#রৌদ্রমাখা বর্ষা
আলহীনা ইনাম [ছদ্মনাম]
০৭,,
“ECSTASY”
জানুয়ারীর একটা সকাল। ঠান্ডা লাগছে। সেইসব মেঘলা, ময়লা শীতের দিনগুলোর একটা। দুস্থ মহিলাদের আশ্রয়কেন্দ্রের সামনের মাঠটায় শিশির বিন্দু জমে থাকা ঘাসের উপর থেকে খালি পায়ে হেঁটে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভূত হয়। গাছগুলো নিজেদের পাতা আরো আগে ঝড়িয়ে দিয়েছে। এখন তো মনে হয়, কোকিল প্রস্তুতি নিচ্ছে বসন্তের অপেক্ষায়। তার মেয়ে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে কন্ঠের যত্ন নিচ্ছে। জানালার শার্সিতে ঠেস দিয়ে দলা পাকিয়ে আছে কুয়াশাটি।
আফাফ অবশ্য মাঠ পেরিয়ে পাশের পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেইদিনগুলোর কথা ভাবলে এখনো অবশ্য কিছু অনুভূতি জন্মে আফাফের ভিতর। তবে দুঃখজনকভাবে ধাক্কা খাওয়া সেগুলো একটাও না।
আফাফের গায়ের চাদর ভেদ করে যেন শীত ওর হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ডেলিভারি ডেট এগিয়ে আসছে। এই সকালগুলো ওর খুব ভালো লাগে। সাফাত মির্জা ওকে এখানে আশ্রয় দানের পাশাপাশি খুব খেয়াল রাখেন। আফাফ জানে না কেন? লোকটাকে গম্ভীর মনে হতো। কিন্তু মাঝে মাঝেই তার প্রকাশভঙ্গিমা অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়।
আফাফ মেনে নিয়েছিলো তো সেই কবেই, নিদ্র কখনোই তার হওয়ার নয়। সে বরাবরই আফাফের জন্য রূপকথার বইয়ের পাতায় বন্দী রাজপুত্র যাদের অস্তিত্ব বাস্তব জগতে নেই।
সেদিন আফাফ নীলাভের সাথে যোগাযোগ করেছিলো। সে তাকে বলেছিলো, লোকটা তাকে বাঁচিয়েছিলো। এরপর তাকে নিজের বাড়িতে এনে ভেজা কাপড় বদলে নিজের মৃতা স্ত্রীর শাড়ি দিয়েছিলো পরিধান করতে। ওর থাকার ব্যবস্থা করেছে। অনলাইনে ফ্রী ল্যান্সিং শিখিয়ে দিয়েছে। আফাফের চলার মতো আয় সেখান থেকে হয়।
আফাফ অদ্ভুত কিছু জানতে পেরেছে! নিদ্র বিয়ে করেছে আনাবিয়াকে ও যেদিন থেকে নিখোঁজ, তার কয়েকদিনের ভিতরই। খবরটার ধাক্কার আঘাত পাওয়ার জন্য ও সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত ছিলো। তবে খুবই অদ্ভুতভাবে সেই আঘাতটা লাগেনি। আর কখনোই লাগেনি। আশেপাশে গুজব ছড়িয়েছিলো, আফাফের সন্তান অবৈধ, কারণ ও কখনোই নিজের কথাগুলো এখানে কারো সাথে শেয়ার করেনি। গুজব ছড়িয়েছিলো, নাহ্, সে স্বামী পরিত্যক্তা। আফাফ কোনোটাকেই পাত্তা দেয়নি।
আফাফ শুনেছে, আঞ্জুম নিদ্রের নামে মামলা ঠুকেছিলো আফাফ হারিয়ে গিয়েছে সেই সূত্র ধরে। কিন্তু সেই মামলা টেকেনি। নীলাভ এবং নাহিনই একমাত্র আফাফের সাথে সম্পর্ক রেখেছে। মাঝে মাঝে একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে দেখা করতে আসে। আনাবিয়াকে বিয়ে করায় নাহিন আর নিদ্রের সাথে কথা বলে না।
‘কেমন আছেন?’
ঘাড়ের কাছে কন্ঠটা বেজে উঠলো। আফাফ খানিকটা চমকে পিছনে ফিরে সাফাতকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। বুকে থুথু দিয়ে ঘন একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। এভাবে কেউ চমকে দেয়?’
সাফাত নাক শিটকে বললো,
‘এমন কাজ করবেন না আমার সামনে। বিরক্ত হই।’
‘তা তো হবেনই। শুচিবাই মানুষ!’
সাফাত মৃদু হাসলো আফাফের কথা শুনে, যদিও সে এখানে হাস্যরসের কিছুই পায়নি। নিদ্রের বিয়ের খবর শোনার পর থেকে আফাফ খানিকটা বদলে গিয়েছে। প্রথম সেই রৌদ্রমাখা বর্ষার দিন আফাফকে সে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলো, সেই আফাফ আর এই আফাফের মাঝে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। তিনমাস আগে নিয়াজ শিকদার ইন্তেকাল করেছেন। আফাফ ওনাকে শেষ দেখা দেখতে গিয়ে বিপাকে পরে। আনাবিয়ার সাথে এই সাড়ে ছয়মাসে নিদ্র সুখী হতে পারেনি। আনাবিয়া মডেলিং ছাড়বে না। আর নিদ্র চায়না ও আর মডেলিং করুক। বিয়ের আগে নাকি আনাবিয়া কথা দিয়েছিলো নিদ্রকে, ও ছেড়ে দেবে মডেলিং। সেটা সে করেনি।
তিনমাস আগে আফাফকে দেখে সম্পূর্ণ বোঝা যাচ্ছিলো ও অন্তঃসত্ত্বা। আর বিপত্তিটা এখানেই বাঁধে। ওর দিকে আঙ্গুল তুলতেও কেউ দুবার ভাবেনি। এতোদিন পর ওকে সামনে দেখে কেউ অবাক হওয়ার প্রক্রিয়ায় যাওয়ার আগেই ওর শারীরিক অবস্থা দেখে আঙ্গুল তোলে ওর দিকে। আফাফ সেদিন শেষবার হয়তো কেঁদেছিল। কারণ এরপর সাফাত আর ওকে কাঁদতে দেখেনি। সেদিন সাফাতকে আফাফ অনাকাঙ্ক্ষিত বন্ধুর মতো পাশে পেয়েছিলো। নাহিন সবাইকে সেদিন বলে দিয়েছিলো সন্তানটা নিদ্রের। প্রথমে কেউ সেটা না মানলেও খুব রহস্যজনকভাবে নিদ্র মেনে নিয়েছিলো। আফাফ ধারণা করে, আনাবিয়ার সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনই নিদ্রের বোধদয়ের কারণ। কিন্তু তারপর বিষয়টা আরো জটিল হয়ে যায়। নিদ্র সন্তানের দাবি করে বসে আছে। পরিস্থিতি বেগতিক হওয়ার পথে সাফাত সেদিন আফাফকে নিয়ে একপ্রকার পালিয়ে আসে। আফাফ জানে নিদ্র খুঁজছে ওকে। আর সেটা শুধু ওর সন্তানের জন্য। আফাফ নিজের সন্তানকে কখনোই ছাড়বে না। এটা আবারও প্রমাণ করে, নিদ্র কখনোই তাকে ভালোবাসেনি আর কখনোই ওর হওয়ার নয়। আফাফ নিজের সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ।
‘বাইরে যথেষ্ট ঠান্ডা। ভিতরে চলুন।’
সাফাত কোমল কন্ঠে বললো ওকে।
‘ইচ্ছা করছে না ভিতরে যেতে। এই দিনেরবেলাও লাইট জ্বালাতে হবে আজকে। আকাশটা মেঘলা। এখানেই বেশি ভালো আছি।’
আফাফ কন্ঠে মিষ্টতা ঢেলে বললো।
সেই কন্ঠ! সাফাতকে অদ্ভুত এক প্রশান্তি এনে দিতে যথেষ্ট।
পুরুষদের মস্তিষ্ক পুরুষের কন্ঠ এবং মহিলাদের কন্ঠ আলাদা আলাদা জায়গা থেকে প্রক্রিয়া করে। পুরুষদের কন্ঠ মস্তিষ্কের সেই স্থান থেকে প্রক্রিয়া হয়ে থাকে, যেখান থেকে যানবাহন ও যন্ত্রপাতির শব্দ প্রক্রিয়া হয়ে থাকে। আর মহিলাদের কন্ঠ প্রক্রিয়া হয় যেখান থেকে গান প্রক্রিয়া হয়ে থাকে। এজন্য মহিলাদের কন্ঠস্বর পুরুষের কাছে গানের মতো শোনায়।
কিন্তু সাফাতের কাছে এসবের কোনোকিছুর ব্যখ্যার প্রয়োজন নেই। তার ভালো লাগে এই কন্ঠস্বর। তার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে বা দিনটা সুন্দরভাবে শুরু করতে এই কন্ঠটা প্রয়োজন। সাফাত নিজেকে দেখে অবাক হয়েছে। ও মিলার পরে আর কারো মায়ায় জড়িয়ে পরেছে!
সাফাত আফাফের কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে ওর পাশে দাঁড়িয়েই শীতের সকালটা উপভোগ করছে। কিছু সময় পর গিয়ে মোড়ের মাথার দোকান থেকে দুইকাপ দুধ চা কিনে নিয়ে আসে৷ পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দুজনেই সেই চায়ের স্বাদে নিজেদের অনুভূতিগুলোকে ডুবিয়ে নিচ্ছে আর কথা বলছে। ওদের সম্পর্ক এখন অনেকটা সহজ এবং সাবলীল।
**
রাত দুটোর দিকে আফাফের লেবার পেইন উঠলে ওকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে আসা হয়। সাফাতকে কল করে সেখানকারই একজন নারী। সাফাত তখন কোনোপ্রকার পরিকল্পনা ছাড়াই পড়িমরি করে ছুটে আসে হসপিটালে। সেই আগের মতো অনুভূতি! যেদিন মিলার ডেলিভারি ছিলো! সাফাত প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় ঘেমে যাচ্ছে। হাত পা কাঁপছে। এই কয়েকমাসে মেয়েটার মায়ায় বড্ড জড়িয়ে গিয়েছে। ওকে হারিয়ে ফেলার ভয়টাও তীব্র হচ্ছে। সাফাত টেনশন নিতে না পেরে পায়চারি করছে ক্ষিপ্র পদক্ষেপে।
বেশ অনেকটা সময় পর সরকারি হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের দরজাটা খুলে গেলো। একজন অল্প বয়সী নার্স একটা ছোট্ট শিশুকে সাদা তোয়ালেতে মুড়ে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। এখানে সেই আবাসিকের আরো দুজন মহিলা রয়েছে। তাদের একজন বাচ্চাটাকে কোলে নিতে যেতেই সাফাত তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজে কোলে নেয়। নবজাতকের নীলাভ মুখটা ঠিক তার মায়ের মতোই মায়াভরা। নার্স নিশ্চিত করলো, সে কন্যা, যদিও সাফাত জানতো। সাফাত প্রশান্তি পাচ্ছে তাকে কোলে তুলে নিয়ে। আবার ভয়ও হচ্ছে। সে নার্সকে আফাফের কথা জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলো, আফাফ সুস্থ আছে। সে আযান দিলো বাচ্চাটির কানে। নাম তার ‘ঝিকিমিকি’।
আফাফের জ্ঞান ফেরার পর নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আফাফ সেদিনের পর আবারও কাঁদলো। তবে এটা খুশির কান্না। আফ্রোদিতি!! তার মেয়ে অপরূপা সুন্দরী! আফাফের মনে হচ্ছে, তার এতোদিনের কষ্টের অবসান ঘটছে!
নীলাভ আর নাহিনও এসেছিলো ঝিকিমিকিকে দেখতে। আফাফের পাশাপাশি তাদের খুশিও যেন বাঁধ মানছিলো না। ঝিকিমিকিকে নিয়ে কতো পরিকল্পনাও করে ফেলেছে তারা। আফাফ বহু সংকোচ নিয়ে নীলাভকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলেছিলো নিদ্রের কথা। নীলাভ তেমন কিছুই বলেনি।
ঝিকিমিকি পৃথিবীতে এসেছে দেড়মাস হয়ে গিয়েছে। আফাফ এখন অনেকটা সুস্থ। শীতের সকালে আবাসিকে প্রতিদিনকার মতো সাফাতের আগমন। তবে আজ তাকে প্রথম দর্শনে অচেনা মনে হলো আফাফের কাছে। সাফাত ঝিকিমিকিকে নিজের দুচোখ ভরে দেখে নিলো। সে ঝিকিমিকির বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল। আগের থেকে এখানে যাতায়াত অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
আজকে কথাও কম বলেছে সাফাত। তবে যাওয়ার আগে অবিশ্বাস্য একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে সে। আফাফের দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎই বললো,
‘ফাবি, আপনি এখন ডিভোর্সি। তাই না?’
আফাফ ওনার কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ঝিকিমিকি পৃথিবীতে এসেছে। ও তো ডিভোর্সি! তবুও মানতে কোথাও কষ্ট হচ্ছে। আফাফ সাফাতের কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। সাফাত একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বললো,
‘মিকিকে আমি পরিচয় দিতে চাই। বিয়ে করবেন আমাকে।’
সাফাতের সংকোচহীন সরাসরি প্রস্তাবে আফাফ হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।
#চলবে
*আগের পর্বটা অগোছালো হওয়ার জন্য দুঃখিত। শব্দগুলো এবং তাদের বিন্যাস হয়তো একটু খটমটে হয়েছে। অনেকের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি অনেক ভেবে অন্যভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, তবে আমি স্বীকার করছি, আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমি হয়তো আসল বিষয়টাই বোঝাতে পারিনি। আর মাঝে মাঝে সংলাপ অপেক্ষা আশেপাশের বর্ণনার প্রয়োজন হয় গল্পের মাধুর্যের স্বার্থে। এজন্য কেউ আশাহত হলে, আমি দুঃখিত, আমার কিছু করার নেই।
*মাঝে মাঝে কিছু কমেন্ট পড়ে গল্প লেখার আগ্রহই হারিয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে, লেখিকা স্টার জলসা বা জি বাংলার দর্শক নয়😒😒। এটুকু গল্প লিখতে গিয়েই নিয়মিত প্রেশারের ওষুধের মতো আম্মুর বকা নিয়ম করে খাওয়া লাগে। আর এগুলো দেখতে বসলে তো বেচারা ফোনটা আলমারিতে উঠে যাবে।
*By the way, নায়ক কে আমি নিজেই কনফিউজড। কালকে গল্প দেবো না।