রিস্টার্ট পার্ট-৪৮

0
3902

#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৪৮

ফাইয়াজ অপেক্ষা করছে ওকে এই জেলখানা থেকে বের করার। কিন্তু যারা ওকে বের করবে, তারাই ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করছে। ওদের বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরী হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একজন সৎ অফিসার এর দায়িত্বে আছেন। জেলখানার দিন গুলো ওদের সবার কাছেই জ্বালাময়ী। ওরা কেউই মানাতে পারছে না এই জেলখানার ভ্যাপসা গরমে। এসিতে ছিল না এতদিন। সাধারণ কয়েদিদের মতো খাবার খেতে হচ্ছে। ওদের সাথে কারো দেখা করতে দিচ্ছে না জেলের লোকেরা। কিন্তু সত্যি এটাই, কেউ ওদের সাথে দেখা করে করতেই আসেনি। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সবাই। অতঃপর ফাইয়াজ এক কারারক্ষীকে ফুসলিয়ে নিজের বাবার কাছে একটি বার্তা পাঠালো। দুদিন পর সেই বার্তার জবাব এলো। ফাইয়াজ সেই চিরকুটটি লুকিয়ে পড়ছে,

“তুমি দয়া করে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না। তুমি যা করেছ এরপর আমাদের অনেক লস হয়ে গেছে। আমি সেসব সামলাচ্ছি। আমি তোমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখব না। তোমাকে দেখলে ব্যবসা আর ফারাজের ভবিষ্যত দুটোই যাবে। যা ঝামেলা করেছ, সব মেনে নাও। আর চালাকি করো না।”

ফাইয়াজ রাগে সেই চিরকুটটি ছিড়ে ফেলে দিলো। বাবা কী করে এটা করতে পারল? ব্যবসা! এই ব্যবসা ও তৈরী করেছে। এই ফারাজ চালাবে এই ব্যবসা? সময় খারাপ হলে নিজের বাবাও হাত গুটিয়ে নেয়। কেউ পাশে থাকে না। সত্যি বলতে ফাইয়াজ যেভাবে প্রিয়মের পেটে নিজের সন্তানকে মে*রে ফেলেছে, ঠিক সেভাবেই ওর বাবা ওকে সব ফেরত দিচ্ছে। এক আজব নেশা ছিল ওর, ক্ষমতার নেশা। সেই ক্ষমতা দিয়ে যেমন ও সবাইকে নাচাতো, ঠিক সেভাবেই সবাই ওকে অন্য নাচ দেখাচ্ছে। এখন যা করার নিজেকেই করতে হবে। কোনো ভাবেই অর্ঘ্যদীপ আর আজফার কে বলা যাবে না।

এদিকে সারার বাসায় চলছে তুমুল ঝগড়া,

– ইউ কান্ট লিভ মি লাইক দিস!
– আই ক্যান। আই কান্ট লিভ উইথ আ ডিসগাস্টিং পার্সন লাইক ইউ!
– দোস আর লাইস! দ্যাট ভিডিও ওয়াজ ইডিটেড।
– ডোন্ট সে আ সিঙ্গেল ওয়ার্ড!

স্টিভ ওকে ছেড়ে চলে আসছিল। সারা চিৎকার করে বলল,

– আ’ম প্রেগনেন্ট!
– হোয়াট শ্যুড আই ডু?
– ইটস্ ইউর চাইল্ড!
– হাউ ক্যান আই বিলিভ ইউ? আই ডোন্ট থিংক ইটস্ মাইন।
– হাউ ক্যান ইউ সে দিস! ইটস্ ইওরস!
– দেন অ্যাবর্ট দিস!

স্টিভ ওকে ছেড়ে চলে গেছে। সারা ওর পেছনে দৌঁড়াতে লাগলো। স্টিভ বের হয়ে গাড়ি তে চলে গেছে। সারা গাড়ির পেছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে স্টিভকে ডাকতে থাকে। একসময় ও পায়ে পা জড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এরপর ওর যখন জ্ঞান ফিরল ওর পাশে ছিল ওর ম্যানেজার। একটু পর ম্যানেজার ওকে বলল ওর মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো ব্যাংক থেকে ওর এই বাড়ি জব্দ করা হবে। এমনিতেই পাওয়ানাদার রা সবাই ওকে ঘিরে ধরে ছিল। ওর পাশে এখন আর কেউ নেই। ও সবাইকে ওর ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলল। তারপর সেখানে বসে একা একা অনেকক্ষণ কান্না করলো। ও যেভাবে প্রিয়মের সন্তানকে নষ্ট করেছিল, তার দাম ওর অনাগত সন্তান দিল। ওর কাছে এখন যেমন লাগছে তা ও বলে বোঝাতে পারবে না। ঠিক এমনটাই প্রিয়মের ও লেগেছিল। সারার কাছে আর কিছু নেই, কেউ নেই। এমন জীবন ও কখনো চায়নি। ওর পক্ষে আর বাঁচা সম্ভব না। নিজের বেড সাইড ড্রয়ার এ একটা লাইসেন্স করা বন্দুক আছে ওর। ফুললি লোডেড সেই বন্দুক বের করে তার লক খুলল। তারপর তা নিজের কপালের পাশে ঠেকিয়ে ট্রিগার টা চেপে ধরলো।

“হারাধনের পাঁচটি ছেলে
কেউ করলো না বিচার,
নিজের শাস্তি নিজেই দিল
রইলো বাকি চার।”

পরদিন সকালে নিউজপেপারে এই খবর দেখে জাহিদ অবাক হলো। সারা আত্ম*হ*ত্যা করেছে। দুজন শাস্তি পেয়েছে। নাদিয়া চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পাশে রেখে ভাবলো, প্রকৃতির প্রতিশোধ। অবশেষে জেলে সেই খবর পেলো তিনজন। আজফার ভয়ার্ত হয়ে বলল, “আমাদের কে বের কর না ফাইয়াজ!” ফাইয়াজের চিন্তা হচ্ছে, কিন্তু ও তা দেখাবে না। ও আস্তে আস্তে বলল, “বাইরে থাকাটাই এখন বিপদজনক। যে দুজন বাইরে ছিল, তারাই ম*রে গেছে। আমরা ভেতরে ভালোই আছি।”

একটি ফাইভ স্টার হোটেলে রাত তিনটার দিকে সব শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের বৈঠক চলছে। তারা যেভাবেই হোক ফাইয়াজ কে তাদের পথ থেকে সরিয়ে দেবে। একজন শ্যুটার ও ঠিক করা হয়েছে। আবার ফাইয়াজের মৃত্যুর পর সোস্যাল মিডিয়া তে প্রপাগান্ডা ছড়ানোর মতো লোক ও সিলেক্ট আছে। ফাইয়াজের মৃত্যু টা কে তারা একটা সুবিচারের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে চায়। নিজেদের সন্তানদের বাঁচাতে সব ই ঠিক আছে।

অতঃপর আসলো সেই দিন। কোর্টে নেওয়া হচ্ছে ওদের। হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলো। পুলিশেরা আহত হলো। ফাইয়াজ আর বাকিদের হাতে হাতকড়া ছিল। তারা ভ্যানের সাথেই আটকানো। কেউ তাদের বাঁচাতে আসছে না। আজফার একটা সময় কাঁদতে লাগলো। ওদের এভাবে কে মা*রতে চাইছে? অর্ঘ্যদীপের হঠাৎ মনে পড়লো, এটা ওদের বাঁচানোর জন্য ও হতে পারে। সে বাকি দের অভয় দিলো। পরক্ষণেই সেখানে মুখোশ পরিহিত দুই যুবক এলো আর তাদের হাতকড়া খুলে সেখান থেকে নিয়ে গেলো। মিডিয়া তে এ নিয়ে নানা গুঞ্জন। কেউ বলছে ওদের এনকাউন্টার করা হয়েছে, কেউ বলছে ওরা বিদেশে পালিয়েছে, আবার কারো মতে পুলিশ ই ওদের আটকে রেখেছে। যাই হোক, ওদের কোনো খোঁজ নেই।

এরপর কেটে গেলো প্রায় দুই মাস…

নাদিয়া আরেকটি স্কুলে জয়েন করেছে। ওর জীবন ও স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকাল বেলা উঠে ও বাবা আর ভাইদের সাথে বসে নাস্তা করছে আর সমসাময়িক নানা বিষয়ে আলোচনা করছে। আজ ও একটা বিষয়ে কথা বলতে চায়। তাই চামচ দিয়ে প্লেট অনেক ঘষা মাজা করছে। ওর বাবা বুঝতে পেরে বলল,

– নাদিয়া, তুমি কী কিছু বলতে চাও?
– হ্যাঁ। মানে না।
– বলো। ভয় পেও না।
– আমি যা বলব, এরপর রাগ করবে না তো?
– তুমি যা বলবে, আমি তাই মানবো।
– আসলে,

নাদিয়া আবার আমতা আমতা করছে। ওর মা ও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাবা গলা ঝেড়ে বলল,

– জাহিদ কে ডিভোর্স দিতে চাও? মাজহার সাহেবের ফোন নাম্বার টা নিয়ে নিও। এত আমতা আমতা করার কিছু নেই। আমি চাই না তুমি এভাবে টেনে হিঁচড়ে বেঁচে থাকো। ইটস ওকে। আমি আর জেদ ধরবো না। তোমার ভালো লাগাতেই আমি খুশি। অনেক সহ্য করেছ মা।

নাদিয়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। বাকি সবাই ও খাওয়া বন্ধ করে দিলো। বাবা এটা কী বলল! মিষ্টি উত্তেজিত হয়ে বলল,

– আরে বাবা, ও রাহু আর সপ্তর্ষির বিয়ের কথা বলতে এসেছিল। ডিভোর্স না।
– তাই নাকি?

এবার রাহু রেগে বলল,
– এসব কী ভাবি?
– সপ্তর্ষি অনেক ভালো মেয়ে। ও এখনো তোমাকে ভালোবাসে। ওর ভুল ও বুঝে গেছে।
– কিন্তু, অরনী কিছু বলবি না?

নাদিয়া স্বাভাবিক হয়ে বলল, “আমি চাই তুই সপ্তর্ষি কে বিয়ে করে সংসার শুরু কর। আর বাবা ধন্যবাদ। এই কথাটাও আমার ভাবা উচিত ছিল। মাজহার আঙ্কেলের নাম্বার টা দিয়ে দিও।”

নাদিয়া সেখানে থেকে উঠে চলে আসলো। কী কাহিনি হয়ে গেল এখানে। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানেই এসে পড়ল আবার। ডিভোর্স!

একটি অন্ধকার জায়গা, পরিবেশ টা ও স্যাঁতসেঁতে। তিনজন কঙ্কালসার লোক দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন বোধহয় মৃত, আরেকজন কান্না করছে। অপর জন চুপ করে বসে আছে। একটু পর সেখানে একে একে জাহিদ আর ওয়াজির ঢুকলো। জাহিদ এসে মৃত ছেলেটার শ্বাস পরীক্ষা করলো। এরপর ওয়াজিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “মৃত।” ওয়াজির ফোন নিয়ে রাহুকে কল করল,

– কী ঔষধ দিলে, মরে গেলো তো।
– হায় হায়! আমি আসছি।

রাহু আসলো একটু পর। আজফার কে আবার পরীক্ষা করে দেখে বলল,

– সেদিনের টর্চারটা বেশি হয়ে গিয়েছিল।
– কী করতাম? এটাই ডিজার্ভ করে। এখন মাটি চাপা দিতে হবে। কী অবস্থা মেইন বস?

ওয়াজির হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে ফাইয়াজ কে। ফাইয়াজ ওভাবেই বসে আছে। ও প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে।
“হারাধনের চারটি ছেলে,
যাচ্ছে খারাপ দিন
একটি মরল অত্যাচারে
রইলো বাকি তিন।”

আর অর্ঘ্যদীপ কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আমাদের এখানে আর কতদিন রাখবে?
– আর বের হতে পারবে না। এখানেই পঁচবি। কী ড্যাশিং লাগতো না তোকে, এখন দেখ কী চেহারা হয়েছে।

অর্ঘ্যদীপ সাথে সাথে এগিয়ে এসে সেখানে পড়ে থাকা কাঁচের ভাঙা টুকরো নিজের গলায় চালিয়ে দেয়। জাহিদ আর রাহু চেষ্টা করে অর্ঘ্যদীপ কে বাঁচানোর। তবে শেষ পর্যন্ত অর্ঘ্যদীপ ও সেখানে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। খুব হঠাৎ করেই এই কাজ টা করলো অর্ঘ্যদীপ।

“হারাধনের তিনটি ছেলে
ছিলো বোয়াল রুই
নিজের গলা নিজেই কাটলো
রইলো বাকি দুই।”

“এখন তো দুটো কবর খুঁড়তে হবে।” জাহিদ এই কথা বলল। জবাবে ওয়াজির বলল,

– সমস্যা নেই। এটা অনেক বড় জায়গা। দুটো কবর কিছুই না।
– তোমার ভয় করছে না। এটা তোমার বাবার,
– সম্পত্তি।
– বেচারা পরে ধরা খেলে?
– কিছু হবে না। আমি গোর খোদক পাঠাচ্ছি। আর তোমরা দুজন এই মেইন বস কে খাঁচার ভিতর ঢোকাও।
– তুমি কোথায় যাচ্ছ?
– ঐশীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তুমি বললে না, দেখা করতে।
– বাব্বাহ! কী সাইকোপ্যাথ তুমি! দুটো লা*শ রেখে ডেট এ যাচ্ছ?
– ডেট না। এই ওয়াসি যে ঠিক হয়ে যাচ্ছে এটা যেমন ভালো, তেমন খারাপ ও। ও আম্মু কে সব বলে দিয়েছে। আম্মু আর ওয়াসি আমার নামে ঐশী কে মেসেজ দিয়ে ডেকেছে। এখন না গেলে আরো বেশি গালাগাল করবে।

রাহু হাসতে থাকে। ওয়াজির বেরিয়ে যায়। জাহিদ আর রাহু ফাইয়াজ কে ধরে খাঁচায় ঢুকিয়ে রাখে। ফাইয়াজ অনেক স্বাভাবিক। ওর কোনো অনুভূতি নেই। ওর সাথে থাকা দুইজন ওর সামনে মারা গেছে। আর ওর কোনো খারাপ লাগছে না। জাহিদ বিষয়টা বুঝতে পারছে। ও অবশ্যই কিছু না কিছু ভাবছে। “কী দেখছেন?” রাহু বলল। জাহিদ নেতিবাচক মাথা নাড়ে।

– আপনি আবার ওভারথিংকিং!
– না। ফাইয়াজ স্বাভাবিক না।
– আর এটাই স্বাভাবিক।
– ও এত সহজে ছেড়ে দেবে?
– তো আবার বদলা নেবে?
– জানি না।
– আপনার চাকরির কী হলো?
– অস্ট্রেলিয়া। যাব কি না ভাবছি।

রাহু চুপ হয়ে গেল। নাদিয়া কী সিদ্ধান্ত নেবে ওটা ওর ই বলা উচিত। পরশু দিনের নাস্তার টেবিলের ব্যাপারটা সিরিয়াসলি না নিলেই হয়। একটু পর রাহুও চলে আসে। আর এদিকে ওয়াজির আর ঐশী একটি ক্যাফে তে বসে আছে,

– কেন ডেকেছ? আর কী বলার আছে?
– তুমি কী এখনো আমাকে গালাগাল করো?
– না। আমি কাউকেই গালি দেই না।
– ভদ্র গালি। ঐ যে, বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক।
– ওসব গালি না। গালি হচ্ছে মা+++, খা%%, সু××××, শা$$, জা@@@
– চুপ করো! তোমার লিসেনাররা তোমার মুখে এসব শুনলে একদম।
– কী? ক্যান্সেল। আই ফাকি% ডোন্ট কেয়ার!
– ওকে ওকে। রেডিও তে তোমার কথা শুনে মনে হয় গালি কী জিনিস সেটা জানোই না। আমি এজন্য ডেকেছিলাম যে আসলে আমি তোমাকে ডাকিনি।
– মানে?
– আমার ভাই ওয়াসি আর মা মেসেজ করেছে, আমার হয়ে। আই নিড টু টেল ইউ সামথিং। তাই দয়া করে মুখটা সেলাই করে বসো।

ওয়াজির ঐশী কে সব খুলে বলল। সব শোনার পর ঐশী স্তব্ধ হয়ে গেল।

– এখন বুঝলে, আমি এজন্যই মিথ্যা বলেছিলাম।
– আর এখন সত্যি বলছ কেন?
– কারণ, কেউ একজন বলেছিল যে আমি যদি তোমাকে সুন্দর করে এসব না বোঝাই তবে তুমি কোনোদিন ও মুভ অন করতে পারবে না। সারাজীবন আমাকে ঘৃণা করবে, আটকে থাকবে।
– এখন তুমি কী করবে?
– আমাকে এস এস এফ আই হেড কোয়ার্টার অফার করেছে। আমি একজন বাগ থেকে স্পাই এ প্রোমোট হয়েছি।
– আর তোমার আর্ট?
– যদি কখনো রিটায়ার করি তবে তখন আর্ট পারস্যু করবো।
– আর?
– আর কী?
– আমি?
– তুমি! দেখো ঐশী, আমার জীবনটা অনেক অনিশ্চিত। আমি এই থাকবো, এই থাকবো না। তোমার পক্ষে তো আর তা সম্ভব না। তুমি মুভ অন করো, আর ভালো কিছু করো।
– কে বলেছে আমি ভালো কিছু করছি না? তোমার কী মনে হয় আমি টাইম ওয়েস্ট করছি? থ্যাংকস টু ইউ! হয়তো তোমার কারণেই আমি আরজে হয়েছি, কিন্তু আজকে আমার প্রচুর ফ্যান ফলোয়ার আছে। আমি আমার প্যাশন খুঁজে পেয়েছি। সামনে আমার কবিতার বই বের হবে। আমার কাছে ব্যাক টু ব্যাক গান লেখার অফার আছে। আর একটা উপন্যাস ও লিখছি। হয়তো আমি একদিন অনেক বড় লেখিকা হয়ে যাব। কিন্তু মনে রেখো, শুধুমাত্র প্রেম ভালোবাসাই জীবনে সব কিছু না। আর বিয়ে শাদী করে সেটেল হওয়াও না।
– কংগ্র্যাটস্! তুমি অনেক বুদ্ধিমান, অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। আমার বিশ্বাস তুমি অনেক বড় কিছু হবে। এরকমই থেকো, মিস ক্যারোলিনা রীপার।

ঐশী মুচকি হেসে সেখান থেকে উঠে চলে আসে। একদম দরজা পর্যন্ত এসে পেছন ফিরে বলে, “যদি কখনো আর্ট পারস্যু করতে ইচ্ছে হয় তো আমার খোঁজ করো।”

ওয়াজির ঐশীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর মুচকি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, “কেন?” ঐশী দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। তারপর দরজা আটকে কাঁচের দরজা দিয়ে ওয়াজির কে দেখতে থাকে। ওয়াজির চেয়ারে হেলান দিয়ে দরজার দিকেই তাকিয়ে থাকে। অতঃপর সেই কাঁচের দরজা খুলে হাসতে হাসতে বলে, “ভালোবাসা ও একটা আর্ট!! আর আমার একটা মিউস দরকার!” এই বলে ঐশী দৌঁড় দিয়ে চলে আসে। ওয়াজির ও খিল খিল করে হেসে বলে, “একদম বড় হলো না। ”

নাদিয়া গাড়ি করে ঠিকানা অনুযায়ী ওয়াজিরদের ফার্ম হাউসে আসলো। সেখানকার গার্ড ওকে ঢুকতে দিচ্ছে না। জাহিদ নাদিয়া কে দেখেই এগিয়ে আসলো। ওর আবার আগের মতো নার্ভাস লাগছে। নাদিয়া কে দেখে ওর হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। ও কী টিনেজার নাকি।

– কী হলো নাদিয়া, তুমি এখানে?
– তোমার সাথেই কথা আছে। গুরুত্বপূর্ণ কথা।

জাহিদ নাদিয়াকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে যেতে যেতে দেখলো মাটি খুঁড়ছে দুজন। নাদিয়ার চোখ ওদিকে দেখে জাহিদ নিজেই বলল,
– কম্পোস্ট।
– মানে?
– ওয়াজির, মানে তোমার ওয়াসি।
– জানি ওর কাহিনী।
– ওর বাবার ফার্ম হাউস।
– তাও জানি।
– ঐ তো। জৈব সার। সব আবর্জনা এখানে রাখা হবে।
– ওহ!

নাদিয়া খেয়াল করলো জাহিদের শার্টের কোনায় রক্ত লেগে আছে। তাই ও সেই অংশ টা জাহিদের প্যান্টের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। জাহিদ খানিকটা অবাক হলো।

– ইন করো না কেন? বাজে দেখায়।
– ওহ!!

জাহিদ হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এরপর আরেকটু ভেতরে যেতে বলতেই নাদিয়া ওকে বাঁধা দিল,

– কী হলো?
– এমনি। তোমার জব? এখনো কী কিছু?
– হয়েছে। ভাবছি যাব না।
– কেন?
– অস্ট্রেলিয়া।
– খারাপ কোথায়? চলে যাও। গুড ফর ইউ।

জাহিদ চুপ করে তাকিয়ে রইলো। “আমি তোমার জন্য যাচ্ছি না নাদিয়া।” এই বাক্য টা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। তবুও ওর বোঝা তো উচিত এই সময়ে এসে। এখনো কী ওর রাগ আছে?

– আর ভাইয়াদের কী অবস্থা?
– আছে। ওনারা ওনাদের মতো। বড় ভাবি বলে এসে ঘুরে যেতে।
– তো যাও না কেন?
– এমনি।

আসলে বড় ভাবির বাচ্চারা গেলেই ওদের নাদিয়া চাচির কথা জিজ্ঞেস করে। ব্যাপারটা ওর ভালো লাগে না। চাচি যে আর চাচার সাথে থাকে না, তা তো আর ওরা জানে না।
– তো ভাইয়াদের সাথে সময় কাটাও না?
– ডেকেছিল ফুফু সেদিন।
– ফুফু কেমন আছে?
– ভালো। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল।
– কী বললে?
– ভালো আছ।
– আমার উপর রাগ করে নেই তো?
– না।

রাগ তো জাহিদের উপর ই করেছে। ওর ভাইয়ারা, ফুফু আর কাজিনরা। তারা বলেছে সব মিটমাট হওয়ার পর যাতে ওর হাত পা ধরে ওকে নিয়ে আসে। সাহিদ ভাইয়া বলেছে নাদিয়া আর জাহিদ একদম মেড ফর ইচ আদার। ওদের জীবন একে অপরের সাথে বাঁধা। এখনো যেহেতু কাগজে কলমে ডিভোর্স হয় নি তো একটা সুযোগ আছে। দরকার পড়লে আগের বারের মতো ফুফু, বড় ভাইয়া ভাবি আর ছোট ভাইয়া ভাবি সবাই মিলে নাদিয়া কে রিকোয়েস্ট করবে। কিন্তু জাহিদ আর ওকে চাপ দিতে চায় না। ওর ইচ্ছে হলেই আসুক, না আসলে ও অপেক্ষা করবে।
– তোমার কী অবস্থা?
– রাহু বলেনি?
– কী?
– আমি জব করছি?
– ও ! বলেছে।
– আর কিছু বলেনি?
– না। ও কেন বলবে?
– বুঝতে পেরেছি, আমার ই বলা উচিত। এই যে ডিভোর্স পেপার। আজকেই মাজহার আঙ্কেল বানিয়ে দিল। চেক করে নাও। এরপর ভুল থাকলে বলে দিও। আর সাইন করে দিও।

জাহিদ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ডিভোর্স পেপার! শুধুমাত্র এটা দিতেই আসলো!

– কী হয়েছে?
– কিছু না। দেখে দিচ্ছি।
– তোমার কোনো চাওয়া পাওয়া থাকলে লিখতে পারো।
– আমার আর কী চাওয়া পাওয়া?
– থাকতেই পারে।
– প্রাক্তন স্ত্রীর প্রতি আর কী চাওয়া পাওয়া? আমাদের কোনো সন্তান ও তো নেই। নইলে তাকে দেখতে যাওয়ার পারমিশন ইত্যাদি।

জাহিদ অন্যদিকে ফিরে গেল। ওর চোখ ভিজে আসছে। আর গলাও ভেঙে এসেছিল। নাদিয়া বলল, “কী হয়েছে?” জাহিদ ওর দিকে ফিরে বলল হাসিমুখে বলল,

– এরপর কী করবে?
– কী কী করব?
– এই যে ডিভোর্স দিয়ে।
– নরমাল লাইফ। ও হ্যাঁ, বাবাও কিছু বলবে না। ইভেন বাবাই এবার সাজেস্ট করলো। এই সম্পর্কে যখন আর কিছু নেই তো এটাকে এভাবে টেনে টেনে আর কী হবে?

আসলেই তো। তবে আরেকটা সুযোগ কী দেওয়া যায় না। জাহিদ নাদিয়া কে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।

– শোনো, আবর্জনাগুলোকে মাটি চাপা দেওয়ার আগে একটু গোসল করিয়ে জানাজা পড়িয়ে নিও।
– জ্বী?
– নইলে অতৃপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে।

নাদিয়া চলে গেল। কিন্তু জাহিদ বুঝতে পারল না ও কী আসলেই জানে? কী আসে যায়। তার পরপরই ওয়াজির ঢুকলো,

– কী রে, নাদিয়া আসলো যে?
– হুম।
– কী বলল?
– এটা দিয়ে গেল।

জাহিদ কাগজটি ওয়াজির কে দিল। ওয়াজির কাগজ টা পড়ে দেখল।

– এটা তো ডিভোর্স নোটিস।
– হুম।
– আবার গন্ডগোল দেখা দিল কেন? এই মেয়েটার মাথা নষ্ট। তুমিও কী দিয়ে দিবে?
– চাইছে, এখন না দিয়ে কী পারি?
– আশ্চর্য! সব কয়টা পাগল! আর এই, আমার মনে হয় কোনো কিন্তু আছে। ও কিন্তু এই নোটিস কুরিয়ার করতে পারতো। নিজে এসে দিয়ে গেল।
– কী আসে যায়? ডিভোর্স নোটিস ই তো দিয়ে গেলো।

গেট দিয়ে ওয়াসি ঢুকছে। লাফাতে লাফাতে হেসে বলল, ” মা বলছে মেয়ের বাড়িতে প্রস্তাব দিতে যাব। কী বলল আরজে টা?” ওয়াজির ওকে বলল জাহিদ কে সান্ত্বনা দিতে। বিয়ের জায়গায় ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে একজনের। আর এদিকে ও পিপিকে সব জানালো। পিপি আবার নাদিয়া কে ফোন করলো। নাদিয়া পিপির ফোন পেয়ে কিছুক্ষণ হাসলো। এরপর রিসিভ করে বলল,
– হ্যালো।
– কী শুনছি এসব?
– কী?
– আবার ডিভোর্স দিচ্ছ কেন?
– তো কী করবো? জাহিদ আর নাদিয়ার কাহিনী অনেক আগেই শেষ। আর টেনে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
– তোমার সমস্যা কী নাদিয়া? ও চিকিৎসা নিয়েছে, তুমি ও নিয়েছ। যা যা সমস্যা ছিল সব ই শেষ হয়ে গেছে। এখন কী?
– সেটাই। এখন আর কিছুই নেই। ভালোবাসা বা ঘৃণা। আমাদের মধ্যে আর কিছুই নেই। শুধু কাগজে কলমে একটা সম্পর্ক আছে, এখন আর তাও রাখতে চাইছি না।
– আমাকে আর রাগাবে না নাদিয়া!
– শুনুন পিপি স্যার, আমি না পারমিতা না। আর জাহিদ ও কায়সার না। আপনার আমাদের নিয়ে আফসোস করতে হবে না। আপনি আপনার তরফ থেকে অনেক চেষ্টা করেছেন। এটা আপনার ব্যর্থতা না আর আমাদের ও না। একটা জিনিস বলুন তো, আপনার কী শতভাগ সফলতার রেকর্ড আছে?
– না।
– তো এটাও একটা সাধারণ বিফলতা ধরুন। আর আপনাকে এসব কে বলেছে?
– ওয়াজির।
– বাহ! জাহিদ থেকে ওয়াজির হয়ে পিপি হয়ে নাদিয়া। এত ফাস্ট।
– তোমার খুব মজা লাগছে না?
– হ্যাঁ। চিন্তা করবেন না। যেটা হওয়ার সেটাই হচ্ছে। আসলে আমাদের বিয়েটা হচ্ছে প্রিয়মের বিচার পাওয়ার একটা প্রসেস মাত্র। ওর অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে। পারপোস টা শেষ, বিয়েটাও শেষ। আমাদের সম্পর্ক এতটুকুই ছিল। নো রিস্টার্ট, জাস্ট শাট ডাউন!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here