#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_১৭
রান্নাঘরে নাদিয়া ছুরি দিয়ে সালাদ কাটছে। আজ সালাদ খাবে। জাহিদ রান্নাঘরে ঢুকতেই দৌঁড়ে গিয়ে সেই ছুরি ধরে টান দিল। নাদিয়া ও ছুরিটার দিকে হাত বাড়ালো। কিন্তু জাহিদ ছুরিটা দিচ্ছে না। ওদের দুজনের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হলো ছুরি নিয়ে। জাহিদ ছুরিটা উপরের দিকে তুলে আছে। জাহিদ ওর থেকে লম্বা হওয়ায় নাদিয়া তা ধরতে পারছে না। অনবরত লাফাচ্ছে। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।
” কী!!!! কী শুরু করলেন !!!” নাদিয়া গর্জন করে উঠল। জাহিদ ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আছে।
” এটা দিন। দিন আমাকে!!! ” আরেকটা চিৎকার। জাহিদ তাড়াতাড়ি ছুরি টা হস্তান্তর করলো। নাদিয়ার হাতে এখন ছুরি আর ছুরির মুখে জাহিদ।
– আমি জানি, আপনি এমনটা কেন করছেন।
– এমনি। আমি, আসলে, সালাদ কাটতে চাইছিলাম।
– সালাদ তো না!! (আরেকটা চিৎকার)
– সত্যি!
– আমি আপনাকে সত্যি টা বলেছিলাম বিশ্বাস করে। আপনাকে আপন ভেবে বলেছিলাম। ভয় লাগানোর জন্য না।
– আমি ভয় পাচ্ছি না তো। (ভীত কণ্ঠে)
– তো কী করছেন এগুলো! আপনি আমাকে ঘরে একা থাকতে দেন না আমি কিছু করব তাই?
– না।
– চুলা চেক করতে থাকেন, আগুন লাগাবে গায়ে তাই?
– না না!
– ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন বাসায় পৌঁছেছি কিনা, অ্যাক্সিডেন্ট করলাম কিনা তাই?
– একদম না।
– সত্যি বলছেন?
– না তো! হ্যাঁ হ্যাঁ।
– দেখুন, আমি আর আগের মতো নেই। আমি বদলে গেছি। বিছানায় শুয়ে আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। আমি জানি আমার জন্য কত কষ্ট হয়েছে সবার। আমার বাবা যেই জমি বিক্রি করে আমার চিকিৎসার খরচ জুগিয়েছিল, সেই জমিটা আজ পঞ্চাশ কোটি টাকা। তার পাশে এয়ারপোর্ট হচ্ছে। কত লস হয়েছে আমি জানি। আমার মা সময়ের আগে রিটায়ার্ড হয়ে গেছে। আর রাহু ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে ডাক্তারি পড়ল। সব ধ্বংস হয়ে গেছে আমার জন্য! এর মূল্য আমি জানি। এত কিছু জেনে আমি আবার কেন করব এমন!!!
নাদিয়া কথা গুলো বলতে বলতে থেমে গেলো। ও এতক্ষণ কথা বলার সময় ওর হাতের ছুরিটা নেড়ে বলছিল। আর তাই জাহিদ ওর দিকে না, ছুরিটার দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন ও নাদিয়ার হাতে ছুরিটা এমন ভাবে ধরা যা দেখে জাহিদ ভয় পাচ্ছে।
– কী দেখছেন?
– কিছু না আপনি বলুন।
– এই যে ছুরিটা, এই ছুরি দিয়ে এখন আর আমি নিজে মরবোনা, মানুষ মারবো!
এই বলে নাদিয়া ছুরিটা রেখে চলে আসে। এরপর ও মাথায় হাত দিয়ে খাবার টেবিলের পাশে বসে। বলে কী ভুল করলো নাকি? জাহিদ এসে ওর পাশে বসে।
– আমি এখন কেন মরবো?
– না, না, কিছু হবে না। আমি এমনিই করছিলাম।
– মিথ্যা বলবেন না। আমি এসব বলেছিলাম যাতে আপনি আপনার মনের সব কথা আমাকে বলতে পারেন! আপনি তো আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন। কেন যেন মনে হচ্ছে আমি এসব আপনাকে ব্ল্যাক মেইল করতে বলেছিলাম।
– না , না।
– তাই তো মনে হচ্ছে। আমি কখনোই আপনাকে ভয় লাগতে চাইনি। আমি এখন আর ওসব চিন্তা করি না। আপনি ভয় পাবেন না।
জাহিদ মাথা নাড়ল ঠিকই কিন্তু এখনো ওর মাথায় ওগুলোই চলছে। ও হয়তো এখন আর সারাদিন ভাবে না, তবে একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না।
– আ’ম স্যরি।
– ইটস ওকে জাহিদ।
– আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি ওসব ঠিক হয়েছে?
– হুম। তবে আপনি কোথায় যেতে চান ?
– পাহাড় বা সমুদ্র এসব না।
নাদিয়ার মধ্যে আবার রাগ দেখা যাচ্ছে। পাহাড় ও না, সমুদ্র ও না। এসবই তো ওর পছন্দ।
– কেন?
– ভালো লাগে না। দুর্ঘটনা হয়।
– তো আপনি কোথায় যেতে চান?
– রাজবাড়ি টাইপের জায়গা। পুরনো ঐতিহাসিক জায়গা।
– ওহ! তা ঠিক কেন?
– ভালো লাগে পুরনো জায়গা। এইজন্য।
নাদিয়া জোর করে একটা হাসি এনে জাহিদের দিকে তাকালো। ও মনে মনে ভাবছে ওর এইসব নিদর্শন দেখার ইচ্ছে নেই। ও জাহিদকে একদম সারপ্রাইজ দেবে। আর জাহিদ ভাবছে যাই হোক এইসব পাহাড়ে সমুদ্রে গেলে আবার কিছু করে ফেললে। হয়তো মনে লাফ দেওয়ার ইচ্ছে জেগে গেল। তখন ও কোথায় যাবে?
একে একে ওরা সব কাজ শেষ করে ফেলল। বৃহস্পতিবার রাতের বেলা ওরা সব প্যাকিং করে বের হলো। নাদিয়া একদম পারফেক্ট প্ল্যানার। চেকলিস্ট বানিয়ে সব নিল। কিন্তু জাহিদ এখনো জানে না কোথায় যাচ্ছে ওরা। রাতের বেলা সোজা ওকে বাসে তুলে ফেলল। বাসের গায়ে কোন জায়গা অন্ধকারে পড়তেও পারলো না।
– আমরা কোথায় যাচ্ছি?
– সারপ্রাইজ।
– বলুন না প্লিজ। এখনো যদি না বলেন, কেমন দেখায়। একটা জায়গায় যাচ্ছি, আর জানিই না সেটা কোথায়?
– আমরা কুমিল্লা, ময়নামতি যাচ্ছি।
– ময়নামতি? আমি গেছি তো। আমাদের দাদা বাড়ি ওখানে। আগে বললেই পারতেন।
– ওহ! কিন্তু আমার তো একদম নতুন জায়গা ভালো লাগে, দেখা জিনিস দেখতে আপনার ভালো লাগবে?
– লাগবে। কিন্তু এটা কী কুমিল্লার বাস? উল্টো লেখা তো কুমিল্লা লাগছে না।
– না, কুমিল্লা থামবে। ডোন্ট ওরি।
নাদিয়ার খুব হাসি পাচ্ছে। ও এখনো জানে না, যখন জানবে তখন চেহারা টা দেখার মতো হবে। যাত্রা পথে কুমিল্লায় গাড়ি থামতেই জাহিদ নামতে চাইলো। নাদিয়া বলল আরেকটু পরে। ও চাইলে এখন ফ্রেশ হতে পারে। হাত মুখ ধুয়ে এসে জাহিদ বলল,
– আমরা কোথায় নামবো? এখন তো রাত, গাড়ি পেতে সমস্যা হবে না?
– না। ব্যবস্থা আছে।
– ওকে।
জাহিদ বসার পর বাস ছাড়লো। কিন্তু বাস আর থামছে না। এটা দেখে জাহিদের একটু সন্দেহ হলো। ও দাঁড়িয়ে বলল,
– কী দেখছেন কুমিল্লা পার হয়ে যাবে, এখনই থামান।
– আরে আরে , কী করছেন!
– কুমিল্লা পার হয়ে যাচ্ছে! আমরা নামবো না?
– না, আমরা নামবো না। আপনি ঘুমান।
বাসের কিছু ঘুমন্ত যাত্রীরা রেগে গেল জাহিদের উপর। এত আরামের ঘুম ভেঙে দিল। জাহিদ খুবই চিন্তিত। এই বাস হয়তো কক্সবাজার যাচ্ছে। ওর নাদিয়াকে বিশ্বাস করা উচিৎ হয়নি। ও সবসময় উল্টো পথেই হাঁটবে। ওর বলাই উচিত হয়নি পাহাড় বা সমুদ্রের কথা। এরপর জাহিদের আর একটুও ঘুম হয়নি। কী এসব ! অনেক আঁকাবাঁকা রাস্তা। একবার এদিক, একবার ওদিক। এটা কী রাঙামাটি যাচ্ছে? পাহাড় না সমুদ্র? সকাল বেলা গন্তব্যে বাস থামতেই জাহিদ নেমে দেখতে চায় ও কোথায় এসেছে। সবাই আবার বিরক্ত। উনি নিজে এলেন আর জানেন ই না কোথায় যাচ্ছে। জাহিদ আশেপাশে তাকিয়ে দুই হাত মাথায় দিয়ে বলে, “খাগড়াছড়ি!!!” পাহাড় পর্বতের জায়গা। ও উঠে এসে নাদিয়ার পাশে বসলো।
– কী হয়েছে?
– খাগড়াছড়ি আসবেন বললেই পারতেন। এত সাসপেন্সের কী আছে?
– আমরা খাগড়াছড়ি যাচ্ছি না তো।
– তো!!!
– আস্তে আস্তে। রাস্তা এখনো বাকি। সবাই নাস্তা করতে নামবে, চলুন।
নাদিয়া একটা ট্রাভেল গ্রুপের সাথে এসেছে। এখানে সব বয়সের মানুষই আছে। ইউনিভার্সিটি গ্রুপ, নতুন বা পুরাতন বিবাহিত যুগল। কয়েকজন গাইড টাইপের লোক ও আছে। মূলত ওনারাই এই যাত্রা পরিচালনা করেন। জাহিদ তাকিয়ে তাকিয়ে সবাইকে দেখছে। এ কোথায় চলে এসেছে! একজন লোক এসে বলল,
– আপনি জানতেন না কোথায় আসবেন ? আপা কী আপনাকে কিডন্যাপ করসে?
– না না।
– দেখলেই পারতেন গাড়িতে কী লেখা।
জাহিদ গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো। খাগড়াছড়ি লেখা। কিন্তু নাদিয়া তো বলল কুমিল্লা থামবে। একই দিকেই তো। একদম স্কুলের সারপ্রাইজ টেস্টের মতো সারপ্রাইজ সফর। নাস্তা করে ওরা চান্দের গাড়ি নামক একটা বাহনে সাজেক যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিদিন শুধু সকাল দশটা আর বিকাল তিনটায় ই সাজেকে প্রবেশ ও বাহিরের অনুমতি আছে। আশেপাশে অনেক সেনাবাহিনী, কড়া নিরাপত্তা। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সেখান থেকে ওরা সাজেকে পৌঁছালো। জাহিদ সৌজন্য রক্ষার্থে ব্যাগ গুলোর দায়িত্ব নিল। এত ভারি আর বড়। এত কিছু আনার কী দরকার? এটা তো বিদেশ না। ছোট্ট একটা জায়গা আর অল্প কয়টা দিন। সবার কত ছোট ব্যাগ। দুজন, দুটো ছোট ব্যাগ যথেষ্ট। ওদের সাথের জ্যেষ্ঠ দম্পতির পুরুষটি বলল,
– হানিমুন?
– হ্যাঁ। ঐরকম ই।
– নতুন জীবন, নতুন দায়িত্ব। অভ্যস্ত হতে হবে। হাহাহ! গুড লাক!
ওদের কটেজে যেতে নাদিয়ার মন খুশি হয়ে গেল। ও দৌঁড়ে গিয়ে সেই বারান্দায় গিয়ে মনোরম দৃশ্য দেখতে থাকে। “এত সুন্দর!” নাদিয়ার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। নাদিয়াকে এত উৎফুল্ল দেখে জাহিদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, “মাশাআল্লাহ!” জাহিদের মুখে এই শব্দ শুনে নাদিয়া ওর দিকে তাকায়,
– জ্বী?
– মমমাশাআল্লাহ এই দৃশ্য!
– ওহ!
– কিছু মনে না করলে, ছবি তুলি?
– হ্যাঁ তুলুন। জিজ্ঞেস করার কী আছে।
জাহিদ ওর ফোন বের করে একটা ছবি তোলে। নাদিয়া হঠাৎ চমকে ক্যামেরার দিকে তাকালো। জাহিদ আরো একটা ছবি তুলল। নাদিয়া হাত তুলে জাহিদ কে বারণ করছে। জাহিদ ওর আরো একটা ছবি তুলল,
– আপনি আমার ছবি তুলছেন যে?
– আপনি টাস্ক ভুলে গেছেন?
– ওহ! হ্যাঁ! আমি তো আপনার সেই সারপ্রাইজ ফেসের ছবিই তুলিনি। মিস হয়ে গেল।
– কাজটা আপনি ঠিক করেননি।
আশেপাশে ইউনিভার্সিটির ফেন্ডগ্রুপ গুলি বলছে এরা হয়তো নিউলি ম্যারিড। অ্যারেঞ্জ নাকি লাভ সেটা অনুমান চলছে। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাওয়া শেষে আশে পাশে একটু ঘুরতেই হঠাৎ সাজেকে মেঘের আগমন। এ যেন মেঘের রাজ্যে ওরা দুজন। ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকায়। এরপর ফোন বের করে দুজনেই দুজনের ছবি তুলে। দুজনের মুখের সামনে ফোন, এমন ছবি এসেছে।
– এভাবে হবে না জাহিদ। হাহাহাহ!
– আপনি তাহলে ওদিকে দাঁড়ান।
– আপনি দাঁড়ান, আপনি তুলেছেন। আমি এখনো তুলিনি।
– ওকে।
ওরা একে অপরের ছবি তুলছে। সবাই দেখে ভাবছে কী ভালোবাসা। এর পরেই বৃষ্টি শুরু হলো। জাহিদ বিচলিত হয়ে বলল,
– এখন কী হবে?
– চলুন আমরা বৃষ্টি দেখি। ভেতরে গিয়ে। এরকম জায়গায় বৃষ্টি দেখব আমি কখনো ভাবিনি।
– আমিও।
– আপনি তো জানতেন ই না। আমি মূলত এর জন্যই এসেছি।
ওরা ভেতর থেকে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। জাহিদ হঠাৎ বাইরে গিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখলো। নাদিয়া ওর দিকে তাকিয়ে আছে। জাহিদ সেই বৃষ্টির পানি হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে কী যেন বিড়বিড় করছে। এরপর সেই পানি তার চোখে ছোঁয়ায়। এত সুন্দর দৃশ্য দেখে নাদিয়া জাহিদের একটা ভিডিও করতে লাগলো। জাহিদ ওর দিকে তাকাতেই বলল,
– আপনি কী করছিলেন?
– দোয়া।
– কীসের?
– রহমতের। বৃষ্টি রহমতের রূপ।
– বৃষ্টিতে দোয়া করলে কী হয়?
– বৃষ্টি দোয়া কবুলের সময়।
– ওহ!
নাদিয়া ভিডিও বন্ধ করে এসে বৃষ্টি ছুঁয়ে মনে মনে বলল, ” হে আল্লাহ্, তুমি এই মানুষটার মন থেকে সেই ভার গুলো সরিয়ে দাও। সে যাতে তার সব কথা আমাকে বলতে পারে।”
– আপনি কী দোয়া করলেন?
– হুম।
– কী দোয়া?
– রহমতের ই।
– ওহ! আমরা এরপর কী করবো?
– সূর্যাস্ত দেখবো। এখানে একটা জায়গা আছে।
– এই বৃষ্টি তে?
– থেমে যাবে।
বৃষ্টি থামার পর সবাই সূর্যাস্ত দেখতে যায়। এই সূর্যাস্ত নাদিয়ার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর সূর্যাস্ত। আর জাহিদের দেখা প্রথম। জাহিদ হা করে তাকিয়ে দেখছে। প্রথমবার এত সুন্দর দৃশ্য দেখার উত্তেজনা ওর মুখে এক উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠেছে। নাদিয়া ওর দিকে তাকিয়ে ওর একটা সুন্দর ছবি তুলে। এই ছবিটা ওর ওয়ালপেপার দেওয়ার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। জাহিদ ওর দিকে তাকাতেই ও লুকিয়ে ফেলে,
– আপনি একটু ওদিকে দাঁড়ান।
– কেন?
– ছবি তুলব।
– ওকে।
বাড়ি ফেরার সময় নাদিয়া জাহিদকে খাবারের অর্ডার দিয়ে আসতে বলল। কারণ রাতে অর্ডার ছাড়া ওরা রান্না করে না। খাবার নষ্ট হতে পারে। জাহিদ বেচারা আজ এত খুশি যে অর্ডার দিতে ভুলে গেল। সবাই অনেক গান বাজনা করছিল যে জাহিদের আর মনেই পড়ল না ওর একটা কাজ ছিল। স্বামী স্ত্রী দুজনেই আসর উপভোগ করতে ব্যস্ত। রাতের খাবারের সময় সবাই যখন খাচ্ছে ওদের তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই। ওদের সফরসঙ্গীরা অনেক ভদ্র হওয়ায় ওদের সাথে খাবার ভাগাভাগি করতে চাইলো। নাদিয়া জাহিদের দিকে ক্ষান্ত দৃষ্টি দেখিয়ে ওদের ঘরে চলে এলো। সবাই বলাবলি করছে ওরা হানিমুন কাপল। বেচারা স্বামী টা আজ গেছে।
নাদিয়া ওর ঘরে বসে আছে। জাহিদ এসে ওর পাশে বসলো।
– স্যরি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
– ইটস্ ওকে।
– এখন খাবার ,
– কাপ নুডলস এনেছি। শুধু গরম পানির ব্যবস্থা করুন।
নাদিয়ার মন খারাপ। ওর খুব ইচ্ছে ছিল এখানকার স্পেশাল ব্যাম্বু বিরিয়ানি খাওয়ার। জাহিদ কষ্ট করে গরম পানির জোগাড় করলো। এখন কাপ নুডলস ই ভরসা। নাদিয়া ব্যাগ থেকে কাপ কেক ও বের করলো।
– কেন?
– শুধু কাপ নুডলস এ আপনার পেট ভরেনি আমি জানি।
– আপনি?
– আমি কেক খাইনা।
– আপনার কাপ নুডলসে পেট ভরবে?
– আমার পেট ছোট। রাতে এমনিতেই কম কম খাই।
– ঐদিন যে দুজনের খাবার খেয়ে ফেললেন?
নাদিয়ার খুব লজ্জা লাগছে। ‘তো উনি এখনো ভোলেননি। ভালো ভালো, কথা বলা ভালো। সেই প্রায়শ্চিত্ত আজ ও করে যাচ্ছি।’
– আচ্ছা, এইটা চকলেট ফ্লেভার না। পাইন্যাপেল। আপনি তো চকলেট পছন্দ করেন না জানি।
– না না!
– থাক। শুকনো খাবার হিসেবে এগুলো এনেছি। এমন কিছু হবে, সেই প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি।
জাহিদ নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কী করে নাদিয়াকে যে বলবে ওর চকলেট কেক আর অরনী দুটোই খুব পছন্দ। আর এই পাইন্যাপেল ফ্লেভার টা একদম ভালো লাগে না। পাইনঅ্যাপেল ও একটা ফ্লেভার। এখন এইটা বললেও রাগ করবে। তাই মুখে হাত দিয়েই জোর করে খেতে হচ্ছে। নাদিয়ার ব্যাগে পাইনঅ্যাপেল বিস্কিট ও দেখা যাচ্ছে। এটাও নাকি জাহিদের জন্য। নিজের জন্য সল্টি ক্র্যাকার।
রাতের বেলা ওরা বাইরে বসে আকাশে চাঁদ তারা দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দিলো। মধুচন্দ্রিমা বলে কথা। পাশে ভার্সিটির ছেলেমেয়েগুলো গান গাইছে। খুব সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরী হয়েছে সেই বারান্দায়। নাদিয়া চাঁদ দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়লো। জাহিদ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আজ ঘুমন্ত নাদিয়া কে চিন্তিত লাগছে না। আজ খুবই শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ক্লান্ত বোধহয়।
“I just wonder what you’re dreaming of
When you sleep and smile so comfortable
I just wish that I could give you that
That look that’s perfectly un-sad”
নাদিয়া ঘুমের ভেতর অজান্তেই জাহিদের হাতে হাত রাখলো। জাহিদ ওর হাতটা আস্তে সরিয়ে দিলো। পাশ থেকে একটা ছেলে বলল,
– আপুকে ভেতরে নিয়ে যান। আসলে আমরা এখানে সিগারেট খাব তো। সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং।
– ওকে।
এখন নাদিয়া কে কী জাগাবে কী না তা চিন্তা করছে। আরেকটা ছেলে বলে,
– আপুকে কোলে নিয়ে নিন। আগে নেননি?
– জ্বী!
সবাই হাসতে লাগলো। অনেকে বলল লজ্জা পাওয়ার কী আছে? জাহিদ তাই সাহস করে নাদিয়া কে কোলে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিল। এরপর ওর ফোন বের করে ওর একটা ছবি তুলল। নাদিয়ার এই নিষ্পাপ মুচকি হাসি ও সবসময় দেখবে। একটু পর ফজর হয়, জাহিদ ফজর পড়ে এসে ওর পাশে এসে ঘুমিয়ে যায়। আজ অনেকদিন পর একটু গভীর নিদ্রা এলো ওদের। তাই বুঝি বিয়ের পরের ভ্রমণ কে মধুচন্দ্রিমা বলা হয়। মধুর মতো মিষ্টি এই ঘুমের অভিজ্ঞতা। নাদিয়ার খোলা চুল জাহিদের গালে লাগছে। জাহিদকে এই ঘুমের মধ্যে ও নাদিয়ার চুলের ঘ্রাণ কাবু করে দিচ্ছে। জাহিদের আর নিজের প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে তার হাত বাড়িয়ে নাদিয়া কে আরো কাছে টেনে নেয়। নাদিয়া কে সে নিজের ভেতর ধারণ করে রাখে। হাত দিয়ে ওর চুল সরিয়ে নিজের সুঁচালো নাক দিয়ে নাদিয়ার ঘাড় স্পর্শ করে। এরপর নিজের ঠোঁট দিয়ে নাদিয়ার ঘাড়ে একটা মিষ্টি চুমু এঁকে দেয়। সোনালী সকালে নাদিয়া আর জাহিদ। এটাও কী স্বপ্ন? না সেদিনের মতো বাস্তব কিছু? ” শুভ সকাল।” এই বলে জাহিদ চোখ খুলে।
কোথায়? নাদিয়া কোথায়? এ তো বালিশ! সাত সকালে এসব কী চিন্তা ধারা। কিন্তু নাদিয়া কোথায়? আশেপাশে তাকিয়ে দেখে একটা চিরকুট, “আমি পাহাড়ে গেলাম। আপনি তো আর উঠবেন না তাই একলা চলো রে।”
যার ভয় ছিল তাই হলো। নাদিয়া পাহাড়ে গিয়েছে একা। অবশ্যই সেখানে কিছু একটা করে ফেলবে। হন্তদন্ত হয়ে জাহিদ সেখান থেকে বের হলো,
– আচ্ছা নাদিয়া , মানে আমার স্ত্রী যে পাহাড়ে গেছে সেটা কোথায়?
– কংলাক পাহাড়?
– এখানে যে পাহাড় সেটা।
– ঐদিকে, ও আপনাকে নিয়ে যাবে।
জাহিদ অন্য লোকটার সাথে নাদিয়ার খোঁজে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগলো।
(চলবে)