রহস্যময় সারপ্রাইজ পর্ব-১

0
1701

রহস্যময় সারপ্রাইজ (রিপোস্ট)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

পর্ব-১

র‍্যাপিং পেপার খুলে ভালোবাসার মানুষটি লাশ দেখে বাকরূদ্ধ হয়ে গেলো তুরাগ। প্রিয়তমার লাশ, জন্মদিনের উপহার হিসেবে পাবে এমনটা কল্পনা করেনি সে। সবাই জন্মদিনে কত সুন্দর চোখ ধাঁধানো উপহার পায়। সেক্ষেত্রে তুরাগ কী পেয়েছে? র‍্যাপিং পেপার মোড়ানো ট্রলি ব্যাগভর্তি স্ত্রীর লাশ! যাকে কিনা সে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে! এমনটা তো হবার কথা ছিলো না। কাল সন্ধ্যা অবধি ও তো দুজনে কত হাসি খুশী ছিলো। স্বপ্নের মতো দিন ছিলো। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একটা ঝড়ো হাওয়া এসে সব তছনছ করে দিয়ে গেলো। স্ত্রীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে জ্ঞান হারালো তুরাগ। হুইলচেয়ারেই ঢলে পড়লো। ভালোবাসার মানুষটির লাশ দেখার চেয়ে ভয়ংকর মুহুর্ত আর কী হতে পারে? এটা খুবই কষ্টদায়ক বিষয়।

আওয়াজ পেয়ে কাজের মেয়ে শিলা দৌড়ে এলো সদর দরজার কাছে। দরজার কাছে এসে তুরাগের সামনে থাকা ট্রাভেল ব্যাগে প্রতিভার লাশ দেখে সজোরে চিৎকার দিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে একটু মালকিনকে ছুঁতে গিয়ে ও ছুলো না। আবার চিৎকার দিলো। শিলার চিৎকার শুনে পাশের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলেন জাহাঙ্গীর আলম। তুরাগের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা থাকায় ভিতরে এসে প্রতিভার লাশ দেখে আঁতকে উঠলেন । জাহাঙ্গীর আলম ঠান্ডা মাথার মানুষ। হুটহাট উত্তেজিত হন না। তিনি নিজের ভয় আর আতঙ্ক নিজের মাঝে চাপিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে হাতে নিলেন। তারপর বিল্ডিংয়ের মালিক সমিতির সভাপতি, পুলিশ এবং প্রতিভার পরিবারকে খবর দিলেন।

**

প্রতিভার মা তিহানা জাহান এসে মেয়ের লাশ দেখে জ্ঞান হারালেন। বাবা প্রভাত মির্জা মাথা আর হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে মেয়ের থেকে খানিক দূরে চেয়ারে বসে স্থির দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। একমাত্র সন্তানের এমন করুণ মৃত্যু তিনি মানতে পারছেন না। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। কাল রাতেও মেয়ে তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে, কত শাসন করেছে! কাল অবধি মেয়েটা কত চাঞ্চল ছিলো কিন্তু আজ তার চঞ্চল মেয়ের বদলে পড়ে আছে মেয়ের নিষ্প্রাণ দেহ! কে জানতো বাবাকে দেখে ফিরতে গিয়ে মেয়েটা আর ফিরবে না, চিরবিদায় নিবে! এমন হবে জানলে কাল ফিরতেই দিতেন না তিনি। নিজের কাছে রেখে দিতেন।

প্রভাত মির্জার পিছনে দাঁড়িয়ে বিলাপ করে কেঁদে যাচ্ছে এক যুবতী। বয়স প্রতিভার মতোই হবে। এই বাইশ কি তেইশ? শ্যামবর্ণের মায়াবী চেহারার এই মেয়েটির নাম স্বরূপা। সম্পর্কে প্রতিভার বান্ধবী। আর সবাই তাদের বান্ধবী মনে করলেও তারা কখনো একে অন্যকে বান্ধবী মনে করতো না। বোনের মতো আপন ভাবতো। একের দুঃখে অন্যে দুঃখী, একের সুখে অন্যে সুখী এমন ভাব দুজনার। খুবই বিশ্বস্ত আর ভালোবাসার মানুষ। স্বরূপা প্রতিভার পরিবারের একজন। তিহানা আর প্রভাত মির্জা স্বরূপাকে ও তাদের মেয়ে ভাবেন। সেই হিসেবেই ট্রিট করেন। রক্তের সম্পর্ক না হলেও সম্পর্কটা আত্মার। আত্মার সম্পর্কের বিচ্ছেদের কষ্ট অসহনীয়। বান্ধবীর লাশ দেখে স্বরূপার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। বান্ধবীর মৃত্যুর খবর শুনে কিভাবে যে এসেছে সে-ই জানে। পরনে বাসায় পরার পাতলা টি-শার্ট আর প্লাজো। গায়ে ওড়না নেই,চুল সব এলোমেলো, কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে। দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রতিভার বাবা মায়ের মতো সেও ট্রমার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

স্বরূপার বিলাপে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠলো সাব ইন্সপেক্টর অধরা আনানের মুখে। তরুনী ইন্সপেক্টর অধরা আনান প্রতিভার লাশের সামনে বসে লাশ খুঁতিয়ে দেখছেন। এখনো কোন সুত্র পায়নি সে। স্বরূপার বিলাপে তার মনোযোগ ভগ্ন হচ্ছে বারবার। এতেই বিরক্ত সে। প্রতিভার দিকে খানিক তাকিয়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো অধরা। তারপর স্বরূপাকে ডাকলো। স্বরূপা হেঁচকি তুলতে তুলতে ধীর পায়ে অধরার সামনে এসে দাঁড়ালো।

অধরা একবার স্বরূপাকে পরখ করে বললো,
“কান্না থামিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
স্বরূপা ভেজা গলায় বললো,
” জ্বি, বলুন।”
” তোমার পরিচয়? ”
কান্না থামিয়ে মিনমিনে গলায় স্বরূপা উত্তর দিলো,
“আমি স্বরূপা। প্রতিভার বান্ধবী। ”
“প্রতিভার সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন ছিলো?”
“আমাদের আত্মার সম্পর্ক ছিলো। অটুট বন্ধন ছিলো।বোনের মতো ছিলাম। কত আনন্দে ছিলাম। এক ঝড়েই সব শেষ হয়ে গেলো!”
আর বলতে পারলো না। স্বরূপা আবার স্বশব্দে কেঁদে ওঠল। স্বরূপার কথা আর ভাবভঙ্গি দেখে অধরা বুঝতে পারলো দুজনের বন্ধনের গভীরতা বেশ, প্রতিভার মৃত্যুতেও সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে । স্বরূপার এখন কথা বলার অবস্থায় নেই। অধরা স্বরূপাকে আর জিজ্ঞেস করলো না। উপস্থিত সবার দিকে একবার চোখ বুলালো। তারপর কাজের মেয়ে শিলাকে ডাকলো। শিলা ভয়ে ভয়ে এগুলো। অধরা বললো,
“তোমার পরিচয় ?”
“শশিলা। এই ব্বাসসার ক্কা..মের মমইয়্যা।
ভয়ে তটস্থ হয়ে তোতলিয়ে বললো শিলা। অধরা গম্ভীরমুখে বললো,
“কবে থেকে এই বাসায় কাজ করো?”
” দ্দুই ব্বচ্ছর ধোরি কাম করি।”
“কাল রাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত তুমি কোথায় ছিলে?”
“এই ব্বাসসাত আচছিললাম।”
“তুরাগ মানে প্রতিভার স্বামী কোথায় ছিলো?”
“ব্বাসসাত আচছিলো।”
“প্রতিভা কোথায় ছিলো?”
“বাপের বাসাত গেছিলো রাইচ্ছা। ”

অধরা এবার নড়ে চড়ে দাঁড়ালো। তারপর বললো,
“বাবার বাসায় গিয়েছিলো কখন আর ফিরেছিলো কখন?”
” হাইঞ্জিন্না গেছিলো, রাইচ্ছা আইবের কথা। আর ত আইয়েনো।”
শিলার ভাষার কাঠিন্য বেশ। অধরার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। অধরা বললো,
“গ্রামের বাড়ি কোথায় তোমার?”
“ননোয়াখখাললী।
শিলার তোতলানো দেখে অধরা শান্ত কন্ঠে বললো,
” ভয় না পেয়ে ঘটনা খুলে বলো। আমি কিছুই করবো না। তবে সত্যটা গোপন করলে পরে আস্ত রাখবো না। বলো আজ সকালে কী হয়েছিলো।”

অধরার কথায় ঢোক গিললো শিলা। ভয়ে কলিজাটা কাঁপছে তার। ছোটবেলা থেকেই পুলিশকে ভীষন ভয় পায় সে। অধরা এক কনস্টেবলকে কাছে ডাকলো। তারপর শিলাকে বললো,
” কি হলো বলো?”

শিলা তোতলিয়ে তোতলিয়ে তার গ্রামের ভাষায় কাল রাত থেকে সব ঘটনা বললো। যার সারসংক্ষেপ এই যে, কাল বিকেলে প্রতিভার বাবা প্রভাত মির্জা সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন। এতে তার মাথা ফেটে যায় এবং হাত কেটে যায়। চিকিৎসা শেষে সন্ধ্যায় তার ম্যানেজার তাকে নিয়ে বাসায় পৌঁছান। বাবার অসুস্থতার খবর শুনে সাথে সাথেই প্রতিভা বাবাকে দেখতে ধানমন্ডি বাবার বাসায় যায়। তুরাগকে শিলার দায়িত্বে রেখে যায়। বাবার বাসায় গিয়ে প্রতিভা খানিক পর পর শিলাকে ফোন দিয়ে তুরাগের খোঁজ নেয়। শিলাকে জানায় রাতেই সে বাসায় ফিরবে তবে দেরি হতে পারে। যাতে তুরাগকে ডিনার করিয়ে ওষুধ খাইয়ে দেয়। প্রতিভার কথায় রাত দশটা নাগাদ শিলা তুরাগকে ডিনার আর ওষুধ খাইয়ে রুমে নিয়ে দিয়ে আসে। তুরাগকে বিছানায় শুইয়ে দিতে চাইলে তুরাগ নিষেধ করে। তুরাগ জানায় হুইলচেয়ার এ বসেই সে প্রতিভার আসার জন্য অপেক্ষা করবে। অপেক্ষা করতে করতে তুরাগ হুইল চেয়ারেই ঘুমিয়ে যায়। শিলা প্রতিভার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে বসার ঘরে। রাত বারোটা পর ও প্রতিভা না এলে শিলা প্রতিভার কাছে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন বন্ধ পায়। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ শিলার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে প্রতিভার নাম্বার থেকে। ম্যাসেজটা এমন ছিলো যে, বাবার অসুস্থতার জন্য আজ বাসায় আসবে না। কাল সকালে আসবে। সাবধানে থাকতে। তুরাগের খেয়াল রাখতে।”
প্রতিভার ম্যাসেজ পেয়ে শিলা নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল আটটায় শিলা তুরাগকে ঘুম থেকে জাগিয়ে উঠায়। তুরাগ তখনো হুইলচেয়ারেই বসা। চোখ খুলেই স্ত্রীর খোঁজ করে তুরাগ। স্ত্রীকে ফোন করে বন্ধ পেয়ে চিন্তিত হয়ে যায়। শেষে শিলা প্রতিভার ম্যাসেজের কথা বললে তুরাগ কিছুটা শান্ত হয়। তুরাগ মলিন মুখে স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সকাল সাড়ে আটটায় বাসার কলিংবেল বাজে। কলিংবেল পেয়ে প্রতিভা এসেছে ভেবে শিলা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। স্ত্রী এসেছে ভেবে তুরাগ ও নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর বসার রুমের এক কোণায় থাকা সদর দরজার কাছে যায়। দরজা খুলে নুর করিমকে দেখে শিলা তুরাগ দুজনেই হতাশ হয়। দুধওয়ালা এসেছে গরুর দুধ দিয়ে যেতে। বায়োবৃদ্ধ দুধওয়ালা নুর করিম প্রতিদিন সকাল আটটা কী নয়টার মাঝে এসে তার পোষা গাভীর দুধ দিয়ে যায় বাসায় বাসায়। আজো তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
শিলা নুর করিম থেকে দুধের প্যাকেট নিয়ে নেয়। নুর করিম চলে যায়। শিলা দরজা বন্ধ করতেই চোখ যায় দরজার পাশে রাখা র‍্যাপিং পেপার মোড়ানো বড় গিফট বক্সটার উপর। শিলা তুরাগকে দেখায়। স্ত্রীর চিন্তায় তুরাগের মনের অবস্থা ভালো না থাকায় গিফটের দিকে ভালো করে নজর দেয় না। বলে হয়তো অন্য কারো। শিলাকে ভিতরে আসতে বলে। শিলা ভালো করে গিফট পেপারের উপর তাকাতেই তুরাগের নাম দেখতে পায়। টেনেটুনে এইট পাশ করায় এটুকু পড়তে বা বুঝতে সমস্যা হয় না যে গিফটটা তুরাগের জন্যই আসছে। শিলা বক্সটা ঠেলে ঠেলে ভিতরে নিয়ে আসে যেহেতু অনেক ভারি। ভিতরে এনে তুরাগের সামনে রেখে তুরাগকে নেমকার্ডে তুরাগের নাম দেখায় এবং গিফটটা খুলে দেখতে বলে।
র‍্যাপিং পেপারের উপর নেম কার্ডে “শুভ জন্মদিন তুরাগ,তোমার জন্মদিনে ছোট্ট একটা উপহার আমার পক্ষ থেকে” লেখাটা দেখে তুরাগ গিফট খুলতে নেয়। কারণ লেখাটা ছিলো প্রতিভার। স্ত্রীর লেখা চিনতে অসুবিধা হয় না তার। তুরাগ ভাবে প্রতিভা তাকে জন্মদিনের সারপ্রাইজ দিবে বলেই বাবার বাসা থেকে আসেনি। আর প্রতিভাই এই গিফট পাঠিয়েছে। তুরাগ যখন গিফটটা খুলতে ব্যস্ত তখন শিলা রান্না ঘরে চলে যায় সকালের নাস্তা তৈরি করতে। মিনিট বিশেক পরে বসার ঘর থেকে কোন স্টিলের ঝনঝন আওয়াজ শুনে বসার ঘরে আসে শিলা। দেখে তুরাগ হুইল চেয়ারে ঢলে পড়েছে তার মাথাটা কাত করা। হুইলচেয়ার হেলে গিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেকেছে। শিলা তুরাগের কাছে গিয়ে তুরাগকে ঠিক করে বসায়। তারপর কয়েকবার ডাকে কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পায় না। তারপর পানি আনার জন্য পা বাড়াতেই সামনে বিশাল সাইজের ট্রলি ব্যাগের ভিতরে প্রতিভাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। এবং চিৎকার জুড়ে দেয়। এরপর পাশের ফ্ল্যাটের চাচা আসে এবং সবাইকে খবর দেয়।

শিলার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল অধরা। তারপর ভাবুক কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা তুরাগ হুইল চেয়ারে কেনো! কী হয়েছে আর কবে হয়েছে?”

১৫ কি ১৬ বছরে কিশোরী শিলা জবাব দেয়,
“এক্সিডেন অইছে দুইমাস আগে। রাস্তায় গাই চালাইতো যাই। হাসপাতালে আছিলো বিশ দিন। ঠ্যাং ভাঙি গেছে। আইট্টো মাইট্টো হারে না। হিল্লাই ডাকতরে হুইলচেয়ার এ চইলবেল্লাই কইছে। হেসমে তুন ভাইয়া হুইলচেয়ার এ আছে।”
“ওহ আচ্ছা। তা ওদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন ছিলো? ”
“মেলা ভালা আছিলো। ভাইয়া ভাবির তো লাভ মেরিজ। মেলা ভালোবাসে দোনোগায় দোনোগারে। ”
“কখনো রাগারাগি বা ঝগড়া হয়নি? বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে?”
“না ম্যাডাম, কিচ্ছু অয় নো। বিয়ার হরে তুন কোনদিন হেতাগো রাগারাগি ও করতে দেখি নু। ভাবি তো ভাইয়ার সেবা করে দিন রাত। ভাইয়ার মেলা খেয়াল রাখে। ”
“ওহ আচ্ছা।”

অধরা জাহাঙ্গীর আলমের কাছে যায় এবং তার সাথে কথা বলে। সেও প্রতিভা আর তুরাগের সম্পর্কে ভালো ধারণাই প্রকাশ করেছে। কোন খারাপ দিক দেখেনি। জাহাঙ্গীর আলমের সাথে কথা বলে অধরা আবার লাশের কাছে গেলো।
তরুনী সাব ইন্সপেক্টর অধরা আনান আরো একবার প্রতিভাকে সুক্ষ্ম ভাবে পরখ করে।এই কেসটা অধরাই হেন্ডেল করবে। তার কপালে চিন্তার ভাজ। পুলিশে জয়েন করেছে প্রায় বছর কয়েক হবে। এর মাঝে অনেক চ্যালেঞ্জিং কেস হাতে পেয়েছে। অল্প সময়ের মাঝে অনেক জটিল কেস সমাধান করে সুনাম অর্জন করেছে। চারদিকে তার নিষ্ঠা আর সাহসিকতা জয়গান হয়। মেয়ে হয়েও কখনো পিছনে থাকেনি। বরং অনেক পুরুষ পুলিশ যা সাহস করে করতে পারেনি তা অধরা করেছে। বড় বড় রাঘব বোয়ালের মুখোশ টেনে খুলেছে নির্ভয়ে। কিন্তু তার নাতিদীর্ঘ কর্মজীবনে প্রতিভা কেসের মতো এমন চ্যালেঞ্জিং আর রহস্যময় কেস আর পায় নি সে।

যখন থানায় ফোন দিয়ে কেউ একজন বলেছিলো র‍্যাপিং পেপার মোড়ানো ট্রলি ব্যাগে একটা লাশ পাওয়া গেছে দ্রুত আসতে। তখনি অধরার মনে হয়েছে বেশ রহস্যময় কেস পেতে যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে এসে প্রতিভার লাশ দেখে তার মনের ভাবটা বেড়ে গেলো। এর আগে অনেক লাশ দেখেছে কিন্তু এমন লাশ দেখেনি অধরা। স্ত্রীকে খুন করে লাশকে বারবি গাউন আর পার্টি সাজ দিয়ে স্বামীর জন্মদিনে পাঠানো হয়েছে! দুধে আলতো ফর্সা মেয়েটার চেহারায় ভয়ার্ততার পরিবর্তে রয়েছে বিস্ময়ী ভাব। গোল গোল চোখ দুটো বড় বড় দিগুন গোল করে তাকিয়ে আছে। মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় দেখলে যেমন অবাক হয় তেমনি একটা ভাব। মৃত্যুর আগে হয়তো চমকপ্রদ কিছু দেখেছে যার দরুন সে বিস্মিত হয়েছে। বিস্মিত ভাবটা অতিমাত্রায় ছিলো বলেই চেহারায় মৃত্যু কষ্ট থেকে চমকপ্রদ বিষয়ের বিস্ময়ী ভাব লেগে আছে। যা মৃত্যু কষ্টকেও তুচ্ছ করেছে। তাইতো গোল গোল দুটো আর চেহারায় বিস্ময় মাখিয়েই মারা গেছে। তা আর স্বাভাবিক হয় নি। এখনো সেভাবেই আছে। পরিধানে একটা অফ হোয়াইট বারবি গাউন। হাতে অফ হোয়াইট ডায়মন্ড ব্রেসলেট,গলায় ভারী কাজের ডায়মন্ড নেকলেস,
যা পুরো গলাটাকে ডেকে রেখেছে। কানে নেকলেসের সাথে মিলানো ইয়ারিং,বাঁ হাতের অনামিকা আঙুলে ডায়মন্ড রিং। মাথার চুল গুলো পাফ করে খোঁপা করা। চেহারায় মেকাপের কমতি নেই। ভারী মেকাপ করা হয়েছে। পার্টি সাজে সাজানো হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতিভার রূপ এখনো নজরকাড়া। না জানি চেহারাটা স্বাভাবিক থাকলে কেমন লাগতো! নিশ্চয়ই অপ্সরীর মতো লাগলো,কিংবা পুতুলের মতো।

তবে একটা বিষয় অধরাকে অবাক করেছে তা হলো, প্রতিভার সাজসজ্জার নষ্ট না হওয়া। প্রতিভার সাজসজ্জা একটুও এদিক ওদিক হয় নি। না লিপস্টিক ছড়িয়েছে আর না একটা চুল এলোমেলো হয়েছে। সব কিছুতে চকমকে ভাব। যেন খানিক আগেই কেউ খুব যত্ন করে সাজিয়ে ট্রালি ব্যাগে হাটু গুজিয়ে আলতো করে শুইয়ে দিয়েছে কিংবা নিজে সেজেগুজে ‘দ’ স্টাইল শুয়ে আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, খুনটা কিভাবে করা হয়েছে? এতক্ষণ পরখ করার পর যা বুঝা গেলো, শরীরে আচঁড়ের লেশ মাত্র নেই। না গলায় কোন দাগ আছে, আর না শরীরে। অফ হোয়াইট গাউনটার কোথাও একটাও রক্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তারমানে কোথায় কাটাছেঁড়া ও নেই। তবে খুন করলো কিভাবে! প্রতিভার গেট আপ ও অধরাকে ভাবাচ্ছে। যদি সাজিয়ে খুন করা হয় তবে মৃত্যুর আগে খানিক ধস্তাধস্তি হলেও প্রতিভার সাজ বিঘ্ন হওয়ার কথা। কিন্তু তা তো হয় নি। সব সাজে নতুনত্ব বজায় আছে এখনো। তবে কি খুন করার পর লাশকে সাজানো হয়েছে! তারপর ‘দ’স্টাইলে ব্যাগে রেখে দিয়েছে! নাকি সাজানোর পর অন্য কোন উপায়ে প্রতিভাকে খুন করেছে। যা প্রথমে প্রতিভা নিজেই টের পায় নি। পরে যখন টের পেয়েছে তখন সে ভীষণ রকমের বিস্মিত হয়েছে। তবে দেখে বুঝা যাচ্ছে প্রতিভাকে খুন করা হয়েছে বেশি সময় হয় নি। সর্বোচ্চ সাত আট ঘন্টা হবে। অধরা তার বাম হাতটা উঁচু করে হাতে পরে থাকা কালো বেল্ডের ডায়াল ঘড়িটায় সময় দেখে নিলো। এখন বাজে সকাল সাড়ে ন’টা। আনুমানিক সাত ঘন্টা আগে খুন করা হলে প্রতিভা খুন হয়েছে রাত দু’টায়। প্রতিভার বাবা বললো, প্রতিভা বাবার বাসা থেকে বের হয়েছে রাত এগারোটায়। অথচ বারোটায় শিলাকে ম্যাসেজ দিয়ে বলছে সে তখনো বাবার বাসায়। কাল আসবে বাসায়। প্রতিভা মিথ্যা বললো কেনো! এগারোটায় বাবার বাসা থেকে বের হয়ে স্বামীর বাসায় না ফিরে গিয়েছিলো কোথায়! ম্যাসেজই বা করেছে কেনো!

আর প্রতিভার লাশ মোড়ানো র‍্যাপিং পেপার এর উপর নেম কার্ডে প্রতিভার লেখা কিভাবে এলো! খুনি কি প্রতিভার লেখা নকল করেছে না কি প্রতিভাই লেখেছে। আর চিরকুট কে লিখেছে! নিজের লাশের উপর নিজে চিরকুট রেখেছে প্রতিভা! অধরা তুরাগের হাত থেকে নেয়া চিরকুটটা হাতে নিয়ে আরেকবার চোখ বুলালো।
“সারপ্রাইজ হয়ে আমি তোমার জীবনে এসেছি। সারপ্রাইজ হয়েই তোমাকে রাঙিয়ে, তোমাকে ভাঙিয়ে চলে যাচ্ছি। তোমার জন্মদিনে কি উপহার দেয়া যায় ভাবতে ভাবতে গত একসপ্তাহ আমার মাথা ধরে গিয়েছিলো। হুট করেই এই প্ল্যান মাথায় এলো তাই কাজে লাগালাম। কেমন লাগলো সারপ্রাইজ? আমাকে এই বেশে কেমন লাগছে? নিশ্চয়ই ভালো। ভালো তো লাগতেই হবে। দেখতে হবে না বউটা কার? যাই হোক শুভ জন্মদিন। নিজের খেয়াল রেখো,ঠিকমতো মেডিসিন নিয়ো,একদম হেয়ালি করো না। আর হ্যাঁ সবাইকে বলে দিও আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। আমি আত্মহত্যা করেছি।”

অধরা চিরকুটটা পড়ে আবারো ভ্রু কুঁচকালো। এটা আত্মহত্যা কিভাবে হয়! আত্মহত্যার জন্য এত পরিকল্পনা কেনো! আর মেয়ে হয়ে বাবার অসুস্থতার দিকে খেয়াল না দিয়ে স্বামীর জন্মদিনের উপহার নিয়ে পড়েছিলো কিভাবে! তাছাড়া আত্মহত্যা হলে লাশের উপর চিরকুট আর লাশ প্যাকিং পাঠানো কে করেছে! চিরকুট আর নেম কার্ডের একি লেখা। তবে মৃত্যুর পর নেম কার্ডে কিভাবে লেখলো! চিরকুট পড়ে বুঝা যায় প্রতিভা মৃত্যুর আগেই সেজেছিলো। কিন্তু সেজেগুজে সুইসাইড করলে সাজ এলোমেলো হলো না কেনো! আর সুইসাইড সাধারণত সবাই গলায় দড়ি দিয়ে,হাতের রগ কেটে কিংবা বিষ খেয়ে করে। কিন্তু প্রতিভার শরীরে এমন কিছুই নেই তবে কিভাবে সুইসাইড করলো। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এটা মার্ডার তবে প্রতিভা চিরকুটে সুইসাইড বললো কেনো! যদি মার্ডার হয় তবে প্রতিভা নিজের হাতে চিরকুট আর নেমকার্ডে লিখলো কিভাবে! কেউ কাউকে পোর্স করে লিখালে হাত কেঁপে লেখা বাঁকা হবে কিন্তু লেখা তো একেবারে স্পষ্ট। যেন যত্ন করে লিখেছে। মার্ডার হলে এটা কিভাবে সম্ভব! অধরার মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আসল রহস্য কি! এটা মার্ডার না সুইসাইড? মার্ডার হলে খুনী কে! আর সুইসাইড হলে হেল্পার কে! এমন সাজিয়ে গুজিয়ে খুন করে স্বামীকে জন্মদিনের উপহার পাঠানোর কারণ কি! কি কারণ!…..

রহস্যময় সারপ্রাইজ
লেখকঃ আফিয়া আপ্পিতা
পর্ব-১

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here