রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব-২৪

0
2298

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২৪
#নবনী_নীলা

” ফাহাদের অতীতের সবটা জানবো বলেই আমি দেশে ফিরে এসেছি। নয়তো এইখানে ফিরে আসার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলো না।”, খুব কঠিন গলায় বললো সুনেয়রা।

” বাট আই চেঞ্জ মাই প্ল্যান।তোমাকে আমি কিছু বলছি না। যা বলার আমি তোমার বাবা মানে আফজাল সাহেবের সাথে শেয়ার করতে চাই।” আদিল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।

সুনেয়রা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। হাতে থাকা রেড ওয়াইনের গ্লাসটা টেবিলের একপাশে রেখে বললো,” কিন্তু তুমি আমাকে সবটা বলবে বলেছিলে। তার মানে কি তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না?”

” তোমার কি মনে হয়? তুমি কি সেই বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছো? যেখানে ফাহাদ আর তোমার সম্পর্কটাই আমার কাছে ক্লিয়ার হয় নি। সেখানে তোমাকে বিশ্বাস করাটা কি বোকামি না?” তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো আদিল।

সুনেয়রা একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” ঠিক আছে কি জানতে চাও বলো। আমি তোমাকে সব বলছি।”

আদিল তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” ফাহাদের সাথে তোমার কি করে বিয়ে হলো? আমার জানা মতে অবৈধ কাজে জড়িত থাকায় ওর শাস্তি হয়েছিলো। ”

” হ্যা, হয়েছিল কিন্তু বাবা ওকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর থেকেই ও বাবার সাথে কাজ করছে। আমাদের বিয়েটা হয়েছে ঠিক কিন্তু সবসময় ফাহাদ আর আমার মধ্যকার দূরত্ব দিন দিন
বেড়েছে। প্রথমে না বুঝলেও ধীরে ধীরে আমি সে সবই বুঝতে পারি। আমি ওকে ভালোবাসলেও ফাহাদ আমাকে ভালোবাসেনি।” নিচু স্বরে বললো সুনেয়রা।

” আমি তো ভেবেছিলাম আমার বোনকে ঠকিয়েছে তোমাকে ভালোবাসে বলে।”চোয়াল শক্ত করে বললো আদিল।

” তোমার বোনকে ঠকিয়েছে মানে?”, চমকে উঠে বললো সুনেয়রা।

” আমার বড় বোন আরোহী ভালোবেসে ওকে বিয়ে করেছিলো। বিয়ের পর হটাৎ সে উধাও তারপর খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে জেলখানায় বন্ধি। অবৈধ কারবারের জন্যে তাকে অ্যারেস্ট করা হয়। শুধু তাই নয় ফাহাদ আমার বোনকে ঠকিয়ে তোমায় বিয়ে করেছে শুধু ক্ষমতার লোভে। আর এই সব আঘাতের কারণেই আমি আমার বোনকে হারিয়েছি। বাকি সব আমি নাই বা বললাম। তাই যেকোনো মূল্যে আমি ফাহাদের শেষ দেখতে চাই।” বলতে বলতে হাত মুষ্টি বন্ধ করলো সে।

” ফাহাদ আর আমার মাঝে অনেক দুরত্ব ঠিকই কিন্তু ওর কোনো ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না।”, কাঠ গলায় বলল সুনেয়রা।

” তোমার চাওয়া না চাওয়াতে তো কিছু হচ্ছে না। তুমি যতই ফাহাদের প্রতি নিজের কেয়ার ভালোবাসা দেখানোর চেষ্টা করো।কিন্তু তুমি নিজে ওকে ব্যাবহার করেছো। সো ডোন্ট অ্যাক্ট লাইক ইউ কেয়ার এবাউট হিম।”,তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো আদিল।

“দেখো আবরার এই বিষয়ে আমি তোমাকে কোনো হেল্প করতে পারবো না। অ্যাম রিয়েলি সরি।”,করুন দৃষ্টিতে বললো সুনেয়রা।

” আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। সেইজন্যে তো আফজাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করা চাই। ওনার বিরুদ্ধে ফাহাদ যেই ষড়যন্ত্র করছে সেটা ওনাকে জানাবার সময় হয়ে এসেছে।” বলতে বলতে আদিল উঠে দাড়ালো তারপর টেবিলে এক হাত রেখে ঝুকে দাড়িয়ে বলল,” ফাহাদকে পুলিশের হাত তুলে দিতে চাইলে সেটা আমি অনেক আগেই করতে পারতাম কিন্তু আবারো কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের লোক ওকে ঠিক বের করিয়ে আনতো।শাস্তিটাই তো ওর পাওয়া হতো না। তাই ওর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা এইবার আমি নিজে করবো। তুমিও ওকে বাঁচাতে পারবে না।”

____________

বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও স্নিগ্ধা এখনো জেগে আছে। আজ কেনো জানি তার চোখে ঘুম নেই। তখন থেকে একটা বই মুখের সামনে নিয়ে বসে আছে কিন্তু আজ বই পড়ায় তার মন বসছে না। স্নিগ্ধা রেগে বইটা বন্ধ করে ফেললো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকালো। বেশ রাত হয়েছে।
মানে ওই শাকচুন্নির সাথে দেখা করতে গিয়েছে তো উনার ফেরার নাম নেই। সারাদিন তার পিছু পিছু আর যখন তাকে প্রয়োজন তখনই সে উধাও। কি এমন কথা সেই মেয়ের সাথে যে এতো রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে হবে।

কিছু বলাও যায় না বললেই জিলাপির মতন কথা পেচাতে থাকে। নাহ্ বউ থাকতে এতো রাতে বাইরে থাকবে কেনো সে?
আজকে আসুক একবার এই রুমেই জায়গা দিবে না সে। একদম রাত করে বাইরে থাকা ছুটিয়ে দিবে। আজ লোকটা স্নিগ্ধা তাসনিমের আসল রূপ দেখবে। অসভ্য একটা ছেলে। যতই হোক তারই তো বর। তার রাগ হবে না? অবশ্যই হবে। মেয়েরা নিজেদের বরের ব্যাপারে একটু বেশি পসেসিভ হয়। যতই বর তাদের পছন্দের হোক কিংবা অপছন্দের।

স্নিগ্ধা আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত একটা বাজে কিন্তু দেখো কোনো হদিস নেই লোকটার। স্নিগ্ধা উঠে দাড়ালো। তারপর ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় পা তুলে বসে রইলো। আজ এই রুমে আদিলের জায়গা হবে না। যেখানে ছিল সেখানেই থাকুক সে।

______________

আদিল নিজের রুমের সামনে এসে বেশ অবাক হলো। দরজা বন্ধ কেনো? ভিতরে কি কেউ আছে নাকি দরজা লক হয়ে গেছে? লক হয়ে গেলে তো মুশকিল কারণ লকের চাবি তো তার কাছে নেই। আদিল অভ্রর রুমে এসে একবার দেখলো। স্পৃহা আর অভ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। স্পৃহা আর অভ্র এইখানে তাহলে স্নিগ্ধা কোথায়? রূমের ভিতরে নাকি! আদিল একটু অবাক হলো ব্যাপারটা ভেবে। স্নিগ্ধা দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? কখনো তো এমন করে না।

আদিল সারা বাড়িতে খুঁজে দেখলো স্নিগ্ধা কোথাও নেই। তাহলে কি তার ধারণাই সঠিক? আদিল রূমের সামনে দাড়িয়ে আছে। নক করবে কিনা বুঝতে পারছে না। স্নিগ্ধা যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে ঘুম ভাঙ্গানো ঠিক হবে না।

জিম নিজের রুমে যাওয়ার সময় আদিলকে এইভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বললো,” দরজা কি লক হয়ে গেছে?”

আদিল না সূচক মাথা নাড়লো তারপর বললো,” দাড়াও দেখছি।” বলেই দরজায় দুবার নক করলো। কোনো সাড়া শব্দ নেই। কিন্তু তৃতীয় বার নক করতেই স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলে উঠলো,” কি সমস্যা? বার বার নক করছেন কেনো? সবাই কি আপনার মত রাত জাগা পেঁচা নাকি! যে রাত জেগে বেড়াবে? আজকে আমি দরজা খুলবো না। যান যেখানে ছিলেন ঐখানেই যান। এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি এলেন কেনো?”

স্নিগ্ধার এমন কথা জিম আদিল একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। আদিল ভ্রূ কুচকে দরজার দিকে তাকালো। স্নিগ্ধার রাগের কারণ বুঝতে পেরে মুহূর্তেই ঠোঁট কামড়ে নিজের হাসি থামিয়ে জিমের দিকে তাকালো। জিম সন্দেহ জনক দৃষ্টিতে আদিলের দিকে তাকালো।

স্নিগ্ধা রাগে ফুলতে লাগলো। সে যে এতো কথা বললো লোকটার কোনো সাড়া শব্দ আছে? তাহলে কি সত্যি সত্যি চলে গেছে নাকি? এরপর তো আর নক করলো না। স্নিগ্ধার ভাবনার মাঝেই আবারো দরজায় টোকা পড়লো। স্নিগ্ধা উঠে দাড়ালো তারপর ভ্রু কুঁচকে আওয়াজ দিয়ে বললো,” কে? ”

দরজার ওপাশ থেকে জিমের আওয়াজ কানে ভেসে আসলো। জিম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলছে,” দরজাটা খুলুন।”

স্নিগ্ধা কড়া গলায় বললো,” আপনি কি সুপারিশ করতে এসেছেন নাকি? শুনুন এইসবে লাভ হবে না। আমি আজকে দরজা খুলবো না।থাকুক উনি বাইরে।”

জিম ক্লান্ত গলায় বললো,” স্যারের অবস্থা ভালো না। প্লীজ দরজাটা খুলুন।”

স্নিগ্ধার বুকের ভিতরে ধুক করে উঠলো জিমের কোথায়। অবস্থা ভালো না মানে? এইজন্যেই কি আদিল তার কথার জবাব দেয় নি। স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই স্নিগ্ধা দেখলো জিম আদিলকে ধরে রুমে ভিতর নিয়ে এলো। বেশামাল হয়ে পড়েছে আদিল। স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে আদিলকে ধরলো তারপর বিছানায় শুইয়ে দিলো কোনোভাবে।

স্নিগ্ধা ভয়ার্ত গলায় বললো,” কি হয়েছে ওনার?” জিম শান্ত গলায় বললো,” ভুলে মাশরুম সুপ খেয়ে নিয়েছেন। মাশরুমে আবার ওনার সমস্যা আছে। কিন্তু চিন্তার কারণ নেই আমি মেডিসিন পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

স্নিগ্ধার চোখ মুখে চিন্তা স্পষ্ট। জিম রুমে থেকে বেরিয়ে যেতেই সে ব্যাস্ত হয়ে আদিলের পাশে এসে বসলো। জিম যাবার সময় দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিল।

স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে আদিলের কপাল আর গলায় হাত দিয়ে দেখতে লাগলো আসলেই কিছু হয়েছে নাকি। আদিল খুব ধীরে নিজের চোখ খুললো তারপর অস্পষ্ট সুরে বলল,” পানি।”

স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে বললো,” আচ্ছা আমি আনছি।” বলেই সে উঠে পড়ল তারপর টেবিল থেকে গ্লাসে করে পানি নিয়ে এসে আদিলের মাথার কাছে বসলো। আদিলকে খুব যত্নে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরে বসালো তারপর পানি খাইয়ে দিলো। হটাৎ এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো কেনো আদিল।

আদিল ভিতরে আসার উপায় পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সে স্নিগ্ধার হাত স্পষ্ট কাপতে দেখছে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন স্নিগ্ধা ঘাবড়ে যায়। কি করবে সে বুঝতে পারে না। নিজেকে তখন অসহায় মনে হয়। স্নিগ্ধা অস্থির হয়ে বললো,” আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে? এসি বাড়িয়ে দিবো? গরম লাগছে?” বলতে বলতে আদিলের কপালের সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিলো। অস্থিরতায় ভরে গেছে স্নিগ্ধার চেহারায়। ঐ শাকচুন্নি আবার উল্টা পাল্টা কিছু খাইয়ে দেয় নি তো। স্নিগ্ধা এসি বাড়াতে যেই উঠতে যাবে আদিল খপ করে স্নিগ্ধার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো।

হটাৎ আদিলের এমন ব্যাবহারে স্নিগ্ধা বিষ্ময় নিয়ে তাকালো।বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যখন আদিল মৃদু হেসে তাকালো। সেই হাসির আড়ালে দুষ্টু হাসিটা চোখে পড়তেই রাগে দাতে দাত চেপে তাকালো স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” এতক্ষণ আপনি নাটক করছিলেন আমার সাথে?” বলেই নিজের হাত ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো সে। রাগটা এবার তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here