রেড রোজ (পর্ব ৯) – শেষ পর্ব

#রেড_রোজ (পর্ব ৯) – শেষ পর্ব

১.
মোহাম্মদপুর থানার ছোট্ট একটা রুমে কাঠের চেয়ারে রায়ান ঝিমোচ্ছিল। এরা কাল রাতে ওকে ধরে নিয়ে এসেছে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে। ক্ষুধা লেগেছে খুব, এরা কি নাস্তা দেবে?

এমন সময় দরজা খুলে যায়, একজন কনস্টেবল নাস্তা নিয়ে ঢোকে। রায়ান লোভাতুর চোখে তাকায়, লালচে বাদামি পরোটা, সবজি, ডিম ভাজি। নাস্তার ঘ্রাণে পেটে ক্ষুধা মোচড় মারে। প্লেটটা রাখতেই ও আর অনুমতির তোয়াক্কা করে না, হাপুসহুপুস করে খেতে থাকে।

খাওয়ার শেষ পর্যায়ে রাহাত ঢোকে। একজনকে দু’কাপ চা দিতে বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে অবাক হয়, লোকটার নার্ভ ভীষণ শক্ত। দেখে মনে হচ্ছে এতটুকুও চিন্তিত না। চা আসতেই ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘চা নিন রায়ান।’

রায়ান একটা কৃতজ্ঞতার হাসি দেয়। দু’জনেই নীরবে চা খেতে থাকে। একসময় নীরবতা ভেঙে রাহাত বলে, ‘আপনি অত রাতে রয়ার কবরে কেন গিয়েছিলেন?’

রায়ান চায়ের কাপ রেখে একটা তৃপ্তির শব্দ করে, তারপর বলে, ‘কাল রাত থেকেই আপনারা এই প্রশ্ন করছেন। বলেছি তো, গোলাপের গাছ লাগাতে গিয়েছিলাম। রয়া রেড রোজ ভালোবাসত। এর আগেও একটা লাগিয়েছিলাম, ওটা মরে গেছে। তাই নতুন আরেকটা লাগিয়ে দিলাম।’

রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এটা কেউ বিশ্বাস করবে? এত রাতে কেউ ওখানে গোলাপ গাছ লাগাতে যায়? আপনি নিশ্চয়ই আপনার সেই মোবাইল ফোন ওখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেটা আনতেই আজ রাতে রয়ার কবরে গিয়েছিলেন।’

রায়ান জোরে মাথা নাড়ে, ‘প্রথমত আমার কোনো লুকানো ফোন নেই। দ্বিতীয়ত, আমি ওখানে গাছ লাগাতেই গিয়েছিলাম, আপনারা দেখেছেন।’

রাহাত হাসে, ‘আর কিছুক্ষণ পরেই আপনাকে নিয়ে দিনের আলোতে রয়ার কবর খুড়ব। তখন দেখবেন কি বের হয়। রয়াকে যে মোবাইল দিয়ে ভয় দেখানো হতো সেটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।’

রায়ান একটা বিদ্রুপের হাসি দেয়,’মোবাইল পাওয়া গেলেই কি? আমি যে রেখেছি তার প্রমাণ তো নেই। আপনি যদি মিথ্যে একটা মোবাইল ওখানে আগে থেকে রেখে দিয়ে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন তাহলে কিন্তু ভুল করবেন। আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি, কাল রাতে আমি যখন গোলাপ গাছ লাগাচ্ছিলাম সেটা ফেসবুকে লাইভ করছিলাম। আপনারা এলেন, টর্চ লাইটের জোরালো আলো পড়ল আমার মুখে সেগুলো সব লাইভ স্ট্রিমিং হয়েছে। আপনাদের একজন মোবাইল কেড়ে নিল সেটাও। এতক্ষণে হয়ত ফেসবুক তোলপাড় হয়ে গেছে।’

রাহাত স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। এত ধুরন্ধর এই লোকটা! তারমানে কাল কোনোভাবে রায়ান বুঝে ফেলেছিল পুলিশ ফলো করছে। কেন যেন রাগ হচ্ছে খুব। ওই বোকা হাফিজের জন্য বেটাকে হাতেনাতে ধরা গেল না।

রাহাত এবার শেষ অস্ত্রটা ছাড়ে, ‘আপনি আসলেই দারুণ বুদ্ধিমান। কিন্তু আপনিই যে রয়াকে ভয় দেখাতেন তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। সেদিন রাতে রয়ার যে ফোন এসেছিল সেখানে আপনি সব স্বীকার করেছিলেন। আপনিই ওকে ফোনে ভয় দেখাতেন।’

রায়ান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর একটা ধূর্ত হাসি হেসে বলে, ‘আপনি খুব বুদ্ধিমান পুলিশ অফিসার। ভালো লেগেছে আমার। কিন্তু একটা জিনিস ভেবে দেখা দরকার, আমার যে অডিও রেকর্ড আপনার কাছে আছে সেটা শুনলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে সেরাতে আমি ড্রাংক ছিলাম। কথাগুলো সুস্থ মস্তিষ্কে বলিনি। মদ্যপ অবস্থায় বলা আমার কথাগুলো আদালত গ্রহণ করবে তো?’

রাহাত একটু থমকে যায়, এ ব্যাপারটা তো ও চিন্তা করে দেখেনি। সত্যিই তো! লোকটা যে এতটা ধুরন্ধর সেটা ভাবতেই পারেনি। তাহলে কি ফস্কে যাবে? এই যখন ভাবছিল ঠিক তখনই এসপি স্যারের ফোন আসে।

রাহাত রুম থেকে বাইরে এসে ফোন ধরে, ‘রাহাত, তোমার থানায় কি রায়ান নামে কাউকে কাল কবরস্থান থেকে গ্রেফতার করেছ?’

রাহাতের চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়, নিরাসক্ত গলায় বলে, ‘হ্যাঁ স্যার। রয়ার সন্দেহভাজন খুনি।’

ওপাশ থেকে এসপি স্যারের বিরক্ত গলা শোনা যায়, ‘রাহাত, কাল রাতের পুরো ঘটনা ফেসবুকে লাইভ হয়েছে। জনগণের সেন্টিমেন্ট এখন রায়ানের উপর। মৃত স্ত্রীর কবরে ফুল গাছ লাগাতে গিয়েছে আর পুলিশ তাকে হয়রানি করতে গ্রেফতার করেছে। এখনই ছেড়ে দাও ওকে।’

রাহাত বলার চেষ্টা করে, ‘কিন্তু স্যার, ও তো ওখানে মোবাইল লুকিয়ে রেখেছিল। কবর খুড়লেই পাওয়া যাবে।’

স্যার একটু ভেবে বলে, ‘এখন আদালতের অনুমতি ছাড়া ভুলেও কবর খুড়তে যেও না। ক’টা দিন পরে করো। মোবাইল যদি পাওয়া যায় তখন বেটাকে চেপে ধরো। আপাতত ছেড়ে দাও।’

রাহাত ফোনটা রাখে। মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে, এই রায়ানকে ও সাত দিনের মধ্যে গ্রেফতার করবে। আর তখন ওকে দিয়েই সুস্থ মস্তিষ্কে সব অপরাধ স্বীকার করাবে।

২.
রয়ার কবরের চারপাশে আজ অনেক মানুষের ভীড়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে সাংবাদিকরাও এসেছেন। কিছুদিন আগে এই রহস্যময় খুনের কেসটা আলোচনায় আসে। রাহাত নামে একজন পুলিশ অফিসার জোর করে মেয়েটার স্বামি রায়ানকে ফাঁসাতে চাচ্ছিল। বেচারা না হয় রাত করেই কবরে এসেছিল, কিন্তু ও তো ফুলের গাছ লাগাতে এসেছিল। অথচ পুলিশ ভাবল সেই মোবাইলটা কবরে লুকিয়ে রেখেছে। এই নিয়ে একটা দারুণ কৌতুহল আছে মানুষের মাঝে। যদি সত্যিই মোবাইল পাওয়া যায়!

ফরেনসিক বিভাগের লোকজন সতর্কতার সাথে কবর খুড়ছিল। রাহাত ওর লোকজন নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়েছিল। একটু যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে না তা না। যদি আজ মোবাইল না পাওয়া যায় তাহলে এই খবরের কাগজের লোকজন পেয়ে বসবে। এমনিতেই পুলিশের নানা বদনাম।

গোলাপের গাছ বরাবর দু’হাত পর্যন্ত খুড়তেই একজন হাত তোলে থামতে ইশারা করে। তারপর লোকটা সাবধানে হাত দিয়ে মাটি সরাতে থাকে। একটু পরেই একটা প্লাস্টিক মোড়ানো জিনিস দেখা যায়। সাথে সাথে সাংবাদিকদের ক্যামেরা ফোকাস করে জিনিসটার উপর। রাহাতের বুক এবার ধুকপুক করছে। ছেঁড়াফাটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভেতর পরিস্কার একটা কালো রঙের মোবাইল দেখা যায়। রাহাত একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, যাক, মোবাইলটা পাওয়া গেল। নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। ফরেনসিক টিমের লোকজন সাবধানে মোবাইলটা একটা বক্সে রাখে। এটা ল্যাবে পাঠাতে হবে।

সাংবাদিকরা সবাই ঘিরে ধরে রাহাতকে, প্রশ্নের পর প্রশ্নে ওকে জর্জরিত করে ফেলে। একজন গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, এই মোবাইলের মালিক কে তা বুঝবেন কী করে?’

রাহাত মাথা নেড়ে বলে, ‘আমাদের ফরেনসিক টিম অবশ্যই বের করে ফেলবে এই মোবাইল আসলে কে ব্যবহার করত। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে এটা একটা স্মার্ট ফোন। আর এটা অক্ষত আছে একদম। সেক্ষেত্রে এর ব্যবহারকারীকে খুব সহজেই সনাক্ত করা যাবে।’

৩.
রায়ান রাত দশটার নিউজ দেখছিল। ক’দিন ধরেই একটা চাপা উদ্বেগ কাজ করছিল মনে। আজ তো কবর খোড়ার কথা। কিন্তু ওকে এখনও থানা থেকে ফোন করেনি। সাংবাদিকরাও তো নিউজ করার কথা? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ নিউজটা দেখে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখে ওর লুকানো মোবাইল খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। একটা নিঃশ্বাস ফেলে, তা খুঁজে পাক। ওকে তো আর ধরতে পারবে না। ফোনটা যে ওরই সেটা তো কেউই প্রমাণ করতে পারবে না।

ভাবনার এই পর্যায়ে রাহাতের সাক্ষাৎকার দেখায়। কী বলছে লোকটা? আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সহজেই জানা যাবে ফোনটা কে ব্যবহার করত! সাক্ষাৎকারটা শেষ হয়ে যায়। এখন অন্য খবর দেখাচ্ছে।

রায়ান উঠে দাঁড়ায়, পায়চারি করে ভাবতে থাকে। আচ্ছা, পুলিশ কি করে জানবে এটা ও ব্যবহার করত? মাথায় কিছুই আসে না। হঠাৎ কি মনে হতে ও গুগলে সার্চ দেয়, মোবাইল ফোন ফরেনসিক লিখে। প্রথম ওয়েবপেজ খুলে ও পড়া শুরু করে। যতই পড়ে ততই ওর নিঃশ্বাস দ্রুত পড়তে থাকে। বুকের ভেতর একটা চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।
আসলেই তো, পুলিশ ওকে ধরে ফেলবে! রায়ান ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা নিষ্ঠুর হাসি খেলে যায় ওর চোখে মুখে। রান্নাঘরে গিয়ে একটা বড় হাড়িতে পানি গরম দেয়। কিছুক্ষণ পর পানিটা টগবগ করে ফুটতে থাকে। রায়ান চোখমুখ শক্ত করে হাত দুটো এগিয়ে নিয়ে যায়। তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে হঠাৎ হাত দুটো গরম পানিতে চুবিয়ে দেয়।

জামশেদ একটা বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে রায়ানের বাসার দরজায় মাত্রই এসে দাঁড়িয়েছে। ঘন্টাখানেক আগে ওকে এক প্যাকেট বিরিয়ানি এনে দিতে বলেছিল। কলিং বেলে চাপ দিতে যাবে ঠিক তখনই ভেতর থেকে একটা গগনবিদারী চিৎকার ভেসে আসে। জামশেদের কলিজা কেঁপে ওঠে। আকুল গলায় ও চিৎকার করতে থাকে, ‘স্যার, কি হইল, স্যার দরজা খোলেন।’

৪.
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের একটা কেবিনে রায়ান শুয়ে আছে। দুই হাতে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। ডাক্তার বলেছেন খুব খারাপভাবে পুড়ে গেছে, আঙুলগুলো পাশাপাশি লেগে গিয়েছিল। অনেক সময় নিয়ে সার্জারি করে মোটামুটি ঠিক করতে পেরেছে। ডাক্তার সাহেব ভীষণ অবাক হয়েছিলেন, এভাবে শুধু দশটা আঙুল কী করে পুড়ে যায়! শরীরের আর কোথাও গরম পানির ছিটাও লাগেনি, অদ্ভুত!

রাহাত ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে রায়ানের কেবিনে ঢোকে। রাহাতকে দেখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে রায়ানের ঠোঁটের কোণে। মৃদু অথচ কঠিন গলায় বলে, ‘কি মি. রাহাত, শেষ পর্যন্ত মোবাইল খুঁজে পেলেন তো, কংগ্রাচুলেশনস। এবার খুনিকে ধরে ফেলুন।’

কথাটা বলে ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের আঙুলের দিকে একবার তাকায়।

রাহাত হাসে, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, আর দেরি করা যায় না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেল। সেদিন রাতেই ধরা পড়ত। যাই হোক, আপনার সাহসের প্রশংসা করতে হয়। ফিংগারপ্রিন্ট মুছে ফেলতে নিজের হাত গরম পানিতে চুবিয়ে পুড়িয়ে ফেললনে? আপনার মতো এমন আরেকজন নিষ্ঠুর অপরাধী ছিল, জলদানব গফুর। সেও শেষ পর্যন্ত বাঁচেনি, ধরা পড়েছে।’

রায়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তারপর ব্যান্ডেজ করা হাত দু’টো বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘নিন, আমার হাতের ছাপ নিন, তারপর মোবাইলের স্ক্রিণের উপর থাকা আমার আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখুন। ফিংগারপ্রিন্ট দিয়ে লক করা মোবাইল খুলে প্রমাণ করুন এবার।’

কথা শেষ করে পাগলের মতো হা হা করে হাসতে থাকে রায়ান।

রাহাত শিউরে ওঠে, কেমন অসুস্থ মানুষের হাসি। ওর হাসি থামতেই রাহাত লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, ‘একটা জায়গায় মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন আপনি। তাড়াহুড়োয় আপনি একদম ভুলে গেছেন আপনার হাতের আঙুলের ছাপ ইতোমধ্যেই আমাদের কাছে আছে। আপনি যখন ন্যাশনাল আইডি কার্ড করেছিলেন অথবা পাসপোর্ট, তখন কিন্তু আপনার আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত আছে। আমরা সেটা হাতে পেয়েছি। মোবাইলের স্ক্রিণের উপর প্রাপ্ত আঙুলের ছাপের সাথে আপনার ফিংগারপ্রিন্ট মিলে গেছে। আর আপনার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ফিংগারপ্রিন্ট দিয়েই তো মোবাইল লক করা ছিল? ওটার একটা থ্রি ডি প্রিন্ট করার ব্যবস্থা হয়েছে। মাসখানেক সময় লাগবে, ওটা চলে আসতে। শুধু শুধু আপনি আঙুলগুলো পোড়ালেন। অবশ্য একদিক দিয়ে প্রকৃতি আপনাকে ঠিক সাজাটা দিয়ে দিল। এই আঙুল দিয়েই তো মেসেজগুলো টাইপ করেছিলেন, রয়াকে ভয় দেখাতেন। আপনার উচিত সাজা আপনি পেয়েছেন।’

রায়ানের হঠাৎ করেই তলপেট খালি হয়ে যেতে থাকে। ইশ, এটা তো এই পুলিশ অফিসার ঠিক বলেছে। ওর ফিংগারপ্রিন্ট তো এদের কাছে আছেই। হায়! তাড়াহুড়ায় একবারও এটা মনে পড়েনি। ও ধরা পড়ে গেল! একটা আক্ষেপ ফুটে উঠে চোখেমুখে।

তারপর রাগী গলায় বলে, ‘রয়াও ওর সাজা পেয়েছে। খুব ভালো করেছি ওকে ভয় দেখিয়ে। এমনিতেও মেরে ফেলতাম। কিন্তু ভীতু মেয়েটা নিজেই ছাদ থেকে পড়ে মরে গেল।’

রাহাত মন খারাপ গলায় বলে, ‘কেন মারতে চাইলেন?’

রায়ান হিসহিসিয়ে বলে, ‘ও আমাকে ভুলে গিয়ে ওই সাজিদের সাথে প্রেম করত। প্রথমে বুঝতে পারিনি। একদিন সন্দেহ হলো, প্রায়ই বিকেলে বাসার সিসি ক্যামেরা বন্ধ থাকত। আমি লুকিয়ে একটা সিসি ক্যামেরা লিভিংয়ে বসালাম। আর যেটা দেখতে চাইনি তাই দেখলাম। মাথায় সেদিন খুন চেপে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম সেদিনই ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেব। কিন্তু পরে মনে হলো তাতে করে ওর শাস্তি ও পাবে না। আমাকে ঠকিয়েছে, তার শাস্তি যে ওকে যে পেতেই হবে। আমার সমস্যা ছিল, তাই সন্তান হতো না আমাদের। ও করুণা করত আসলে আমাকে। তাই ওকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই।’

রাহাত মাথা নাড়ে, তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘জীবনের একটা পর্যায়ে রয়া হয়ত ওর ভালো লাগার মানুষ পেয়ে গিয়েছিল। আপনি যখন জানতেই পারলেন তখন আপনি ডিভোর্স দিতে পারতেন।’

রায়ান ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘আমি একদম ঠিক কাজই করেছি। আমার আর এই কথা বলতে ভয় নেই। যেহেতু সবই প্রমাণ হয়ে গেছে, এখন আর বলতে বাধা নেই।’

রাহাত সন্তর্পণে মোবাইলের রেকর্ড অপশনটা বন্ধ করে। তারপর বলে, ‘বাইরে একজন ম্যাজিস্ট্রেট অপেক্ষা করছেন, আপনি কি আপনার স্বীকারোক্তি দেবেন এখন?’

রায়ান গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ে।

ভেতরে একজন একটা ফাইল নিয়ে ঢোকে সাথে একজন ম্যাজিস্ট্রেট। রাহাত ওনাদের রেখে বাইরে বেরিয়ে আসে। রায়ানের অডিও রেকর্ডটা পাঠাতে হবে।

বাইরে আসতেই টের পায় বাতাসে একটা সুন্দর ঘ্রাণ। গাছে গাছে কচি সবুজ পাতা। বসন্ত এসে গেছে। মনটা উদাস হয়ে যায়। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে এগোতে থাকে। সিগন্যালে গাড়ি থামতেই একটা ছোট্ট মেয়ে অনেকগুলো লাল গোলাপ নিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘স্যার, আফার জন্য নিয়া যান।’

রাহাত মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকে, রয়া নামের একটা মেয়ে লাল গোলাপ পছন্দ করত।

রায়ানকে সেদিনই গ্রেফতার করা হয়। প্রত্যেকটা টিভি নিউজে এই চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনাটা সবিস্তারে দেখায়। মানুষ কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারে তা দেখে শিউরে উঠে মানুষজন। সেইসাথে মেধাবী পুলিশ অফিসার রাহাতের বুদ্ধিমত্তার ভূয়সী প্রশংসা করে।

সেদিন রাহাত থানায় বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছিল। ওর সহকারী হাফিজ এসে বসে, তারপর কৌতুহলী গলায় বলে, ‘স্যার, একটা ব্যাপারে কৌতুহল ছিল। যে মোবাইলটা উদ্ধার করা হলো, ওটা এতদিন মাটির নিচে ঠিক ছিল? আর সেটা ফিংগারপ্রিন্টে খুলবেও? মোবাইলের স্ক্রিণের উপর লেখার সময় যে আঙুলের ছাপ পড়েছিল সেটাও কি এতদিন থাকে?’

রাহাত হাসে, তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘এক কথায় উত্তর হলো, থাকে না। সাধারণত অপরাধীর ফেলে যাওয়া মোবাইল যদি এক দু’দিনের মাঝে পাওয়া যায়, তাহলে ব্যবহারকারীর আঙুলের ছাপ দিয়ে অপরাধী ধরা সম্ভব। আর মোবাইল যদি ফিংগারপ্রিন্ট দিয়ে লক থাকে তাহলে তো সোজা। রায়ানের মোবাইলটা আসলে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই ফিংগারপ্রিন্ট দিয়ে খোলার প্রশ্নই আসে না। আর স্ক্রিণের উপর আঙুলের ছাপ তো আর এতদিন থাকে না।’

হাফিজের চোয়াল ঝুলে যায়, বিস্মিত গলায় বলে, ‘তাহলে?’

রাহাত হেসে ফেলে ওর অবস্থা দেখে, বলে, ‘আসলে রায়ানের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতেই এই মিথ্যেটা বলেছি। না হলে যে কিছুতেই প্রমাণ করা যাচ্ছিল না ওই মোবাইলটা ব্যবহার করত। ও ধরা পড়ার ভয়ে নিজেই নিজের আঙুলগুলো পুড়িয়ে ফেলল। বুঝতে পেরেছ, কতটা নিষ্ঠুর!’

হাফিজ মাথা নেড়ে বলে, ‘স্যার তা বুঝেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও আপনার বুদ্ধির কাছে হেরেছে। বহুদিন পর এমন একটা কঠিন মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের কেস পাইলাম, সেই জাদুকর চিত্রকরের আহমেদ নকিবের মতো।’

রাহাত মাথা নাড়ে। আসলেই কেসটা একজন অপরাধীর সাথে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই ছিল। এই ক’টা মাস ভীষণ মানসিক চাপ গেছে। কিন্তু একটাই স্বস্তি, শেষ পর্যন্ত অপরাধী ধরা পড়েছে, শাস্তিও হবে নিশ্চয়ই। শুধু রয়া নামের মেয়েটার জন্য মন খারাপ হয়, যে কি না লাল গোলাপ পছন্দ করত।

(সমাপ্ত)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১০/০৩/২০২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here