা তা আল্লাহর হাতে, কিন্তু আল্লাহ যদি ওকে আমাদের কোলে নাও দেন, আমি মরিয়ম একটু সুস্থ হলে আমি রুমন আর মরিয়মকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠে যাব।”

(ছবি কালেক্টেড)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here