রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-৬

0
800

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[৬]

বিশাল বড় বাড়িটাই একজন বৃদ্ধা মহিলা ছাড়া আর কোনো মেয়েমানুষের চিহ্ন দেখতে পেলেন না সোফায় বসা লোকটি। চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে সাগর সাহেবকে বলল,
‘ আপনার স্ত্রী কবে মারা গেছে?
সাগর সাহেব চমকে উঠলেন।
সাজেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ এইতো বেশকিছুদিন আগে।
লোকটির ভাবান্তর ঘটল না। বলল,
‘ মেয়ের শ্বশুর হিসেবে আপনাকে আমার মনে ধরেছে। আপনার ছেলে তো এখনও আসেনি। নিশ্চয়ই ছেলে ও ভালো হবে কিন্তু সমস্যা একটাই। মেয়েমানুষের জন্য মেয়েমানুষ লাগে। এতবড় সংসার বুঝিয়ে পড়িয়ে দিতে ও একজন মানুষ লাগে। আমার মেয়েটা শান্তশিষ্ট প্রকৃতির। একটু ভীতু ও। তারজন্য একটা মেয়েমানুষ থাকলে ভালো হতো আর কি।
সাগর সাহেব অভয় দিয়ে বললেন,
‘ আমার চাচি আছে না? সব শিখিয়ে পড়িয়ে দেবে। ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। আর ওরা তো দুইভাই, আরেকজনের জন্য ও বউ আনলে দুই জা হয়ে যাবে ওরা। ওসব নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
লোকটির তারপর স্বস্তি মিলল না চেহারা দেখে বুঝা গেল।
দরজা ঠেলে বাড়িতে ডুকল সাহিল। ড্রয়িংরুমে এত অপরিচিত লোক দেখে ভুরু কুঞ্চন হলো তার। সাজেদ সাহেব হেসে বলল,
‘ এদিকে এসো সাহিল। পরিচয় করিয়ে দিই।
সাহিল গেলনা। সচল মস্তিষ্ক ধরে ফেলল কি হচ্ছে এখানে। বাবার উপর উঠা রাগকে চাপা দিয়ে সাহিল সৌজন্যেতাবোধে হাসল। বলল,
‘ এখুনি আসছি।
এখুনি আসছি বলে গেল, কিন্তু এল দশ বারো মিনিট পরে। তা ও নাহিলকে নিয়ে। লোকগুলোর সামনে নাহিলকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ এই যে আপনাদের জামাই বাবাজি।
লোকগুলো ঠাহর করতে পারল না, আসলেই এখানে বড় কে? কিংবা ছোট কে?
নাহিল অবাকসুরে বলল,
‘ ভাই, কি হচ্ছে?
সাগর সাহেব দাঁড়িয়ে গেল। কড়া কন্ঠে বলল,
‘ ইয়ার্কি নয় সাহিল।
সাহিল হেসে ফেলল। লোকগুলোকে ইশারা করে বলল,
‘ জামাই হিসেবে এই ছেলেটাকে যদি মনে ধরে তাহলে আলহামদুলিল্লাহ।
নাহিল সাহিলকে ঠেলে দিল। বলল,
‘ ইয়ার্কি হচ্ছে ভাই?
সাগর সাহেব গর্জে ডাক দিলেন।
‘ সাহিল?
সাহিল ও সমান তালে গর্জে বলল,
‘ কি হয়েছে? আমি বলেছি তোমাকে মেয়ে দেখতে? এ বাড়িতে এতই যখন মেয়েমানুষের অভাব তখন গিয়ে নিজের বউকে নিয়ে এসো না? তা তো পারবেনা।
সাগর সাহেব ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। লোকগুলো সোজা বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে।
সাহিল স্পষ্টসুরে বলল,
‘ আমার পারমিশন ছাড়া, এতবড় সিদ্ধান্ত তোমাকে কে নিতে বলেছে বাবা?
সাগর সাহেব চোখ তুলে ছেলেকে দেখে। নিস্পৃহ কন্ঠে বলে,
‘ এখন থেকে সবকিছুতে তোর পারমিশন নিতে হবে?
সাহিল তীক্ষ্ণ মেজাজে বলল,
‘ নিতে হবে। আর নেবে ও।
সাগর সাহেবের কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছেলের দিকে। সাহিল রুক্ষ কন্ঠে বলে,
‘ আমার মা নাকি মৃত? কোথায় পেয়েছ এই খুশির সংবাদ? কার কাছে পেয়েছ? মেজবান দাওনি কেন?
সাগর সাহেব একেবারে চুপ মেরে যান। সাহিল চেঁচাতে থাকে। সামনে থাকা সেন্টার টেবিল লাতি দিয়ে ফেলে দেয়। আর না পেরে সাগর সাহেব জোরে চড় বসায় ছেলের গালে। বলে,
‘ মৃত বলেছি বেশ করেছি। যার নিজের স্বামী সন্তানের কথা মনে পড়েনা সেই মহিলা আমার কাছে মৃত। আমার কথা বাদ দে। আমি কোন ছাই, কিন্তু তুই? তুই তার পেটের সন্তান। দশমাস দশদিন পেটে ধরেছে তোকে। তোর কথা ভেবেই তো আসতে পারে।
সাহিল তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় সাগর সাহেবের দিকে। সাগর সাহেব হেসে দেয় ছেলের তাকানো দেখে। বলেন,
‘ তুই আসলে চাসটা কি? বিয়ে ও করবি না। ব্যবসা ও সামলাবি না। তো কি করবি? কি করবি বল।
সাহিল তিরিক্ষি মেজাজে চেঁচিয়ে বলে,
‘ যা ইচ্ছা তাই করছি। করব ও। আরেহ তোমরা মা বাবা নামে কলঙ্ক। আমি কি করছি না করছি তাতে তোমাদের মাথা ব্যাথা থাকার কথা নয়।
সাগর সাহেব রুদ্ধ কন্ঠে বলে,
‘ আমি তোর কেউ নই? তোর অভিভাবক হতে পারিনি আমি? তোর কাছে তোর মা ই সব? আমি যে এতগুলো বছর তোকে আগলে রেখেছি।
সাহিল আওয়াজ করে হেসে দেয়। বলে,
‘ আগলে রেখেছ? কোথায় আগলে রেখেছ? ওই বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছ। কোথায় আগলে রেখেছ? জীবনের বেশঅর্ধেক সময় তো আমি একা একাই কাটিয়েছি। ছিলে না তুমি, ছিলেনা মা। কে ছিলে তোমরা? কে?
মা তো আমার নয় বছর হওয়ার সাথে সাথেই ফেলে চলে গিয়েছিল। তোমরা কেউ আমার কথা ভেবেছ? কেউ ভাবোনি। তাহলে আমি কেন ভাবব? বলতে পারো?
সাগর সাহেব মুখ বন্ধ করে দিল সাহিল। বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ ব্যাথার আঁচ পেলেন হঠাৎ। সোফায় বসে বুকে হাত চেপে ধরতেই সাজেদ সাহেব আর নাহিল দৌড়ে গেল। আষ্টেপৃষ্টে ধরতেই সাগর সাহেব তাদের দূরে যেতে বলেন। সাহিলের ভেতর কাজ করে ভয়। তার জন্য বাবার যদি কিছু হয়ে যায়। শক্ত খোলস ভেঙে তারপরও দৌড়ে যেতে পারেনা সে। সাগর সাহেবের জন্য ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার প্রেশক্রিপশন লিখে দেয়। বলে যায়, সাবধানে রাখতে। হার্টের রোগী বলে কথা। বেশি টেনশন না দিতে।

ভরদুপুরে ছাদের এককোণায় দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত সিগারেট টানতে গিয়ে চট করে দূরে ফেলে দেয় সাহিল। হাতের কাপড়গুলো ছাদে টানা রশিতে বিলিয়ে দিতে দিতে জিনিয়ার চোখের পলক থমকে গেল ওই ছাদের কোণায় দাঁড়ানো ছেলেটিকে দেখে। এমন সময় ছেলেটিকে তো ছাদে দেখা যায় না। আজ হঠাৎ?
জিনিয়া অস্বস্তি নিয়ে ডাকল,
‘ শুনছেন? একটা কথা ছিল।
সাহিল সিগারেটটি পায়ের তলায় গুড়িয়ে ফেলতে ফেলতে বলল, হ্যা।
জিনিয়া বলল,
‘ আন্কেলের আজ কি হয়েছে? আব্বা বলেছে, আন্কেলের নাকি হার্টের সমস্যা আছে।
সাহিল বলল,
‘ হ্যা।
জিনিয়া খেয়াল করল সাহিল অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছে। তা ও হ্যা ছাড়া অন্যকিছু নয়। এত অবহেলা হৃদয়ের ছোট্ট কুটিরে হঠাৎ করে খানিকটা অভিমানের জায়গা করে দিল। পাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল জিনিয়া।
‘ আপনার কি মন খারাপ?
সাহিল তাকাল এবার জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া বলল,
‘ না, এমনি। মানে আপনাকে কেমন জানি লাগছে দেখতে। শরীর খারাপ?
সাহিল মাথা নাড়ায়। বলে,
‘ তুমি এখান থেকে যাও। তোমার আব্বা দেখলে বিষয়টা ভালো দেখাবেনা।
জিনিয়া কিছু বলতে চাইলে সাহিল বলে,
‘ যাও। আমার কথা বলার ইচ্ছে নেই।
জিনিয়া পা বাড়ায় একরাশ মনখারাপ নিয়ে। আর পিছু ফিরে তাকায় না।

মধ্যেরাতে সেই নাম্বার থেকে আবার ও ফোনকল এল। জিনিয়া ফোন কানে দিয়ে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
‘ কে আপনি? আবার ফোন দিয়েছেন কেন? রাখছি আমি। আপনার বাজে কথা শোনার সময় নেই।
লোকটি বারণ করল।
‘ না না ফোন কাটবে না। আমি কিছু কথা বলে ফোন রেখে দেব।
জিনিয়া বলল,
‘ কি বলবেন? আপনি যার কাছ থেকে আমাকে দূরে রাখতে চাইছেন, তাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। অযথা ফালতু কথা বলবেন না।
লোকটির কথাগুলো ভার শোনায়। জিনিয়াকে বলে,
‘ সাহিল নয় সীমান্তর কাছ থেকে ও দূরে থাকবে তুমি। এই দুজনের কাছেই তুমি সেফটি নও। দুজনের কাছেই তোমার বিপদ। আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি তোমার ভালো চাই। তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।
জিনিয়া ফোন কেটে দেয়। জায়িদের কাছে ছুটে যায়। আবার কি মনে করে চলে আসে রুমে। নাম্বারটা সাহিলকে দিয়ে দেবে। হয়ত সাহিলের কোনো শত্রু। নয়ত সীমান্ত। দুজনই যদি ধরতে না পারে তাহলে জায়িদকে জানাতে হবে।

হসপিটালে সীমান্তের সাথে দেখা হলো তারপরের দিন। সীমান্ত নাম্বারটা দেখে হেসে ফেলল। বলল,
‘ সাহিলেরটা বলতে পারব না। কিন্তু লোকটা আমার নাম কেন নিল জিনিয়া? আচ্ছা তুমি বলো আমাকে দেখলে কি মনে হয় আমি তোমার ক্ষতি চাই। আমি তোমার ভালো চাই জিনিয়া। তোমার ভালো থাকার দায়িত্ব নিতে চলেছি আমি। তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো?
জিনিয়া আমতাআমতা করে বলল,
‘ না। আপনাকে সন্দেহ করছিনা আমি। কিন্তু আমি মিঃ সাহিলকে ও সন্দেহ করতে পারব না। ওনাকে কেন জড়াচ্ছে আমি সেটাই বুঝতে পারছিনা।
সীমান্ত বলল,
‘ সাহিল জড়িয়েছে তাই তোমার টেনশন হচ্ছে? আর আমার?
জিনিয়া বলল,
‘ আচ্ছা, এসব কথা থাক। আমাকে ওনার সাথে কথা বলতে হবে। আচ্ছা আপনি কি ওনাকে চেনেন? মানে মিঃ সাহিলের কথা বলছি আমি।
সীমান্ত বলল,
‘ হ্যা চিনি সামান্য সামান্য৷ তোমার সাথে ওর কি?
জিনিয়া বিরক্ত বোধ করল।
‘ আমার সাথে কিছুনা। কিসব উল্টাপাল্টা বলছেন?
সীমান্ত বলল,
‘ উল্টাপাল্টা বলছিনা। ওইদিন কফিশপ থেকে বের হয়ে আমি দেখেছি।
জিনিয়া চমকে উঠে বলে,
‘ কি দেখেছেন?
সীমান্তর ঠোঁটের কোণায় বিশ্ব জয়ের হাসি৷ জিনিয়া বলল,
‘ কি দেখেছেন?
‘ তোমার হাত ধরে রয়েছে সাহিল।
জিনিয়া দুই পা পিছু হাঁটে। বলে,
‘ ভুল দেখেছেন। এসব ফালতু কথা বলবেন না। আমার আব্বা শুনলে কষ্ট পাবে।
সীমান্ত প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে। ফোনের স্ক্রিন তুলে ধরে জিনিয়ার সামনে। জিনিয়া চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কড়া কন্ঠে বলে,
‘ আপনি ছবি তুলেছেন কেন? আপনার উদ্দেশ্য কি?
সীমান্ত নিষ্পাপ চেহারায় বলে,
‘ আরেহ রাগ করছ কেন জিনিয়া? এসব কি আমি খারাপ উদ্দেশ্য তুলেছি? এজন্যই তুলেছি, যে তোমার হাত সাহিল ধরল কেন? তুমি যাতে অস্বীকার করতে না পারো তাই তুলেছি। তুমি ঠিক সেটাই করেছ জিনিয়া৷ কেন অস্বীকার করেছ? তুমি কি সাহিলকে?
জিনিয়া পা বাড়ায়। সীমান্ত তার পিছু পিছু যেতে যেতে বলে,
‘ জিনিয়া আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। ছবিটা কি আমি স্যারকে দেখাব?
জিনিয়া থমকে যায়। পিছু ফিরে তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকায় সীমান্তর দিকে।
‘ এই লোকটার মাঝে সে মুগ্ধতা খুঁজত? এই লোকটার মাঝে?
সীমান্ত হেসে দেয়। বলে,
‘ আমি কখনোই বলব না। তুমি শুধু আমায় সত্যিটা বলো। তুমি কি সাহিলকে পছন্দ করো?

রাস্তার পাশে পার্ক করা একটি লাল রঙের মার্সিডিজ। সীমান্ত খেয়াল করল সেই মার্সিডিজ থেকে বের হয়ে বাইকে চেপে বসেছে সাহিল। মাথার উপর পড়ে নিয়েছে হেলমেট। এই শ্যামবর্ণ দীর্ঘকায় শরীরের ছেলেটির চাইতে ও তো সে বেশি আকর্ষণীয়। জিনিয়ার মুগ্ধতা তার কাছে গিয়ে আটকালো কেন হঠাৎ? সীমান্ত কোনদিক থেকে কম?
জিনিয়া তাকায় সীমান্তর চোখ অনুসরণ করে। সাহিলকে দেখে ঢোক গিলে। উল্টো পথে হাঁটা ধরতেই সীমান্ত তার হাত টেনে ধরে। বলে,
‘ কোথায় যাচ্ছ জিনিয়া? আর ও কথা বাকি আছে। তাছাড়া সাহিলকে তুমি খুঁজছিলে না?
জিনিয়া আমতাআমতা করে বলল,
‘ খুঁজছিলাম কিন্তু এখন?
সীমান্ত বলল,
‘ সাহিলকে ডাকি? দাঁড়াও।
জিনিয়া বারণ শুনল না সীমান্ত। সাহিলকে ডাক দিল। সাহিল বাইক নিয়ে রাস্তা পার হয়ে এপাশে চলে আসে। জিনিয়াকে দেখে ও কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না তারমধ্যে সীমান্ত বলল,
‘ মিঃ সাহিল জিনিয়া আপনাকে নাকি কিছু বলবে।
সাহিল সীমান্তর থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল ভয়ার্ত চোখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মুখপানে। এই মায়াবী মুখটার প্রেমে পড়েছিল না সে? একদম প্রথম দেখায়। হ্যা এ মেয়েটিরই তো। ভালোলাগাটা মনে হয় এখন বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। চাপা পড়েছে কেন তাহলে? আস্তরণটা ও এত শক্ত কেন? সরেনা নড়েনা। সাহিলের সেই শক্তি নেই কেন? জিনিয়ার বাবা, পরিবার, ভাই এসব কোনোকিছুই তো সাহিলকে টলাতে পারত না। তারপরে ও সাহিল ধরা দিতে পারছেনা কেন? আগের সেই মুগ্ধতা নিয়ে তাকাতে গিয়ে ও কোথায় যেন একটা বাঁধা পাচ্ছে। এত বাঁধা যখন নিজের ভেতর বাইরে, সাহিল মন দিতে গেল কেন মেয়েটাকে?
জিনিয়া চোখ নামিয়ে ফেলল। সাহিলের দিকে একটি ফোন নাম্বার বাড়িয়ে দিল। বলল,
‘ এই নাম্বার থেকে কেউ একজন।
সাহিল সীমান্তর দিকে তাকালো। সীমান্ত জিনিয়ার দিকে একটুখানি তাকিয়ে চলে গেল। জিনিয়া ভারী অবাক হলো।
‘ ওনি চলে গেল কেন?
সাহিলের উত্তর না পেয়ে জিনিয়া আবার বলল,
‘ ওনি চলে গেল কেন? আপনি?
সাহিল প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘ কেন ডেকেছ?
জিনিয়া ভার কন্ঠে বলল,
‘ আপনাকে তো ওইদিন বলেছিলাম, একটা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল আর বলেছিল যে,
সাহিল জিনিয়াকে কথা শেষ করতে দিল না। বলল,
‘ আমাকে কেন বলছ এসব? সাবধান যখন থাকতে বলছে, সাবধান থাকো। আমার কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখো।
জিনিয়ার মুখ আর ও ভার হয়ে যায়। গলা কেঁপে উঠে। সে বলে,
‘ লোকটা মিঃ সীমান্তের কথা ও বলেছে। কিন্তু লোকটা কে? এসব ওনি আমাকে কেন বলেন,?
‘ তুমি আমার কাছে সেফটি না তাই বলে হয়ত।
‘ কিন্তু আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।
সাহিলের শীতল দৃষ্টিতে ভড়কে গেল জিনিয়া। আমতাআমতা করে বলল,
‘ ভুল কিছু তো বলিনি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি৷ মিঃ সীমান্তকে ও।
সাহিল হেলমেটটি নাড়াতে চাড়াতে বলল,
‘ বিশ্বাস ভালো৷ কিন্তু সাহিল, আর সীমান্ত হয়ত তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে পারবেনা তাই লোকটা তোমাকে সতর্ক করছে।
জিনিয়া আর ও কিছু বলতে চাইল। সাহিল বাইক স্টার্ট দিল। জিনিয়া বলে উঠল,
‘ আমি, আমি । সাহিল মাথা তুলল না। জিনিয়ার কথা শুনল না। বলে গেল,
‘ তোমার আব্বা আমাদের দেখলে অশান্তি শুরু করবেন। দুই পরিবার বিবাদে লিপ্ত হোক আমি চাইনা৷
জিনিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল৷ সাহিলকে বলল,
‘ আব্বাকে ওই লোকটার কথা বললে ও সমস্যা হবে৷ আপনার উপর থেকে একদম বিশ্বাস উঠে যাবে। যা আমি কখনোই চাইনা৷
সাহিল হেসে বলল,
‘ কেন চাওনা? আমাকে বিশ্বাস করারই বা কি দরকার?
জিনিয়া হেসে দিল। মলিন হাসি। বলল,
‘ আপনি আজ আমাকে বেশি বেশি প্রশ্ন করছেন। যদি আমি আপনাকে একটা করি আপনার কি বিশেষ অসুবিধা হবে?

‘ বলে ফেল চট করে। ফট করে উত্তর দেব। যদি দেরি হয় উত্তর দেব না। কখনোই না। নো নেভার।

জিনিয়া ও হাসিমুখে চট করে প্রশ্নটা সেড়ে ফেলল।
‘ আপনি বিয়ে করছেন? মেয়েটি দেখতে কেমন? খুব সুন্দর? ধবধবে ফর্সা? চোখগুলো সুন্দর? ঠোঁট,,,

সাহিলের উচ্চস্বরে হাসির আওয়াজে তোলপাড় হয় মনগহীনে৷ মাথা নিচু করে রাখে জিনিয়া। হাসির পাত্র হওয়ায় যতটুকু না কষ্ট হচ্ছে তার চাইতে ও বেশি কষ্ট হচ্ছে, মুখ দিয়ে না বলে সাহিলের স্বীকারোক্তিতে। তারমানে মেয়েটা আসলেই সুন্দর! নাহলে জিনিয়ার প্রতি ভালোলাগা একনিমেষে ধুঁয়ে যাবে কেন? মুছে যাবে কেন?
জিনিয়াকে চুপ থাকতে দেখে সাহিলের হাসি কমল ধীরে ধীরে। চোখ গেল জিনিয়ার পায়ের কাছে। দৃষ্টি আটকে গেল বৃদ্ধাঙ্গুলিতে গিয়ে। বৃদ্ধাঙ্গুলির উপর এত নোনাজলের আবিষ্কার হঠাৎ করে কোথা থেকে ঘটল তা বুঝা গেল জিনিয়া মাথা উপরে তুলতেই। সাহিল কিছু বলার আগেই জিনিয়া নিরুদ্দেশ হলো। চাপা খুশির সাথে চাপা সূক্ষ্ম এক যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সেইক্ষণ থেকে শুরু করে পুরোটা রাত নির্ঘুম কাটল সাহিলের। বুঝে পেলনা, খুঁজে পেলনা এই নিদারুণ কষ্টের কারণ।

জিনিয়াকে দেখা গেলনা দুই তিনদিন। না ছাদে, না ভার্সিটি যাওয়ার পথে। না জানালা ফটক দিয়ে, না বারান্দায়। সূর্য ও উঠেনি ভালো করে এ কয়দিন। ফাল্গুনের শেষ, চৈত্র মাসের শুরু। চারদিকে ভ্যাপসা গরম ও। বৃষ্টি নামেনা অন্যদিকে গরম ও কমেনা৷ বসন্তেরকোকিল ডাকে কুহু কুহু করে৷ কিছুদিন পরেই তার অবসর। গাছের নতুন পাতায় যেন প্রকৃতির রূপ প্রকাশ পেয়েছে। চারদিকে ঝড়াপাতার সমারোহ।
সাহিল ভাবতে থাকে কোথাথেকে ভেসে এসে কোথায় এসে থেমেছে এখন সে? জীবিকার প্রয়োজনে শহরে এসে, ব্যবসা দাঁড় করাতে পারায় স্থায়ী বসতি গেড়েছে সাগর সাহেব এখানে । গ্রামে বাড়িঘরগুলো এখনও আছে। ওখানে থাকেন এক বৃদ্ধা মহিলা। সবকিছুর দেখাশোনা করেন তার ছেলে আর তিনি মিলে। সাহিলের এখনো মনে পড়ে, এই জায়গাটা কিনেছিল তার বাবা আর কাকা মিলে। গ্রামের বাড়ি থেকে বাবার সাথে দেখতে আসত নতুন বাড়ি, তখনও বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। তখন মা ও ছিল। পাশের বাড়ির ছাদে ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ে তখন পা টিপে টিপে হাঁটা শিখছিল মাত্র। সাহিল তাকাতেই খিলখিল করে হেসে ঢলে পড়ত ভাইয়ের কোলে। ভাই জায়িদ ছিল সাহিলের সমবয়সী। ভাই বোনের খুনসুটি দেখতে ভালো লাগত সাহিলের। তার যদি একটা বোন থাকত? শুধু ছিল এক ভাই। নাহিল। সে বেশিরভাগ থাকত তার নানুর বাসায় মায়ের সাথে। কাকি থাকতে চাইতনা গ্রামে। শহরে নতুন বাড়ি করার পর বাড়িতে উঠেছে। নতুন বাড়িতে উঠার পরে সাহিলের রোজকার অভ্যাস ছিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই বাড়ির বারান্দায় খেলা করা বাচ্চা মেয়েটিকে দেখা। বাবা, ভাইয়ের সাথে কি পাকা পাকা কথা বলে মেয়েটা? যদিও সাহিল শুনতে পেতনা ছোট ছোট আওয়াজ করে বলা কথাগুলো। মেয়েটি আদুরে হতোই কেননা ভাইয়ের অনেক বছর পর সে হয়েছিল বোধহয়। তাই ভাইয়ের কলিজা আর বাবার রাজকন্যা। সাহিলের মনখারাপের দিন তখন। তীব্র নারী বিদ্বেষী বাবা মাকে দু-চোখে সহ্য করতে পারত না। দাদুর জোরাজুরিতে বিয়ে করেছিল। বাবার দুচোখের বিষ ছিল সেই মা। সাহিল নিজের চোখে দেখেছে মায়ের উপর হওয়া নির্যাতন। মায়ের চোখের কান্না। যা ভুলার নয়। তারপরে ও সাগর সাহেবকে সে আজ ও বাবা ডাকে কারণ, আজ সেই বাবা অনুতপ্ত। নিজের করা ভুলের কারণে তার ভাইয়ের সংসারটা ও হয়ে পড়েছে এলোমেলো। ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে একমাত্র ছেলের জীবন। পরিচিত বন্ধুর উপর বিশ্বাস রেখে পাঠিয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া । যাতে সাহিল নতুন করে বাঁচা শিখে, আর মা বাবার এই বিচ্ছেদ তার উপর কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে। সেই দশ বছর বয়সে সে বিদেশের মাটিতে পা রেখেছিল। আসলেই কি সাহিল সেদিন থেকে নতুন করে বাঁচতে শিখেছিল? নাকি সেদিনই বিষাক্ত ফলের বীজ রোপণ করেছিল, নিজের ভেতর। নিজেকে শেষ করার আর বাকিদের।

ছলেবলে কৌশলে জানা গেল জিনিয়ার নাকি গায়ে জ্বর৷ অবাধ্য মনমস্তিষ্ক বলল ছুটে যেতে। কিন্তু অদৃশ্য বাঁধার কারণে যেতে পারল না সাহিল। আত্মসম্মান অনেক বড় বিষয় সাহিলের কাছে। মেয়েটার ফোন নাম্বার রাখা উচিত ছিল। একটা ফোন অন্তত করা যেত।
এক,দুই, তিন করতে করতে এভাবে প্রায় সপ্তাহখানেক গেল।

ছাদের দরজার কাছে এসে থেমে গিয়ে, দরজার ফটক দিয়ে ও-ই পাশের বাড়ির ছাদে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দেখে জ্বর গায়ের মেয়েটির ঠোঁটের কোণায় ফুটে আনন্দের হাসি। ইচ্ছে করে সে ছাদে যায়না। যতক্ষণ ছেলেটি ছাদের এপাশ ওপাশ হাঁটাহাঁটি করে ততক্ষণ মেয়েটি ও দাঁড়িয়ে দেখে লুকিয়ে। তাঁর জন্যই এত উদ্বিগ্ন, চিন্তিত মানবটিকে দেখে বুকের ভেতর অপ্রতিরোধ্য ঝড় উঠে। সেই ঝড়ের তান্ডবে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায় জমানো অভিমান আর অনুরাগ। বৃষ্টিরূপে গাল বেয়ে গড়ায় টলটলে জল। এই অল্পদিনে এসে অল্পঅল্প করে জিনিয়ার মনমস্তিষ্কে জায়গা করে নিয়ে স্থায়ী বসতি গড়ে ফেলেছে ছেলেটি। একে সরানো যায় না, দূরে ঠেলা যায় না,ছুড়ে ফেলা যায় না। এই নো আর নেভারকে শুধু ভালোবাসা যায়। হোক আড়ালে, আবডালে। তার সামনে তো আবার দেখানো ও বারণ। সে পছন্দ করবে, ভালোবাসবে, কিন্তু সেই একই কাজ অন্য কেউ করলে এত রাগ কেন? এত এত নিষেধাজ্ঞা কেন? ভালোবাসার অধিকার তো সবারই আছে। সে এমন কে যার নিষেধাজ্ঞা মানতে হবে। জিনিয়া ঘোষনা করে দিল, নীরবে নিভৃতে । আপনার নিষেধাজ্ঞা আমি মানিনা, মানব না। কখনোই না। নো নেভার।

সপ্তাহ পার হয়ে দশদিন পার হলো। সাহিলের সচল মস্তিষ্ক কিছুদিন ধরে জানান দিল, ছাদের দরজার কাছে দাঁড়ানো মানবীটি আর কেউ নয়। বরঞ্চ তার মনের রাজ্য দখল করে তাকে তার রাজ্য থেকে তাড়িত করা সেই জাদুকরণি, মায়াবিনী। তাকে বনবাসে পাঠিয়ে আবার লুকিয়ে থাকা হচ্ছে? লুকিয়ে লুকিয়ে শোধ তোলা হচ্ছে। ইচ্ছেকরেই ছাদে আর এলোনা সাহিল। দাঁড়ালো না বারান্দায়। দেখা গেলনা তাকে কোথাও। লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা জিনিয়া এবার নিজেকে সামনে আনল। চিন্তিত, বিমর্ষ চেহারায় এদিকওদিক তাকিয়ে খুঁজল সাহিলকে। দেখা পাওয়া গেলনা। অন্যদিকে কথাবার্তা এগোলো সীমান্ত আর তাকে নিয়ে। সীমান্তর প্রত্যেকটা কথার ভাঁজে ভাঁজে জিনিয়া দেখল নিজের প্রতি কেয়ারিং। কিন্তু ভালোলাগা আর ভালোবাসা নামক শব্দটা তখন নিরুদ্দেশ। এই শব্দ দুটো শব্দ হয়ে থেকে গেল শুধু। যার সাথে মানায় এই শব্দদুটো সে ও নিরুদ্দেশ। তার দেখা পাওয়া গেলনা। সীমান্তের পরিবার এল জিনিয়াকে দেখতে। হাতের অনামিকায় রিং পড়িয়ে দিয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে গেল৷ তারা চলে যেতেই, ছাদে গিয়ে সেই রিং আঙুল থেকে খুলে পাশের বাড়ির ছাদে ছুড়ে মারল জিনিয়া। নীরব আর্তনাদে ভেসে গেল সে। পড়নের শাড়ির আচঁল মুখে গুজে কেঁদে উঠে চলে গেল সে।
জিনিয়া যেতেই আড়াল থেকে বের হলো সাহিল। আংটিটি কুড়িয়ে নিল। আংটিটির দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই হাসল। পকেটে রেখে বলল,
‘ তুই থেকে যাহ তার মতো এই বুকপকেটে জমা।
সুযোগ যদি আসে তাকে করতে বলিস ক্ষমা।

জরুরি প্রয়োজনে দেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়া যেতে হলো সাহিলকে। প্রায় চারমাস পর ফিরল। এই চারমাস কারো সাথে যোগাযোগ রাখেনি। বাবার উপর চাপা অভিমান খসে পড়ল না। নাহিলের সাথে যোগাযোগ রাখলে ও কাজের কথা ছাড়া কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে চাইল না সাহিল। নাহিল ও বলার চেষ্টা করল না। চারটা মাস অথচ দেশে ফিরে মনে হচ্ছে কয়েকহাজার বছর চলে গিয়েছে। মনে হলো পরিবর্তন ঘটেছে সবকিছুতে। বাড়ি, বারান্দা, ছাদ।

আষাড়িয়া তান্ডব চারপাশে। শাঁ শাঁ বাতাসে গাছপালা ভেঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছে। সাহিল এই ঝড়বাতাসের মাঝে ও গিয়ে দাঁড়াল ছাদের এককোণায়। মাথার একঝাঁক চুল এপাশ আর ওপাশ করল বাতাসের তালে তালে। পড়নে হাফস্লিভ সাদা টি শার্ট। জিম করা হাতের বাহু ফুলেফেঁপে দৃশ্যমান। বাতাস কানে কানে এসে শ্যামবর্ণের পুরুষটিকে যেন জিজ্ঞেস করল,
‘ কাকে খুঁজছ?
সাহিল বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করল,
‘ ও বাড়ির মেয়েটির কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে? আজকাল ছাদে আসেনা দেখছি।

চলবে,
সবার মন্তব্য আশা করছি। গল্পটি ” সীমাহীন” গল্পের প্রতিচ্ছবি। যদি ও আমি থিমটা চেন্জ করেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here