রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -৬২

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৬২
#Saiyara_Hossain_Kayanat

অপারেশন থেয়াটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আরশিকে। কিছুক্ষণ আগেই আরশি জ্ঞান হারিয়েছে। অজ্ঞান হয়েও রৌদ্রর হাত ধরে রেখেছিল শক্ত করে। আরশিকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই রৌদ্র দরজার কাছে মেঝেতে বসে আছে। রৌদ্রর অবস্থা পাগলপ্রায়। বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করছে। অসহ্য ব্যথা। চোখ দুটো জ্বালাপোড়া করছে। শুকিয়ে গেছে চোখের নোনাজল। এখন আর চোখ দিয়ে পানি আসছে না। ঘন্টাখানিক পর ডক্টর বেরিয়ে এসে জানালো রৌদ্রর মেয়ে বেবি হয়েছে। রৌদ্রর চোখে মুখে অস্থিরতা। এই মুহূর্তে আরশির খবর আগে জানতে চাচ্ছে সে। ডক্টর কিছুটা সময় নিয়ে অতি আফসোসের সাথে জানালো আরশি বেঁচে নেই৷ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে আরশি। রৌদ্র বিশ্বাস করলো না ডক্টরের কথা। ভয়াবহ উত্তেজিত হয়েই ডক্টরকে ঢেলে ভেতরে চলে আসলো। আরশির সামনে এসে দাঁড়ালো। আরশি বললে ভুল হবে এটা তো আরশির লাশ। সাদা কাপড়ে মুখ ঢেকে রাখা লাশ। রৌদ্র স্তব্ধ হয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা হাতে আরশির মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দিয়। ফ্যাকাসে বর্ণের মুখ, চোখের কোণে শুকিয়ে আছে অশ্রুজল। আরশির মুখটা বড্ড মায়াবী লাগছে রৌদ্রর কাছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি উঠে বলবে ‘ভালোবাসি রোদ’ আর তার সাথে সাথেই লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলবে। তবে এমন কিছুই হলো না। আরশি চোখ দুটো বন্ধ করেই শুয়ে আছে আগের মতো। রৌদ্র আরশির হাত ধরে কয়েকবার ডাক দিলো কিন্তু লাভ হলো না। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে রৌদ্রর। মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে কান্না করছে। রৌদ্র কান্নারত অবস্থায় আরশির শুকিয়ে যাওয়া মৃত ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। শেষ ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে দিল আরশির চিরল ঠোঁটে।বিশুদ্ধ অশ্রুজল গুলো রৌদ্রর গাল গরিয়ে পরছে আরশির গালে। রৌদ্র আরশির হাত ধরে ছুঁইয়ে দিল তার ঠোঁট। বিরবির করে কিছু বলে যাচ্ছে। খুব সম্ভবত ‘ভালোবাসি রুদ্রাণী’ কথাটাই বলছে। হঠাৎ করেই কি হলো জানা নেই। আচমকাই বুকে হাত দিয়ে মাটিতে ঢলে পরলো রৌদ্র। রৌদ্রর আরেকটা হাত দিয়ে এখনো আরশির হাত আঁকড়ে ধরে আছে। মাথাটা বেডের সাথের টেবিলে লেগে আছে আধশোয়া অবস্থায়। নিস্তেজ হয়ে পরেছে রৌদ্রর পুরো শরীর। হয়তো বা মৃত্যু ঘটেছে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। হয়তোবা রুদ্রাণীকে ছাড়া রৌদ্র বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পরেছিল।

রাত প্রায় দুটো। রৌদ্র বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। আরশি ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠছে বার বার। রৌদ্র খানিকটা ঝুঁকে ড্রিম লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার রুদ্রাণী কান্না করছে। চোখ দিয়ে গরিয়ে পরা পানি গুলো চিকচিক করছে। অস্বাভাবিক লাগছে আরশিকে। রৌদ্র আরশির গালে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলো। পরপর কয়েকবার ডাকার পর আরশি আচমকাই চোখ মেলে তাকালো। চোখেমুখে ভয়। শরীরটা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। রৌদ্র দিকে অপলক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলছে না। রৌদ্র আরশির দিকে ঝুঁকে বসে আছে। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যে কি হলো আরশির? কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরশি ঝাঁপিয়ে পড়লো রৌদ্রর বুকে। বুকে মুখ গুজে দিয়ে কান্না করছে হিচকি তুলে তুলে। রৌদ্র আরশিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে উত্তেজিত হয়ে বার বার জিজ্ঞেস করছে-

“কি হয়েছে আরু? কান্না করছো কেন! খারাপ সপ্ন দেখেছো বুঝি?”

আরশি কোনো উত্তর দিচ্ছে না। কান্না করেই যাচ্ছে অনবরত। রৌদ্র আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সে বুঝতে পেরেছে আরশি হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে। তাই এতটা ভয় পেয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষন পর আরশির কান্না থেমেছে। কিন্তু কান্নার ফলে এখনো কেঁপে উঠছে বার বার। আর একটু পর পর হিচকি তুলছে। রৌদ্র শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল-

“আরু কোনো খারাপ সপ্ন দেখেছো?”

আরশি মুখে কিছু বলল না তবে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। রৌদ্র আরশিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। আরশির চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে দু হাতে আরশির মুখ মুছে দিলো। গালে আলতো করে হাত রেখে বলল-

“আচ্ছা এখন এসব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। সামান্য একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো। এটার জন্য এভাবে কান্নাকাটি করে নিজেকে কষ্ট দিও না রুদ্রাণী।”

আরশি কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। অদ্ভুত রকমের চাহনিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। এটা কি শুধুই একটা সামান্য দুঃস্বপ্ন ছিলো!

“বারান্দায় যাবে আরু? ফ্রেস হাওয়ায় ভালো লাগবে তোমার। যাবে আমার সাথে!”

আরশি মাথা দুলালো। রৌদ্র বিছানা থেকে উঠে লাইট জ্বালালো। আরশিকে কোলে তুলে বারান্দায় নিয়ে আসলো। বারান্দার একপাশের মাঝারি সাইজের সোফাটায় আরশিকে বসিয়ে দিয়ে সে নিজেও আরশির পাশে বসে পরলো। চুপচাপ বসে আছে দুজনে। তাদের শব্দ পেয়ে পাখি গুলো চেচামেচি শুরু করে দিয়েছে। ময়না পাখিগুলো এখন অনেক কথা শিখেছে। তবে সব সময় শুধু “ভালোবাসি রোদ” আর “ভালোবাসি আরু” এই দুটো কথাই বলে। আর মাঝে মাঝে “তুলতুলের আম্মু” বলে ডাকে। এই কথাটা অবশ্য ধ্রুব শিখিয়েছে। এক সপ্তাহ হলো ধ্রুব দেশের বাহিরে গেছে। আবারও চেকআপ করিয়েছে। তেমন কোনো ভালো ফলাফল পাওয়া যায়নি। ধ্রুবর বাবা বলেছে অন্য দেশে নিয়ে যাবে। কিন্তু ধ্রুব কড়া গলায় না জানিয়ে দিলো। সে চায় না এভাবে দেশে বিদেশে ঘুরে সময় নষ্ট করতে। কোনো লাভ তো হচ্ছে না এভাবে সময় আর টাকা নষ্ট করে। তার চেয়ে বরং যতদিন বাঁঁচবে ততদিন না হয় সবার সাথে হেসেখেলেই পাড় করে দিবে। আজ সকালেই রৌদ্রকে ফোন করে জানিয়েছে ধ্রুব দু একদিনের মধ্যেই দেশে ফিরবে। ধ্রুব হাল ছেড়ে দিলেও রৌদ্র হাল ছাড়েনি। সে প্রতিদিনই নতুন নতুন ডক্টরের সাথে ধ্রুবকে নিয়ে অনলাইনে আলোচনা করছে। বড় বড় বিখ্যাত ডক্টরদের কাছে ইমেইল পাঠিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় হার্টের সন্ধান লাগিয়েছে। কোনো না কোনো একটা উপায় তো পাবেই।
বেশ কিছুক্ষন পর রৌদ্র আরশির দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল-

“কি সপ্ন দেখেছিলে আরু? খুব ভয় পেয়েছো মনে হচ্ছে?”

আরশি মিহি কন্ঠে ছোট করে জবাব দিল-

“তেমন কিছু না।”

রৌদ্র হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। আর কিছু বলল না। আরশি যেহেতু বলতে চাচ্ছে না তাই তাকে জোর করার কোনো প্রয়োজন মনে করছে না সে। শুধু শুধু আরও ভয় পেয়ে থাকবে। পাখিগুলো চেচামেচি বন্ধ করে দিয়েছে। আবারও নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে পুরো বারান্দায়। একটু পর পর বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে তাদের শরীরে। প্রতিবারই আরশি কেঁপে উঠেছে। আরশি নিরবতা ভেঙে নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই তখন আপনি কি করবেন রোদ?”

আরশির কথা রৌদ্র থমকালো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। মনের মাঝে চলছে ঝড়। ভয়াবহ ঝড়। ভিষণ কষ্ট, ভয় আর আতংক ছড়িয়ে পরেছে দেহের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভয়ংকর কষ্ট। যে কষ্ট দমন করা যায় না আর প্রকাশও করা যায় না। শুধু ভেতর ভেতর এই কষ্টের আঘাতে আহত হওয়া যায়। তবে ক্ষতস্থানে মলম লাগানো যায় না। রৌদ্র নিজেকে সামলিয়ে নেয়। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল-

“আমি আগেও তো বলেছিলাম তোমাকে। রৌদ্র তার রুদ্রাণীকে ছাড়া থাকতে পারবে না। তোমার কিছু হলে তোমার এই হার্টের ডক্টর নিজেই হার্ট এট্যাক করে মারা যাবে।”

কথা গুলো বলেই রৌদ্র মৃদু হাসলো। আরশি রৌদ্রর হাসি মুখের দিকে চেয়ে আছে। রৌদ্রর কথায় তার বুকে মোচড় দিয়ে উঠেছে। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে আরশি। চোখের সামনে ভাসছে তার দেখা দুঃস্বপ্নটা। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীর পায়ে রেলিঙের কাছে এসে রেলিঙ ধরে দাঁড়ালো। পাশের অন্ধকার বারান্দার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কতই না সুন্দর ছিল পাশের বারান্দায় থেকে চিঠি মাধ্যমে নিজেদের অনুভূতি ভাগাভাগি করা। কোনো ভয় ছিলো না তখন। আরশির মলিন মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুমন্ত শহর আরশির কাছে সব সময়ই প্রিয় ছিলো। কিন্তু এই মুহূর্তে সব কিছুই বিষাদ লাগছে। রৌদ্র আরশির পাশে এসে দাঁড়ালো। আরশি আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখেই শান্ত গলায় বলল-

“আমাকে একটা কথা দিবেন রোদ?”

রৌদ্র কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

“কি কথা!”

“কথা দিন আমার কিছু হয়ে গেলে আপনি নিজেকে সামলিয়ে নিবেন। শক্ত রাখবেন নিজেকে। আমাকে ছাড়া নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করবেন।”

রৌদ্রর চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। রাগে কপালের রগ ভেসে উঠেছে। দু-হাত কাঁঁপছে। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। তবে আরশি দেখতে পারছে না। সে আগের মতোই আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আজ রৌদ্র নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। আরশির দু বাহু শক্ত করে চেপে ধরে মুখোমুখি করে দাঁড় করালো আরশিকে। এতটাই শক্ত করে চেপে ধরেছে যে আরশি ব্যথায় কুকিয়ে ওঠেছে। এই প্রথম রৌদ্র তার সাথে এমন ব্যবহার করছে। রাগ প্রকাশ করছে। আরশিকে ব্যথা দিচ্ছে। আরশির ঠোঁট প্রসারিত হয়ে এলো। এখন আর ব্যথা অনুভব করছে না। ভালো লাগা কাজ করছে রৌদ্রর রাগ দেখে। মৃত্যুর আগে অন্তত একবার হলেও রৌদ্র তার উপর নিজের রাগ প্রকাশ করেছে ভেবেই আরশির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আরশির হাসি দেখে রৌদ্রর মাথায় ধপধপ করে রাগের শিখা জ্বলে উঠলো। বাঘের মতো হুংকার দিয়ে বলল-

“বার বার আজেবাজে কথা কেন বলছো? আমি বলেছি আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। থাকতে পারবো না মানে পারবো না ব্যস। এর পর যদি আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বা মরে যাওয়ার কথা তোমার মুখ থেকে শুনেছি তাহলে এক আছাড় দিয়ে এই বারান্দা থেকে ফেলে দিতে একটুও দ্বিধাবোধ করবো না। আমি নিজ হাতেই খুন করবো তোমাকে তার আমি নিজেও…”

আচমকাই আরশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রৌদ্রকে। রৌদ্র চুপ হয়ে গেল। দু’হাত মুঠ করে নিচে নামিয়ে রেখেছে। আরশিকে আগলে ধরছে না। আরশির প্রতি প্রচন্ডরকম রাগ কাজ করছে তার মধ্যে।

“ভালোবাসি রোদ। বড্ড বেশিই ভালোবাসি আপনাকে। আমি কখনোই আপনাকে ছেড়ে দিতে চাইনি। কিন্তু নিয়তি খুব নিষ্ঠুর রোদ। নিয়তি হয়তো চায় না আমরা একে অপরের পাশে থাকি। নিয়তি খুব নিষ্ঠুর রোদ।”

রৌদ্রর থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো-

“কি বলতে চাচ্ছো তুমি?”

আরশি রৌদ্রকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থাতেই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো-

“আর কত লুকিয়ে রাখবেন রোদ? আপনি কি ভেবেছেন আমি কিছুই জানি না! কিছুই বুঝতে পারিনি না? আপনাদের অভিনয় আমি বুঝতে পারবো না এতটা বোকা আমি নই।সারারাত আমার দিকে চেয়ে নির্ঘুম কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমার সামনে সবাই হাসছেন তবে প্রানহীন হাসি। সব কিছুই আমি খেয়াল করেছি রোদ। কিন্তু কিছু বলিনি। আমি তো অনেক আগে থেকেই জানতাম। আমার প্রেগ্ন্যাসি রিপোর্ট দেওয়ার সময়ই ডক্টর আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আমার প্রেগ্ন্যাসির সিচুয়েশন খুবই ক্রিটিকাল। রিস্ক থাকবে। তুলতুল আর আমার দুজনের জীবনই অনিশ্চিত। যদিওবা চান্স খুব কম তবে ভাগ্য ভালো থাকলে আমরা দুজনেই সুস্থ থাকতে পারি। ডক্টর বলেছিলেন আমি চাইলে এবশন করাতে পারি। কিন্তু আমি রাজি হইনি। কিভাবে আমি এই নিষ্ঠুরতম কাজ করতাম রোদ? আমাদের কত কষ্টের ফল এই তুলতুল। আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন। আমাদের জীবনের অপ্রত্যাশিত একটা চমৎকার গিফট। আমি কিভাবে পারতাম তুলতুলকে মেরে ফেলতে! তাই রিস্ক নিয়ে নিলাম। যদি অপ্রত্যাশিত ভাবে আবারও ভালো কিছু পেয়ে যেই সেই লোভে।”

রৌদ্র আরশিকে দূরে সরিয়ে দিলো। কঠিন গলায় বলল-

“সব কিছু জেনেও কেন এমন করলে আরু? একটা বাচ্চাই কি তোমার কাছে সব ছিলো? আমার কথা কি একবারও ভাবোনি? তোমার কিছু হলে আমার কি হবে সেটা চিন্তা করোনি কখনো? এই অনাগত বাচ্চাটার মায়ায় জড়িয়ে যাওয়ার পর তাকে হারিয়ে ফেললে কি হবে ভেবে দেখোনি? কিছুই কি চিন্তা করোনি তুমি?”

আরশি চুপ করে আছে। রৌদ্র আরশির বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে বলল-

“আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছো না কেন?”

আরশি খানিকটা কেঁপে উঠলো। ভয় জড়ানো কন্ঠে বললো-

“ভেবেছি রোদ। প্রথম থেকেই ভেবে যাচ্ছি। কিন্তু তুলতুলের কথা বলার পর আপনার মুখে যেই খুশিটুকু দেখেছি সেই খুশিটা আমি কেড়ে নিতে চাইনি আপনার কাছ থেকে।”

রৌদ্র আরশিকে ছেড়ে দিলো। হতাশ হয়ে ক্লান্ত গলায় বলল-

“আমি বাচ্চা চাইনি আরু। আমি তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে চেয়েছিলাম। তোমাকে হাসিখুশি দেখতে চেয়েছিলাম। তোমার সাথে সারাজীবন বাঁচতে চেয়েছিলাম আরু। ভালোবাসতে চেয়েছিলাম তোমাকে। যদি জানতাম তোমার ইচ্ছে পূরণের জন্য তোমাকেই হারিয়ে ফেলতে হবে তাহলে কখনই এই অভিশপ্ত ইচ্ছে পূরণ করতে চাইতাম না।”

আরশি ভড়কে উঠলো। শক্ত গলায় বলল-

“অভিশপ্ত কেন হবে রোদ? আপনি কি বলছেন এসব? তুলতুল আমাদের সব। আমি জানি আপনিও তুলতুলকে ভালোবাসেন। তাহলে কেন এসব আজেবাজে কথা বলছেন? আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে। উনি যা করবেন আমাদের সকলের ভালোর জন্যই করবেন। তুলতুল আমাদের গুড লাক। আমি জানি ও কখনো আমাদের জীবনে বিষাদ বয়ে আনবে না। তুলতুল আমাদের আমাদের ছোট্ট পরিবারে ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে আসবে। খুশির জোয়ার বয়ে আনবে। আর মাত্র তো কিছু দিন। তারপরই তুলতুল আমাদের মাঝে চলে আসবে তার ছোট ছোট হাত পা নিয়ে।”

আরশি শেষের কথা গুলো খুব আবেগী হয়ে বলল। রৌদ্র আরশির দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আরশি চুপ হতেই রৌদ্র আরশিকে জড়িয়ে ধরলো। অবুঝ অসহায় বাচ্চাদের মতো কান্না জুরে দিয়েছে। রৌদ্রর কান্নার সাথে কেঁপে উঠছে আরশির বুক। আরশি নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে। এখন তাকে শক্ত থাকতে হবে। ভেঙে পরলে চলবে না। রৌদ্রকে সামলাতে হবে তার। আরশি রৌদ্রর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রৌদ্র জড়ানো কন্ঠে বলল-

“আমি তোমাদের সবাইকে সুস্থ চাই আরু। আমি নিজের চোখের সামনে তোমাদের কাউকে হারিয়ে যেতে দেখতে পারবো না। আমি তোমাক চাই। আমি তোমাকে সারাজীবন আমার পাশে চাই আরু। তুলতুলকেও চাই আমাদের ছোট্ট সংসারে। ধ্রু…”

রৌদ্র থেমে গেল। ধ্রুবর কথা আরশিকে বলার মতো সাহস তার নাই। এক সাথে এতো কষ্টের বোঝা সে আরশিকে দিতে চায় না। রৌদ্র নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে হাল্কা হেসে বলল-

“রুমে চল আরু। সকাল হয়ে যাচ্ছে। তোমার ঘুমাতে হবে নাহলে শরীর খারাপ করবে।”

রৌদ্র আরশির হাত ধরে ধীরে ধীরে রুমে নিয়ে আসলো। আরশি আর কোনো কথা বাড়ায় নি। দুজনেই পাশাপাশি শুয়ে আছে তবে কারও চোখেই ঘুম নেই।

—————————

আরশি প্রেগ্ন্যাসির আট মাস শেষ হয়ে ন’মাস চলছে। দিন যাচ্ছে দ্রুত। তার সাথে ভয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সেটা কেউ প্রকাশ করছে না। প্রকাশ করছে ভালোবাসা। তীব্র গাঢ় ভালোবাসা। যখন তখন একে অপরকে হুট করেই ভালোবাসি বলা এখন রৌদ্র আর আরশি অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রতি রাতে বারান্দা বসে চন্দ্রবিলাস করা আর চাঁদ না উঠলে অন্ধকারবিলাস করা তাদের নিয়ম হয়ে উঠেছে। যতটা পারছে ভালোবাসা দিয়ে দিন গুলো রঙিন করে তুলছে।

আজ সকাল থেকেই আরশির মনটা ছটফট করছে। কিছু খারাপ হতে চেলেছে সেই ভয়ে সকাল থেকে পায়চারি করে যাচ্ছে। রৌদ্র রান্নাঘরে আরশির জন্য রান্না করছে। হঠাৎই বারান্দা থেকে কিছু একটার বিকট শব্দ আসলো। আরশি কোমড়ে এক হাত দিয়ে পা টিপে টিপে বারান্দায় আসলো। রৌদ্র আর রুদ্রাণীর খাঁচাটা নিচে পড়ে আছে। পাখি দুটো নেই। খাঁচায় পাখি দুটোর অনেক গুলো পালক দেখা যাচ্ছে। সামনের বড় গাছটাতে একটা চিল বসে আছে। আরশি দ্রুত পায়ে খাঁচাটা এসে ধরতেই চিলটা উড়ে গেল। রৌদ্র রুদ্রাণী নামক পাখি দুটোকে দেখতে পেলো না। পুরো বারান্দায় খুঁজেও পাচ্ছে না। ময়না পাখিগুলো পাখা ঝাপটিয়ে চেচামেচি করছে। তাদের সঙ্গী হারিয়ে ফেলার তীব্র কষ্ট প্রকাশ করছে চেচিয়ে চেচিয়ে।

চলবে…

[প্রায় অনেক দিন আগে খবরের চ্যানেলে দেখেছিলাম সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় স্ত্রী মারা যায় আর সেটা শুনে স্বামী সাথে সাথেই হার্ট এট্যাকে মারা যায়। বাচ্চাটা সুস্থই ছিল। অনেকদিন আগের কথা। তাদের নাম মনে নেই। আমি ভেবেছিলাম গল্পের এন্ডিং এভাবে দিবো। কিন্তু তা আর হলো না। আপনারা রৌদ্র রুদ্রাণীকে হ্যাপি দেখতে চান তাই আপনাদের ইচ্ছে রাখতে থিম পাল্টে দিয়েছি। তবে আপনারা চাইলে এই পর্ব ডিলিট করে আমার ভেবে রাখা থিমেই এন্ডিং দিতে পারি।🙄 যাইহোক নীরব পাঠকেরা একটু সাড়া দিন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here