রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-৭

0
730

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[৭]

খাবার টেবিলে দুই ভাই বোনের ঝগড়া। জায়িদের একটু বেশিই ভালোলাগে বোনকে রাগিয়ে দিতে। জিনিয়ার পাত থেকে মাছ তুলে সে খাওয়া শুরু করল। জিনিয়া নাক মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। আর খাবে না বললে শফিক সাহেব চড়া হলেন ছেলের উপর। তুই আমার মেয়ের পাত থেকে খাবার কেন কেড়ে নিবি?
জায়িদ হাসল। জিনির গাল টেনে দিয়ে বলল,জুনননু তুই শ্বশুড়বাড়ি যাবি? যাহ। কিন্তু মনে রাখিস আমি সেখানে ও যাব তোর খাবার থেকে ভাগ বসাতে।
জিনিয়া গাল ঢলতে ঢলতে বলে,
‘ তুমি জীবনে ও বউ পাবেনা ভাইয়া। দেখে নিও। জায়িদ হাসল৷ বলল,
‘ আমি চাইলে বউ এখন লাইন ধরবে।
জিনিয়া বলল,
‘ তোমার হাতের ডান্ডা দেখলেই বউ ভয়ে পালিয়ে যাবে।
শফিক সাহেব মেয়েকে সমর্থন করলেন। জাহেদা বলল,
‘ আর কথা পাসনা? আমার ছেলের বউ নিয়ে আসব তুই শ্বশুরবাড়ি যাহ আগে।
জিনিয়া বলল,
‘ আমাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচো তোমরা।
শফিক সাহেব বলল,
‘ এভাবে বলছ কেন আম্মা? তোমাকে তাড়াব কেন? তোমাকে তো ভালো ছেলের হাতে তুলে দিচ্ছি। তোমার একটা সংসার হবে। আমরা চাই তুমি ভালো থাকো।
জিনিয়া বলল,
‘ সীমান্ত ব্যাটার জীবনটাই আমি ত্যানা ত্যানা বানিয়ে ফেলব। দেখে নিও।
সবাই একসাথে হো হো করে হেসে। শফিক সাহেব বলল,
‘ সাগর মিয়ারে সবার আগে আসতে বলব এখানে, শালা কয়বার বিয়ে ভাঙছে আমার মেয়ের। শেষ রক্ষে আর হলোনা।
সবাই হাসল কিন্তু জিনিয়া হাসল না। খাওয়া শেষ করে চলে গেল।

___________________

বিয়ের কেনাকাটা করার জন্য শপিংমলের পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা ছিল সীমান্তর । কিন্তু জিনিয়া প্রায় আধঘন্টার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে ও দেখা পাওয়া গেলনা সীমান্তর। জিনিয়া উঁচু পিলারের সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সীমান্ত এল তার অনেকক্ষণ পর। তার পিছু পিছু শপিংমলে ডুকে পড়ল জিনিয়া। সীমান্ত এটা ওটা জিজ্ঞেস করলে ও কোনো উত্তর পেলনা জিনিয়ার কাছ থেকে। পছন্দের শাড়িটি হাতে নিল। জিনিয়াকে বলল,
‘ পছন্দ?
জিনিয়া মাথা দুলিয়ে সায় জানাল। সীমান্ত জিনিয়ার মাথায় পড়িয়ে দিল একটুখানি। পড়ানো শেষ হতে না হতেই তাদের সামনে কোথাথেকে একটা লোক এসে মুখ থুবড়ে পড়ল জিনিয়ার পায়ের কাছে। জিনিয়া চেঁচিয়ে উঠল। সীমান্তর পেছনে গিয়ে শার্ট আঁকড়ে ধরল। লোকটির মুখে কাটাকাটা দাগ। বীভৎস চেহারা। মাথার লম্বাচুলগুলো পেছনে ঝুটি করা।
জোরে লোকটার মুখ বরাবর লাতি বসাল সাহিল। জিনিয়া কে লাতি মারা লোকটিকে দেখল না। পড়ে গড়াগড়ি খাওয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে চেঁচাতে থাকল। সীমান্ত বলল,
‘ জিনিয়া শান্ত হও। এরকম করোনা। জিনিয়া?
সাহিল মাথা নিচু করে শার্টের কলার ধরল লোকটার। গালে ইচ্ছেমত চড় বসিয়ে তীব্র আক্রোশ নিয়ে বলল,
‘ আমার মা কোথায় বল? বল? জীবন্ত কবর দেব নইলে। বল তাড়াতাড়ি।
লোকটা কথা বলতে পারল না। জিনিয়া যেন নড়াচড়া করতে ভুলে গেল। পা কাঁপতে লাগল তরতর করে। মাথার ভেতর আওয়াজ হলো ঝিমঝিম। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ল। মাথার ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগল। এত হিংস্র রূপ? কখন ফিরল লোকটা?
সাহিল গলা চেপে ধরল লোকটার। আশেপাশের কেউ ছাড়াতে আসছেনা। সীমান্তকে ঠেলল জিনিয়া। লোকটাকে মেরে ফেলবে, ছাড়তে বলুন। যান না। ওনি কি পাগল হয়ে গেছেন?
সীমান্ত বলল,
‘ আমি আটকাতে গেলে আমাকে ও দেবে। মরবে না, ওই গুন্ডাগুলো মরেনা। এমন মাইর এরা রোজ খায়। দেখতে পাচ্ছ না? মাইর খাচ্ছে এত, কিন্তু তারপর ও স্বীকার করছেনা।
জিনিয়ার গলা শুকিয়ে এল। ভাইয়া যদি ওনাকে এভাবে মারতে দেখে নির্ঘাত জেলে ডুকাবে।
সাহিল আর ও জোরে গলা চেপে ধরল। রক্তবর্ণ চোখদুটো হিংস্র বাঘের দপদপ করছে৷ গলার রগ ভেসে উঠেছে। জিনিয়া অবাক না হয়ে পারল না। এই লোকটার এত রাগ? মরে যাবে ওই লোকটা।
সাহিল আর ও জোরে চেপে ধরে। লোকটা কোনোমতে বিড়বিড় করে বলল,
‘ ভয় দেখানোর জন্য মিথ্যে বলেছি। আপনার মায়ের খবর জানিনা আমরা। সত্যি জানিনা।
জিনিয়া সাহিলের হাত ধরে। টানতে টানতে বলে,
‘ ছেড়ে দিন। মরে যাবে। আপনারই ক্ষতি হবে। এখানে অলরেডি পুলিশ আসছেন। শুনছেন? ছেড়ে দিন না। আল্লাহ!!!
মরে যাচ্ছে তো। এভাবে কেউ ধরে? ছাড়ুন।

সাহিল এক ধাক্কা দেয় জিনিয়াকে। জিনিয়া গিয়ে পড়ে দোকানে রাখা সেই লোহার চেয়ারে। সীমান্ত উচ্চাস্বরে ডাক দেয়,
‘ জিনিয়া?
জিনিয়ার কপাল ফুলে যায় সাথে সাথে। সামান্য ছিলে যায়। সীমান্ত গিয়ে ধরে জিনিয়াকে।
সাহিল ‘ জিনিয়া ‘ ডাকটি শোনার সাথে সাথে ফিরে জিনিয়ার দিকে। কপালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়া মেয়েটিকে দেখে নিজের দুহাতের দিকে তাকায়। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ে অবিরত। নিজের দুপায়ের ফাঁকে পড়ে থাকা লোকটি সরে পড়ে সুযোগ পেয়ে। সবার চোখের আড়াল হয় প্রাণপণে। সাহিল জিনিয়ার কাছে ছুটে যায়। ধরতে গিয়ে বাঁধা পায়। সাহিল অগ্নিচক্ষু দিয়ে সীমান্তকে দেখে। সীমান্ত জিনিয়াকে ধরতে বারণ করে সাহিলের কানেকানে ফিসফিস করে বলে,
‘ ও আমার হবু বউ । অন্তত তাকে একটু ছাড় দে ভাই।
সাহিল সীমান্তর হাত ছিটকে ফেলে দেয়। জিনিয়া কপাল ধরে বসে থাকল। সাহিল এপাশ-ওপাশ করে বলল,
‘ আইস? আইস কোথায় পাব? জিনি? বেশি কষ্ট হচ্ছে?
জিনিয়া কপাল থেকে হাত সরায়। ফুলে গেছে। ফুটো দিয়ে সামান্য সামান্য রক্ত দেখা দিচ্ছে। যন্ত্রণা হচ্ছে।
জিনিয়ার সেদিকে ত্রুক্ষেপ নেই। সে সাহিলের দিকে তাকাল বহুকষ্টে। বলল,
‘ আপনার মা কোথায়?
সাহিল বলল,
‘ তোমার কপাল ফুলে গেছে। প্রশ্ন পরে করো। সীমান্ত হুট করে যেন কোথায় গেল।
সাহিল জিনিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই জিনিয়া আটকালো। বলল,
‘ আমার কিচ্ছু হয়নি। ব্যস্ত হবেন না। আমি বিয়ের কেনাকাটা শেষ হলেই চলে যাব।
সাহিল বিক্ষুব্ধ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ চুলোয় যাক বিয়ে।
জিনিয়া হাত ছাড়িয়ে নিল তাড়াতাড়ি। বলল,
‘ জোর করবেন না। অধিকার দেখাবেন না।
সাহিল দাঁড়িয়ে রইল। ফিরতি কোনো প্রশ্ন করল না জিনিয়াকে। জিনিয়া খেয়াল করল সাহিলের হাতে, গলায় রক্ত। জিনিয়া টিস্যু বের করে দিল। সাহিল নিল না। বিড়বিড় করে বলল,
‘ তুমি সীমান্তকে বিয়ে করতে পারো না জিনি।
জিনিয়া হাসল। বলল,
‘ মিনমিন করে বলছেন কেন? একটু জোরে বললে আমার আর ও একটু ভালো লাগত।
সাহিল হাতের মুঠি শক্ত করে চোখ বন্ধ করে। আবার খুলে জিনিয়াকে বলে,
‘ আজ কোনো কেনাকাটা হবেনা।
সীমান্ত বরফ এনে জিনিয়ার কপালের কাছে ধরে। বলে,
‘ তো কি হবে? আজ কেনাকাটায় হবে।
সাহিলের চোখ দেখে ভড়কালো না সীমান্ত। জিনিয়া থাকায় বলল,
‘ আপনি এখন আসতে পারেন ভাই। যা শুরু করে দিয়েছিলেন? কি অবস্থা করেছেন জিনিয়ার?
সাহিল জিনিয়ার দিকে তাকায়। বলে,
‘ জিনি চলো হসপিটালে নিয়ে যাই। তোমার কপাল ফুলে গেছে।
সীমান্ত হাসল। বলল,
‘ এত বড় একজন ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে আপনার সামনে আপনি বুঝতে পারছেন না?
সাহিল দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বলে
‘ পেয়েছি। আর এই ডাক্তার কত বড় অকর্মা সেটা ও বুঝতে পেরেছি। নইলে এই মেয়ের কপালে এতক্ষণে ব্যান্ডেজ লাগানো থাকত।
সাহিল গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। জিনিয়া কপালে হাত চেপে ধরে বলল,
‘ আমি বাসায় ফিরব। শরীর খারাপ লাগছে আমার। লিস্টে যা আছে তা কিনে ফেলুন৷ আমার বিশেষ পছন্দ নেই।

রিকশা থেকে ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে ডুকে পড়ল জিনিয়া। কপালের পাশে এতবড় ফোলা দেখে চমকাল জাহেদা। চেঁচিয়ে দৌড়ে এল। বলল,
‘ কে করেছে এমন অবস্থা? এ্যাহ?
জিনিয়া মাথা এলিয়ে দিল। ক্লান্ত চোখ দুটো বন্ধ করে নিজের কাছে নিজেই বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমি যাকে সর্বস্ব দিতে চেয়েছিলাম সে আমাকে আঘাত করল আম্মা। ওই লোকটা এমন কেন? এই আমার বিয়ে টিয়ে এসব শুনে ওনার কি হৃদয় কাঁপেনা? কষ্ট হয়না? কেন হয়না? ওনি যে বলেছিলেন আমাকে ভালোবাসেন। আমার সামনে একবার তো স্বীকার করেছিল। তাহলে এখন এত চুপ কেন? এখন কি এভাবে গুটিয়ে থাকার সময়? এতদিন কোথা থেকে এল লোকটা?
জাহেদার চেঁচামেচি কানে গেলনা জিনিয়ার। শফিক সাহেব বাসায় ফিরে চরম অবাক হলেন। জায়িদ আসামাত্রই বলল,
‘ সাহিলের হাতে আঘাত পেয়েছে। ও ধাক্কা মেরেছে।
রাগে দুঃখে জিনিয়া সীমান্তকে ফোন দিয়ে কথা শুনিয়ে দিল। বলল,
‘ ওনার নাম নেওয়ার কি দরকার ছিল? ভাইয়াকে কেন এসব বলেছেন?
আব্বা আর ভাইয়া এমনিতেই ওনার পরিবারের কাউকে সহ্য করতে পারেনা। আর আপনি?

সীমান্ত রেগে বলল

‘ তুমি আমাকে মিথ্যে বলতে বলছ?

‘ প্রয়োজন হলে মিথ্যে বলবেন।

‘ ঠিক আছে। আমি ফোন করে বলে দেব স্যারকে যে ধাক্কা আমিই মেরেছি, সাহিল নয়।
জিনিয়া ফোন রেখে দেয় রাগে। দিশেহারা হয় সে । কি করছে সে? কি হচ্ছে তার সাথে?
কেউ ভালো থাকবেনা এসবে। না সে। না সীমান্ত।

হলুদ সন্ধ্যা। সকাল থেকে নতুন অতিথিদের আনাগোনা পুরো তালুকদার বাড়ি। জায়িদের তদারকিতে সবকিছু। একমাত্র বোনের বিয়ে বলে কথা। শফিক সাহেব ঘটা করে দাওয়াত দিয়ে আসলেন সাগর সাহেবকে। দুজনের কথা কাটাকাটি হতে যাচ্ছিল। নাহিল আটকালো। সে না থাকলে হয়ত তুমুল ঝগড়া লেগে যেত।
গায়ে হলুদ কমলা শাড়ি পড়িয়ে আনা হলো জিনিয়াকে। সীমান্তকে বিশেষ অনুরোধ করে ডেকেছে জিনিয়া। সীমান্ত মহা খুশি। বউ তাকে চোখে হারাচ্ছে।
জিনিয়া সবার চক্ষুর আড়াল হয়ে সীমান্তকে ডেকে নিল ছাদে। লাইটিংয়ের আলোয় আলোকিত ছাদ।
এদিকওদিক তাকিয়ে জিনিয়া চলে এল। সীমান্ত আগে থেকেই ছাদে ছিল। দরজা বন্ধ করে আসা মেয়েটির গায়ে গাঢ় কমলা পাড়ের হলুদ শাড়ি। মাথায় গাজরা। হলুদাভ গায়ের রঙের সাথে মিশে একাকার গায়ের পড়নের শাড়ি। সুদীর্ঘপল্লব নয়নজোড়া চোখে পড়তেই কেঁপে উঠে সীমান্ত। নানা কামনা বাসনা জেগে উঠে। নিজের এই অবাঞ্ছিত বাসনাকে পাত্তা না দিয়ে সীমান্ত গলা ছাড়ল,
‘ এখানে কেন ডেকেছ জিনিয়া? খুব বিশেষ কিছু?
জিনিয়া অসহায়, নিষ্প্রাণ চোখে সীমান্তর দিকে তাকাল। সীমান্ত তরল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কিছু বলবে?
জিনিয়া বলার জন্য আকুপাকু করতে লাগল। কিন্তু বলে উঠতে পারল না। সীমান্ত তার এক হাত জিনিয়ার মুখে ছোঁয়ায়। জিনিয়া শিউরে উঠে। সীমান্ত সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলে,
‘ কি হয়েছে?
জিনিয়া বলল,
‘ আমার এই বিয়েতে মত নেই। আপনি ভালো থাকবেন না আমার সাথে। আমি ও ভালো থাকব না।
সীমান্ত তার দুইহাত দিয়ে আগলে ধরল জিনিয়ার মুখ। ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ কিন্তু আমি তো আপনার কাছেই ভালো থাকব ম্যাডাম। আর আপনাকে ভালো রাখার দায়িত্ব এই আমার। এখন এসব বলে কি হবে জিনিয়া? স্যার কষ্ট পাবে। তোমার কেন মনে হচ্ছে তুমি আমার কাছে ভালো থাকবেনা।
জিনিয়ার নাক কেঁপে কেঁপে উঠে। সীমান্ত তার কপালে কপাল ঠেকানোর সাথে সাথে জিনিয়া দূরে সরে পড়ে। আমতাআমতা করে দুই পা পিছু হেঁটে পিছু করে দাঁড়ায় সীমান্তকে। নীরবে জল গড়ায় গন্ডদেশ বেয়ে। শাড়ির ধরে শক্ত করে। সীমান্ত পেছনে এসে দাঁড়ায়। জিনিয়ার একহাতের ভাঁজে এক হাত নিয়ে কানের পাশে এসে শ্বাস ছাড়ে। জিনিয়া দৌড়ে দরজা খুলে চলে যায়। সীমান্ত বলল,
‘ এই যাহ, চলে গেল। এত আয়োজন করে তাহলে ডাকল কেন? আশ্চর্য!
সীমান্ত হাতের ভর দিয়ে দাঁড়ায় রেলিঙে। দপদপ করে দুটো চোখ দেখা যায় ওই বাড়ির ছাদে। সীমান্ত মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে বলে,
‘ ভাই আমার। বিয়েটা আটকে দেখা।
শীতল চক্ষু দিয়ে সীমান্তর দিকে তাকিয়ে থাকে সাহিল। রেলিঙে হাতের মুঠি দিয়ে আঘাত করে বলে,
‘ তুই যদি সাহিলের চাইতে ভালো হতি, আল্লাহ কছম আমি তোর হাতে জিনিয়াকে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু তুই তো তা নস কুত্তার বাচ্চা। তুই তার চাইতে ও বেশি জঘন্য। তুই যেমন চরিত্রহীন, তেমন জঘন্য একটা মানুষ।
সীমান্ত দাঁত দেখিয়ে হাসে। বলে,
‘ তুই তো ভালো মানুষ আমার চাইতে। তো তুই ছাড়লি কেন ভাই? এত উদার কেন তুই?
সাহিল দাঁতের সাথে দাঁত চেপে উত্তর দিল।
‘ আমি জিনিয়ার ভালো চাই যেকোনোভাবে। তাই ওকে আমরা সাথে জড়াতে চাইনা। কিন্তু আমি তোর মতো জঘন্য মানুষের সাথে ও জড়াতে দেবনা। তোকে আমি এমনভাবে ফাঁসাব। তুই পালিয়ে কূল পাবিনা।
সীমান্ত হো হো করে হাসে। বলে,
‘ তোর বাবার বন্ধুর নাম কি যেন? ও হ্যা ইয়াজিদ সাহেব । ওনি দেশে ফিরছেন । কালই। আর কালই আমার বিয়ে। তুই যদি কিছু করার চেষ্টা করিস তাহলে আমি ও কিছু করব।
সাহিল থেমে যায়। গলার স্বর খানিকটা নিচে নামিয়ে বলে,
‘ ইয়াজিদ সাহেব এখানে আসছেন কেন? আর আমাকে জানাননি কেন?
সীমান্ত আর ও জোরে হাসল। বলল,
‘ তোকে বলব কেন? টা টা, যাই আমি। বিয়ে বলা কথা। তুই ও আসিস। প্রেমিকার বিয়ে বলে কথা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে দেখবি আর ইয়া বড় বড় ছ্যাঁকা খাবি। ভীষণ ভালো হবে। আর আমাকে বলবি কিন্তু ছ্যাঁকা মিষ্টি,ঝাল,টক নাকি তিতা?

বলতে না বলতেই সীমান্ত উচ্চস্বরে হাসল। সাহিল হাতের মুঠি শক্ত করল। বলল,
‘ যে হাত দিয়ে ছুঁয়েছিস ওকে সেই হাত যদি আমি না কাটি তোর? কুত্তার বাচ্চা আর সাহস দেখাস?
সীমান্ত ঘাড়ে হাত ম্যাসাজ করে। হাসে পাগলের মতো। হুট করে থেমে গিয়ে বলে,
‘ ভীষণ ভয় পেয়েছি। ছুঁবোনা?
সাহিল ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সীমান্ত হেসে বলল,
‘ বাসর রাতের ফুটেজ তোকে দিয়ে দেব। সমস্যা নেই। শুধু বিয়েতে ঝামেলা করিস না ভাই।
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় সাহিল। সে ভাবতে পারছেনা এই ছেলেটার সাথে কি করে জিনি বাকি জীবন কাটাবে? তার চাইতে তো তার কাছে থাকলে ভালো থাকবে। জিনিয়ার বেশি ভালো চাইতে গিয়ে কি সে কোনো বড় ভুল করে ফেলল? এই ছেলেটার চাইতে ও তো সে ভালো রাখতে পারবে জিনিকে। এই নোংরা মনমানসিকতার ছেলে শুধু তার প্রয়োজনে জিনিকে বিয়ে করছে। তার কাজের হাতিয়ার হিসেবে জিনিকে ব্যবহার করার জন্য। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই ছেলের বিয়ে করা বউ কিংবা প্রেমিকা আছে। একটা না অনেকগুলো। যার কথায়, ইশারায় মেয়ে উঠবস করে। সাহিল কি করে এর হাতে জিনিকে ছাড়বে? জেনেশুনে এতবড় ভুল কি করে করবে? সারাজীবন অপরাধবোধে ভুগতে হবে তাকে। তার চাইতে সে যদি? কিন্তু ভবিষ্যৎ?
সাহিল আর কিছু ভাবল না। চলে গেল। সীমান্তর হাসির আওয়াজ কানে এল অবিরত। নাহিল, সাহিলের এই অস্থির পায়চারি দেখে চিন্তিত হলো। বলল,
‘ ভাই বিয়ে বাড়ি যাবেনা? আমি তো খেয়েদেয়ে পেট তাজা করে আসছি। এই দেখো পেট কত বড় হয়ছে?

সাহিল লাতি বসালো চেয়ারে৷ নাহিল ভয় পেয়ে গেল। সাগর সাহেব আর সাজেদ সাহেব দৌড়ে এল। সাগর সাহেব সাহিলকে একপলক দেখে হাসল আনমনে। নাহিলকে বলল,
‘ বাছাধন চলো সবাই বিয়ে বাড়ি যাই। এত দামী দামী গিফট দিচ্ছি, আর খাব না?
নাহিল হাসল। সাহিল সাগর সাহেবের দিকে তাকাল। বলল,
‘ এই বিয়ে হবেনা। সীমান্ত জঘন্য একটা ছেলে তা আমার চাইতে বেশি কেউ জানেনা। আমি এই বিয়ে হতে দেব না।
সাগর সাহেব গোঁফে আঙুল ঘষে বললেন,
‘ সিনেমার হিরোদের মতো ডায়লগ।
সাহিল আর ও এক লাতি বসায় চেয়ারে। বলল,
‘ আমি যেটা বলি সেটা করে দেখায়।
সাগর সাহেব এবার চিন্তিত হন। কড়া কন্ঠে বলেন,
‘ কি করবি তুই?
সাহিল বলে গেল,
‘ লাশ ফেলব নয়ত জেলে ডুকাবো।

_______________

দামী শাড়ি, গহনা গায়ে জড়ানো হলো জিনিয়ার। হাতের মেহেদীর মাঝখানে লিখা এস লেটার। কিন্তু মিনিংটা আজ অন্য কারো নামের। হাতের উপর টপটপ টপটপ দুফোঁটা জল গড়াল৷ জিনিয়া চোখ মুছল জাহেদার আগমনে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন অনেকক্ষণ জাহেদা । জিনিয়া মায়ের বুকে গুজে গিয়ে মিনমিন করে বলল,

‘ আম্মা এই বিয়েটা কেন থেমে যাচ্ছেনা৷ আমি কেন থামাতে পারছিনা। সীমান্তকে বিয়ে না করার কোনো কারণ কেন খুঁজে পেলাম না আম্মা। আব্বার কাছে কোনো কারণ নিয়ে কেন দাঁড়াতে পারলাম না আম্মা? সীমান্তকে আমি ভালো রাখতে পারব না আম্মা। আমার মন যে অন্য কারোজন্য মন কাঁদে। এতবড় পাপ কি করে করব আমি আম্মা? কি করে সীমান্তর সাথে অতবড় অন্যায় করব? শেষপর্যন্ত আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছিনা। আমি কি করে একটা পাষাণ মানুষকে ভালোবাসলাম আম্মা? এতবড় ভুল আমি কি করে করলাম? আমার মরতে ইচ্ছে করছে আম্মা। আমি কেন মারা যাচ্ছি না।

জাহেদা মেয়ের মুখ থেকে বিড়বিড়িয়ে বলা কথা বুঝতে না পেরে ডাকে,
‘ জিনু? ওমা অমন করছিস কেন? কি হয়েছে? এভাবে কাঁদতে আছে? মেয়ে যখন হয়েছিস পরের বাড়ি যেতে তো হবেই। এভাবে কাঁদিস না মা।
জিনিয়া মায়ের বুক থেকে মাথা তুলতেই ভেসে আসে বর এসেছে শব্দ। মুখোরিত পুরো তালুকদার বাড়ি। জিনিয়া আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাকে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠে পাষাণ এক চেহারা। এতটা পাষাণ কি করে হয় মানুষ? এতটা?
জায়িদ না থাকায় জিনিয়া আর ও জোরে আওয়াজ করে কাঁদল। এজন্য বোধহয় ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলেছিল,
‘ জুননু খুব তাড়াতাড়ি আসব আমি। জরুরি কাজে বেরোচ্ছি।
অভিমানে হৃদয় হলো ভার। ক্ষতবিক্ষত হলো হৃদয়। বুকের ভেতর এক আকাশ যন্ত্রণা নিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো জিনিয়াকে। জিনিয়া আজব বনে গেল। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওই লোকের ভীড়ে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকা পান্জাবী পড়া শ্যামবর্ণের পুরুষটিকে দেখে। এই পাষাণ, হৃদয়হীন মানুষটা এখানে কেন এসেছে? বিয়ে দেখতে এসেছে? পোলাও মাংস খেতে এসেছে?
জিনিয়ার চোখাচোখি হওয়ায় সাহিল চোখ সরিয়ে মজে গেল পাশের লোকটার সাথে কথায়।

সীমান্তর চোখেমুখে বিশ্বজয়ের হাসি। তার চাচা এসে তাড়া দিল কাজীকে। যাতে তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়ানো হয়। কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করল। শফিক সাহেবের ফোনে কল এল। তিনি ফোন কানে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়ে আবার ফিরে এলেন। বললেন,
‘ আমার ছেলে আসলে বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। তার আগে নয়। ওর একমাত্র বোন। ও নিজ চোখে বিয়ে দেখতে চাই। একটু সবুর করুন। ও চলে আসছে।
সীমান্ত হাসল। বলল,
‘ সমস্যা নেই স্যার। অপেক্ষা করতে পারব। জিনিয়ার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিল। বলতে পারব?
শফিক সাহেব মাথা দুলিয়ে বলে,
‘ হ্যা হ্যা কেন নয়। যাও। ওখানে যাও। নয়ত ছাদে যাও। তেমন কেউ নেই। কথা শেষ করে চলে এসো। জায়িদ এখুনি আসবে। আর হ্যা বাবা ডাকতে শিখো।
সীমান্ত হেসে মাথা চুলকালো। জিনিয়ার হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ খুব জরুরি কথা জিনিয়া। বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে।
জিনিয়া আগেপিছে কিছু না ভেবে উৎফুল্ল মনে হেসে গেল সীমান্তর সাথে।
ফোনে কথা বলা শেষ করে সাহিল সামনে থাকাতেই সীমান্তকে দেখতে পেলনা। জিনিয়াকে ও না। দৌড়ে স্টেজের আশেপাশে তাকালে ও দেখতে পেলনা কাউকে। সাহিল দৌড়ে গেল নাহিলের কাছে। বলল,
‘ জিনিয়া কোথায়? আর সীমান্ত?
নাহিল বলল,
‘ কথা বলার জন্য কোথাও গেছে বোধহয়। সাহিল লোকলজ্জা ভুলে বাড়ির অন্দরমহলে ডুকে পড়ল। এই ঘর ওই ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজল। কোথাও পেলনা তাদের। শফিক সাহেব পায়ের উপর পা তুলে বসল। গল্পে মজে গেল বিয়েতে আসা অতিথিদের সাথে। সাগর সাহেবকে পিঞ্চ করে কথা শোনাচ্ছে। সাগর সাহেব ও পায়ের উপর পা দিয়ে রাখল। শফিক সাহেবের মুখের উপর পাল্টা জবাব দিতে লাগল। শফিক সাহেব মনে মনে বলল,
‘ আমার বাড়ি এসে তুই আমার মুখে মুখে কথা বলস? এত বড় সাহস? বিয়েটা মিটে যাক। দেখ তোকে কি করি আমি?

ছাদে দরজা বন্ধ করে দিল সীমান্ত। জিনিয়া বলল,
‘ দরজা বন্ধ করছেন কেন? এখন কেউ আসবেনা। আর আমাদের কথা কেউ শুনতে ও পারবেনা।
সীমান্ত জিনিয়ার খুব কাছাকাছি এসে জিনিয়ার ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বলল,
‘ চুপ। একদম চুপ।
জিনিয়া ভয়ার্ত চোখে তাকাল। শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলার আগেই সীমান্ত দূরত্ব কমিয়ে খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ে জিনিয়ার মুখে। জিনিয়া নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আমাদের এখনো বিয়ে?
সীমান্ত একহাতে টেনে ধরে জিনিয়ার শাড়ি। পেছনে থেকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘ আমি তোমাকে বিয়ে করব না। যেটা বলছি মন দিয়ে শোনো।
অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তরে জিনিয়া খুশি হয়। বিয়ে হবেনা? কিন্তু সীমান্তর এমন স্পর্শ ভালো ঠেকল না জিনিয়ার। আনমনে কিসব ভাবতে ভাবতে জিনিয়া খেয়াল করে তার গলার নেকলেস খুলে পড়েছে। জিনিয়া অবাক হয়ে সীমান্তর দিকে ফেরার আগেই সীমান্ত খামচে ধরে জিনিয়ার উদরের কাছে শাড়ি। জিনিয়া চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ঠোঁট চেপে কেঁদে দেয়। বলে,
‘ কি করছেন আপনি? শাড়িটা এভাবে ধরেছেন কেন?
সীমান্ত স্বাভাবিক হেসে বলে,
‘ কিছুনা। তোমার কি আমাকে খারাপ মনে হয়? শোনো কি বলছি।
জিনিয়ার বাধ্য মন সায় জানায় কোনো খুশির সংবাদ শোনার জন্য। বিয়েটা করতে হবেনা অন্তত।
সীমান্ত জিনিয়ার কানের দুল খুলে নেয়, মাথার টিকলি, নাকের নথ। জিনিয়া বলল,
‘ আমাকে বলুন, আমি খুলে দিচ্ছি। সীমান্ত জিনিয়াকে ফাঁদে ফেলতে পেরে হাসে। সীমান্ত বলল,
‘ এইসব স্বর্ণের জিনিস খুলে দাও আমি চলে যাব।
জিনিয়ার সচল মস্তিষ্ক জানান দিল খুব লোভী মানুষ এই সীমান্ত। কয়েকটা স্বর্ণের জিনিসের জন্য এমন করে কেউ? এত নাটক? ঘৃণায় গা রি রি করলে ও তা দেখাল না জিনিয়া৷ এই লোকটাকে উচিত শিক্ষা দেবে সে। জিনিয়া চুড়ি খোলার আগেই সীমান্ত তার হাত ধরল। একে একে সব চুড়ি খুলে ফেলল। জিনিয়া অনেক কষ্টে সহ্য করল। অলংকারহীন জিনিয়ার মাথার খোঁপা ও একটানে খুলল সীমান্ত। জিনিয়া চুলের গোড়ায় ব্যাথা পেল। এবার ভয় শুরু হলো। খোঁপা কেন খুলল এই লোক? তার লোভ তো এই গহনার প্রতি। জিনিয়ার প্রতি নয়। তাহলে?
জিনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে মিথ্যে প্রমাণ করে দিল সীমান্ত। জিনিয়ার উন্মুক্ত ঘাড়ে মুখ গুজে দিল জিনিয়ার দুহাত পেছনে ধরে। শুঁষে নিল নিজের আশা আকাঙ্খা। একহাত দিয়ে জিনিয়ার দুহাত শক্ত করে ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে জিনিয়ার উদরে বিচরণ করতে করতে বলল,
‘ আওয়াজ করেও কোনো লাভ হবেনা। তোমার আব্বার সম্মানহানি হবে। তারপর হাট এট্যাক। তারপর কবরে।
জিনিয়া ততক্ষণে চিৎকার দিয়ে ফেলেছিল। এই নোংরা স্পর্শগুলোর মাঝে হঠাৎ মনে পড়ল খুব প্রিয় মানুষটার আলতোকরে হাত ছোঁয়ার কথা। সেই স্পর্শে ছিল না কোনো নোংরামি, ছিলনা কোনো অপবিত্রতা, ছিলনা কামনা, বাসনা। লোকটা কেন তার হলোনা?
জিনিয়ার কান্না গিয়ে পৌঁছাল না বিয়েবাড়ি অব্ধি। সীমান্তর জালে আটকে গেল সে। জিনিয়া সীমান্তর হাতে কামড় বসাতেই সীমান্ত কষে চড় বসাল জিনিয়ার গালে। জিনিয়া দূরে ছিটকে পড়ে ডাকে, আব্বা? ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়। মুখের প্রসাধনি ও লেপ্টে যায়। জিনিয়া ঠোঁটের রক্ত মুছে নিল হাত দিয়ে ঘষে। ঠোঁটের উপর লাগানো প্রসাধনির প্রলেপ ঠোঁটের আশেপাশে লেগে গেল মুহূর্তেই। শাড়িতে লাগানো পিনগুলো আলগা হয়ে যায়। জিনিয়া খুলে নেয় একটি পিন। সীমান্ত জিনিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। বীভৎস এই রূপ আগে কেন দেখল না জিনিয়া। তারমানে ও-ই ফোন করা লোকটা ঠিকই বলেছিল।
সীমান্ত এগোতেই থাকল। কোমল ঠোঁটের আশেপাশে লেগে থাকা রক্ত দেখে ও যেন পিপাসা বেড়ে গেল মুহূর্তেই। জিনিয়া উঠে ছাদের দরজা খোলার জন্য দৌড় দিতেই সীমান্ত তাকে টেনে ধরল। দরজা খোলা গেলেই তার আওয়াজ শুনতে পাবে।
আজ ওই ছাদটা ও খালি৷ ওই ছাদের দাঁড়ানো মানুষটি থাকলে রিয়েকশন কেমন হতো? খারাপ লাগত মানুষটার?
জিনিয়া চেষ্টায় ছাদের দরজা খোলায়। তাকে পেছন জড়িয়ে ধরা লোকটি দাঁত বসাল তার গলায়। অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল জিনিয়া। পিন ফুটিয়ে দিল সীমান্তের হাতে। সীমান্ত চিৎকার দিয়ে উঠল। ছাদের দরজা ও খুলে গেল। জিনিয়াকে চড় মেরে ফেলে দিল সীমান্ত। জিনিয়া পড়ল ছাদের কোণায়। রেলিঙে মাথা ঠেকল। কপাল ফেটে রক্ত বেরোলো। আর্তনাদ করতে লাগল সে। পুরো ছাদে পড়ে রইল গহনা, অলংকার, খোঁপায় গুজা ফুল। আর একটি লাল শাড়ি পড়া মেয়ে। সীমান্ত ছাদঘরের দেয়ালে লাগানো চুম্বকের মতো ক্যামেরা পকেটে পুড়ে নিল। ভিডিওটি ট্রান্সফার করল কাউকে। তারপর জিনিয়ার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে জিনিয়ার হাত উপরে তুলে নিল। হাতের উল্টোপিঠে দাঁত বসিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ভিডিও করেছি। আমার নামে যদি থানায় থানায় মামলা পাঠায় তোমার ভাই তাহলে এই ভিডিও ভাইরাল করে দেব। আমার সব উদ্দেশ্য ভেস্তে দিল তোমার ভাই। সে আসছে আমাকে ধরতে, তাই চালাকি করে বিয়ে বন্ধ রাখতে বলেছে। এই সব ওই শয়তানের কাজ। আমি ও কম না। আমি পাল্টা গুটি চেলেছি। আমি তোমাকে কলঙ্কিত করলাম। যাও।
জিনিয়া চেঁচিয়ে ডাকে, আব্বা?
সীমান্ত হো হো করে হাসে। আর ও একটা চড় বসায় জিনিয়ার গালে। জিনিয়া ঢলে পড়ে। সীমান্ত ছাদের দরজা বন্ধ করে দেয়। জিনিয়া ছাদে থেকে যায়। হাঁটার শক্তি নেই। আব্বার কি হবে? আব্বা কি সহ্য করতে পারবে সবটা? কি হবে আব্বার? আম্মার?
সীমান্তকে নিচে নামতে দেখে সবাই উৎসুক হয়ে তাকাল। সাহিল দৌড়ে আসল। সীমান্তর কলার চেপে ধরে বলল,
‘ জিনিয়া কোথায়?
সীমান্ত পাত্তা দিলনা সাহিলের কথার। এগিয়ে গেল। পকেট থেকে একটি পেনড্রাইভ বের করে দিল শফিক সাহেবের হাতে। বলল,
‘ জিনিয়া এখানে।
্ তারপর বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। তার সাথে আসা লোকজন ও পালিয়ে যেতে থাকে তার ইশারায়। সবাই কেটে পড়ল ধীরে ধীরে। পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। জায়িদ হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ডুকে পড়ে ডাকে,
‘ জুননু? এই জুননু?
কেউ আসেনা। জায়িদ চেঁচিয়ে বলল,
‘ আব্বা জুননু কই? সীমান্ত ওই ক্রিমিনাল কই? আব্বা কিছু বলো?
সাহিল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জায়িদ শফিক সাহেবের হাত থেকে পেনড্রাইভ নিয়ে তাড়াতাড়ি ল্যাপটপে ভিডিওটা প্লে করে। বীভৎস কাহিনি, দৃশ্য ফুটে উঠে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। পুরো একবাড়ি মানুষ দেখে সেই দৃশ্য। কান্নায় ভেঙে পড়ে এত শক্তপোক্ত জায়িদ। সাথে জাহেদা। সাহিল কাঁপা-কাঁপা পায়ে ছাদে উঠে যায়। ঘৃণা নিয়ে তাকায় শফিক সাহেবের দিকে। জিনিয়া ছাদে তা কেন বলল না তাকে?
ছাদের দরজা খুলতেই সাহিল মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। গিয়ে পড়ল পড়ে থাকা একটি মেয়ের কাছে। উন্মুক্ত কাঁধে, তলায় এসব কিসের দাগ? সাহিলের ঠোঁট কাঁপল, হাত কাঁপল। চোখ ফেটে অগ্নিবর্ষণ হলো। সাহিল চেঁচিয়ে ডাকল, জিনি?
জিনিয়া পিটপিট করে তাকায়৷ সাহিলকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে। বহুকষ্টে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ও পড়ে যায়। দূরে যেতে যেতে বলে,
‘ আমাকে ছুঁবেন না। ছুঁবেন না। আমি নেই আর। নেই।
জায়িদ ছাদে দৌঁড়ে আসে। জিনিয়াকে ওভাবে দেখে এলোমেলো সুরে ডাকে,
‘ জুননু আয়। আমি কথা রাখতে পারিনি জুননু। জুননু আমায় ক্ষমা কর। আমি এ কি করলাম? কার সাথে তোকে জড়াতে যাচ্ছিলাম। এতবড় ভুল কি করে করলাম? কেন এতবড় আসামীকে আমি চিনলাম না জুননু। আমাকে ক্ষমা কর তুই। সাহিল না বললে আমি কি করে জানতাম? জুননু তোর অভাগা ভাইকে ক্ষমা কর।
জিনিয়া গলার স্বর বসে যায়। জিনিয়া ঢলতে ঢলতে বলে,
‘ ভাইয়া আমাকে ওইলোক ছুঁয়েছে। ভাইয়া বাজেভাবে ছুঁয়েছে। নোংরা,,,,
জিনিয়া ঢলে পড়ে। সাহিল আষ্টেপৃষ্টে ধরে জিনিয়াকে। মুখ ধরে ডাকাডাকি করতে থাকে অবিরত। জিনিয়া জ্ঞান হারায়। অচেতন হয়ে পড়ে। সাহিল বসে পড়ে জিনিয়াকে নিয়ে। পুরো বিয়ে বাড়ির মানুষ ভেঙে আসে ছাদে। সাহিলের বুকে পড়ে থাকা মেয়েটির এই অবস্থা দেখে কানাঘুষা শুরু হয়। মুখ ঠোঁটের শাড়ির এই কি অবস্থা? ছিঃ।
শফিক সাহেব সেই সোফায় বসেছে আর উঠতে পারল না। সাগর সাহেব অবিরত ডাকাডাকি শুরু করল শফিক সাহেবকে। শফিক সাহেব বিড়বিড় করে বহুকষ্টে ডাকল,’ আম্মা!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here