রিস্টার্ট পার্ট-৪৯

0
3684

#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৪৯

খুব ভোরে উঠে জাহিদ ফজরের নামাজ আদায় করলো। মোনাজাতে প্রতিবারের মতো প্রিয়মকে জান্নাতবাসী করার দোয়া আর নাদিয়ার ফিরে আসার জন্য আকুতি করলো। নামাজ শেষে জাহিদ আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢুকে ফাইয়াজ কে দেখল। ওর চোখে এখনো কোনো আফসোস নেই। বাকি দুজনের চোখে একটা আফসোস তো ছিল। ও কেন আফসোস করছে না? বেরিয়ে এসে জাহিদ রাহুকে ফোন করলো।

– কী সমস্যা, তুমি আসছো না যে।
– বিয়ে বাড়ি ছেড়ে কী করে আসি?
– কার বিয়ে?

বলতেই রাহু ফোন রেখে দিলো। জাহিদ ভাবলো রাহু কী ওকে ইগনোর করছে? কিন্তু হঠাৎ কেন? নাস্তার টেবিলে ওয়াজির আর ওয়াসি ওর দুশ্চিন্তা লক্ষ্য করেছে। নাস্তা শেষেও একই অবস্থা। ওর এই আচরণ দেখে ওয়াজির বলল,
– শালা আসেনি বলে এত চিন্তা কেন?
– ও বলল বিয়ে।
– তো চিরাচরিত দুলাভাই হয়ে মান করছ কেন? তোমাকে দাওয়াত দেয়নি বলে গাল ফোলাবে?
– তা না।
– তোমাকে ডিভোর্স ধরিয়ে দিয়ে গেল, আর তুমি।
– এক মিনিট। রাহু আমাকে ইগনোর করছে, নাদিয়া ডিভোর্স লেটার দিয়ে গেল। তারমানে কী?
– ও বিয়ে করছে?

জাহিদ চুপসে গেল। ওয়াসি হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে গেল। এবার ওয়াজির ও হাসতে লাগলো,

– তুমি আবার ওভারথিংকিং করছো?
– না। কিন্তু সত্যি বলতে,
– ওয়েট, ওর ভাবিকে ফোন দাও তো। কী যেন নাম, মিষ্টি।
– দাঁড়াও।
– লাউডস্পিকারে।

জাহিদ মিষ্টিকে কল করতেই মিষ্টি ফোন তুলে বলল,

– আমরা অনেক ব্যস্ত জাহিদ ভাই।
– কার বিয়ে?
– বিয়ে না, আকদ।
– কার?
– আপনি জানেন না?
– না। কেউ বলেনি। কার আকদ?
– যার হওয়ার কথা।
– কে? কার বিয়ে হওয়ার কথা? আমি জানলে কী হবে?

মিষ্টি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল,

– মন খারাপ হবে আপনার। থাক, না বলি।
– যাই হবে , আমি মেনে নিতে প্রস্তুত।
– দাঁড়ান! দাঁড়ান!
– বর কে?
– বর!
– জ্বী! বিয়ে কার সাথে হচ্ছে?
– বেশি বলতে পারব না। পরিচিত ই। খুব কাছের লোক।
– কার? নাদিয়ার কাছের লোক?
– আমার ও কাছের লোক।
– ও! আচ্ছা, নাদিয়া কোথায়?
– ওটা তো বলা যাবে না।
– কেন?
– কারণ ওর খবরই তো দেওয়া মানা।
– কী করছে , তা তো বলুন।
– এই টাইমে মেয়েরা কী করে?
– মানে?
– পার্লারে গেছে। দুপুরের দিকে আকদ। আমি তো ভাবি মানুষ তাই যাইনি। এখন রাখি। মন খারাপ করবেন না। মনে রাখবেন, যত নন্দাই ই আসুক না কেন, আপনি সবসময় আমার কাছে আমার প্রিয় নন্দাই ই থাকবেন।

মিষ্টি ফোন টা রাখতেই জাহিদ কান্নায় ভেঙে পড়ে। ‘যত নন্দাই ই আসুক না কেন?’ মানে আরেকজন নন্দাই আসছে। এখনো জাহিদ ডিভোর্স লেটারে সাইন করলো না আর নাদিয়া ওদিকে বিয়ে করছে। ওয়াসি আর ওয়াজিরের চেহারাও বেজার হয়ে গেল। ওয়াসি আস্তে আস্তে বলল,

– এখন কী করবি?
– কী করবো?
– ডিভোর্স তো হয়নি, বিয়ে কী করে হবে?
– ও এটা কী করে করতে পারলো?
– মন খারাপ করিস না। চল ডিভোর্স লেটারে সাইন করে ওটা ওকে দিয়ে আসি। নইলে পরে ওর ঐ বিয়েটা হবে না। ওটা অবৈধ হয়ে যাবে। তুই না ওকে ভালোবাসিস। ওর জন্য সব পারিস।

ওয়াসির কথা শুনে ওয়াজির আর হাসি আটকাতে পারল না। নাদিয়ার বিয়ে বৈধ করতে নাকি এখন জাহিদ ডিভোর্স লেটার নিয়ে যাবে। চোখ মুছে জাহিদ বলল, “চলো! নাদিয়ার বিয়েতে চলো। গত বছর আমার জন্মদিনে আমাকে উপোস রেখেছিল। পরে বলেছিল আগামি বছর ভালো উপহার দেবে। এটাই সেই উপহার। আমি তোমাকে তোমার বিয়ে উপলক্ষে আরো ভালো উপহার দেব নাদিয়া। ”

দুই ভাই অবাক হয়ে বলল, “আজকে তোমার জন্মদিন!” জাহিদ আর কিছু বলে না। কুচকানো সাদা রঙের পাঞ্জাবি টা পরে বের হলো সে। ওর হাতে ডিভোর্স লেটার আর কলম। যার বউয়ের বিয়ে সে তো একদম উষ্কো খুষ্কো চুলে। এদিকে ঐ দুই ভাই খুব ভালো করে তৈরী হয়েছে বিনা দাওয়াতে বিয়ে খেতে। সবাই মিলে গাড়ি নিয়ে এলো নাদিয়াদের বাড়ি। আকদের জন্য একটু কম সাজানো হয়েছে ওদের বাড়ি। জাহিদ নাদিয়ার বিয়ের সময় অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছিল। একদম রাজবাড়ির মতো। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। হঠাৎ ওয়াসি বলল, “দ্বিতীয় বিয়ে অনুযায়ী অনেক ভালোই সাজিয়েছে।” জাহিদ অনেক রাগের দৃষ্টিতে তাকালো ওয়াসির দিকে। ওয়াজির ওয়াসির পায়ে লাথি মেরে বলল, “মুখে কিছু আটকায় না? তুই পাগলই ভালো ছিলি রে।”

জাহিদ সামনে আর ওয়াজির আর ওয়াসি ওর পেছনে। অত্যন্ত অভিমানের সহিত জাহিদ হাঁটছে। ওয়াসি ওর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বিয়ে বাড়ির কাজের লোকদের সাথে ধাক্কা খেয়ে সব এলোমেলো করে দিল। আর ওয়াজির ওর ভাইকে উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এই দৃশ্য বাকি অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এই দুজন কারা? এই লোকটা তো নাদিয়ার স্বামী। এভাবে হেঁটে আসছে কেন? জাহিদ হাঁটতে হাঁটতে একদম ছাঁদে চলে গেল। সেখানে গিয়েই দেখতে পেল মিশানকে।

মিশান একদম পরিপাটি সাজে। মাথায় টুপি লাগিয়ে ফটোসেশন করছে। জাহিদের হঠাৎ মনে পড়লো ওর মেজ ভাইয়ের আকদের কথা। শুধুমাত্র আকদ হলে বর বউয়ের পোষাক অনেক সাদামাটা থাকে। জমকালো বিয়েতে শেরওয়ানি পরা হয়। আর মিষ্টি ভাবিও বলেছেন নাদিয়া আর তার খুব কাছের লোক হচ্ছে বর। শেষমেশ এই দুশ্চরিত্র মিশান!

মিশান জাহিদ কে এভাবে দেখে এক গাল হাসি নিয়ে বলল, “তুমি আসবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।” জাহিদ ওকে কিছুই বলে না। অভিমান তো নাদিয়ার উপর হচ্ছে। ওর না হয় জাহিদ কে পছন্দ না, তাই বলে এই মিশান? তখনই পেছন থেকে নাদিয়া ওকে ডাকলো। জাহিদ পেছনে তাকিয়ে দেখলো নাদিয়াকে। ও কী সুন্দর করে সেজেছে। মেরুন রঙের শাড়িতে ওকে দারুণ লাগছে। এই রঙের শাড়ির সাথে একই রঙের লিপস্টিক নাদিয়ার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ওর গলার আর কানের গয়নাগুলো সোনার। এভাবে সোনার গয়না পরলে মেয়েদের নতুন বউ নতুন বউ ভাব আসে। নাদিয়া কে খুব ভালো করে অবলোকন করার পর ওর মনে হলো এই গয়না গুলো ওর দেওয়া নয়। পরক্ষণেই জাহিদ মিশানের দিকে তাকিয়ে দেখল ও একই রঙের জ্যাকেট পরেছে। রক্ত এবার ওর মাথার উপর উঠলো। নাদিয়া ওর কাছে এগিয়ে এসে বলল,

– এভাবে, এখানে, কেন?
– দুঃখিত!
– আচ্ছা যখন এসে গিয়েছ কারণ টা বলে ফেল। এমনিতেই সবাই কানাকানি করছে।
– কানাকানির ভয় তোমার আছে?
– না। তাও বলছি, কারণ আমার মা বাবার কানাকানির ভয় আছে।
– ভয় থাকলে অন্তত পক্ষে এই ডিভোর্স পেপারে সাইন নিয়ে নিতে। আর কিছুটা দিন অপেক্ষা করতে। অন্তত ডিভোর্স গ্রান্টেড হওয়ার। ইদ্দত না হয় পালন করলেই না।
– এসব আমি কেন করবো?
– এই যে বিয়েটা নইলে অবৈধ হবে। ধর্মীয় ভাবে আর আইনি ভাবেও।
– ওহ তাই! এমন কিছু আছে, জানতাম না তো। ধন্যবাদ!

নাদিয়ার কথা শুনে জাহিদের খুব রাগ হলো। ওর মধ্যে কোনো সহমর্মিতা নেই। ওদের এই দৃশ্য দেখতে ছাঁদে একটা ভীড় হয়ে গেছে। জাহিদ আশেপাশে তাকিয়ে সেই ডিভোর্স পেপার বের করে সাইন করে নাদিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “আমার জন্মদিনে তোমাকে আমি উপহার দিলাম। সুখে থাকো!”

নাদিয়া কাগজ টা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল,

– তো মিস্টার জাহিদ, আপনি তো সাইন করে দিলেন।
– জ্বী।
– তারমানে আমরা এখন আর স্বামী স্ত্রী নেই।

জাহিদের মন খারাপ হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি! নাদিয়া কথা শুনে ওর ঘৃণা হচ্ছে। তাই ও আর কোনো জবাব দিল না।
– আপনি কী পেপার টা পুরো পড়ে দেখেছেন?
– দেখেছি।
– আপনার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই?
– না! আমি তোমাকে সবকিছু থেকে মুক্তি দিলাম।
– আপনি মিথ্যে বলছেন কেন, আপনি এটা পুরোটা পড়ে দেখেন নি।
– না দেখিনি! দেখতেও চাইনা।
– কাগজটা আমি আপনাকে দিয়েছিলাম পড়ে দেখার জন্য। এভাবে এখানে হিন্দি সিরিয়ালের মতো সিন ক্রিয়েট করা জন্য না।

নাদিয়া কাগজটা জাহিদের হাতে ধরিয়ে দিল। জাহিদ এবার কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগলো। এটা একটা শর্ত সাপেক্ষের ডিভোর্স পেপার। সেখানে লেখা বাক্য গুলোর সারসংক্ষেপ এমন যে, জাহিদ আর নাদিয়ার বিয়ের কাহিনী এখানেই শেষ। যদি সে প্রিয়মের বন্ধু শুদ্ধ হয়ে ফিরে আসতে পারে তো নাদিয়া ও প্রিয়মের বন্ধু অরনী হয়ে রিস্টার্ট করতে চাইবে। আর যদি জাহিদের এতে আপত্তি থাকে তবে সে ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে পারে। জাহিদ বুঝতে পারলো সে কত বড় বোকামি করেছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে আছে। নাদিয়া ওর তর্জনী দিয়ে জাহিদের চিবুক তুলে ধরলো। জাহিদ এবার ভেজা বিড়ালের মতো নাদিয়ার দিকে তাকালো। নাদিয়ার পেট ফেটে হাসি আসছে। আশেপাশের কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। অতঃপর জাহিদ ই মুখ খুলে বলল,

– তো বিয়েটা কার?
– তুমি কী ভেবেছিলে আমার?

জাহিদ পেছনে মিশানের দিকে তাকালো। এরপর সামনে তাকাতেই দেখলো মিষ্টি কে। মিষ্টি হাসি আটকাতে পারল না। জাহিদ এবার বিরক্ত হয়ে মিষ্টি কে বলল, “আপনি না বললেন?” নাদিয়া মিষ্টির দিকে তাকাতেই মিষ্টি হাসি বন্ধ করে বলল, “ও মা! নন্দাইয়ের সাথে মজা করব না তো কার সাথে করব?” নাদিয়া হেসে বলে,

– কী বলেছিলে ভাবি?
– বলেছিলাম, আকদ হবে। উনি অন্য কিছু ভাবছিল, আমি ঘি ঢালছিলাম। বলল বর কে? আমার না তখন এত হাসি পেয়েছিল, বর কে? বর পক্ষ তো আমরা। বর পক্ষ কী কখনো জিজ্ঞেস করে বর কে? জাহিদ ভাই, আজকে আমার আর নাদিয়ার দুজনেরই কাছের লোক রাহুর বিয়ে। মানে আকদ।

জাহিদের সাথে এত বড় একটা প্র্যাংক হয়ে গেল। ও আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো সবাই মেরুন কিছু না কিছু পরেছে। বিয়ে বাড়ির থিম মেরুন। নাদিয়া মিষ্টির দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই মিষ্টি সবাইকে ছাঁদ থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। সবাই হাসতে হাসতে ছাঁদ থেকে নেমে গেল। নাদিয়া এবার জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,

– তো?
– কী?
– কাগজের শর্ত মঞ্জুর?
– হুম।

জাহিদ মাথা নাড়লো। নাদিয়া কাগজটা ওর হাতে নিয়ে কুঁচি কুঁচি করে ছিড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাপি বার্থডে! এই নাও তোমার বার্থডে গিফ্ট।” এরপর জাহিদের কপালে দুই ভ্রমরের মাঝখানে তর্জনী দিয়ে চেপে বলল,

– রিসেট টু শুদ্ধ এন্ড অরনী। হাই শুদ্ধ, আমি প্রিয়মের বন্ধু অরনী।
– হাই অরনী, আমিও প্রিয়মের বন্ধু। আমি শুদ্ধ।
– তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।
– আমার ও খুব ভালো লাগলো। লেটস রিস্টার্ট!

এই বলে শুদ্ধ অরনীর কপালে চুমু খেল। এভাবেই ওদের জীবনের রিস্টার্ট হলো। শুদ্ধ অরনীর কোমর জড়িয়ে ওকে খুব কাছে টেনে নিল। এতদিন পর স্বামী কে কাছে পেয়ে অরনীও রোমান্সে মশগুল হলো। সেই মুহূর্তে আবার মিষ্টি এসে অপ্রস্তুত হয়ে গেল,

“তোমরা কী বিয়ে তে যাবে না?”

শুদ্ধ মিষ্টিকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে অরনীকে ছেড়ে দেয়। অরনী শুদ্ধ কে জড়িয়ে ধরে মিষ্টির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, “আমরা আসতেও পারি, নাও আসতে পারি। আমাদের ডিস্টার্ব করো না।” অরনীর কথা শুনে মিষ্টি লজ্জা পেয়ে যায়। পেছন থেকে অংশু ভাইয়া ঢুকতেই মিষ্টি অংশু টেনে নিয়ে চলে যায়। শুদ্ধ লজ্জা পেয়ে বলল,

– তুমি গেলে না কেন?
– তোমাকে এই অবস্থায় নিয়ে যাব? ওয়াজিরদের বাসায় আয়রন নেই?
– আছে, তবে ঐ মুহূর্তে আয়রন করার মুড ছিল না।
– পাঞ্জাবি পরার ছিল?
– যাই হোক, তুমি যেতে?
– তোমাকে ছাড়া?

এরপর শুদ্ধ আর অরনী একসাথে ঘুরতে বের হলো। প্রথমে ওরা প্রিয়মের সাথে দেখা করে। তারপর ওরা এক সাথে সেই সব জায়গায় ঘুরে যেসব জায়গায় শুদ্ধ অরনীকে প্রথম দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। প্রিয়ম বলেছিল অরনীর ফুচকা পছন্দ। সেই কম দামি ফুচকার সাথে একটি ফাইভ স্টারে ডিনার ডেট। সব শেষে শুদ্ধের প্রিয় চকলেট কেক। প্রথমে চকলেট কেক দেখে অরনী অবাক হয়ে যায়। শুদ্ধ ওর নিষ্পাপ হাসি দিয়ে বলে, “আমার আরেকটা কনফেশন করার আছে। আমার আসলে চকলেট কেক পছন্দ। শুধু পছন্দ না খুবই পছন্দ।” অরনী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো শুদ্ধের দিকে,

– এমন না যে আমি মিথ্যা বলেছি। আমি কখনো বলিনি ওটা পছন্দ না। আমার পছন্দ, আর সেজন্যই আমি মুখে হাত দিয়ে খাচ্ছিলাম। সেদিন আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল চকলেট কেক দেখে। কেকটা ভালোও ছিল। মুখের ভিতর আনন্দের বোমা ফুটছিল। তোমার সামনে লজ্জা পেতে চাইনি, তাই হাত দিয়েছিলাম।
– আর?
– আর তো একটাই ভুল করলাম। এতদিন তার মাশুল ই দিচ্ছি।
– আমি কী খুব অত্যাচারী?
– কে বলল?
– তোমার মুখ খুলত না কেন?
– এমনি।
– ভালো, স্বামীদের মুখ বন্ধ থাকলেই ভালো লাগে।
– আচ্ছা, আমরা এরপর কোথায় যাব?
– আপাতত তুমি যেখান থেকে এসেছ সেখানে চলে যাও, আমিও বাসায় যাব। এরপর একটা ছোট বাসা দেখতে হবে।
– তারপর?
– আমরা শিফট হয়ে যাব। আচ্ছা, তুমি কী অস্ট্রেলিয়া যেতে চাও?
– একদম না। আমি যেতাম না। আমি অন্য জব দেখব। দেশেই থাকবো।
– তাড়া নেই। আস্তে ধীরেও দেখতে পারো। কিছুদিন হাউস হাসবেন্ড থাকলে সমস্যা হবে?
– না। একদম না! তুমি যেটা বলবে সেটা হবে।

শুদ্ধ আর অরনী বাড়ি চলে আসে। ওয়াজির শুদ্ধ কে বলেছিল বউ নিয়ে ওর ফার্ম হাউসে থাকতে , কিন্তু অরনীর স্কুল ওদিকে। অরনীর বাবা বলল জামাই কে নিয়ে ওদের বাসায় থাকতে, তবে অরনী থাকবে না। পিপি এতদিন অনেক চিন্তা করছিলো। অরনীর উপর তার খুব রাগ। তাই শুদ্ধকেই ফোন করলো। ওনারা দুজন সেই সময়ে বাসা দেখছিল। শুদ্ধ ফোন দেখেই বলল,
– এই রে! ওনাকে তো বলিই নি।
– ভালো করেছ। লাউডস্পিকারে দাও তো।

শুদ্ধ ফোনটা লাউডস্পিকারে দিলো, “এই জাহিদ! তুমি কী ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছ? দেখ, কাগজটা আমার কাছে আনো। আমি একজন বড় উকিল চিনি। আমরা এতে ভুল ধরিয়ে তোমার আর নাদিয়ার বৈবাহিক জীবন আরো ছয় মাস বাড়াবো। এর মধ্যে তোমাদের আরো টাস্ক দেব। তারপর তোমরা আবার এক হয়ে যাবে।”

ওদের দুজনেরই খুব হাসি পেল পিপির কথা শুনে। পিপি পুরোই পাগল হয়ে গেছে। অরনী ইশারায় শুদ্ধ কে কিছু শিখিয়ে দিল। শুদ্ধ বলল,
– থাক স্যার, যা হওয়ার হয়ে গেছে। মুভ অন করাই ভালো।
– কী মুভ অন করবে তুমি? কেউ আছে নাকি? নাকি সারাজীবন একলা?
– নতুন পেয়ে গেছি। নাদিয়ার চ্যাপ্টার ক্লোস।
– মজা করছো আমার সাথে? কে আছে সাথে?
– ওর থেকে বেটার। আর আমি এখন ডেটে। আমাদের ডিভোর্স ডান।
– নাদিয়া একদম ঠিক! তুমি অনেক বাজে মানুষ!

এবার নাদিয়া বলল,
– জাহিদ অনেক বাজে মানুষ। আর নাদিয়া ও। ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
– নাদিয়া?
– না অরনী। শুদ্ধ আর অরনী।

সব শোনার পর পিপি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এই দুজন তাকে খুব নাচিয়েছে। অবশেষে এক হলো।

শুদ্ধ ওয়াজির আর ওয়াসির ফার্ম হাউস থেকে বিদায় নিচ্ছে। এতদিন এখানে ছিল, অনেক মায়া লেগে গেছে জায়গা টা। ফাইয়াজের দায়িত্ব এখন ওয়াসির। অরনী বাইরে শুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করছে। ওয়াজির অরনীকে বলল,

– নিয়ে গেলে তো ছেলেটাকে আমাদের থেকে।
– আমার জিনিস আমি ফেরত নিচ্ছি, তাতে তোমার কী?
– ভালো থেকো।
– তুমিও। আর অনেক অনেক ক্যামেরা বানাও। দোয়া করি একদিন জেমস বন্ড হও। ধন্যবাদ, শুদ্ধের এত খেয়াল রাখার জন্য।

ওরা বিদায় নিয়ে ওদের নতুন বাসায় চলে আসলো। আগের বাসার অনেক পুরনো জিনিস ই আছে। কারণ পুরনো জিনিস গুলো অরনীর বাবা ওদের গ্যারেজে এনে রেখেছিল। এই বাসা টা এত বড় নয়। একটা বেড, কিচেন আর ছোট একটা বসার জায়গা। নাম মাত্র একটা সরু বারান্দা আছে। সেখানে দুজন ঠিক করে দাঁড়ানো যায়না। এখন আর আগের মতো গেস্ট রুম নেই যে ঘন ঘন রাগ দেখানো হবে। আর রান্নাঘর আর বেডরুম সবই ছোট ছোট টোনাটুনির জন্য ঠিক আছে।

শুদ্ধ আর অরনী ওদের ঘর কে আগের মতো গুছিয়ে নিচ্ছে। একটু কম দামে, তবে চলে যাচ্ছে। অরনীর চুলগুলো আবার একটু লম্বা হয়ে গেছে। তাই আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছে। শুদ্ধের কোনো কাজ নেই, খাটে হেলান দিয়ে বসে বসে সেই দৃশ্য উপভোগ করছে। এখন আর এত ভয় লাগছে না। পেছনে আরজে ঐশী বকবক করেই যাচ্ছে। হঠাৎ একটা গান শুরু হলো,

” তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে
ভাঙল কাঁচের আয়না।।

তোমার ছলাকলা দেখতে দেখতে।
এ ভাঙল বুকের আয়না।।”

গানটা শুনেই অরনী শুদ্ধের দিকে অবাক হয়ে তাকালো।

– কী করে জানলো?
– জেনে যায় আরকি।
– জাদু জানে নাকি?
– হয়তো।

এরপর শুদ্ধ গুনগুন করতে থাকে,

“আমি যেমন তোমারই ছিলাম
তেমন তোমারই আছি।
তুমি আয়নাকে প্রশ্ন করো।
শুনে নাও কী বলে আয়না।।”

এরপর অরনী এসে শুদ্ধের পাশে শুয়ে পড়লো। তারপর শুদ্ধ ওকে এক হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলো।
– তুমি জানো, আমি তোমাকে কতবার দেখতে গিয়েও ফিরে এসেছি।
– কেন?
– ভয় পেতাম। প্রিয়ম আমাকে অনেকবার তোমাদের বাসার কাছের সেই বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিল। বারবার তোমার পেছন থেকে দেখে চলে আসতাম।
– কেন?
– ভয় পেতাম তাই। তুমি কী আমার মতো বলদকে পছন্দ করতে?
– এখনো কী খুব বুদ্ধিমান?

শুদ্ধ অরনীর দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকায়। অরনী হাসতেই তা গায়েব হয়ে। এরপর শুদ্ধ অরনীকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

– তুমি না একদম প্রিয়ম যেমন বলেছিল, তেমনই।
– কেমন?
– সব। সব মিলেছিল।
– তবে চিনতে পারনি কেন?
– কী করে চিনতাম? আগে যে দুটো বেণী ছিল।
– বেণী থাকলে চিনতে?
– হয়তো।
– তাই বেণী মাধব?

অরনী ওর জায়গা থেকে উঠে গিয়ে দুটো রাবার ব্যান্ড আর চিরুনি এনে শুদ্ধের হাতে দিয়ে বলল, “দেখি, দুটো বেণী করে দাও তো।” অরনী পেছনে ফিরে গেল। শুদ্ধ ওর চুলের দুটো ভাগ করে এক পাশে এসে বেণী করতে লাগলো। ছেলেটা বেণী করতে জানেনা। কী বিকলাঙ্গ বেণী করেছে। অরনী দেখেই হাসতে লাগলো। শুদ্ধ ও লজ্জা পেল। এরপর অরনী শুদ্ধ কে বেণী করা সেখাতে লাগলো। “এক পাশে এর উপর ঘুরিয়ে আরেকটা।” এবার খুব সুন্দর দুটো বেণী হয়েছে। অরনী শুদ্ধের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “এখন কী চিনতে?” শুদ্ধ ওর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, “না। চুল গুলো তখন আরেকটু লম্বা ছিল। আর তখন অনেক ছোট ছিলে। এখন কত বড় হয়েছ। চিনতে পারার মতো না।” এরপর অরনী শুদ্ধের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হালকা অভিমান হচ্ছে বোধহয়। কিন্তু শুদ্ধ অরনীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই ওর সেই অভিমান ভালোবাসায় পরিণত হয়। কত যে নির্ঘুম রাত কেটেছে এই সময়টার অপেক্ষায়। কতটা অনিশ্চিত ছিল যে এই সময়। ওদের সোনালী মুহূর্তে কাঁটা হয়ে আসলো ওয়াজিরের ফোন। শুদ্ধ প্রথম ফোন টা কেটে দিলো। পরবর্তীতে ওয়াজির আবার ফোন করল। শুদ্ধ ফোন তুলে বলল,

– কী সমস্যা!
– ফাইয়াজ পালিয়ে গেছে।
– কী বলছ!
– ওয়াসি পড়ে আছে এখানে। ওর মাথায় আঘাত লেগেছে। ফাইয়াজ পালিয়ে গেছে। ও নেই এখানে। গার্ড ও আহত।

শুদ্ধ সাথে সাথে বেরিয়ে পড়লো। অরনী ও ওর সাথে গেল। শুদ্ধ আর ওয়াজির কথা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী কে যে এই তিন আসামী যাদের ওরা নিচ্ছে তারা আর বের হবে না। কিন্তু ফাইয়াজ তো পালিয়ে গেছে। এই ছেলে পালিয়ে না জানি এখন কী কাহিনি করবে। এক রাত পার হয়ে গেছে। হাসপাতালে ওয়াসি আর গার্ডের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। শুদ্ধ অরনী আর ওয়াজির অপেক্ষা করছে ওদের জ্ঞান ফেরার। এর মধ্যেই টিভিতে ব্রেকিং নিউজ, “সুসময় টিভির সাংবাদিক নুসরাতকে বন্দি বানিয়ে পুরো সুসময় টিভি বিল্ডিং কে জিম্মি করেছে ফাইয়াজ। তার দাবি সে কিছুক্ষণের মধ্যেই জানাবে।” এই খবর দেখে ওরা সবাই দৌঁড়ে সেই ভবনের নীচে গেল। আশেপাশে সোয়াত আর পুলিশ। শুদ্ধ অরনী আর ওয়াজির ভেতরে যেতে পারছে না। বাহিরে ফাইয়াজের পুরনো লোকেরা পাহারা দিচ্ছে। ভেতরে অনেক সাংবাদিক বন্দি আর ওপরে ছাঁদে নুসরাত কে জিম্মি করে রেখেছে ফাইয়াজ। নুসরাতের ক্যামেরা ম্যান ভয়ে ভয়ে ফাইয়াজের বক্তব্য রেকর্ড করছে, ” আমার ঐ জাহিদ না কী শুদ্ধ, ওকে চাই। ও আসলে আমি সবাইকে ছেড়ে দেব।”

(চলবে)

[কালকে শেষ পর্ব আসবে। Then #shutdown. ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here