যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-৩

0
1220

#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব৩

“রুমনের কি জ্বর এসেছিল?”

“নাহ্। রুমন এখনো ঘুমাচ্ছে। মরিয়ম, ভালো হয়েছে তুমি চলে এসেছ। আমি তো ভয়ে ছিলাম ঘুম থেকে উঠে তোমাকে না দেখলে রুমন আবার অস্থির হয়ে যায় কিনা।”

“টানা ঘুম দিচ্ছে দেখি। ডাক্তার কী ঘুমের ঔষধের মাত্রা বেশি দিয়ে দিলেন? এতক্ষণ তো একটানা ঘুমায় না।”

“নাহ্ আমার ফোনে কথা হয়েছে। তিনি বললেন এখন ঘুম রুমনের জন্য ভালো। একটানা ঘুমিয়ে উঠলে ঝরঝরে লাগবে, মাথায় ব্যথাটাও কমে যাবে।”

“শিহাব, থ্যাংক ইউ। তুমি আমাকে আর রুমনকে এত দেখে রাখ, তোমার কথায় মনে শক্তি পাই।”

“মরিয়ম, তুমি তো এমন ভাবে বলেছো যেন আমি বাইরের মানুষ, সাহায্য করে ধন্য করছি! রুমন আমার ছেলে না? তুমি আমার বৌ না? আমি না দেখলে কে দেখবে।”

ভালোবাসায় হঠাৎ মরিয়মের চোখটা আদ্র হয়ে যায়। জীবনে সে অনেক কিছু পায়নি, গাইনিকোলোজিস্ট হওয়ার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু ছেলেকে সময় দিতে ক্লিনিক্যাল লাইন ছাড়তে হয়েছে। এই সব কিছুর ভেতর শিহাবকে স্রষ্টার তরফ থেকে বড়ো এক উপহার মনে হয় মরয়মের।

ডাক্তার মেয়েকে ডাক্তার ছেলের সাথেই বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল মরিয়মের বাবা মায়ের। মরিয়মেরও নিজস্ব কোন পছন্দের মানুষ ছিল না, তাই তারও কোন আপত্তি ছিল না। মরিয়ম তখন সবে মেডিকেল অফিসার হিসেবে একটা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরিতে ঢুকেছে, পাশাপাশি এফসিপিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই হাসপাতালে শিহাব সাহেব এসেছিলেন ওনার মাকে নিয়ে, সুগার লেভেল কমে যাওয়ায় ওনাকে ইমার্জেন্সি ভর্তি করানো হয়। সেইদিন নাইট ডিউটি ছিল মরিয়মের। শান্ত, মিষ্টভাষী আর স্নিগ্ধ চেহারাী অধিকারী মেয়েটার জন্য হঠাৎ মনের ভেতর একটা তোলপাড় সৃষ্টি হয় শিহাবের। তিনদিন পর রিলিজ দিলেও মাকে নিয়ে জোর করে আরও একদিন থেকে যায় শিহাব, উদ্দেশ্য ছিল মরিয়মকে আরেকবার দেখে যাওয়া। মরিয়মের সেদিন ডেঅফ ছিল, পরেরদিন এসেও শিহাব সাহেবের মাকে কেবিনে থাকতে দেখে অবাক হয়, “আপনাদের রিলিজ হয়নি? পেশেন্টকে তো রিলিজ দেওয়ার কথা।”

“জ্বি হয়েছে। আমিই আরেকদিন রাখলাম। আম্মা আরেকটু সুস্থ হোক। বাসায় আমি ছাড়া দেখাশোনার কেউ নেই। তারচেয়ে হাসপাতালে থাকা ভালো।”

“আপনার ভাইবোন কেউ নেই?”

“আছে মা, আমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি রাজশাহী গিয়েছে, ইদ করবে সেখানে। এমনি ঢাকায় থাকে। আমি শিহাবকে মানা করলাম মেয়েকে ডাকতে, নতুন বিয়ে, ওনারা কী ভাবেন কে জানে।”

শিহাবের পক্ষ থেকে মা জবাব দেন।

“হোক নতুন বিয়ে, মায়ের দরকার হলে মেয়ে আসবে।”

এভাবেই মা ছেলের সাথে টুকটাক কথা বলে রুটিন চেকআপ শেষে বের হয়ে যায় মরিয়ম। স্যার রাউন্ডে আসার আগে ফাইলে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে হবে, নাহলে কিছু খুঁত পেলে সবার সামনে ঝাড়বে স্যার। রিলিজ পাওয়ার পর চলে যাওয়ার আগে আরেকবার ডক্টরস রুমের কাছে আসে শিহাব, মরিয়ম ভেবেছিল হয়তো আবার প্রেসক্রিপশনের কিছু বুঝতে এসেছেন। কিন্তু মরিয়মকে অবাক করে দিয়ে একটা ভ্যালেন্টাইন কার্ড দেয় শিহাব। চকিতে মরিয়মের মনে পড়ে আগামীকাল চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি।

“এটা কেন?”

“প্লিজ রাগ করবেন না। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেই দেওয়া। মাকে নিয়ে খুব অসহায় অবস্থায় হসপিটালে এসেছিলাম। বাবাকে আগেই হারিয়েছি, মায়ের জন্য তাই ভয়টা অনেক বেশি ছিল। সে সময় আপনি আর আপনারা আন্তরিক ভাবে পাশে ছিলেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

কার্ড দিয়ে আর দাঁড়ায় না শিহাব, তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যায়। মরিয়মের ভালোই লাগে। মেডিকেল প্রফশনে রোগীর কাছে পাওয়া ধন্যবাদ বিরাট আনন্দ নিয়ে আসে। যদিও সেই উপলক্ষ খুব কমই পাওয়া যায়, অধিকাংশ সময় বরং ডাক্তার পেশেন্ট সম্পর্কে আর্গুমেন্ট আর অভিযোগই বেশি পেতে হয়। রুমে ঢুকে কার্ডটা খুলতেই একটা চিঠি পায়,

“আপনাকে কী বলে সম্মোধন করা উচিত জানি না। নাম ধরে বলবো নাকি প্রিয় মরিয়ম বলবো? জানি এই চিঠি বা কার্ডের কোন গুরুত্ব আপনার কাছে নেই, আপনার প্রাণিপ্রার্থীর নিশ্চয়ই অভাব নেই। তারপরও মনে হলো মনের কথা না জানালে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এত দ্রুত ভালোবাসা যায় না জানি, সেক্ষেত্রে আপনি হয়তো আমার আকর্ষণকে সাময়িক আবেগ নাম দেবেন, কিন্তু আমি জানি এটা ”love at first sight’.

আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ, বাংলায় অনার্স করেছি, চাকরিতে ঢুকিনি, বরং বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসার হাল ধরেছি। ব্যবসাও বড়ো কিছু না, স্যানিটারি মালামালের দোকান আছে। একটা বোন আছে আর মা। নিতান্ত ছা পোষা মানুষ। যদি ছাপোষা মানুষটার সাথে কখনো এককাপ কফি খেতে ইচ্ছে করে, তাহলে একটা দিন কবিতা ক্যাফেতে একটি বিকেল সময় চাই আপনার কাছে। আমার নাম্বারটা দিলাম নিচে। জানি হয়তো কোনদিন ফোন আসবে না। তারপরও অপেক্ষায় থাকব।”

মরিয়ম দ্রুত চিঠি লুকিয়ে ফেলে, অন্য কোন মেডিকেল অফিসারের চোখে পড়ার আগে কার্ডও ব্যাগে ঢুকায়। ফোন সে করবে না। এনাটমি বইটা খুলে পড়ায় মন দেয়, এফসিপিএস পার্ট ওয়ানের আর বেশি সময় নেই। রাতদিন পড়তে হবে।

“হ্যালো, আমি মরিয়ম।”

“গত তিনদিন যতগুলো আননোন নাম্বারের কল এসেছে, প্রতিটি ফোন আপনি ভেবে রিসিভ করেছি। আমার টান টা এত তীব্র যে আপনাকে টেনে নিয়েই এলো।”

“আপনি সাহিত্যক না ব্যবসায়ী?”

“পেশায় ব্যবসায়ী। সাহিত্য করে পেট চলে না।”

কবিতা ক্যাফেতে একটা বিকেল এনাটমি বইকে ফাঁকি দিয়ে আসতে রাজি হয় মরিয়ম। একটা বিকেল থেকে অনেকগুলো সন্ধ্যা হয়ে যায়। মরিয়মের বাসার কেউ রাজি ছিল না, কিন্তু দীর্ঘদিনের চেষ্টায় দুইহাত এক হয়। আর এখন শিহাব মরিয়মের বাবা মায়ের কাছে নিজেদের ছেলের জায়গা করে নিয়েছে। এই একটা দিকে স্রষ্টা তার কপালটা ভীষণ ভালো করেছেন। দেখতে দেখতে তেরো বছর কেটে গিয়েছে। ভালোবেসে প্রতারিত হতে হয়নি। শাশুড়ির কাছেও মরিয়ম অনেক আদরের ছিল। এমনকি রুমনের সমস্যা ধরা পরার পরও তিনি মরিয়মের পাশে ছিলেন। ইদানীং বয়সের চাপেই হোক, বা বংশধরের আশাতেই হোক, তিনি চান মরিয়ম আর শিহাব আরেকটা সন্তান নিক। রুমনকে তিনি অনেক আদর করেন, ছেলের ঘরের প্রথম নাতি। কিন্তু রুমনকে সারাজীবন অটিজম সাথে নিয়েই চলতে হবে বোঝার পর থেকে তিনি মরিয়মের সাথে আরেকজন নাতি নাতনি পৃথিবীতে আনার জিদ করছেন। ধীরে ধীরে এই বিষয়টা ওনাদের সম্পর্ক নষ্ট করছে।

“মরিয়ম ঠিক আছ? অনেকক্ষণ হলো তুমি বাথরুমে। ”

শিহাবের ডাকে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে মরিয়ম। আসলেই কত দেরি হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে বের হয় মরিয়ম। রুমন উঠে গিয়েছে। ওকে খাইয়ে ঔষধ দিয়ে দিয়েছে মরিয়ম। এখন রঙ করছে।

“শিহাব, দোকানে যাবে না আজ?”

“একবারে সন্ধ্যায় যাব। দোকানের ছেলেটাকে আজ সব সামলাতে বললাম। তোমাকে আর রুমনকে সময় দেই আজ। মাও বাসায় নেই, তোমরা একা।”

“মা কবে আসবেন আপার বাসা থেকে? আমার উপর রাগ করে আছেন এখনো তাই না?”

“বয়স হয়েছে, কথায় কথায় তাই অভিমান করে। তুমি কিছু মনে রেখো না প্লিজ। শিলুর বাসায় আর কয়দিন থাকবে, রাগ কমলে চলে আসবে। শিলুর সাথে কথা হয়েছে আমার।”

“আরেকটা সন্তান আমিও নিতে চাই শিহাব, কিন্তু রুমনের পেছনেই আমার সবটুকু সময় চলে যায়। নতুন মানুষটাকে আমি সময় কিভাবে দেব? তাছাড়া এত খরচ।”

“মরিয়ম যার যার রিজিক সে সাথে করেই আনে। তাই খরচের কথা ভেব না। তবে এটা ঠিক তোমার উপর অনেক ধকল যাবে। তাছাড়া সাইত্রিশ বছর বয়স চলছে তোমার, আমার চল্লিশ। এই সময় পরিবার বাড়ানোর সিদ্ধান্তটা কতটুকু সঠিক হবে আমি জানি না।”

রঙ করা শেষে রুমন আবার ঘুম দেয়। ঔষধের প্রভাবে অনেকটাই শান্ত, ঘুমটাও ভালো হচ্ছে। বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছে। এই সময় মরিয়ম বাসায় শাশুড়ির সাথে থাকে, আর শিহাব দোকানে। ওরা দুইজন সময় ভাগ করে নিয়েছে। সকালে মরিয়মের চাকরির সময়টা শিহাব বাসায় থাকে। দুপুরে মরিয়ম এলে, দুপুরের খাবার খেয়ে শিহাব বের হয়ে যায়। একবারে দোকান বন্ধ করে রাতে ফিরে। দু’জনের একসাথে সময় কাটানো হয় না বললেই চলে। আর দশটা দম্পতির মতো ছুটির দিনে একা ঘুরতে বের হয় না, একা শাশুড়ি রুমনকে দেখে রাখতে পারেন না। কোথাও বেড়াতে গেলেও এমন জায়গায় যান, যেখানে রুমন অস্বস্তি বোধ করবে না। বিয়ে, জন্মদিন এধরণের পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো এখন একটু এড়িয়েই চলে তারা। এসব জায়গায় অনেক সময় অনেক বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

আজ অনেকদিন পর একটা বিকেল শুধু দু’জনের। শিহাব বসার ঘরে পেপার পড়ছে। মাগরিবের আজানের পর হালকা নাস্তা খেয়ে দোকানের জন্য বের হবে। বেশি সময় থাকবে না, একটু হিসাবপত্র দেখে চলে আসবে। মরিয়ম চা দিয়ে গেল, তাই খাচ্ছে। শিহাবের দিকে দূর থেকে তাকিয়ে মরিয়মের কী মনে হলো জানে না। সালোয়ার কামিজটা বদলে একটা সুতি শাড়ি পরলো। চোখে একটু কাজল, আর গালে একটু পাউডার বুলিয়ে নিল। এই সামান্য সাজেই কেমন স্নিগ্ধ লাগছে। বহুদিন শিহাবের জন্য সাজা হয় না। আজ একটু চমকে দিলে কেমন হয়!

বসার ঘরে মরিয়মকে এই রূপে দেখে অনেকদিন পর যেন নতুন বিয়ের পরপর সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল শিহাবের। কতদিন পর এতটা সময় নিয়ে দু’জনের কাছে আসা হয়েছে। মরিয়মেরও মনে হয়েছে শিহাব দীর্ঘদিন এই সময়টুকুর অপেক্ষায় ছিল। গভীর ভালোবাসায় ডুবে যেতে যেতে মনে হয়, ভালোই হয়েছে আজ বাসায় মা নেই। এভাবে একান্ত সময়টুকু পাওয়া অনেক দরকার ছিল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here