রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ। [০৪]

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[০৪]

গতরাত থেকে বৃষ্টি। রাতের দিকে বৃষ্টির বেগ কম থাকলেও সকাল থেকে শুরু হয়েছে মুশলধারায়। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি বলে কথা। কাথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে দিগন্ত তালুকদার। কাল সারারাত ভালো ঘুৃম হয়নি তার। একা একটা ফ্ল্যাটে থাকে সে। বৃষ্টির কারনে না আজ সে অফিসে যেতে পারছে আর না রান্না করতে পারছে। বর্ষার এই বৃষ্টি তার শরীরকে অলসতার চাদর দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে। বৃষ্টি দেখলেই মনে পরে তার ছোট বেলার কথা। ছোট্ট বেলার বৃষ্টি সময় সে কাদামাটির গন্ধ পেত। সে সময়ের খেলার সাথী তার প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে কত বৃষ্টিতে ভিজেছে। চোখ ভিজে উঠে দিগন্তের। সে হাড়িয়ে ফেলেছে তার প্রিয় বন্ধুকে। এখন বৃষ্টি পছন্দ না তার। বিছানারা ছেড়ে উঠে যায় বারান্দায়। স্বচ্ছ কাছ বেদকরে বৃষ্টির পানি পরছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন মুক্তোদানা গাড়িয়ে পরছে। দিগন্ত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে। চোখের সামনে ভেসে উঠে তার সেই প্রিয় অতীত। বছর পাচেকের একটা ছোট্ট্ পুতুল। উঠোনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে তারা। সাড়া শরীর কাদায় মাখামাখি। দিগন্তের ভাবনার মাঝেই ওর সেলফোনটা ভেজে উঠে। দ্রুত পায়ে ঘরে এসে বিছানা থেকে মোবাইলটা হাতে নেয়। রফিক মির্জার কল। দিগন্ত দ্রুত কল ব্যাক করে। ওপাশ থেকে রফিক মির্জা কিছু বলতেই দিগন্ত” ইয়েস স্যার” বলে কল কেটে রেডি হতে থাকে।

ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পিচ ঢালা কালো পথ অতিক্রম করে দ্রুত পায়ে হেটে চলেছে দিগন্ত তালুকদার। গন্তব্য তার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অব বাংলাদেশ, সিআইবি হেড কোয়াটার। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনের এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর রফিক মির্জার কল পেয়ে এই ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সিআইবি হেড কোয়াটারে চলে আসে দিগন্ত।

নিজের কেবিনে উকি দিয়ে রফিক মির্জার কেবিনে নক করে। রফিক মির্জা তখন চিন্তিত মনে খবরেরকাগজের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দিগন্ত যেতেই তার দিকে খবরেরকাগজ এগিয়ে দিলেন। দিগন্ত খবরেরকাগজের দিকে চোখ বুলিয়ে অবাক হতবম্ব। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রথম পাতার ছবির দিকে যার উপরে হেডলাইন,
” চা বাগান থেকে বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের কাটা লাশ উদ্ধার।”

রফিক মির্জা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আমি চাই তুই এই কেইসের ইনভেস্টিগেশন করো।”

” আমাকে কবে যেতে হবে স্যার?”

” আজই যাও।”

” ওকে স্যার।”

______________________
এইনগেজমেন্টের চারদিন পর আজ কলেজে এসেছে ভূমি। চারদিন কলেজে না আসায় অনেক নোটস বাকি পরেছে। ভূমি একবার ভাবলো দিয়ার কাছ থেকে নিবে। কিন্ত দিয়া? সে কলেজের আসার পর ইমাদের সাথে কই লাপাত্তা হয়ে গেল কে জানে। একা একা লাইব্রেরিতে চলে আসলো ভূমি। সকাল বেলা লাইব্রেরিতে খুব একটা মানুষ নেই। ওই দু একজন আসে যায় আর কি। লাইব্রেরির এক কোনে চুপচাপ বসে আসে ভূমি। দৃষ্টি তার হাতে থাকা রিং এর দিকে। আরাভ স্যারের মতো একটা হ্যান্ডসাম ছেলে তার ফিয়ন্সে, ভাবতেই অজানা এক শিহরণে শীতল হয়ে যাচ্ছে শরীর। ভূমির স্পষ্ট মনে আছে কলেজে যেদিন প্রথম এলো সেদিন যখন নিজের ক্লাস খুঁজে পাচ্ছিল না তখন থার্ড ফ্লোরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো বিষন্ন মনে। হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখে তার মনের বিষন্নতা দূর হয়ে যায়। ছেলেটাকে দেখে ওর সেইম ইয়ার মনে হলো। ব্ল্যাক জিন্স আর ব্ল্যাক শার্টের পরা সেই ছেলেটির কাছে নিজের ক্লাস সম্পর্কে জিগ্যেস করেছিলো ভূমি। ছেলেটা ক্লাস সম্পর্কে কিছু না বলে শুধু বলেছিলো,” ফলো মি”। ভূমি ছেলেটাকে ফলো করে তার ক্লাসে যায়। ভেবেছিল ছেলেটা বোধহয় তারই ক্লাসমেট। পরে ক্লাসে গিয়ে তার ভুল ভাংলো। আর যা দেখলো সেটা বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। ছেলেটা ছিলো তাদের স্যার। সেদিন একবার দেখে যার উপর ক্লাশ খেয়েছিলো পরে স্যার জেনে নিজের মনকে সংযত করেছে। ভুলে গিয়েছিল সেদিনের ভালো লাগার কথা। সবসময় স্যার হিসাবেই সম্মান দেখিয়েছে সে। এতদিনেও তার প্রতি কোন অনুভূতি জন্মায়নি ভূমির।

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ বইটা নিচে নামিয়ে ঝাড়া দেওয়ার সময় আরাভের চোখ আটকে যায় লাইব্রেরির কর্ণারে বসে থাকা মেয়েটির উপর। বিষন্নতায় ঘেরা এই মায়াবী মুখের দিকে তাকাতেই আরাভের বুকটা কেমন ছেদ করে উঠে। আচ্ছা মেয়েটার কি মব খারাপ? এইনগেজমেন্টের পর আজ প্রথম কলেজে এসেছে। তাও এভাবে মব খারাপ করে বসে আছে।এর কারন কি? আরাভ বই হাতে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। আরাভের উপস্থিতি বুঝতে পারলো না মেয়েটা। তাই আরাভ নিজেই গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে বলল,

” তোমার পাশে একটু বসতে পারি।”

” হ্যাঁ, হ্যাঁ স্যার বসুন না।”

আরাভ সামনের চেয়ার টেনে বসে পরলো। ভূমির দৃষ্টি আরাভের দিকে। চোখে তার প্রশ্ন, ভ্রুদ্বয়ে সামান্য ভাজ। আরাভ হয়তো ভূমির চাহনি বুঝতে পারলো তাই সে বলল,

” একা বসে ছিলে তাই কোম্পানি দিতে এলাম। তোমার কি পছন্দ হয়নি। চলে যাব আমি।”

” না স্যার ঠিক আছে। আপনি বসুন। সামান্য হেসে বলল ভূমি।

আরাভ ভূমির মুখের দিকে অর্ন্তভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,

” মন খারাপ কেন?

ভূমি অবাক চাহনিতে আরাভের দিকে তাকালো। আরাভ কি করে জানলো তার মন খারাপ। কই সে তো কারো মন খারাপ বুঝতে পারেনা। ভালো করে আরাভকে পরখ করতে লাগলো। মাথার পরিপাটি চুল থেকে, ড্রেসআপ এমনি হাতের নোখও খেয়াল করলো। ধবধবে সাদা নোখগুলো সমান করে কাটা। ভূমি তার নিজের হাতের দিকে তাকালো। তার নোখগুলো কোনটা সমান আবার কোনটা নদীর ঢেওয়ের মতো আঁকাবাঁকা। তার উপর হাতে নেইলপালিশ দিয়েছিলো। নোখের অর্ধেকটায় নেইলপালিশ আছে আবার অর্ধেকটায় নেই। লজ্জায় নিজের হাতটা নিচে নামিয়ে ফেলল ভূমি। মাথা নিচু করে আড় চোখে আরাভের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

” সবসময় এমন পরিপাটী থাকা মানুষটার সাথে অগোছালো এই আমি মানিয়ে নিতে পারবো তো।”

ভূমির ভানার মাঝেই প্রশ্ন করলো আরাভ,
” এতদিন আসোনি কেন?”

ভূমি মাথা তুলে আরাভের দিকে তাকালো। এখনি কেমন অধীকার বোধ। ভূমি কিছু বলবে তার আগেই আরাভ বলল,
” এস এ টিচার্স, এটা আমার জানার অধীকার আছে।”

ভূমি মিনমিনিয়ে বলল,
” মামার বাড়ি গিয়েছিলাম।”

আরাভ আর কিছু বলল না। হাতে ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়াল। ভূমির দিকে একপলক তাকিয়ে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়ে থেমে গেল। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ভূমির দিকে কিছুটা ঝুকে বলল,
” ছুটির পর অপেক্ষা করবে।”
ভূমিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় আরাভ। আর ভূমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরাভের চলে যাওয়ার দিকে।

আজ আর ক্লাসে মন বসাতে পারলো না ভূমি। দুটো ক্লাস করেই বেড়িয়ে যায়। দিয়া সেই সকালে ইমাদের সাথে বেড়িয়েছে এখনো আসার নাম নেই। ক্যাম্পাসের বড় বটগাছের নিচে বসে আছে ভূমি। ওর পাশেই রয়েছে কয়েকজন ছেলেমের। জুনিয়র হবে হয়তো। তারা বসে নিজেদের মাঝে আড্ডা দিচ্ছে। ভূমি সে দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফেলল। কত সুন্দর একটা বন্ধুমহল। একজনের হাতে গীটার একজনের হাতে বাঁশী। কেউ একজন মোটা ফ্রেমের চসমা পরে কাঁধে ভারী ব্যাগ। কারো মুখে প্রান খোলা হাসি আবার কেউ থাকে চুপচাপ।ভূমির ইচ্ছেহলো ওদের সাথে আড্ডা দেওয়ার। নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্যদিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। ওদের সাথে আড্ডায় যোগ দিল। অনেক দিন পর, অনেক দিন পর মনে হলো ভূমি প্রান খুলে হাসছে। চারতলায় দাড়িয়ে কেউ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভূমির এই হাসির দিকে। কিছুক্ষণ পর ভূমির মোবাইলে একটা মেসেজ আসলো,

” গাড়ির কাছে যাও আমি আসছি।”

মেসেজটা দেখে ভূমির রাগ হলো। মনে হচ্ছে লোকটা ভূমির খুশি সহ্য করতে পারে না। ভূমি মেসেজ লেখলো,

” সরি স্যার, এখন যেতে পারবোনা।”

মোবাইলটা শক্ত করে ধরলো আরাভ। আজকাল ভূমির মুখে স্যার শব্দটা শুনতে তিক্ত লাগে। কোন কথা বলার আসে পরে সব সময় স্যার বলবে। স্যার ছাড়া যেন বাক্যের শুরু করতে পারেনা। শক্ত চোখে ভূমির দিকে তাকিয়ে মেসেজ লেখলো,

” এখুনি গাড়ির কাছে যাবে, ইটস্ মাই অর্ডার।” তারপর মোবাইল পকেটে পুরে অফির রুমের দিকে চলে যায় আরাভ। ভূমি আড্ডা ছেড়ে উঠে আসে আরাভের গাড়ির কাছে। রাগ হচ্ছে। খুব রাগ হচ্ছে ভূমির। ইচ্ছে করছে ওর পরিপাটি চুল এলোমেলো করে কাক বসিয়ে দিতে। মনে মনে হাজারো গালি দিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ভূমি।

চলবে,,,,,,,,,

Mahfuza Afrin Shikha.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here