#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৩]
মাগরিবের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলার কফি হাতে নিয়ে ছাদে গেল সাহিল। এবাড়িটা এমন জায়গায় করা ভারী ভুল হয়েছে। এই ছাদ আর ওই ছাদের মাঝে কোনো প্রাইভেসির ব্যাপার স্যাপার নেই। দেখা যাবে নতুন বউয়ের সাথে প্রেম পিরিতি করতে গেলে ও ওই বাড়ির শফিক আন্কেল হা করে তাকিয়ে থাকবে। যদি বউটা তার মেয়ে হয় তাহলে একটু রক্ষে। মেয়ে জামাইয়ের প্রেম নিশ্চয় তিনি চশমা নামিয়ে দেখবেন না। কিন্তু তা কি আর হওয়ার আছে? তিনি শুধু শুধু কেন এই নরপুরীতে মেয়ে দেবেন?
ছাদের রেলিংয়ে হাতের ভর দিয়ে সামনের বাড়ির ছাদে তাকাল সাহিল। তাদের বড়ই গাছটি বড্ড বেয়াদব। যেন তাকে শফিক আন্কেল রোজ খেতে দেয়। কাত হয়ে ওই বাড়ির দিকে হেলে পড়েছে। এত মিষ্টি বড়ই খেতে মন চাইলে ও খাওয়া যায়না। চিকন বাঁশের মাথায় কাঠি বেঁধে ও নাগাল পাওয়া যায়না। কিন্তু ওই বাড়ির ছাদ থেকে বেশ ভালো নাগাল পাওয়া যায়। গেলে যাক। ওই বাড়ির মেয়েটা ছাড়া বাকিরা খেলে কিন্তু সমস্যা। মেয়েটা তো আহমেদ বাড়ির ছেলের পছন্দের পাত্রী৷ সেক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার কথা না৷ কিন্তু বাকিরা খেলে একআধটু না অনেক বেশিই সমস্যা হতে পারে। আমাদের গাছের বড়ই ওরা কেন খাবে? বড়ই খাবে খাবে আবার উঠানে বড়ই পঁচে পড়ার কারণে ঝগড়া কেন করবে? বড়ই যখন খাচ্ছে তখন পাকা বড়ই আর বড়ই পাতা ও পরিষ্কার করতে হবে। সবকিছুতে সুবিধা খুঁজলে তো আর হবেনা। কিন্তু শফিক আন্কেল করুক, তার মেয়েটার পরিষ্কার না করতে হলেই হয়েছে৷ মোটকথা মেয়েটা বড়ই খাবে, কিন্তু বড়ই পাতা পরিষ্কার করবে মেয়ের বাবা। শফিক আন্কেল বড়ই খায়না এমন কি কোথাও লেখা আছে? খায় হয়ত মেয়ে আর মেয়ের মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে। ছিঃ ব্যাপারটা দেখতে কেমন কেমন না?
কফির মগে চুমুক দিয়ে সাহিল নিজের আনমনে হা হু করে হাসল। কিন্তু আওয়াজ বের হলোনা। অন্ধকার বেশি কোথায় এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। কফির মগে চুমুক দিয়ে ভাবল সে নিজে নিজে একটু বেশিই ভেবে ফেলে। শফিক সাহেব বেশ ধার্মিক মানুষ অন্যের গাছের বড়ই কেন খাবে?
আবার পরক্ষণে ভাবল, সাহিলরা কি কম ধার্মিক নাকি?
কফির মগ শেষ হলোনা, বিরক্তি নিয়ে পা বাড়াতেই বিরক্তিটা হুট করে কমে এল। বিরক্তর কারণটা ও সাহিলের কাছে স্পষ্ট হলো। ওই বাড়ির ছাদে মৃদুমন্দ আলো আঁধারিতে ফোন কানে এপাশ ওপাশ ঘুরে কথা বলা মেয়েটি আচমকা থমকে গেল। সাহিল নিজেকে একটু আড়াল করে নিল। জিনিয়া সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকল। লোকটা কি ভেবেছে তাকে দেখা যাচ্ছেনা? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে জিনিয়া। জিনিয়া কথা বলতে বলতে হাসল। যদি ও কথা বলা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এই লোকটার সমস্যা কি খুঁজে বের করতে হবে আগে। সাহিল তাড়াতাড়ি কফি শেষ করে সিগারেট হাতড়াল পকেটে। পেশাদার সিগারেট খোর না হওয়ায় পকেটে যখন তখন সিগারেট পাওয়া মুশকিল। সাহিলের রাগ লাগল। ভাবল,
‘ আমি পালাতে চাইছি কেন? মেয়েটাকে আমি ভয় পাই নাকি? উহু মোটে ও ভয় পাইনা। হুহ। সাহিল আহমেদ কাউকে ভয় পাইনা। বুক ফুলিয়ে হাঁটে।
সাহিল হেঁটে হেঁটে সামনে আসল। জিনিয়ার সামনাসামনি এসে দাঁড়াল। কিন্তু চোখ দুটো ততক্ষণে নিচতলায় গিয়ে ঠেকল। এমনভাবে মাথা নামিয়েছে তোলার নাম নেই। জিনিয়া ভাবল,’ নিচে কি হয়েছে? এই লোকটা নিচে কি দেখছে?
জিনিয়া চোখ নিচে নামিয়ে দেখতেই সাহিল চট করে চোখ তুলে একনজর জিনিয়াকে দেখে নিল। মগজে ঢুকিয়ে নিল গোলাপি ওড়না পড়া মেয়েগুলো ভারী কুৎসিত হয়। একটু ও সুন্দর না। হতেই পারেনা। এদের সুন্দর ভাবা ও পাপ। বলা আর ও পাপ।
জিনিয়া চোখ তুলতেই সাহিল আবার চোখ সরিয়ে জিনিয়াকে পিঠ করে দাঁড়াল। কফির মগ ঠোঁটের কাছে দিয়ে ভাবল,
‘ শালার কফি শেষ হওয়ার আর সময় পাইলি না। এখন আমি ভাব দেখাব কি দিয়ে? সিগারেট তো খেতে পারব না। এখন উপায়?
জিনিয়া হাসল। ফোনটা কানে দিয়ে নিজে নিজেই বলল
‘ শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো? শুনতে পাচ্ছেন? আমি জিনি বলছি।
সাহিল কানকাড়া করে শুনতে লাগল। বিড়বিড় করল,
‘ জিনি, জিনি, জিনি। সাহিল্লের জিনি। মাথা আর মুন্ডু। ধ্যাত কেমন কুৎসিত শোনায়। একটু ও মানাল না সাহিলের সাথে। হুহ৷
জিনিয়া ফোন কানে দিয়ে বকেই গেল।
‘ আজব প্রাণী দেখেছেন কখনো?
‘ আরেহ চিড়িয়াখানায় যাওয়া লাগেনা আজব প্রাণী দেখতে। ঘরে, বাহিরে, উঠানে, রাস্তায়, ছাদে, শপিংয়ে, বিয়ে বাড়িতে যেখানে আর সেখানে ও আজব প্রাণী দেখা যায়।
সাহিল গলা খাঁকারি দিল। জিনিয়া হাসল। ফোনে বলল,
‘ আপনি বোধহয় দেখেননি। কিন্তু আমি দেখেছি। রোজ দেখি। কত লাকি আমি?
সাহিল ধপধপ পায়ের আওয়াজ তুলে চলে গেল। জিনিয়া হাসতে হাসতে ঢলে পড়ার অবস্থা হলো। নিজে নিজেই হাসতে লাগল। সাহিলকে ওভাবে ছাদ থেকে নামতে দেখে সবাই ভারী অবাক হলো। নাহিল ডাক দিল,
‘ বড় ভাই ঝালমুড়ি মেখেছি। খেলে এসো। খেলা চলছে টিভিতে। তাড়াতাড়ি এসো। খেতে খেতে খেলা দেখব।
সাহিল ধপাধপ হেঁটে যেতে যেতে বলল,
‘ খেলা অলরেডি হয়ে গেছে। আর আমি আউট ভাই।
কেউ কিছু বুঝল না। সাহিল নিজের ঘরে গেল। দরজা বন্ধ করে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মুখের উপর বালিশ চেপে বলল,
‘ মেয়েটা একদম ভালো না। সাহিল এই মেয়েকে কখনো পছন্দ করেনি। করবেনা ও না। নো নেভার।
______________
পাত্রপক্ষ থেকে এসেছে বরের মামা আর উকিল। শফিক চায়ের কাপ তুলে দিয়ে বেশ সাহেবের মতো বলল,
‘ কি আর বলব ভাইজান? আমার মেয়ের নামে বলতে শুরু করলে তো আর শেষ করতে পারব না।
উকিল সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিল। বলল,
‘ মেয়ে দেখব ভাইজান। ছেলের মামা এসেছেন ওনি মেয়েকে এক নজর দেখবেন।
শফিক সাহেব নড়ল, চড়ল। বলল,
‘ আমার মেয়েকে আমি দেখাব না এখন। সবকিছু পাকাপোক্ত হলে তখন মেয়ে দেখাব। আপনারা দেখে আমার মেয়ের হাতে একটা হাজার টাকার নোট গুজে দেবেন, আর কি করবেন? আমি আমারে মেয়েকে নিয়ে ব্যবসা করিনা যে, যাকে ইচ্ছা তাকে মেয়ে দেখাব। আমার মেয়ে অপছন্দ হওয়ার মতো মেয়েই না।
উকিল সাহেব হাসলেন। বললেন,
‘ ছেলে ভালো বলেই এনেছি। ছেলে আর্মি অফিসার৷ বেশ টাকা পয়সা ইনকাম করে। দেখতে ও ভালো। আপনার মেয়েকে ভার্সিটি যাওয়ার পথে নাকি ছেলের চাচা দেখেছে।। শফিক সাহেব থামিয়ে দিলেন।
‘ ছেলের চাচার পছন্দ হয়ে গেল?
উকিল মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ জ্বি। তার ভাইয়ের ছেলের জন্য নাকি এই মেয়েটাই পার্ফেক্ট হবে।
শফিক সাহেব মাথা দুলালেন। বললেন,
‘ আমি ছেলে দেখব আগে। ছেলে আমার মনমতো হলে তারপর আগাব। ছেলে নামাজকালাম পড়ে তো?
ছেলের মামা বললেন,
‘ তা আর বলতে হবেনা ভাই। আমার বোনপো একদম খাঁটি নামাজি।
বেশ কথাবার্তা ভালো ভালোই হলো। উকিল চলে যেতেই জাহেদা এসে বলল,
‘ কথাবার্তা কেমন হলো?
শফিক সাহেব বললেন,
‘ ছেলে দেখি আগে। জায়িদকে বলব খোঁজখবর নিতে। তারপর দেখা যাক।
সন্ধ্যা হতে না হতেই পাত্রপক্ষ নিজে নিজেই শফিক সাহেবকে ফোন করে জানাল এই সম্পর্কটা করতে তারা রাজী নন। ক্যান্সেল। শফিক সাহেব চিন্তায় পড়ে গেল। এমন কি হলো যাতে ডিরেক্ট মানা করে দিল। জিনিয়া রুমের দরজা বন্ধ করে খুশিতে নাচল ও। উফফ কি খুশি! বিয়ে হবেনা।
চিন্তিত চেহারায় শফিক সাহেবকে এপাশ ওপাশ ঘুরতে দেখল সাগর সাহেব। ছাদের দরজার কাছাকাছি লুকিয়ে থেকে মিটিমিটি হাসল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ তোমার মেয়েরে আমি ছেলের বউ বানামু ডাক্তার বাবু। তুমি লুকায় লুকায় বিয়া দিবা মাইয়্যারে। দেখি কিভাবে বিয়া দাও। বিয়া ভাঙব আমি হুহ। সাগর যেটা বলে তার থেকে বেশি কাজে করে দেখায়। জিনিয়া আমার বাড়ির বউ হইবো।
___________
ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে জিনিয়ার মুখোমুখি হয়ে গেল সাগর আর সাহিল। সাহিল ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল তার বাবাকে। অটো ডেকে দুজনই উঠে বসার সময় চোখাচোখি হয়ে গেল তিনজনই। জিনিয়া মাথা নামিয়ে সাইড দিয়ে বসল সাগরকে। সাগর মিটিমিটি হাসল। সাহিল বলল,
‘ আমি অন্য গাড়িতে উঠি।। সাগর সাহিলের হাত চেপে ধরল। বলল,
‘ এখানে সিট থাকতে আবার অন্য গাড়িতে কেন উঠবি? আয়। বোস।
সাহিল জিনিয়া থাকায় কথা বাড়াতে চাইল না। সাগরের পাশে বসল। সাগর গলা খাঁকারি দিয়ে জিনিয়াকে ডাকল,
‘ কোথায় গেছিলা মামুনি?
জিনিয়া মাথা তুলল। বলল,
‘ আমাকে বলছেন?
সাগর হাসল। জিনিয়া বলল
‘ ভার্সিটিতে গেছিলাম আন্কেল। সাগর বলল,
‘ ভালা ভালা। ভালো কইরা পড়ো। ভালা জামাই পাবা।
জিনিয়া হাসল আওয়াজ ছাড়া। বলল,
‘ নতুন কিছু জানলাম।
সাগর হাসে। সাহিল একদম চুপচাপ। মাথা নিচু করে বসে আছে একদম। জিনিয়া আড়চোখে সাহিলকে দেখে ভাবে,
‘ আহারে বেচারা কি শরম তার?
সাহিল আড়চোখে তাকাতেই সব শেষ। সাগর গলা খাঁকারি দেয় মুহূর্তেই। সাহিলকে বলে,
‘ তুমি মাইয়্যাটারে পছন্দ করে ভালা কথা। একবার বললে ভালো হতো না আব্বা? মাইয়্যাটার যদি বিয়াশাদী হইয়্যা যায় তখন?। সাহিল সাগরের হাত চেপে ধরল। দোহাই লাগে। জিনিয়া বাইরে চোখ রাখল। যত্তসব ঢংয়ের কারখানা।
সাগর একটু ভাবসাব নিয়ে জিনিয়াকে বলল,
‘ তুমি কও আম্মা, কোনো মেয়েরে যদি পছন্দ লাগে, তারে না বলাটা কি অন্যায় না?
জিনিয়া বেশকিছুক্ষণ ভেবে জবাব দেয়।
‘অন্যায় বটে। ভারী অন্যায়।
সাহিল মনে মনে বলল,
‘ ভারী অন্যায় কাউকে পছন্দ করা। ভারী ভারী।
সাগর হাসল। বলল,
‘ এই গাধারে আমি বুঝাই পায়না আম্মা, কতবার বলি মেয়েটারে গিয়ে বল। বল। বল।
না সে শোনেনা।
জিনিয়া হেসে দিল। বলল,
‘ গাধারা কথা শোনেনা। এজন্যই গাধা৷
সাগর ও হাসল জিনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে। সাগর বলল,
‘ তুমি রাগ টাগ কইরোনা তোমার আব্বার লগে ঝগড়া করি বলে। তোমার আব্বা আর আমি ঝগড়া করা ছাড়া আর কিছু পারিনা।
জিনিয়া বলল,
‘ না, না এসব আপনারা বড়দের ব্যাপার।
সাগর জিনিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। গন্তব্য চলে আসায় তিনজনই গাড়ি থেকে নামল। সাগর গাড়ি ভাড়া দিয়ে দিল জিনিয়ার। জিনিয়া না না করে উঠল। বলল,
‘ না না আন্কেল আব্বা দেখলে ভারী রাগ করবে। সাহিল পকেটে হাত পুড়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাগর গাড়ি ভাড়া দিয়ে অটো ড্রাইভারকে বিদায় দিল। জিনিয়া বলল,
‘ আন্কেল আব্বা বলেছে আপনার কাছ থেকে কোনোকিছু না নিতে।
সাগর রেগে বলল,
‘ তোমার আব্বা ছোটবেলায় চকলেট দিতে ও বারণ করত। এখন ও কোনোকিছু দিতে পারিনা। এই সামান্য ভাড়াগুলা ও নিবানা?
জিনু!!!!
গর্জন ভেসে এল। জিনিয়া ভয়ার্ত চোখে উপরে তাকালো। দুতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখল শফিক সাহেব। বলল,
‘ জিনু এখনি আসবে। টাকাগুলো ও দিয়ে আসো। তাড়াতাড়ি আসো। তোমাকে বলেছি না ওদের থেকে দূরে দূরে থাকতে। ওদের সাথে একগাড়িতে উঠেছ কেন?
জিনিয়া ভাড়ার টাকা দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল একটি হাত। সাহিল চোখ বড়বড় করে তাকাল জিনিয়ার হাতের দিকে। নিজের হাত বন্দী জিনিয়ার দুহাতে। অপ্রত্যাশিত কিছু পেলে মানুষ কি করে তখন? সাহিল ভেবেই নিল, এই হাতটা তার ভারী দামি।
নয়নজোড়া ততক্ষণে স্থির,নিবদ্ধ, অশান্ত হয়ে ঠাঁই পড়ে রইল সামনে দাঁড়ানো চিন্তিত রমণীর বদনে।
জিনিয়া ওই উপরে তার বাবার দিকে তাকাতে তাকাতে টাকাগুলো গুজে দিতে লাগল সাহিলের হাতে। কিন্তু সাহিলের হাতের তালু মেলে থাকায় টাকাগুলো দিতে পারল না। জিনিয়া বলল,
‘ টাকাটা নিন না? নিন। আব্বা বকবে আমায়। ধরুন।
বলতে বলতে জিনিয়া তাকালো সাহিলের দিকে। ভয়ার্ত চোখ মেলে। চোখের কোটরে কি কিছু লেখা থাকে? ওইখানে ওভাবে দেখার কি আছে? জিনিয়া মিনমিন করে বলল,
‘ নিন।
সাহিলের জবাব পেলনা। জিনিয়া একটু আওয়াজ করে ডাকল।
‘ নিন।
সাহিল হেসে ফেলল। বলল,
‘ নিয়েছি না জানিয়ে।
জিনিয়া বলল,
‘ আরেহ নিতে বলেছি না?
সাহিল জিনিয়ার হাত ঝেড়ে ফেলল।
‘ এই মেয়ে বলেছি না নিয়েছি। কতবার বলব?
জিনিয়া কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল। বলল,
‘ কোথায় নিয়েছেন? কি নিয়েছেন?
সাহিল চট করে টাকাটা নিয়ে ফেলল জিনিয়ার হাত থেকে। বলল,
‘ এই তো টাকা নিয়েছি।
জিনিয়া মাথা নামিয়ে ফেলল। ছেলেটাকে যতটা ভদ্র মনে হলো ততটা ও না। কিভাবে বকল?
সাগর শফিককে চোখের ইশারায় সাহিল আর জিনিয়াকে দেখিয়ে দিল। হেসে হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ ইয়ে ইয়ে।
শফিক গর্জন করে ডাকল।
‘ জিনু তোমাকে আসতে বলেছি?
জিনিয়া তাড়াতাড়ি পা বাড়াতেই সাগর ধরে ফেলল জিনিয়ার হাত। শফিক সাহেব চেঁচালেন,
‘ আল্লাহর ওয়াস্তে আমার মেয়েকে ছাড়। ধরিস না ভাই। দিয়া দে আমার মেয়েকে। জিনু হাতে কামড় বসিয়ে দৌড়ে চলে আসো। আসো। আসো। ওই তুই ছাড় আমার মেয়েকে। ছাড়।
সাগর বলল,
‘ আমার মাথা গরম কইরা দিছস শালা। ছাড়ব না আর তোর মাইয়্যারে। ছাড়ব না।
শফিক সাহেব চেঁচালেন, গর্জন করলেন। জাহেদা দৌড়ে এল । শফিক সাহেব পারলনা দুতলা থেকে লাফ দিতে। জিনিয়া তার বাবার চেঁচানো দেখে আনমনে হেসে ভাবল,
‘ পুতুল কেড়ে নিলে সে যেভাবে ছটপট করত ছোটবেলায়, এমুহূর্তে তার বাবার দশা ও একই।
সাহিল দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে দাঁড়ায়। মনে মনে বলল,
‘ বাবা আমার সেই নটাংকিবাজ। ক্যারি অন। ক্যারি অন বাবা।
সাগর হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যেতে লাগল জিনিয়াকে। জিনিয়া বলল,
‘ আন্কেল ছাড়ুন আমায়। আব্বা এখন আশেপাশের লোক জড়ো করে ফেলবে। আন্কেল মানুষ হাসবে। ছাড়ুন। আন্কেল?
সাহিলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিনিয়া বলল,
‘ আপনি কিছু বলছেন না কেন? কিছু তো বলুন। শুনছেন?
সাহিল হেসে জবাব দিল।
‘ শুনছি।
নাহিল দৌড়াতে দৌড়াতে এল। কানের ইয়ারফোন খুলে পড়ে গেল। সাহিলকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘ বড়ভাই কি হচ্ছে এখানে?
সাহিল বলল,
‘ কমেডি।
নাহিল বলল,
‘ ওই দেখো বড়ভাই জিনিয়াকে তো বড়আব্বা আমাদের নরপুরীতে নিয়ে যাচ্ছে। ও আল্লাহ এটা কি আমি সত্যি দেখছি।
সাহিল হাসল। বলল,
‘ এই শফিক আন্কেলের চিল্লানির জ্বালায় কোথায় যাইতাম বলতো। চল ঘরে যাই।
নাহিল বলল,
‘ বড়ভাই মিষ্টি খাওয়াও। নরপুরীতে নারীর আগমন। হিপ হিপ হুররে।
সাহিল ঘাড় ধরল নাহিলের। বলল,
‘ চুপ থাক ভাই আমার। এখন এই নরপুরীর সামনে বিরাট মিছিল হবে। চল আমরা কেটে পড়ি। ওসবে আমরা নাই।
তরিনা খাতুন হাঁপাতে থাকল জিনিয়া আর সাগরের সামনে এসে। হায় হায় করে বলল,
‘ এটা কি করলি রে সাগর? এ তো ডাক্তারের মেয়ে। তুই তারে কেন আনলি? তার বাপ কই?
সাগর বলল,
‘ তার বাপ পাগলা কুত্তার মতো ঘেউঘেউ করে। জিনিয়ার খারাপ লাগল।
জোরে চিল্লিয়ে বলল,
‘ আমার আব্বাকে এভাবে বলবেন না আন্কেল। ভালো হবেনা। আমার হাত ছাড়ুন।
সাগর বলে,
‘ রাগ কইরোনা আম্মা। কথার কথা বলেছি। তোমার আব্বা আমার মাথা গরম কইরা দেই । তার ছেড়ির কি আমি ধইরা রাখুম? কিভাবে চিল্লাইলো?
জিনিয়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ আমি যাব আন্কেল। এসব কেন করছেন আপনি? প্লিজ যেতে দিন আমাকে। ভাইয়া শুনলে কেয়ামত ঘটে যাবে।
সাগর বলল,
‘ আমি ভয় পাইনা। তোমার বাপেরে শাস্তি দেওয়া লাগবো তো। কতবড় সাহস বলে কিনা আমার ছেলেরে মাইয়্যা দিবোনা। দিতেই হইবো। আমার ছেলের বউ তোমারে হতেই হইবো। বুঝছ?
জিনিয়া শক্ত হয়ে গেল মুহূর্তেই। মুখ দিয়ে কোনো আর্তনাদ বের হলোনা। এসব কি শুনল সে?
কাঁপাকাঁপা গলায় জিনিয়া বলল,
‘ আমি যাব। থাকব না এখানে।
সাগর এক ধমক দিল।
‘ আরেকটা কথা বললে একদম ঘরবন্দী করে রাখব। তোমার বাপের সাথে সাথে তোমারে ও শাস্তি দেব।
ঘৃণায় জিনিয়ার শরীর রি রি করে উঠল। এরা আসলেই খারাপ। কেন এত ভালো হতে গেল সে? আব্বা এদের এজন্যই পছন্দ করেনা।
জিনিয়া হাত মোচড়ামোচড়ি করে পালাতে চাইল। এক দৌড় দিতেই কারো বুকের উপর গিয়ে পড়ল একদম। ভয়ে শার্ট খামচে ধরে কেঁদে দিল ঝরঝর করে। সাগর সাহিলকে দুটো অপশন দিল,
‘ ছাড়বি নাকি রাখবি?
জিনিয়া মাথা তুলে দেখল সাহিলকে। কানে এল,
‘ ছাড়বি নাকি রাখবি?
সাহিলের ঠোঁটের কোণায় রহস্য হাসি। জিনিয়া ভড়কে গেল। তরিনা বেগম চলে গেল হুট করে। তরতর করে কাঁপতে কাঁপতে কোথায় যেন চলে গেল। জিনিয়া সাহিলকে এক ধাক্কা মারল। চিল্লিয়ে কেঁদে উঠে ডাকল,
‘ আব্বা! আব্বা কোথায় তুমি। আমি যাব। আমাকে যেতে দিন।
চলবে,