রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-৮

0
887

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[৮]

বিপদ যখন আসে তখন সব একসঙ্গে আসে। একের পর এক। পুরো বিয়েবাড়ির একঝাঁক মেহমান দেখল মুহূর্তেই ঘটে যাওয়া কুরুক্ষেত্র। জিনিয়ার মামা, চাচারা ও হতভম্ব। কি থেকে কি হয়ে গেল?
জায়িদ ফোনের উপর ফোন লাগিয়ে সীমান্তর পেছনে পুলিশে লাগিয়ে দিল৷ রাগে,আক্রোশে গুলি করে উড়িয়ে দিতে বলল। জিনিয়াকে সাহিল গাড়িতে তুলে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করল। জাহেদা জ্ঞান হারিয়ে এককোণায় পড়ে রয়েছে। কয়েকজন মহিলা তার হাত আর পায়ের তালুতে ম্যাসাজ করছে।
শফিক সাহেব চোখ খোলামাত্রই পাগলের মতো জিনিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে বলে,
‘ তোকে বিয়ে দেব না মা। আর কোথাও যেতে বলব না।
সাগর সাহেব তাকে আটকালেন। বললেন,
‘ জিনিয়া হসপিটালে। সবাই এরকম করলে তো হবেনা।
শফিক সাহেব নিজের করা ভুলের জন্য স্ত্রীর দিকে পর্যন্ত তাকাতে পারলেন না। এত বড় বিশ্বাসঘাতক সীমান্ত? হসপিটালের অনৈতিক কাজকারবারের সাথে তারমানে সীমান্তই জড়িত। কিডনি পাচার করে? ছিহঃ!
সীমান্ত ধরা পড়ে যাবে বলে ক্ষতি ও করে গেল। এখন এই সমাজের কাছে মুখ দেখাবে কি করে? সমাজ কি তার মেয়েকে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে এই সমাজে বাঁচতে দেবে? এই সমাজ তো দুর্বলতা ধরেই খোঁচায়। দুর্বলতায় আঘাত করে তারা মজা পায়। শফিক সাহেব সাগর সাহেবকে দেখে অবাক হলেন। এই লোকটা তার সাথে যতই ঝগড়া করুক দিনশেষে এই মানুষটা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর সে কিনা এই মানুষটাকে নিজের শত্রু মনে করত?
এত লোকের ভীড়ে একজন তো বলে উঠল,
‘ মেয়েটার এই অবস্থা করে ছেড়ে গেল? বিয়ে হয়ে গেলে একটা কথা ছিল।
শফিক সাহেব রেগে বলে দিলেন,
‘ বিয়ে হয়নি ভালো হয়েছে। ওরকম একটা পশুকে অন্তত স্বামী হিসেবে পরিচয় দিতে হবেনা আমার মেয়েকে।
লোকটা বিদ্রুপ করে বলল,
‘ তাহলে? আপনার মেয়েকে আর বিয়ে করবেই বা কে? যে পালিয়েছে তাকে এনে তুলে দিন।
শফিক সাহেবের অগ্নিমূর্তি প্রকাশ পেল মুহূর্তেই। উচ্চস্বরে বলে উঠেন,
‘ আমার মেয়ের বিয়ে আর দেবনা। বিয়ে না হলে কি হবে? কি হবে? আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে। আমি এই সমাজের কাছে আমার মেয়েকে হেরে যেতে দেবনা। আমার মেয়ে তার নিজের পরিচয়ে বাঁচবে। সে কোনো অন্যায় করেনি। তারসাথে অন্যায় হয়েছে। সে অন্যায়ের শাস্তি সে দেবে। আমি আমার মেয়েকে হেরে যেতে দেবনা। আর এই সমাজের কথা আমি কানে কেন নেব? আমি একদিন উপোস থাকলে তারা আমাকে এসে খাওয়াবেনা। আমার দুঃখে যখন তারা হাসে,তখন তাদের কথা কেন আমি কানে নেব?

_______________

জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে আওয়াজ করে কেঁদে উঠল জিনিয়া। কেবিনের ভেতর থেকে এমন উচ্চস্বরে কান্নার আওয়াজ শুনে নাহিল দৌড়ে সাহিল আর জায়িদের কাছে গেল। জিনিয়ার জ্ঞান ফিরেছে শুনে জায়িদ পাগলের মতো দৌড়ে গেল। জিনিয়া ততক্ষণে বেড থেকে নেমে পড়েছে। জায়িদ দৌড়ে গিয়ে বোনকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। মাথায় ঘনঘন চুমু দিয়ে বলল,
‘ জুননু কাঁদিস না। কিচ্ছু হয়নি তোর। ওই শয়তানকে আমি তোর পায়ের কাছে এনে ফেলব। জুননু তুই কাঁদিস না প্লিজ। দেখ আমার কষ্ট হচ্ছে। তুই এভাবে কাঁদলে আমার খারাপ লাগে জুননু। কষ্ট হয় ভীষণ। নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
জিনিয়া পড়ে থাকে ভাইয়ের বুকে। এলোমেলো সুরে কাঁদতে থাকে৷ নিজের হাতের উল্টোপিঠে বসে থাকা স্পর্শ দেখে গা গুলায় ৷ ঘৃণায় বমি আসে। শরীর খারাপ করে। স্পর্শগুলো মনে পড়তেই গা শিউরে উঠে। দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারায় সে।
চিকিৎসা চলতে থাকে। অতিরিক্ত ভয় আর উত্তেজনায় স্বাভাবিক হতে পারেনা জিনিয়া। শফিক সাহেব আর জাহেদা এসে মেয়েকে ওই অবস্থায় দেখে আর ও ভেঙে পড়ল । তাদের হাসিখুশি মেয়েটার কি থেকে কি হয়ে গেল? সবকিছু শুরু হওয়ার আগেই কেন যেন সব শেষ হয়ে গেল।
শফিক সাহেবকে দেখার পর জিনিয়া আর ও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে। জাহেদা ভেঙে পড়ে। অসুস্থ হয়ে পড়ে। সাগর সাহেব আসে তাদের পিছুপিছু। জিনিয়াকে দেখে রাগ হয়, ঘৃণা হয় ওই পশুটার উপর। এই মেয়েটাকেই শেষ পর্যন্ত নিজের অপকর্মের হাতিয়ার বানাল? আর সেই পশুকে এরা চিনতে পারল না। ভালো করে না জেনে, না শুনে কেন মেয়েটাকে একটা পশুর হাতে তুলে দিতে যাচ্ছিল? শফিক সাহেবের উপর চাপা রাগ চেপে রাখে সাগর সাহেব। এই লোকটার জন্য হয়েছে সবকিছু।

____________________

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে, গলায়, কপালে, ঠোঁটের পাশে টুকরো টুকরো সাদা ব্যান্ডেজ দেখল জিনিয়া। নোংরা স্পর্শগুলো মনে পড়তেই নিজের উপর ঘৃণা উপচে পড়ছে। নিজেকে মনে হলো উচ্ছিষ্ট, নর্দমার কীট। কিন্তু সে তো নির্দোষ । সে কোনো অন্যায় করেনি। তাহলে তার সাথে কেন অন্যায় হলো? নির্দোষ মানুষগুলোর সাথেই কি তাহলে অন্যায় হয়?
নিজের উপর তীব্র বিতৃষ্ণা জন্মালো জিনিয়ার। হসপিটাল থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে সবাই ঘুমোতে গিয়েছে। জাহেদা বেঘোর ঘুম৷ জিনিয়া বিছানায় শোয়া মাকে একনজর দেখে রুম থেকে বের হয়ে গেল। বাবার রুমে গিয়ে বাবাকে দেখল। ভাইয়ের রুমে গিয়ে ভাইকে দেখল। তারপর গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলে গেল ছাদে। ছাদ থেকে নিচে তাকাতেই ডুকরে কেঁদে উঠল সে। কি করে লাফ দেবে এই এত উঁচু থেকে? আদরে যত্নে বড় করা মেয়েটিকে যখন রক্তাক্ত অবস্থায় নিচে পড়ে থাকতে দেখবে, তখন আব্বা আম্মার কি অবস্থা হবে? ভাইয়ের অবস্থা?
কিসের জন্য নিজের এতবড় ক্ষতি করছে জিনিয়া? কার জন্য? আত্মহত্যা যে মহাপাপ। একটা পশুর কাছে সে হেরে যাচ্ছে?
কিন্তু পরক্ষনে জিনিয়ার ঘৃণা হয় নিজের উপর। নিজের দিকে তাকালে মনে হয় নোংরা। অপবিত্র। সে কোনোদিন কি সাহিলের সামনে দাঁড়াতে পারবে? লোকটার ঘৃণামিশ্রিত চেহারা সে দেখতে পারবে না। ওই চোখদুটোর মাঝে দয়া সে দেখতে পারবেনা। রাস্তায় বেরোলেই লোকমুখে খারাপ কথা সে শুনতে পারবেনা। কিছুতেই না।

লম্বা চুলের একটি নারী অবয়ব দেখা যাচ্ছে ওই বাড়ির ছাদের মৃদুমৃদু লাইটের আলোয়। সাহিলের হাতে কফির মগ। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। কফির মগে চুমুক দিয়ে ছাদের নারী অবয়বটি ভালো করে দেখে মনে হলো, মেয়েটি ছাদ থেকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে একদম নিচে। সাহিলের বুক কেঁপে উঠল। তার হাত থেকে কফির মগ পড়ে আওয়াজ হলো। সেই আওয়াজ অনুসরণ করে জিনিয়া তাকালো সামনের দিকে। সাহিলকে দেখে বাক্যহীন তাকিয়ে থাকল।
সাহিল উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন। চট করে ফোন করল জায়িদকে। কয়েকটা লাগাতার টেক্সট পাঠিয়ে দিল। জিনিয়ার গন্ডদেশ বেয়ে একটুখানি খুশির জল গড়াল। যাক, শেষটায় দেখা হলো তবে।
সাহিল ডাক দিল,জিনি? এতরাতে এখানে কি করছ?
জিনিয়া উত্তর দিল না। সাহিল আবার বলল
‘ জিনি এতরাতে ছাদে দাঁড়াতে নেই। যাও ঘুমিয়ে পড়ো। জিনি শুনতে পাচ্ছ? এই মেয়ে?
জিনিয়ার আওয়াজ পাওয়া গেলনা। সে নিচে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। সাহিল চিৎকার দিল,
‘ জিনি খারাপ কিছু মাথায় একদম আনবেনা। জিনি কি ভাবছ তুমি? এইসব সামান্য ব্যাপার তুমি কেন বারবার ভাবছ? জিনি দেখো তোমার আব্বা আম্মার কথা চিন্তা করো। জিনি তাকাও এদিকে। আমার দিকে তাকাও। জিনি?
জিনিয়া বেশখানিক্ষণ পর ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। সদ্য ঘুম থেকে উঠা জায়িদ বোনকে দেখে দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরে। জিনিয়া ছোড়াছুড়ি করতে থাকে। হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে একদম অবশ হয়ে পড়ে যায় ভাইয়ের বুকে। কেঁদে কেঁদে সারা হয়। জায়িদ চোখ বন্ধ করে বোনের মাথায় মুখ লাগিয়ে রাখে। বলে,
‘ জুননু তোকে ছাড়া কিভাবে থাকব আমরা? এমন করিস না প্লিজ। তোর কিচ্ছু হয়নি জুননু।
জিনিয়া চোখ বন্ধ অবস্থায় কাঁদে। বলে,
‘ আমার ঘৃণা লাগছে নিজের উপর। কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া।
জায়িদের হাতের মুঠো ঘনঘন শক্ত হয়। রক্ত টগবগ করে ফুটে। প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠে।
শফিক সাহেব আর জাহেদা বেগম জিনিয়ার উদ্দেশ্য জানতে পেরে চোখের জল ছেড়ে দেয়।
জিনিয়ার মাথার কাছে বসে জাহেদা মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। শফিক সাহেব মেয়ের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে,
‘ আম্মা এত নরম কেন? শক্ত হও। এত দুর্বল হয়ে থাকলে আর ও আঘাত পাবে। এই সমাজ দুর্বলদের দুর্বলতা ধরেই আঘাত করে। তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি। তোমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে তার শাস্তি দেওয়ার জন্য হলেও তোমাকে শক্ত থাকতে হবে। তুমি পারবেনা? শাস্তি দিতে পারবেনা?
জিনিয়া মাথা দুলায় ঘনঘন। পারতে হবে তাকে। শফিক সাহেব হাসে। বলে,
‘ তুমি পারবে।

_________________

দলে দলে লোক আসল জিনিয়াকে দেখার নাম করে। তাদের আসল উদ্দেশ্য তো আসলে খোঁচা মারা। দুয়েক একজন জিনিয়ার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ জানালে ও বেশিরভাগই জিনিয়াকে নিয়ে নানান খারাপ মন্তব্য করে গেল। শফিক বাহবা দিলেন তাদের এই সভ্য সমাজকে।
জায়িদের কথা অনুযায়ী জিনিয়াকে কয়েকদিনের জন্য অন্য জায়গায় রাখলে ভালো হয়। এই ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। শফিক সাহেব জানালেন,
‘ এখানে কেউ থাকবেনা। অন্যকোথাও চলে যাবে বাসা ভাড়া করে। জিনিয়া স্বাভাবিক হলে চলে আসবে।
ঠিক তাই হলো। জায়িদ সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখল। সবকিছু গোছগাছ করার তোড়জোড় শুরু হলো জাহেদার।
খবরটি পৌছে গেল আহমেদ বাড়িতে। সাগর সাহেব দেখতে এল জিনিয়াকে৷ শফিক সাহেবের সাথে কথা বললেন না৷ জিনিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জায়িদ আর জাহেদা বেগমকে বললেন,
‘ জিনিয়া এখানেই থাকবে। এভাবে চলে যাওয়ার মানেই পালিয়ে যাওয়া। জিনিয়া এখানেই থাকবে। আর ওর বিয়ে ও হবে। আমি আমার ঘরে নিয়ে যাব ওকে। আমার ঘরের রাণী। আমার পুত্রবধূ হিসেবে।
জিনিয়া ঘুম। সাগর সাহেব জিনিয়ার মাথায় হাত বুলায় ঘনঘন। জায়িদ হতভম্ব। সাথে জাহেদা আর শফিক সাহেব। সাগর সাহেব তাদের বিস্মিত চোখ দেখে হেসে ফেললেন। বললেন,
‘ অন্তত না শব্দটা আমি আর শুনতে চাইনা। আমি জানি জিনিয়া ও এটাই চাইত। আফসোস তোরা জানতে চাসনি।
শফিক সাহেব অবাকসুরে বললেন,
‘ চাইত? কিন্তু?
সাগর সাহেব কটাক্ষ করে হাসেন। বলেন,
‘ কিন্তু কি? আমি যেটা বলেছি সেটাই হবে। এবার ও যদি মনে হয় সাহিল জিনিয়ার যোগ্য নয় তাহলে আমার আর কিচ্ছু বলার নেই। বাকিসব তোদের হাতে।
সাগর সাহেব এই বলে চলে গেলেন। শফিক সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। জিনিয়াকে বললে ও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলনা। কেমন নির্বাক, নিরুত্তর! এমন কেন?

আহমেদ বাড়ির ছাদে বাবা ছেলের কথাকাটাকাটি চলছে। জিনিয়া ছাদে যেতে গিয়ে ও গেলনা। ছাদের দরজার কাছে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কানে এল,
‘ আমি জিনিকে বিয়ে করতে পারব না বাবা। আমি ওকে ভালো রাখতে পারব না। আমাকে জোর করোনা।
জিনিয়া দেয়ালে চেপে গিয়ে হেসে ফেলল। আচ্ছা তারা বলেনা কেন,
‘ জিনিয়াকে বিয়ে করাই যায়না। অন্তত নোংরা হয়ে যাওয়া জিনিসকে কে মাথায় তুলে রাখতে চায়? রাস্তায় পড়ে থাকা ইটপাথরকে কেউ কখনো মাথায় তুলে রাখেনা। পা দিয়ে লাতি মেরে দূরে সরায়। জিনিয়া ও এখন সেই ইট পাথরের মতো উচ্ছিষ্ট।
সাগর সাহেব বুঝিয়েই গেলেন। আমি কথা দিয়ে ফেলেছি। তুই আমার সম্মানহানি করবি না সাহিল।
সাহিল ও বুঝিয়ে কূল পেলনা। জিনিয়া আর ও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। সে ঠকে যাইনি যে না পারতে সাহিলকে বিয়ে করতে হবে। সাহিল সাগর সাহেবকে বোঝানোর জন্যই বলল,
‘ আমি বিয়ে করব জিনিকে । কিন্তু কোনোদিন যদি জিনির মনে হয় সে আমার কাছে ভালো নেই সেদিন তার দায়ভার কিন্তু আমার না। তোমার।
সাগর সাহেব খুশিতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ সাবাশ ব্যাটা। তোর কাছে জিনি ভালো থাকবেনা, এটা হয় আদৌ? আমরা যাকে ভালোবাসি তারকাছে দুইবেলা উপোস থেকে ও ভালোআছি বলা যায়। নাহলে ভালোবাসা শব্দটা আছে কেন রে ?
সাগর সাহেবের এত এত খুশি সাহিলকে খুশি করতে পারল না। তার অনেক কাজ আজ থেকে। অনেক দায়িত্ব। এবার থেকে জিনিকে ভালোরাখার লড়াই। জিনিয়া নিজের ঘরে চলে গেল। ওই দুইচোখে যদি কখনো দয়া দেখা যায়? তার প্রতি মায়া দেখতে পায় তখন কি করবে জিনি? এই জিনিকে কি সত্যি ভালোবাসা যায়? অতবড় মন কার আছে? সাহিলের আছে?
সাগর সাহেবের কাছ থেকে চারটা দিন চেয়ে নিল সাহিল। এই চারটা দিন সাহিল বাড়ি ফিরল না। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সাগর সাহেব দিনে কয়েকবার করে দেখতে গেল জিনিয়াকে। জিনিয়ার সাথে জোর করে করে কথা বলল। এটা ওটা বলে জিনিয়াকে হাসানোর চেষ্টা করল।
নিজের আলমারিতে কাপড়ের ভাঁজে থাকা বড় সোনার গলার গহনাটি বের করে দিল তরিনা খাতুন। জিনিয়াকে পড়িয়ে দিয়ে দোয়া করে দিলেন। জিনিয়ার থুতনি ধরে মুখ তুলে বললেন আমি তোমার ও গ্রান্ডমা। আমাকে আজ থেকে গ্রান্ডমা ডাকবে। গুড্ডু এই চিরকুট তোমাকে দিতে বলেছে।
জিনিয়ার হাতের মুঠোয় একটি চিরকুট গুজে দিল তরিনা খাতুন। জিনিয়া নিল। তরিনা খাতুন ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ গুড্ডু কি লিখেছে আমাকে বলিও তো। আমাকে তো একদম না দেখতে বলেছে। কি লিখেছে আল্লায় জানে। চারটা দিন সময় কেন চাইল জেনে নিও৷ চার চারটা দিন কি কম সময়?
জিনিয়া মাথা নামিয়ে হাসি আটকাল। তরিনা খাতুন আবারও বলল,
‘ ওই নরপুরী এবার নারীপুরী হবে। আমার একটা সঙ্গী আসবে। কি যে খুশি লাগছে আমার?
জিনিয়া ও একটুখানি হাসল তরিনা খাতুনের সাথে তাল মিলিয়ে।
শফিক সাহেব দূর থেকে দাঁড়িয়ে হাঁফ ছাড়লেন। যাক মেয়েটা অন্তত তার চোখের সামনে থাকবে। মেয়েটা ভালো থাকলেই হলো। সাগর যত্নে রাখবে তার ছেলের বউকে। ভালো রাখবে। নিজের মেয়ের মতোই আগলে রাখবে। জাহেদা ও খুশি। আগে থেকে যদি এমন হতো তাহলে তার মেয়ের জীবনে ও-ই কালো দিবসটি থাকত না। আমরা আসলেই শুরুতেই কিছু বুঝিনা। বুঝতে চাইনা। বেশি ভালোটা খুঁজতে গিয়ে ভালোটাকেই হারায়। ধাক্কা খেয়েই পাক্কা হই। যাক শেষমেশ তাদের মেয়ে ভালো থাকলেই হলো।

___________________

মধ্যরাতে জিনিয়ার তেষ্টা পেল। গলা শুকিয়ে একদম কাঠ। ঘুমের ঘোরে কিসব আজেবাজে দেখল এখন মনে পড়ছেনা। কপালটা ঘেমে উঠেছে। জগ থেকে ঢেলে পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল সে । গায়ের সুতির ওড়না দিয়ে কপালটা মুছে নিল। ব্যান্ডেজ খসে পড়ায় ব্যাথা লাগল কপালে। আয়নায় দেখে দেখে আবার লাগিয়ে নিল। ফ্যানটা আর ও একটু বাড়িয়ে নিল। বিছানায় শোয়ার আগে মনে পড়ল বালিশের নিচে রাখা একটি চিরকুট। বালিশ সরিয়ে চিরকুটটি হাতে নিল সে। খুলল। গুটিগুটি হাতের লেখা। তাতে লেখা,

‘ আজ থেকে তোমার গায়ের কলঙ্ক আমি মেখে নিলাম।
সেই কালিতে যদি আমি কলঙ্কিত হয়,
দোষ আমার নয় বলে দিলাম।
আমি কলঙ্কিত মনে হলে, ছেড়ে যেতে পারবেনা কথা নিলাম।

কথা দিলে?

জিনিয়া গুটিগুটি অক্ষরে চিরকুটের নিচে লিখে ফেলল।

কথা দিলাম। নিলাম।

চিরকুটটি বালিশের নিচে রেখে দিল জিনিয়া। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজ হাতের লেখা অংশটুকু ছিঁড়ে ফেলল সে। সাহিলের লেখা টুকু যত্ন করে রেখে দিল।

___________________

চারদিন পার হয়ে সেই শুভক্ষণ আসল। নাহিল পুরো আহমেদ বাড়ি নিজ দায়িত্বে সাজাল। সাহিল ফিরল সন্ধ্যার দিকে। পুরো বাড়িটার অন্যরূপ দেখে চমকাল। নাহিলের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই নাহিল হেসে হেসে বলল,
‘ নরপুরী নারীপুরীতে পরিণত হচ্ছে বড়ভাই। সাজাবো না?
সাহিল কোনোকথা না বলে চলে গেল। সাগর সাহেবের খুশি দেখে কে? আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করবেনা বলে বলেও অনেক আত্নীয় স্বজনকে বলে রাখল। শফিক সাহেব কাউকেই ঘটা করে দাওয়াত করলেন না। জিনিয়ার মামার বাড়ি, আর চাচারা আসল শুধু।

প্রতিবেশীরা কানাঘুঁষা করলে কানে তুললেন না সাগর সাহেব। সাহিলের জন্য আর ও ভালো মেয়ে পেত। কথাটা সাগর সাহেব পাত্তাই দিলেন না। সাহিলের জন্য আর ও ভালো মেয়ের কি দরকার। সাহিল যার সাথে ভালো থাকবে তাকেই তো ভীষণ দরকার।

____________________

সীমান্তর দেওয়া শাড়িটা ছাদে নিয়ে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল জায়িদ। দাউদাউ করে জ্বলল লাল টকটকে বেনারসিটা। পুরো এলাকা ধোঁয়ায় রাঙিয়ে উঠল যেন। জিনিয়ার নতুন জীবনে পা রাখার সাক্ষী হলো এই ধোঁয়া।
গায়ে ভারী শাড়ি আর গহনার সাজ নিয়ে দৌড়ে ছাদে চলে এল জিনিয়া। কিছু পোড়ার গন্ধ নাকে আসছে। কি পুড়ছে?
পড়নের শাড়িটা সে খামচে ধরল। এই শাড়িটা সাহিলের দেওয়া। কলঙ্কহীন, পবিত্র ছোঁয়া শোভা পাচ্ছে শাড়িটাতে।
এভাবে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ নাকে আসায় আহমেদ বাড়ির সবাই ছাদে ছুটে আসে। জিনিয়া আর জায়িদকে কি যেন পোড়াতে দেখে। জিনিয়া ধোঁয়ার ধোঁয়াশা চোখে দেখতে পায় ওই দূরে কৌতূহল নিয়ে শীতল চোখে চেয়ে তাকিয়ে থাকা ছেলেটিকে। যার সাথে আজ থেকে জীবনের বাকিটা পথচলা শুরু। জীবনের প্রত্যেকটা ঘাত প্রতিঘাতে যে বিশ্বাস, ভরসা, আশ্রয়, শক্তি।

________________

বিয়ের শুভক্ষণে শফিক সাহেব সাহিলকে ডেকে নিলেন আলাদা করে। সাহিলের হাত ধরে বললেন,
‘ জিনির কিছু রোগ আছে। তা লুকোতে চাইছিনা তোমার কাছে। লুকোলে সমস্যা। ওই, মাঝেমাঝে ওর ভীষণ পেটব্যাথা হয়। পুরো শরীর ব্যাথা হয়। মাথা ব্যাথার সাথে জ্বর আসে অতিরিক্ত। অসুস্থ হয়ে পড়ে ভীষণ। তখন খেতে পারেনা, ঘুমাতে পারেনা। সেই সময়টাতে একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় তার। একটু দেখে রেখো। খাওয়া দাওয়ায় প্রচন্ড অনীহা। অনেকবার এক্সরে করিয়েছি তেমন সিরিয়াস কিছু ধরা পড়েনি।

তুমি ভালো রেখো তাকে। আগলে রেখো। আমি তোমার উপর বিশ্বাস রাখলাম। সাহিল তার অন্য হাত শফিক সাহেবের হাতের উপর রাখল। বলল,
‘ আমি ভালোরাখার দায়িত্ব নিয়েছি যখন, তখন ভালো রাখব আন্কেল। শেষপর্যন্ত আমি জিনিকে ভালো রাখব। কথা দিলাম আপনাকে। আমার এই কথার নড়চড় হবেনা। আমি হতে দেবনা।

শফিক সাহেব হেসে বুকে আগলে ধরেন সাহিলকে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
‘ চিন্তা হচ্ছে শুধু তোমার বাপকে নিয়ে, শালা এখন কত ব্ল্যাকমেল না করে আমাকে জিনিকে নিয়ে।
সাহিল হেসে ফেলল। বলল,
‘ আপনাদের ঝগড়া যুগের পর যুগ বেঁচে থাকুক।

কাজী বিয়ে পড়ালো। বর কনের মাঝে পাতলা একটি পর্দা। আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে হয়ত বধূবেশে বসে থাকা মেয়েটিকে। সাহিল ভ্রু কুঞ্চন করে দেখার চেষ্টা করল। ভাবল,
‘ বউ সাজলে নাকি প্রত্যেকটা মেয়েকে সুন্দর লাগে। কিন্তু এই মেয়েকে এমন লাগছে কেন? একেবারে জঘন্য। মারাত্মক জঘন্য। না না এরদিকে তাকানো যাবেনা। নইলে সর্বনাশ। সর্বনাশ। সাহিলের নিজের এতবড় সর্বনাশ কখনোই করবে না। কখনোই না। নো নেভার।
কাজী কবুল বলতে বলল জিনিয়াকে। জিনিয়া মা, বাবা, ভাইকে দেখে ফুঁপিয়ে উঠল। জাহেদা দৌড়ে এসে মেয়ের কাছে বসল। জিনিয়া মায়ের হাত খামচে ধরল। তারপর বলে দিল, কবুল করে নিল জীবনসাথীকে।
সাহিলকে বলতে বলল। সাহিল জিনিয়ার পাশে জাহেদাকে দেখল। কিন্তু তার আশেপাশে কোথাও তার মা নামক জীবটিকে দেখল না। উত্তেজনায়, আড়ষ্টতায় তিনবারের বদলে কবুল চারবার বলে ফেলল। এই নিয়ে হাসাহাসি হয়ে গেল একদফা। নাহিল সাহিলকে পিঞ্চ করে বলল,
‘ বড়ভাই একটা এক্সট্রা বলেছ কেন?
সাহিল নাহিলের হাত চেপে ধরল। বলল,
‘ এই ভরা মানুষের মাঝে আমার ইজ্জত সম্মান প্লাস্টিক করিস না ভাই আমার।
নাহিল হো হো করে পর্দা সরিয়ে জিনিয়াকে বলল,
‘ ভাবিজান শ্বশুড়বাড়ি কিসে করে যাবেন বলে ফেলুন। পালকি করে যাবেন নাকি ঘোড়ার গাড়ি করে যাবেন?
জিনিয়া মাথা তুলল না। সাহিল তার কোলে থাকা পাগড়ি নাহিলের মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এইবার তোর বউ কখন আসবে সেটা বল।
নাহিল চুপ হয়ে গেল।
জিনিয়া মাথা তুলে নাহিলকে ওই অবস্থায় দেখে হেসে ফেলল। নাহিল লজ্জা পেয়ে উঠে চলে গেল। নাহিল উঠে যাওয়ায় জিনিয়াকে আর ও লজ্জায় ঘিরে ধরল। সাহিল মাথার পেছনের চুল চুলকাতে চুলকাতে বলল,
‘ শোনো মেয়ে আমি তোমার দিকে একটুও তাকাচ্ছি না। তাকাব ও না। নো নেভার। লজ্জা পেয়ে কাজ নেই।
জিনিয়া মাথা আরও নামিয়ে ফেলল। সাহিলের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে যখন মাথা তুলল। চোখাচোখি হয়ে গেল চারচোখ। সাহিল মাথার চুল চুলকাতে চুলকাতে আড়চোখে জিনিয়াকে দেখল। আড়চোখে পূর্ণ দৃষ্টিতে পরিণত হলো। গায়ের হলুদাভ রঙের সাথে ডাগর ডাগর চোখ, চিকন ভুরু, নাক, কচি কিশলয়ের মতো ঠোঁট, সুদীর্ঘপল্লবযুক্ত আঁখিজোড়া। গালের দুইপাশে অজান্তে পড়ে যাওয়া দুইটাগর্ত। সাহিল চোখ পিটপিট করে বিড়বিড় করল,
‘ মাশাল্লাহ। মারাত্মক। জঘন্য।

জিনিয়া কিছু শুনতে পেলনা। সে চোখ একবার নামিয়ে আবার তুলে দেখল,
‘ শ্যামবর্ণের লোকটির বড় চেহারা, পুরু ভ্রুজোড়া, নাক, ঠোঁট আর চোখের দৃষ্টিতে ও মেশানো প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব আর মায়া। জিনিয়া বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, কালাই গলার মালা।

সাহিল জিনিয়ার ঠোঁটের কোণার হাসি দেখে ভ্রুকুঞ্চন করল। একটু ঝুঁকে বলল,
‘ শেষমেশ আমার হয়ে গেলে?
জিনিয়ার চোখের দৃষ্টিতে কতশত কথা। সাহিল পড়তে পারে একটি,
‘ আমি তো হতেই চেয়েছি। আপনি চাননি।
সাহিল বলল,
‘ এই যে চেয়েছি। এখন ও বলবে চাইনি?
জিনিয়া বলল,
‘ এর পেছনে ও নিশ্চয় কারণ আছে। হুট করে একদিন না হয় জানতে চাইব সেই কারণ। বলবেন না?
সাহিল জবাব দেওয়ার আগে কয়েকটা মেয়ে জিনিয়াকে নিয়ে যায়। সাহিল কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘ আমার বউ আমার সাথে কথা বলছে, এদের এত গায়ে জ্বালা কেন বুঝিনা।
জিনিয়া পিছু ফিরে সাহিলের বিরক্তিমাখা মুখটা দেখল। হেসে আবার ফিরে গেল। সাহিল বলল,
‘ হাসার কি আছে আশ্চর্য?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here