#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_২১
স্তব্ধ জাহিদ, আর সামনে নিথর নাদিয়া। রক্তা*ক্ত হাত আর লাল পুরো শরীর। জাহিদ তার জীবদ্দশায় তিনজন খুব কাছের মানুষ কে হারিয়েছে। তাদের কারোরই মৃ*ত্যু ও স্বচক্ষে দেখেনি। তবে আজ বোধহয় তা দেখা হলো।
নাদিয়া, অর্থ নরম, নমনীয়। ওর সামনের নাদিয়া টা আজ এমনই। অরনী, অর্থ পাথর, যা দিয়ে আগুন জ্বলে। অরনীর দুটো নামের মতো ওর দুটো ব্যক্তিত্ব একে অপরের বিপরীত। প্রিয়মের মৃত্যুর আগে সে ছিল শক্ত মনের অরনী, এরপর তার ব্যক্তিত্বে আমূল পরিবর্তন আসে।
নাদিয়া আর ওর আশপাশ টা রক্তা*ক্ত। আশেপাশের এই রক্তের ছিটা জাহিদ কে ওদের বাসরের কথা মনে করিয়ে দেয়। যে বাসর ওদের আজও হয়নি। তখন রক্তের বদলে ছিল লাল গোলাপ। নাদিয়ার পরনে ছিল লাল শাড়ি। আজ যেন এক রক্তাক্ত বাসর। রক্ত ছাড়াও অনেকগুলো ভাঙা কাঁচ পড়ে আছে। কয়েক ঘন্টা আগেও এই আয়নায় চেহারা দেখে বের হয়েছিল নাদিয়া। আর এখন সেই কাঁচ গুলো ভাঙা। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন সেই কাঁচ গুলো তে জাহিদের চেহারা দেখা যাচ্ছে। হয়তো এই সকল কাঁচের মধ্যে ওর ও নাম লেখা আছে। জাহিদ সেখান থেকে একটা ভাঙা কাঁচের টুকরো ওর হাতে নিল। নাদিয়া ই যখন নেই, তখন আর বেঁচে থেকেই বা কী করবে। ওর মধ্যেই কোনো সমস্যা আছে, সবাই ওকে ছেড়ে চলে যায়। ওর হাতের উপর কাঁচের টুকরো চালাতে যাবে তখনই ওদের বেল বাঁজতে থাকে। পাগলের মতো কেউ বেল বাঁজিয়েই যাচ্ছে। জাহিদ কাঁচ টা ফেলে গিয়ে দরজা খুলে দেখে রাহু।
জাহিদ কে রক্তাক্ত দেখে রাহুর যেন হৃৎপিন্ড টা এক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। ও জাহিদ কে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে গিয়ে নাদিয়াকে এই অবস্থায় দেখে কিছুক্ষণের জন্য চিৎকার করলেও নিজেকে সামলে ওর পালস চেক করল। এরপর ও চিৎকার করতে লাগলো,
– জাহিদ ভাই! জাহিদ ভাই!
– জ্বী রাহু।
– ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।
– বেঁচে আছে?
– হ্যাঁ। পালস খুব কম। এখনই না নিলে জানিনা কতক্ষণ! জলদি ওকে নিয়ে নামুন, আমি গাড়ি এনেছি।
এরপর জাহিদ আর রাহু নাদিয়া কে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ইমার্জেন্সি তে নেওয়ার পর অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। অনেক ব্লাড লস হয়েছে। রক্তের দরকার। ও নেগেটিভ রক্ত এখন পাওয়া যাচ্ছে না। নাদিয়া ছাড়া এই রক্ত শুধু রাহুর আর ওর বাবার। বাবা দিতে পারবে না। তখনই মিশানের কল এলো।
– অরনীর সাথে কথা হয়েছে?
– ভাইয়া, ও সুইসাইড অ্যাটেম্পট নিয়েছে। ব্লাড দরকার। তোমার কী ও নেগেটিভ?
– কী!
মিশান নিজেকে সামলে সাথে সাথে হাসপাতালে আসলো।জাহিদ হাসপাতালের একটি কর্নারে নিস্তব্ধ বসে আছে। ওর ও ফার্স্ট এইড হয়েছে। রাহু হাসপাতালের অথরিটি কে আর পুলিশ কে বুঝিয়ে পুলিশ কেস হতে দেয় নি। পুলিশ অংশুর পরিচিত। এসব সামান্য ফ্যামিলি ম্যাটার।
এদিকে বাসায় সবাই জানে নাদিয়া রাগ করে চলে গেছে। অংশু কিছু বলেছে তাই। বাকি কথা আর কেউ বলেনি। থাপ্পড়ের কথাও না। নাদিয়ার বাবা বা মা জানেন না যে নাদিয়া এখন হাসপাতালে। শুধু মিষ্টি আর অংশু জানে। সবাই ভাবছে মাথা ঠান্ডা হলে এটা ফোন করবে। মিষ্টি বিছানায় বসে বসে কাঁদছে। এত রাতে অংশু বের হলে সবাই বুঝে যাবে কিছু একটা হয়েছে। ড্রয়ার থেকে টাকা নিয়ে অংশু অপেক্ষা করছে আরেকটু রাত হওয়ার। এরপর ও বেরিয়ে যাবে।
অংশু হাসপাতালে এসে মিশান কে দেখল। মিশান কে দেখেই একটা ঘুষি দিয়ে ওকে মাটিতে ফেলে দিল। রাহু গিয়ে অংশু কে আটকালো।
– ভাইয়া ও রক্ত দিয়েছে।
– ওকে এখান থেকে যেতে বল! ও আর এক মুহূর্ত ও যদি এখানে থাকে তো আমি ওকে মেরে ফেলব।
মিশান ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে বলে,
– ও আজ এখানে আমার জন্য না, তোমার জন্য।
– চুপ কর!
– রাহু পুলিশ কে এখন যতই সামলাও। আমি ঠিকই ডাকবো। এই জানোয়ারটা কে জেল খাটাবো। তোদের ফুল ফ্যামিলি আমার অরনীকে হ*ত্যার দায়ে জেলে যাবে। ওর স্বামী ও।
অংশু এখনো তেড়ে যাচ্ছে। রাহু মিশান কে রিকোয়েস্ট করায় ও চলে গেল।
– জাহিদ কোথায়?
– বেচারা এখনো শকে।
– মিশান কে দেখেনি তো?
– না।
– ওকে বলিস না।
– জানা দরকার!
– তুই জানিস না কী হবে!
– তুমি তো খুব জানো তাই না? তোমার বেশি জানার জন্যই আজ আমরা এখানে।
রাহু এক কাপ কফি নিয়ে জাহিদের পাশে বসে।
– জাহিদ ভাই?
– জ্বী।
– কফি।
– না লাগবে না।
– আপনার অবস্থা তো ভালো না। আপনাকে পেইন কিলার দিয়েছে।
– হুম। নাদিয়া কেমন আছে?
– আউট অফ ডেঞ্জার। কড়া ঔষধ দেওয়া, জ্ঞান ফিরতে দেরি হবে।
– কী হয়েছিল?
– জ্বী?
– তুমি তো ছিলে। কী হয়েছিল?
– ভাইয়া চড় মেরেছে।
– কেন?
– ভুল বুঝেছে।
– কী জন্যে?
– শুনুন , অরনীর কোনো দোষ নেই। সব মিশান ভাইয়ার দোষ। ও বলেছে কিনা জানি না।
– কী ? মিশান ভাইয়া কী করেছে?
– বলছি। এখন বলা দরকার তাই বলছি, তবে জিনিস টা ওর বলা উচিত ছিল।
মিষ্টি আর অংশুর এঙ্গেজমেন্ট হচ্ছিল। প্রিয়ম আসছে না কেন তাই অরনী ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার আগে মিশান মিষ্টির সাথে দেখা করে।
– এই যে ফুলটা নিয়ে এখনই অরনীর চুলে গেঁথে দিবি।
– তারপর।
– বলে দিবি।
– চুপ চুপ! আজ ই?
– হ্যাঁ। অংশু এখানে ব্যস্ত থাকবে। রাহু কেও এখানে পাঠা। মিঠাই ও আমার পাশে। অরনী ওখানে একা। আর ওর বডিগার্ড প্রিয়ম ও আসেনি। এটাই সূবর্ণ সুযোগ।
দুশ্চিন্তিত অরনীর কাঁধে গিয়ে হঠাৎ হাত রাখল মিশান। ও একটু অস্বস্তি বোধ করে মিশানের দিকে তাকালো।
– কী?
– এখানে কী করছ?
– প্রিয়ম আসছে না। অপেক্ষা করছি।
– ওহ! আজকে থেকে আমাদের আরেকটা সম্পর্ক হচ্ছে, জানো?
– মানে? কেন?
– তোমরা ছেলেপক্ষ, আমরা মেয়ে পক্ষ। আমরা বেয়াই বেয়ান হবো।
– কী আশ্চর্য ভাইয়া! আমরা তো কাজিন। এত দূরের সম্পর্ক কেন ধরবো?
– অরনী, আজকে থেকে আর ভাইয়া ডেকো না। কল মি মিশান। অনলি মিশান।
– তুমি আমার বড় ভাইয়া, আমি নাম ধরে ডাকতে পারব না।
– বললাম তো, ভাইয়া ডাকবে না! (রেগে)
– কেন?
মিশান ওর হাতের ফুলটা অরনীর কানে গুঁজে দিয়ে মাথা নিচু করে ওর সমানে এসে ওর দিকে তাকায়। বিষয় টা ওর একদমই ভালো লাগছে না।
– আই লাইক ইউ। না না, লাভ ইউ অরনী।
– ছি! আমরা ভাইবোন!
– ও প্লিজ! আপন ভাইবোন না। আর আমি তোমাকে বোন হিসেবে দেখি না। লেটস ডেট।
মিশান ওর দুই হাত দিয়ে অরনীর হাত ধরে। অরনী রাগ করে হাত ছাড়িয়ে নেয়।
– পাগল হয়েছ! বাবা জানলে,
– মামা কিছু বলবে না। তুমি রাজি হলে মামা মামি রাজি।
– প্লিজ, এই কথা আর কাউকে বলো না। আমিও ভুলে যাব এখানে কিছু হয়েছিল।
– মানে?
– আমার বমি আসছে। তোমাকে আমি ভাই হিসেবে দেখি!
– এই অরনী, আরেকবার ভেবে দেখো।
– এই ছাড়ো তো! কী জঘন্য চিন্তা ভাবনা!
অরনী চলে আসছিল। মিশান গিয়ে ওর বাহু টেনে ধরল।
– এই! কী হয়েছে?
– তুমি ছাড়ো আমাকে! বাড়াবাড়ি করো না।
– আমি ভালোবাসি! ভালোবাসি তোমাকে!
– মাই ফুট!
অরনী রেগে ওকে ধাক্কা দিল। অরনীর কাছ থেকে এই প্রত্যাখ্যান পেয়ে মিশানের মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। ও সজোরে অরনীর দুই বাহু চেপে ধরে ওকে দেওয়ালে ঠেকিয়ে কিস করার চেষ্টা করতে থাকে। অরনী ওর দুই হাত দিয়ে ওকে ঠেকানোর চেষ্টা করে আর “বাবা! বাবা!” করে চিৎকার করতে থাকে। তখন ওর নিজেকে অনেক অসহায় লাগতে শুরু করে। ও কখনো ভাবেনি নিজের ভাইয়ের মতো লোকটা এমন একটা কাজ করবে। আশেপাশে ওকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। রাহু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজকে প্রিয়ম থাকলে হয়তো ওর সাথে এমন হতো না। কিন্তু ও তো স্ট্রং। ও হার মানবে না। মিশানের মতো শক্তিশালী পুরুষের সাথে হেরে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু জান থাকতে ও হারবে না। সময়টা ঘড়ির কাঁটায় বেশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু অরনীর কাছে সেটা কয়েক যুগের মতো। আল্লাহর রহমতে ওর বাবা সেই মুহূর্তে সেখান দিয়েই যাচ্ছিলেন আর এই দৃশ্য দেখে মিশান থেকে অরনীকে ছাড়িয়ে মিশানকে চড় মারেন। অরনীর পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। ওর বাবা ওকে আগলে চিৎকার করতে লাগলেন,
– কী করছিলে তুমি! ও তোমার বোন না!
– না ! আপন বোন না! মামাতো বোন!
– আরেকটা থাপ্পড় লাগাবো। কে শিখিয়েছে এগুলো? আর তুমি ওর সাথে যা করছিলে তা বেয়াদপি! তোমাকে আজ আমি পুলিশে দিব।
সাথে সাথে সেখানে সবাই চলে আসে। অরনী প্রচন্ড শকে আছে। অরনীর ফুফু বিশ্বাস ই করতে চাইছে না তার ছেলে এমন করতে পারে। উল্টো মিষ্টি এসে একটা ভেজাল লাগিয়ে ফেলল, “মামা, আমার মনে হয়ে আপনি ভুল বুঝেছেন। ওরা একজন একজনকে ভালোবাসে।” মিষ্টি নিছক না বুঝেই বলেছিল কথা টা। কারণ ওর চোখে মিশানকে অরনী না বলতেই পারে না। কিন্তু ওর এই কথা পরে বিষফোঁড়া হলো। সবাই অরনীকেই দোষারোপ করতে লাগলো।
– বলেছি আমি , তোমার মেয়েই আমার ছেলেকে ফাঁসিয়েছে! এখন যত্তসব ঢং!
– আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার মেয়ে বাঁচার জন্য বাবা বাবা করছিল!
– নাটক করছে ও। একটা বেয়াদব মেয়ে!
– তুই অন্ধ হয়ে গেছিস ছেলের ভালোবাসায়।
– তুমি নিজে অন্ধ ভাইয়া!
চাচা তার দুই ভাইবোন কে থামাতে চাইছিলো। তিনি চান না তার পরিবার এভাবে ভেঙে যাক। অংশু মিশান কে মেরেই ফেলবে। ততক্ষণে মিষ্টি বুঝল অরনী মানা করে দিয়েছিল আর তাই মিশান জোর করে তা করছিল। কিন্তু মুখের কথা কখনো ফেরত নেওয়া যায় না। মিঠাই এসব নিতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে গেলো। সেই থেকে ও আর কখনো মিশানের সাথে কথা বলে না।
– ভাইয়া, তুমি যদি মিশানকে জেলে দাও, তো আমার মরা মুখ দেখবে।
– তোর মতো বোন মরে যাওয়া ভালো! আরে তুই একটা মেয়ে হয়ে আমার মেয়ে কে কী করে দোষ দিচ্ছিস!
– আমি মা। আমার ছেলে এমন করতে পারে না।
– তোর ছেলে একটা লম্পট!
– আজ থেকে তুমি আমার ভাই না। তোমার পরিবারের সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ!
– তুই আর তোর ছেলে আমাকে আর কখনো তোদের চেহারা দেখাবি না।
তাদের ঝগড়ায় মিশান তো জেলে গেল না, কিন্তু মিষ্টি আর অংশুর এঙ্গেজমেন্ট আর হলো না। ওদের সম্পর্ক টাই ভেঙে গেল। অরনীর সাথে এত বড় ঘটনা হলো , কিন্তু এরপরও ও ভেঙে পড়েনি। পরদিন ই পড়তে বসে যায়। ও ভুলে যেতে চায় সবকিছু। ওর বাবা ওর পাশে যেভাবে ছিল, তাতে পরিবারের বাকি সদস্যদের কথা ও গায়ে লাগায়নি। কিন্তু মিষ্টি কে হারিয়ে অংশু মনমরা হয়ে যায়। সবাই এর জন্য অরনীকে দোষারোপ করে। এই ঘটনার দুদিন পর ই প্রিয়ম আত্মহত্যা করে। তখনো সবাই অরনীকেই দোষারোপ করে। ওর ছোটভাই রাহু ও। সেই সময় অংশু রাহুর কষ্ট একই থাকায় ওরা দুই ভাই অনেক ভালো বন্ধু হয়ে যায়। দুজনেই কোথাও না কোথাও নিজেদের এই অবস্থার জন্য অরনীকেই দায়ী ভাবতো। অরনী তা বুঝতে পারতো, প্রকাশ করত না। ওর কাউন্সিলিং ও হয়নি। সব মিলিয়ে ও সেই সময় এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ওর অ্যাক্সিডেন্টের পর দুই পরিবার মিলে যায়, কিন্তু মিশান নিষিদ্ধ থাকে। অরনী হাসাপাতালে থাকাকালীন অংশু আর মিষ্টির সম্পর্ক ও ঠিক হয়ে যায়। ওর জ্ঞান ফেরার পর অংশু ওর অনুমতি নিয়েই মিষ্টিকে বিয়ে করে। কিন্তু মিষ্টির সেই একটা কথার জন্য অরনী আজ ও ওকে পছন্দ করে না। ও কথাটাই তো সেখানে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছিল। মিষ্টি আজও মিশানের সাথে কথা বলে। অরনীর সব খবর বলে। ওদের অনেকবার মিলিয়ে দিতে চেয়েছিল। ও কেন বুঝতে চায় না মিশান ওর জীবনে একটা রাক্ষস ছাড়া কিছুই না। আজ এতো বছর পর ও পরিবারের অনেক সদস্যরা মনে করে মিশান নির্দোষ, অরনীই তখন ইচ্ছে করে এমন করেছিল। আর চাচা তাদের একজন। তাই তিনি অংশুকে এসব বলেছেন। তবে তিনি জানতেন না এমন কিছু হবে।
সব কথা শুনে জাহিদ বলল,
– তো তোমরা জানতে।
– কী?
– অরনী আত্ম*হ*ত্যার চেষ্টা করেছিল?
– হুম।
– তো তোমরা কিছু করোনি কেন?
– বদনাম হবে। সবাই এমনিতেই ভাবতো ও মিশান ভাইয়া কে পছন্দ করে। তখন হয়তো বলত ওর জন্য পাগলামি করছে। তাই ওকে কাউন্সিলিং করানো হয়নি। আর ওকে যদি বলা হতো ও সুই*সাইড অ্যাটেম্পট নিয়েছে, হয়তো আবার করতো। তাই আমরা ওকে বলিনি। বলেছি নরমাল অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সবাই ওভাবেই চলছিলাম।
– তোমাদের কী মনে হয়, কেউ আ*ত্ম*হত্যা করতে গিয়েছিল আর সে সেটা ভুলে যাবে!
জাহিদ চিৎকার দিয়ে উঠল। রাহু ভয় পেয়ে গেল। ওর হঠাৎ কী হয়েছে!
– কী হলো আপনার?
– ও আজ আবার চেষ্টা করেছে। তোমরা তো বলোনি ওকে, ও আবার কেন করলো?
– জানি না।
– ওর হেল্পের দরকার ছিল। ওর কাউন্সিলিং এর দরকার ছিল। তোমরা এটা না করে ওকে মৃ*ত্যুর মুখে ঠেলে দিলে!
– আমরা তখন বুঝতে পারিনি। ভেবেছি ভুলে যাবে। নরমাল ও হয়ে গিয়েছিল।
– বাহ! তোমরা আবার ওকে জোর করে আমার বাড়িতে পাঠিয়েছিলে। ও যদি তখন কিছু করতো?
– এত বছর পার হয়ে গেছে। আমরা কী জানি?
– এত বছর! এত বছরে ছোট ঘা ও ক্যান্সার হয়ে যায়। আসল কথা হলো তোমাদের মিথ্যা পারিবারিক সম্মান ! আজকে ও মারা গেলে সম্মান যেত না? একটা মানুষের থেকে সম্মান বেশি?
– আপনি ভুল বুঝছেন।
জাহিদ কান্না করছে। রাহু ওর পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
– আমি ভেবেছিলাম উনি আজ মারা গেছেন। আমি কখনো এত ভয় পাইনি। তোমরা ওনাকে শুধুই আঘাত দিয়েছ। ভেবেছ উনি একটা পাথর। ওনার কষ্ট হয় না? উনি রাগী, বদমেজাজি, চিৎকার করেন, ভাঙচুর করেন ব্যাস! ওনার ও একটা মন আছে। আজ যেটা হয়েছে এটা আগের সব ঘটনার ফসল। এটা সামনেও হবে। উনি সুস্থ হলে আমি একজন ভালো সাইকোলজিস্ট দেখাবো, আর কোনো পরিবারের সম্মান না। উনি এখন আর তোমাদের পরিবারের সদস্য না। উনি আমার স্ত্রী। ওনার কোনো ডিসিশন তোমরা নেবে না। উনি নেবেন!
জাহিদ নাদিয়ার কেবিনের সামনে গেল। বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে ওকে দেখেই কাঁদতে লাগলো। সকাল হতেই ও পিপিকে কল করলো। পিপি ফোন ধরতেই কাঁদতে লাগলো। ওর সত্যি এখন জড়িয়ে ধরে কাঁদার মতো একটা মানুষ নেই। পিপি আসতেই ওনাকে ধরে কাঁদতে লাগলো। পিপি যেন ওদের সেই কাছের বন্ধু হয়ে গেছে। পিপিও ওকে ধরে কিছুক্ষণ সান্ত্বনা দিল। অংশু রাহু দাঁড়িয়ে সব দেখছে। জাহিদ পিপিকে সব খুলে বলল। পিপি সত্যিই প্রতিদিন আফসোস করে ওদের নিয়ে।
– জাহিদ, তুমি কী কিছু বাদ দিয়ে গেছ?
– জ্বী?
– তুমি যখন ভেবেছিলে ও মারা গেছে , তখন তুমি প্যানিক করছিলে?
– জ্বী।
– তখন কী নিজেও চেষ্টা করো নি?
জাহিদ নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে। পিপি ওর কাঁধে হাত রাখে,
– আমি জানি, আমরা এরকম মুহূর্তে বুঝতে পারি না কী করা উচিত। মাথা ঠান্ডা রাখা টা মেইন। তুমি ওকে হাসাপাতালে আনতে পারোনি কারণ পালস চেক করতে ভুল হয়েছিল। কিন্তু তুমি এটা কী করতে গিয়েছিলে!
– আমার মনে হচ্ছিল দুনিয়াটা শেষ হয়ে গেছে। আপনি ঐদিন সেইসব বলার পর আমি প্রায় দুঃস্বপ্ন দেখতাম নাদিয়া আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর দুঃস্বপ্ন টাই আমার সামনে সত্যি ছিল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না।
– মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। কাছের মানুষ মারা যাচ্ছে দেখলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে, তার সাথে মরে যাওয়া এর সমাধান নয়। কাপুরুষের মতো কাজ করো না। বাই দ্য ওয়ে, তোমার কী মনে হচ্ছিল দোষটা তোমার উপর আসবে?
– জানি না।
– অপেক্ষা করো, আসবে। বাড়ি গিয়ে পোষাক বদলে নাও। নাদিয়া বেঁচে আছে এটাই অনেক। সাক্ষী দিতে পারবে। আমার দেখা এক ব্যক্তির জন্য সাক্ষী দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। তা তোমার মতো সে ও বোকামি করে বসে। তোমাদের দুজনের কেসে আমি ওদের দেখতে পাই। পার্থক্য এটাই তোমরা ভাগ্যবান, ওরা ছিল না।
– কারা?
– সময় এলে বলব।
পিপি যাওয়ার পর জাহিদ ওর বাসায় যায়। এরপর পোষাক বদলে রাহেলা খালা সহ ঘর পরিষ্কারের পর সোসাইটি সেক্রেটারি ওকে তলব করে। সেখানে ওকে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
– আপনার থেকে এটা আশা করিনি।
– দুঃখিত।
– আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার কী নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল?
– কোনো ঝামেলা হয়নি।
– তবে তিনি এমন কেন করলেন? আপনি কিছু বলেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতেই তো এমন আচরণ।
সেখান থেকে ফিরে ও আবার হাসপাতালে গেল। নাদিয়ার এখনো জ্ঞান ফিরেনি। জাহিদ ওর ব্যান্ডেজ হাত ধরে বসে আছে। ওর হাতেও ব্যান্ডেজ। সেখানে মিষ্টি ও আছে।
– বাবা মা জানে।
– না।
– ওনাদের বলে আসুন।
– জাহিদ ভাই! ওনারা সহ্য করতে পারবে না।
– আমি গিয়ে বলে আসবো?
– ওকে। আমিই বলছি।
অরনীর মা বাবা এসব শোনার পর স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়েন। হাসপাতালে ওকে দেখতে আসার পর কাঁদতে থাকেন।
– বাবা, আপনারা ওনাকে কাউন্সিলিং কেন করাননি?
– আমার ভুল হয়ে গেছে।
– বাবা, এবার আমি চাই উনি ডাক্তার দেখাক। আপনার কোনো অবজেকশন আছে?
– ডাক্তার তো দেখাচ্ছে।
– মানসিক ডাক্তার। ওনাকে কেউ পাগল বলবে না। তবে আগেও পাগল বললেও, আজকে এমন ঘটত না।
– নাহিয়ান, তোমাকে ওকে থাপ্পড় মারার সাহস কে দিয়েছে।
অংশু কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– তুমি তো বলেছিলে ওকে শাসন করা দরকার।
– থাপ্পড় মেরে?
– তুমিও তো থাপ্পড় মেরেছিলে ও যখন ডিভোর্স দিতে চাইছিল। আমি তো ভেবেছিলাম ও আবার ডিভোর্স দিচ্ছে।
– আমি তোকে পুলিশে দেব!
জাহিদ অবাক হয়ে যায়। এর আগেও নাদিয়া কে থাপ্পড় দিয়েছিল! তাও আবার ওর জন্যই। জগতের সব কষ্টই নাদিয়া জাহিদের জন্যই পেয়েছে। সেদিন প্রিয়ম সেখানে থাকলে মিশান এমনটা করতে পারত না। পরোক্ষভাবে সেখানেও জাহিদ জড়িত।
– থাক বাবা, এভাবে কিছুই হবে না। যা হওয়ার হয়েছে। উনি উঠুক, যা করার উনি করবে।
– কী করবে?
– পুলিশে দেবে না অন্য কিছু। আমি আর ওনাকে প্রেসার দেব না। আপনারাও আমাকে বলেননি , ওনাকে জোর করে পাঠিয়েছিলেন। আমি আর ওনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করছি না। ওনার সব সিদ্ধান্তে আমি পাশে থাকবো।
নাদিয়ার বাবা জাহিদের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, তিনি সেরা পাত্রই পেয়েছেন তার মেয়ের জন্য। শুধু মেয়ের মাথাটা ঠান্ডা থাকলেই হয়।
(চলবে)