যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-২

0
1386

#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব২

“হ্যালো লিসেনারস, আপনারা শুনছেন রেডিও মাস্তি, ৮৯.৯ এফএম। আমি আরজে নুসরাত আছি আপনাদেরই সাথে। আজকের আবহাওয়াটা কী রোমান্টিক তাই না? না গরম, না ঠান্ডা, মিষ্টি বাতাস বইছে, কড়া রোদ নেই, বরং যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এমন আবহাওয়ায় প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে রিকশায় ঘুরতে কার না ভালো লাগে। প্রিয়জনের সাথে এমন দিনের রোমান্টিক কোন স্মৃতি থাকলে আমাদের এসএমএস করে জানাতে পারেন। তাছাড়া এখন এই মুহূর্তে চলছে মিক্সড গানের অনুরোধের আয়োজন, অর্থাৎ বাংলা, ইংলিশ বা হিন্দি পছন্দের যেকোন ভাষার গানের জন্য এসএমএস করে অনুরোধ করতে পারেন..…..”

গাড়ি চলতে শুরু করেছে, রুমির কানে কিছু কথা ঢোকে কিছু ঢোকে না। আরজে মেয়েটার গলা কী খুশি খুশি, যেন এই ম্যাসেজগুলো পড়ে সে ভীষণ আনন্দিত। অনেকেই অনেক রোমান্টিক স্মৃতি শেয়ার করছেন। ফ্ল্যাশব্যাকে রুমির মনে পড়ে যায় সেই বিকেলগুলো, হিমেল নিজে ড্রাইভ করতো। মন ভালো থাকলে রুমিকে নিয়ে হাইওয়তে লং ড্রাইভে যেত। হিমেলের সাথে রিকশায় চড়া খুব একটা হয়নি, হিমেল খুব পশ লাইফ লিড করতে চাইত। রোমান্স করলেও তা অভিজাত হওয়া চাই তার কাছে। সবসময় টিপটপ থাকা চাই, ক্যাজুয়াল শার্টের সাথে কোন জুতোটা মানাবে, সানগ্লাস পাঞ্জাবির সাথে কখন মানাবে, কখন জিন্স, কখন গ্যাভার্ডিনের প্যান্ট পরতে হবে, এই সব কিছুই হিমেলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দামি পারফিউম তার নেশা। বড় বড় উপলক্ষগুলোতে ফাইভস্টার হোটেলে বুফ লাঞ্চ, বা ডিনার ছাড়া হিমেল চিন্তাও করতে পারত না। অনেক বেশি খরচের হাত তার, তবে অনেক মেয়েরা বোধহয় এমনই পছন্দ করে। নাহলে জেনীর মতো অর্ধেক বয়সী একটা মেয়ে হিমেলের দিকে এমন পতঙ্গের মতো ছুটে যাবে কেন!!”

গান বাজতে শুরু করেছে, আয়ুষ্মান খুরানার নতুন সিনেমার গান, “মাফি”, আয়ুষ্মান মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছে, তার শাস্তিও পেয়েছে, এখন গানে গানে ক্ষমা চাইছে। অনেক নাকি শাস্তি পেয়েছে, এবার ওকে মাফ করে দিক।

“রুমি, আর কত শাস্তি দিবে? It was a mistake, trust me. ঐ বিচ আমার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছিল। Trust me Rumi.”

গানের লাইনগুলোর সাথে স্মৃতিরা রিলের মতো একের পর এক সামনে আসতে থাকে। হিমেল, সুপুরুষ, অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে, পেশায় ডাক্তার। সোশ্যাল মিডিয়ায় রুমি আর হিমেলের জুটি জনপ্রিয়।

“আপু চলে এসেছি, কোন বাসার সামনে থামাব?”

উবারের চালকের ডাকে ধ্যান ভাঙে রুমির।

“ঐ তো, গলির শেষ মাথার বাসাটা।”

বাসায় ঢুকেই এখন কী কী শুনতে হবে জানে রুমি। তিতলির নামে এক ঝুড়ি অভিযোগনামা রুমি ফ্রেশ হওয়ার আগেই ওর কাছে পেশ করা হবে। এমনিতে রুমির আম্মা নাতনিকে ভীষণ ভালোবাসেন, কিন্তু মুখের ভাষায় তিনি বরাবরই রুক্ষ। তাছাড়া এভাবে দিনে ছয় সাত ঘন্টার জন্য দেখাশোনা করার দায়িত্ব তিনি নিতেও চান না। মেয়েটার বয়স সবে আড়াই, চার বছর হলে রুমি একটা স্কুলে দিয়ে দিবে, স্কুল শেষে বাসায় আসার আগে পর্যন্ত মেয়েকে হসপিটালে নিজের কাছেই রাখবে ভেবেছে। তখন হয়তো আম্মার চাপ কমবে, রোজ রোজ একগাদা কথা হজম করতে হবে না। এখন বেশি ছোট, হসপিটালে সাথে করে ছয়ঘন্টা রাখা সম্ভব না, রুমির বেতনও এত বেশি না যে বাঁধা একজন লোক রাখবে শুধু মেয়েকে দেখার জন্য। মাঝেমাঝে তাই কথার বিষটা তিতা ঔষধ ভেবে হজম করে নিতে হয়।

“রুমি কয়টা বাজে? ঘড়ি দেখছস?”

“দুইটা চল্লিশ আম্মু।”

“তোদের কী আমারে মানুষ মনে হয় না? সারা জীবন কী আমি তোদের টেনে যাব, একটু যদি শান্তি পাইতাম আমি। সময়মতো গোসল, নামাজ, খাওয়া কিছু করতে পারি না।”

“আম্মু তাড়াতাড়ি আসার জন্য বাসে না উঠে উবারে আসলাম। আমার কতগুলো বাড়তি খরচ হলো। দুইটা পর্যন্ত আমার চাকরির সময়, আমি চল্লিশ মিনিটে এসেছি। এই ঢাকা শহরে এর চেয়ে আগে আসতে হলে উড়ে উড়ে আসতে হবে।”

“ঢাকা শহর খালি তুই চিনস, আমি তো চিনি না? দুপুর বেলা জ্যাম থাকে? এইটুকু পথ আসতে দশ মিনিটও লাগে না। এই হলো কপাল, তোদের জন্য খেটে, আবার তোদের কাছেই কথা শুনতে হয়। তোর মেয়ে একটা যে দুষ্ট হইছে, বারান্দায় গিয়ে রশ্মির শখের গাছের পাতা সব ছিঁড়ে ফেলেছে, রশ্মি চিল্লাইয়া শেষ আমার উপর, বিছানায় পানি ঢালছে……”

আম্মা আরও কিছু অপরাধের বর্ণনা দিচ্ছিল, রুমির এসব রোজ শোনার অভ্যাস। এসব শুনতে শুনতেই গোসলের জন্য পা বাড়ায়। তিতলি এখন ঘুমাচ্ছে, যতই দুষ্টুমি করুক, দুপুর একটার ভেতর খেয়ে দুইটার ভেতর ঘুমিয়ে যায়। একবারে বিকেল চারটায় ওঠে। আম্মা যতই বকাঝকা করুক, রুমি জানে তিতলির কোন অযত্ন হয় না। তাই সব কথা চুপচাপ হজম করে। আম্মার কষ্ট হয় বোঝে রুমি, এই বয়সে এতক্ষণ ছোটো একটা বাচ্চা দেখা সহজ নয়। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসায় ওঠার সামর্থ্য রুমির নেই। প্রাইভেট একটা ডেন্টাল কলেজের লেকচারার কাম মেডিকেল অফিসারের আর বেতন কত, তাও ওদের প্রতিষ্ঠানটা একটা সম্মানজনক স্যালারি দেয়, অধিকাংশ প্রাইভেট মেডিকেলে তো নামকাওয়াস্তে একটা স্যালারি ধরিয়ে দেয়। এফসিপিএসের পার্ট টু টা হয়ে গেলে হয়তো প্রমোশন হবে, তখন বেতন বাড়তে পারে। কিন্তু সে আরও দুইবছর। কিছু পুঁজি ব্যবস্থা করতে পারলে কারও সাথে শেয়ারে ডেন্টাল চেম্বার দিতে পারতো। কিন্তু সেটাও অন্তত লাখ পাঁচেকের নিচে হবে না। মাসের শুরুতেই বেতনের অর্ধেক তুলে ফেলেছে, এটা মায়ের হাতে দিবে, বাবা মা শুরুতে নিতে না চাইলেও রুমি জোর করেই দেয়। বিয়ের আগে আর বিয়ের পরে বাবার বাড়িতে মেয়েদের অবস্থান বদলে যায়। তাই রশ্মির জন্য যেটা অধিকার, এখন রুমির জন্য সেটাই বাহুল্য।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here