#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_১৪
নাদিয়া বোতলটা ঘোরালো। আর এইটাও ইচ্ছে করেই জাহিদের দিকে দিল। জাহিদ জানে এমনই হবে। নাদিয়া আজ শুধু সত্যি টাই জানতে চায়। কী সেই সিক্রেট? আজ জাহিদের ওকে সব বলে দেওয়া উচিত। কারণ ও জানলেই ওকে সাহায্য করতে পারবে।
– ট্রুথ অর ডেয়ার?
– ডেয়ার। ( ফিসফিসিয়ে)
– টেল মি, ইওর সিক্রেট! (আস্তে আস্তে)
– শুনতে চান?
– জ্বী।
জাহিদ একদম শান্ত হয়ে বসে। ওর হাত দুটো টেবিলের উপরে রাখে। নাদিয়া খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
– আমার সিক্রেট।
– হুম।
– আমি।
– জ্বী।
– আমি।
– কী?
– স*মকামী ….
নাদিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল। তবে কী এটাই ওর সিক্রেট? নাদিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
– নই।
কী? কী বলল এটা! পরে আবার কী বলল?
– কী বললেন? মানে পরিষ্কার করে বলুন।
– আমি স*মকামী নই!
– এইটা আবার সিক্রেট নাকি?
– তো কোনটা সিক্রেট?
– আপনি যদি স*মকামী হতেন তবে সেটা সিক্রেট হতো।
– এটা আপনাকে কে বলল? ওটাই কেন সিক্রেট হতে হবে?
– মানে আপনি ম্যারিড, একজন মহিলার সাথে। মানে আপনি স্ট্রেইট। অন্তত দুনিয়ার চোখে। আপনার ডিজায়ার যদি এর একদম ব্যতিক্রম হতো তবে সেটা সিক্রেট হতো।
– ওহ! তবে এটাকে সিক্রেট বলে।
নাদিয়া জাহিদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, ‘ এক নাম্বারের শয়তান লোক! কেমন মুচকি হাসছে যেন আমি দেখতে পারছি না। মজা করছিল।’ জাহিদ এবার হাসি আটকে না রাখতে পেরে জোরে জোরেই হাসছে। প্রথমবার ওকে নাদিয়া এভাবে হাসতে দেখছে। তার মানে ও ফ্রি হচ্ছে।
– আপনি ভয় পেয়েছিলেন না? (হাসতে হাসতে)
– না। ভয় কেন পাব? আপনি যাই হন আমার কী?
– কিছু না?
– না।
– আমি হলে কী করতেন?
– চলে যেতাম। আমার মনে হয় সবার নিজের পছন্দের মানুষের সাথেই থাকা উচিত। হালকা আকর্ষণ তো থাকা উচিত। আর আমি আপনাকে বলতাম আপনার পছন্দের মানুষের থাকতে।
– আচ্ছা!
– হ্যাঁ। কারণ এটা আমার আর আপনার দুজনের জন্যই টাইম ওয়েস্ট। আর আপনার একটা গার্লফ্রেন্ড থাকা আর বয়ফ্রেন্ড্ থাকা আমার জন্য একই জিনিস। আর এখন যেটা মনে হচ্ছে দুটোর কিছুই নেই। আছে শুধু একটা ওয়াইফ, তাও রুমমেট।
এবার জাহিদ আর কিছু বলল না, বোতল ঘোরালো। ঘোরালো। এবার নাদিয়ার দিকে। জাহিদ হেসে বলল,
– ট্রুথ অর ডেয়ার?
– না, আমি আর খেলছি না।
– না ট্রুথ নিন। আপনি ভয় পেয়েছিলেন।
– একটু। তবে আমি এইটা জানতে চাইনি। অন্য কিছু জানতে চেয়েছিলাম। আই হোপ একদিন বলবেন। তাড়া নেই কোনো। আমি শুনবো। আচ্ছা, আপনার কোনো কথা বলার মানুষ নেই? মানে ছিল না, তাই না?
– জ্বী? আমি কথা বলতে পছন্দ করি না। যত বেশি কথা তত বেশি বিপদ।
– বলা উচিত।
– ঠিক আছে, বলব।
আজকের মতো খেলা শেষ। নাদিয়া পরদিন পিপির সাথে দেখা করতে গেছে ওনাকে আপডেট দিতে।
– ওওও! ও তাহলে ফ্রি হচ্ছে আস্তে আস্তে। মজাও করছে।
– হ্যাঁ। তবে সেদিন নিজেকে দোষারোপ ও করছিল।
– তুমি কী বললে?
– বললাম কারো দোষ নেই। স্বাভাবিক ব্যাপার। আচ্ছা, উনি তো সিক্রেট বলবেন না।
– বলবে , বলবে। ও আস্তে আস্তে আরো ফ্রি হবে। সব সত্যি বলবে। একসময় দেখবে নিজে থেকে সব বলছে। অনেক কথা বলছে।
– কখন?
– একসময়। তবে মনে রেখো, ওর একটা কমফোর্ট জোন তৈরী হবে। কখন জানো? যখন ও ভাববে তুমিও ওর মতো। মানুষ নিজের মতো কাউকে পেলেই সব খুলে বলে। সেটা জেনে বা না জেনে। তবে আমরা যখন বন্ধু খুঁজি তখন কিন্তু নিজের প্রতিচ্ছবি কেই খুঁজি তার মাঝে।
– কিন্তু আমার একটা বন্ধু ও আমার মতো না।
– তোমার মনে হয়। কিন্তু আসলে ওরা তোমারই মতো। কোথাও না কোথাও মনের, বা আত্মার মিল আছে। আমরা তাদের মধ্যে নিজের গুণ গুলো না, ভুল গুলো দেখতে পাই। তাই আমরা বন্ধুত্বের হাত বাড়াই। তুমি নিশ্চয়ই জাহিদের মধ্যে নিজের কোনো কাজের প্রতিচ্ছবি দেখেছ, আর তাই ওর প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছ। স্বীকার করো আর নাই করো। জাহিদের ও তোমার ভেতর সেই প্রতিচ্ছবি দেখতে হবে। তবেই ও ভাববে, তুমিও ওর মতোই একজন। হাজার হোক, আমরা নিজের ভুল গুলো কে ভুল মনে করিনা।
আজ শুক্রবার। আগের দিন কাজের চাপে দেরি হওয়ায় ওরা আর বসেনি। আজ ছুটির দিন জুমার নামাজের পর খাওয়া শেষে দুজনেই দুজনের মতো সময় কাটাচ্ছে। জাহিদ একটা বই পড়ে আসর পড়ল। নাদিয়া একটা কাজ করছিল তাই ওর ট্রুথ অর ডেয়ারের কথা মনে ছিল না। জাহিদ বাইরে অপেক্ষা করছে কখন ওর সাথে খেলবে তা নিয়ে। ও আরেকটু অপেক্ষা করে মাগরিব ও পড়ে ফেলল। কী ব্যাপার নাদিয়ার কী মনে নেই? জাহিদ কফি বানিয়ে অপেক্ষা করছে। নাদিয়ার ঘরের সামনে হালকা পায়চারি করছে। নাদিয়ার কানে হেড ফোন, ও রেডিও শুনছে আর বাচ্চাদের প্রশ্ন সেট করছে।
” দূরের মানুষটি কখন কাছে চলে আসে বোঝা যায় না। অবাক লাগে তাই না? তেমনি দূরেও চলে যায়। তখন মনে হয় এই তো কাছে ছিল। কখন দূরে গেল? তাই কাছের মানুষটির কাছেই থাকুন। তার থেকে চোখ ফেরাবেন না। না জানি আবার কখন দূরে চলে যায়? আমি তো কাছের মানুষ। আমার থেকে দূরে যাবেন না। এই গানটি শুনতে থাকুন, একটু পরই ফিরে আসছি, আরজে ঐশী।”
“কেন দূরে থাকো
শুধু আড়াল রাখো
কে তুমি, কে তুমি আমায় ডাকো?
কেন দূরে থাকো?
শুধু আড়াল রাখো
কে তুমি, কে তুমি আমায় ডাকো?
কেন দূরে থাকো
মনে হয় তবু বারে বারে
এই বুঝি এলে মোর দ্বারে
মনে হয় তবু বারে বারে
এই বুঝি এলে মোর দ্বারে
সে মধুর স্বপ্ন ভেঙ্গো না কো
কেন দূরে থাকো
শুধু আড়াল রাখো
কে তুমি, কে তুমি আমায় ডাকো?
কেন দূরে থাকো।”
নাদিয়ার হঠাৎ মনে হলো আজকে তো খেলতে হবে। বের হতেই দেখল জাহিদ ওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। জাহিদ একটু ঘাবড়ে গেল। কী বলবে? কেন দাঁড়িয়েছিল?
– জাহিদ, আজকে কী খেলবেন?
– ওহ! হ্যাঁ। খেলবো। কিন্তু আমি ঘোরাবো।
– ঠিক আছে।
জাহিদ ঘোরালো। জাহিদ বুঝতে পারে না ও ঘোরালে ওর দিকেই কেন আসে?
– ট্রুথ অর ডেয়ার?
– ট্রুথ।
– উমমমম, আপনার ছোটবেলায় কী হওয়ার ইচ্ছা ছিল?
– মনে নেই।
– মানে কী?
– স্পেসিফিক কিছু ছিল না।
– ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার?
– না।
– তো?
– বিদেশে পড়তে যাওয়া। আর , বড়লোক হওয়া।
– যান নি কেন?
জাহিদ চুপ হয়ে যায়। ও বলতে পারবে না কেন। নাদিয়া তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জাহিদ চশমা ঠিক করে বলে,
– এক বারে একটা প্রশ্ন।
– ওকে।
এবারে নাদিয়া ঘোরালো। কিন্তু ওর দিকে আসলো।
– ট্রুথ অর ডেয়ার?
– ট্রুথ।
জাহিদ ভাবছে কী প্রশ্ন করা যায়। ও তো ছোটবেলায় ডাক্তার হতে চাইতো ও তা জানে। কিন্তু কেন হলো না তা তো জানে না। সরাসরি তো করা যায় না।
– আপনার ছোটবেলায় কী টিচারই হওয়ার ইচ্ছা ছিল?
– না।
– ওকে।
আবার ঘোরালো। এবার নাদিয়া।
– ট্রুথ অর ডেয়ার?
– ট্রুথ।
– তো, টিচার, কেন হলেন?
– একটা কারণে। কারণটা এই মুহূর্তে বলতে চাই না। বুঝবেন না।
– না , বোঝার চেষ্টা করবো।
– অনেক বড় কাহিনী। বলা যায় সিক্রেট।
– টেল মি ইওর সিক্রেট!
– ডু ইউ ওয়ান্ট টু নো?
– ইয়েস।
– দিস ইস মাই ডিপেস্ট ডার্কেস্ট সিক্রেট। আর এটা আমার বাবা মা ও জানে না। রাহু অংশু ভাইয়া ও না। এই প্রথম আপনি জানবেন।
– কী সেটা?
– আমি আত্ম*হ*ত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। আর তাই কোনো অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে পারিনি। তাই ডাক্তার ও হতে পারিনি।
জাহিদ থ হয়ে গেল। কী বলছে নাদিয়া এসব! ও আত্ম*হ*ত্যা করার চেষ্টা করেছিল? কেন? নাদিয়া নিজেই বোতলটা ঘোরালো। এবার জাহিদের দিকে। নাদিয়া জিজ্ঞেস করল,
– ট্রুথ অর ডেয়ার?
– টটটটটট্রুথ।
জাহিদের কথা আটকে আসছিল। ওর ভয় লাগছে।
– আপনার কী জানতে ইচ্ছে করছে কেন করেছিলাম?
– হ্যাঁ! মানে, আপনি যদি কিছু মনে না করেন।
– ভয় পাবেন না। বলছি। আমার কলেজ ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা চলছিল। মানে একাদশ শ্রেণী। আমি খুব সিরিয়াস ছিলাম। তার আগেই বাসায় একটা প্রোগ্রাম হয়েছিল। তাই প্রিপারেশন নরমাল ছিল। তখন আমার বেস্টফ্রেন্ড প্রিয়মের হঠাৎ ফোন আসতে থাকে। প্রিয়ম আর আমি একদম ছোটবেলার বন্ধু। অনেক মিষ্টি মেয়ে ছিল, সারাদিন হাসতো আর হাসাতো। আমার ওর সাথে কখনো ঝগড়া হয়নি। কিন্তু সেদিন আমি ওর সাথে হালকা রাগ করেছিলাম। কারণ আমি ওকে ঐ ফ্যামিলি প্রোগ্রামে আসতে বলেছিলাম, আর ও আসেনি। খবর ও নেয়নি। রাগ করেই ফোনটা অফ করে দিয়েছিলাম। পরদিন পরীক্ষা দেই। খুব ভালো হয়েছিল পরীক্ষা। ফুল মার্কস। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখলাম সব শেষ হয়ে গেছে। প্রিয়ম আর নেই। ওর নিথর দেহ ওর বাড়ির সামনে। কেউ জানে না ও এমনটা কেন করলো। আমি ভাবছিলাম আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। প্রসেস করতে পারছিলাম না। সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। এরপর ওর জানাজা হলো। এরপর আমি ওর মায়ের কাছে গেলাম। উনি আমাকে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেন। মৃ*ত্যুর আগে নাকি ও আমাকে বারো বার কল করেছিল। কী করে বলতাম, তিনবারের পরেই তো আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কেন করলো ও? হয়তো কোনো সমস্যা ছিল। বলতে চাইছিল, শুনিনি। অপেক্ষা করতে পারতো। পরদিন বাড়ি আসতে পারতো। কাছাকাছি বাসা আমাদের। এরপর সবাই আমাকে দোষ দিতে লাগলো আমি নাকি দায়ী। আমি অনেক স্ট্রং। আমি এসব কথা কানে নেইনি। কারণ আমি এমন কিছু করিনি যে ও কষ্ট পাবে। শুধু ফোন না ধরা এর কারণ হতে পারে না। কিছু একটা কারণেই ফোন করছিলো। তা আমি জানতাম না। তাই আমি প্রতিদিন ওর স্কুলের সামনে যেতাম। কোনো বন্ধু তো থাকবে, কেউ তো ওকে চিনবে। ওর স্কুলের কেউ হয়তো জানে। কিন্তু ওরা আমাকে ঢুকতে দিত না। এরপর ধরা খেয়ে গেলাম বাবার কাছে। উনি আমাকে আর কখনো একা বের হতে দিতেন না। এদিকে রাহু, ও নাকি প্রিয়মকে পছন্দ করতো। ছোটবেলা থেকে। যদিও প্রিয়ম বড় ওর থেকে, তবুও ভালোই লাগতো। রাহু ব্যাপারটা বলেছিল আমাকে। প্রিয়ম জানতো না। কিন্তু আমি চাইতাম ও নিজে বলুক। শেষ পর্যন্ত বলতে পারেনি। তাই রাহু অনেক ভেঙে পরে। বাবা মা পরে ওর কাউন্সিলিং করায়। ও স্বাভাবিক হয়। কিন্তু আমি তো স্ট্রং, তাই আমি কাউন্সিলিং করাইনি। মা বলেছিল মেয়ে মানুষ, লোক পরে যদি পাগল বলে। আমার তো তেমন সমস্যা ও হচ্ছে না।
– আপনি কাউন্সিলিং করাননি !
– না। তাই তো বললাম। এরপর নিজেকে পড়াশুনা তে খুব ব্যস্ত রাখি। পড়তে পড়তে পাগল হয়ে যেতাম। আসলে তখন অংশু ভাইয়া ও একটা সমস্যার জন্য আমার সাথে কথা বলত না। আমি একা হয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলের বই ছাড়া বাইরের বইও পড়তাম। আউটনলেজের জন্য। তবুও প্রিয়মকে ভুলতে পারতাম না। ভাবতাম, ও কেনো এমন করলো? ওর কাছে গেলে কী জানতে পারবো? তখন আমার ঘরের সিলিং ফ্যানে ফাঁস লাগাতে যাই। প্রথমবার আমি আত্ম*হ*ত্যার চেষ্টা করি। কিন্তু বাবা মা , রাহু অংশুর ছবি দেখতে পাই। আমার ঘরে অনেক বড় একটা পারিবারিক ছবি ছিল। সেই ছবিটার জন্যই রান্নাঘর থেকে আনা ছুরি দিয়ে হাত কাটতে পারিনি আরেকদিন। বাবার ঘুমের ঔষধ এনেও খেতে পারিনি। তাই ভাবলাম এমন একটা জায়গায় গিয়ে চেষ্টা করব যেখানে ওদের দেখব না। ওদের দেখলে আমি আত্ম*হ*ত্যা করতে পারব না। তখন আমার ঘরের পাশে সেই বেল গাছের সাথে ফাঁস নিতে যাই। মাঝরাতে আমি সব প্রস্তুতি নিয়ে যাই। কিন্তু, বারান্দা থেকে বাবা দাঁড়িয়েছিল। সেদিন ও পারিনি। তবে বাবা বোঝেনি আমি কী করতে গিয়েছিলাম। আর বেল গাছটা বড় তো। সম্ভব হয়নি। অনেক বাজে আইডিয়া ছিল।
নাদিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জাহিদ চুপসে আছে। ওর মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের হচ্ছে না। নাদিয়া নিজেই বলল,
– একদম মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার আগে। আমি কোচিং সেন্টারে আমি তৃতীয় হই। আমার রেজাল্ট খুব ভালো ছিল। ডিএমসিতে কনফার্ম। আমি ক্রেস্ট নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। রাস্তা পার হবো। পাশেই ওভারব্রিজ ছিল। গাড়ি ভাইয়া নিয়ে ছিল। অনেক দিন পর আমি একা বেরিয়েছিলাম। প্রিয়ম সবসময় বলত, ও নাকি বিপদে পড়লে ভাবতো আমি ওর জায়গায় থাকলে কী করতাম। এরপর ও সে কাজটাই করতো। তাহলে সেদিন কেন ভাবলো না? ভাবলেও আমিও কী তাই করতাম? সেদিন অনেক কষ্ট হচ্ছিল। খুব খারাপ লাগছিল। আমি তাই করলাম প্রিয়ম যা করত।
– কী?
– লোকাল বাসের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
অরনীর আহত দেহ এক পাশে, আর আরেক পাশে ওর পুরস্কার। পুরো রাস্তা রক্তাক্ত হয়ে গেল। তাৎক্ষণিক ভাবে ওকে কাছের একটি হাসপাতালে নেওয়া হলো। সেখানে তিনটা মেজর অপারেশনের পর ওকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ওর এই খবর পেয়ে ওর বাবা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক করে। ওর পুরো পরিবার ভেঙে পড়ে। তিক্ত হলেও সত্যি, তখন সবাই অপেক্ষা করত কখন অরনীর মৃত্যুর অফিসিয়াল খবর আসে। এত বড় হাসপাতালে নাদিয়ার চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিল অরনীর বাবা। তিনি তাৎক্ষণিক খরচ যোগাতে একটি জমি পানির দামে বিক্রি করে দেন। আর তাই অরনীর চাচা ওর উপর এখনো রাগ।
অসুস্থ বাবা অরনীর চিন্তায় তখন ভেঙে পড়ার কারণে অংশু ভাইয়াকেই তখন ব্যবসার হাল ধরতে হয়। প্রায় এক বছর অরনী কোমাতে ছিল। অরনীকে হাসপাতালে এভাবে দেখে রাহু ঠিক করে ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে না। ও ডাক্তার হবে। ও ডাক্তার হয়ে অরনীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে। এক বছর পর অরনী জেগে উঠে। ওর চোখ খোলার আগের দুনিয়া আর পরের দুনিয়ায় অনেক তফাৎ। ওর মা, যাকে দেখলে তিন বাচ্চার মা মনেই হতো না তার চেহারা বদলে গেছে। এই এক বছরে তার বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে। অরনীর খেয়াল রাখতে গিয়ে তিনি তার চাকরি ছেড়ে দেন। আর ওর বাবার শরীর ভেঙে গেছে। তার উপর যেন অনেক ক্লান্তির ছায়া। অংশু ভাইয়া একদম বড় হয়ে গেছে। ব্যবসার চাপে তিনিও আর আগের মতো নেই। আর রাহু, অরনীর সাথে একদম স্টেথেস্কোপ আর অ্যাপ্রোন নিয়েই দেখা করতে আসে। ডাক্তার রাহিয়ান। ওর মেডিকেলে চান্স হয়ে গেছে।
অরনীর সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াতে আরো ছয়মাস লেগেছিল। ততদিনে ওর সেকেন্ড টাইমের স্বপ্ন ও শেষ। ওর বাবা ওকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু ও ওর লক্ষ্য বদলে ফেলে। পৃথিবীতে ওর আসার মূল উদ্দেশ্য হয়তো পূরণ হয়নি, আর তাই ই ও মরেনি। ওর জানতে হবে প্রিয়ম কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর তা জানার একটাই পথ আছে, সেই স্কুলে যাওয়া। সেই স্কুলে সবাই ঢুকতে পারে না। সেই স্কুল হলো বাংলাদেশের অন্যতম বিশেষ স্কুল। সেই স্কুলে শুধুমাত্র ক্ষমতাধর প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের সন্তানরাই পড়তে পারে। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে কিছু সাধারণ স্কলারশিপ স্টুডেন্ট যেতে পারে। যেমন প্রিয়ম আর জাহিদ।
কোমা থেকে উঠার পর অরনী ওর ল্যাপটপে রিসার্চ করতে থাকে কী ভাবে ও সেই স্কুলে ঢুকতে পারবে? জানা গেল একটি বিদেশি হায়ার স্টাডিজ ডিগ্রি আর দুই বছর একটি স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর অভিজ্ঞতা থাকলেই ও সেই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে আবেদন করতে পারবে। তাই সময় নষ্ট না করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশে অনার্স মাত্র তিন বছরে শেষ করে বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি নিয়ে এখন এই স্কুলে শিক্ষকতা করছে। আর তাই ও ডাক্তার হয়নি।
জাহিদ নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। নাদিয়া চুপ করে আছে।
– আপনি কিছু বলছেন না যে?
– কেউ কেন বোঝেনি আপনি আত্ম*হ*ত্যা করতে চেয়েছিলেন?
– কারণ ওটা লোকাল বাস ছিল। ওরা এমনিতেও মানুষের উপর চালিয়ে দেয়। তাই কেউ বোঝেনি আমি ইচ্ছে করেই কাজটা করেছিলাম। যতদিনে আমি উঠে বলতাম অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।
– এ কারণেই কী বলেছিলেন, মাথায় সার্জারি?
– জ্বী। আপনার মনে আছে তাহলে! এই যে , এই জায়গা টা। এখানে এখনো সেলাইয়ের দাগ আছে।
নাদিয়া দাগ টা দেখাতে যায়। জাহিদের ওকে এভাবে দেখে কান্না পেয়ে যায়। ও সেখান থেকে উঠে ওর ওয়াশরুমে চলে যায়। নাদিয়া কিছুই বুঝতে পারেনা। জাহিদ কী আবার রাগ করেছে? জাহিদ ওর ওয়াশরুমের দরজার বন্ধ করে আবার কাঁদতে থাকে।
” দোষ টা তো আমার ছিল! আত্ম*হ*ত্যা তো আমার করার কথা। আপনি কেন করলেন? আমার জন্য শুধু প্রিয়মই না, আপনার ও জীবন শেষ হয়ে গেল। অন্য রকম হতে পারতো। আপনার জীবন এমন তো হওয়ার ছিল না!”
প্রিয়মের জানাজার দিন ওর স্কুল থেকে শুধু জাহিদ ই গিয়েছিল। সেদিন একটা মেয়েকে থাপ্পড় দিতে দেখেছিল। ওটা অরনী ছিল। সেদিন রাহু এসে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল ও কে? অরনীকে থাপ্পড় মারার দৃশ্য দেখার পর জাহিদ সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আর কখনো যায়নি সেখানে। স্কুলে গিয়ে প্রায় শুনতো একটা মেয়ে প্রিয়মের বন্ধুর সাথে দেখা করতে চায়। জাহিদ জানে পুরো ঘটনাটা, ও নিজেও সেই ঘটনার অংশ। তাও কখনো কিছুই করেনি। অনেক অন্যায় করেছে ও প্রিয়মের সাথে। ওর প্রিয় বন্ধুর সাথে, যে ওকে খুব ভালোবাসতো। যে ওকে মানুষ হিসেবে দেখত এসব অমানুষের ভীড়ে।
(চলবে)