রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -৬৪

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৬৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

রৌদ্র অস্থির হয়ে পড়ছে আরশির কান্না দেখে। বেশ কিছুক্ষন সময় ধরে আরশিকে সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। আরশি আগের মতোই ব্যথা কাতরাচ্ছে। মৃদুস্বরে আর্তনাদ করছে আর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। রৌদ্রর চোখ দুটো পানিতে ছলছল করে ভরে উঠেছে। আরশিকে এভাবে যন্ত্রণা পেতে দেখে তার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে। একটু পরেই আরশিকে সিজারের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। রৌদ্র সকল ব্যবস্থা কমপ্লিট করেই আরশির কাছে এসেছে। রৌদ্র আরশির হাত ধরে অস্থিরতার সাথে বলল-

“আরু আর কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরো প্লিজ। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তীব্র ব্যথার মাঝেও আরশি মুখে হাসি দেখা দিল। রৌদ্রর হাত শক্ত করে ধরে অস্পষ্টতার সাথে আধো আধো করে বলল-

“একটা কথা রাখবেন রোদ!”

রৌদ্র আরশির হাত তার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল-

“তোমার কোনো কথা তো আমি কখনো ফিরিয়ে দেই নি আরু।”

আরশি বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিল। নিম্ন স্বরে জোড়ালো কন্ঠে বলল-

“রোদ.. আর একবার ভালোবাসি বলবেন আমাকে!”

কথাটা বলার সাথে সাথে আরশির চোখ থেকে কয়েক ফোটা গরম অশ্রুজল গড়িয়ে পরলো। রৌদ্র থমথমে চেহারায় আরশির দিকে চেয়ে আছে। প্রচন্ড ভয় করছে তার। আরশিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। তাদের ভালোবাসার সন্তান তুলতুলকে হারিয়ে ফেলার ভয়। এভাবেই কি শেষ হবে সব কিছু! না-কি নতুন করে শুরু হবে! এই রৌদ্র রুদ্রাণীর শহরে কি নতুন করে সূর্যের আলো দেখা দিবে! অনিশ্চয়তার মাঝে ঝুলে আছে তাদের ভালোবাসার সংসার। রৌদ্র আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল-

“শুধু একবার না আরু। হাজার বার বলবো। সারাজীবন বলে যাবো আমি তোমাকে ভালোবাসি রুদ্রাণী।”

আরশির মুখে তৃপ্তির হাসি। জড়ানো কন্ঠে বলল-

“আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি রোদ। একটা অনুরোধ রাখবেন! আমার কিছু হয়ে গেলেও আপনি নিজেকে সামলিয়ে নিবেন। আমার অনুরোধ রাখার জন্য হলেও নিজের জীবন নতুন করে শুরু…. ”

রৌদ্র আরশিকে থামিয়ে দেয়। আরশির গালে হাত রেখে উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-

“কিছু হবে না তোমার। আমি তোমাকে কিচ্ছু হতে দিবো না আরু।”

রৌদ্র আরশির কপালে গভীর ভাবে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। আরশির কাঁপা কাঁপা ঠোঁট আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। আরশিকে ছেড়ে দিয়ে রৌদ্র কেবিনের বাহিরে এসে আবারও ডক্টরদের ডাকতে লাগলো। নার্সরা আসছে। সব কিছুই রেডি হয়ে গেছে। এখনই আরশিকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে। আরশিকে ওটিতে ডুকানো হবে কিন্তু আরশি রৌদ্রর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ডক্টরা তাড়া দিচ্ছে কিন্তু আরশি রৌদ্রর হাত ছাড়ছে না। চোখের সামনে বার বার সেই দুঃস্বপ্নটা ভেসে উঠছে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। পুরো মুখ চোখের পানিতে ভিজে আছে। চোখের পাপড়িগুলো একটা আরেকটার সাথে লেগে আছে। আরশি ইশারায় রৌদ্রকে কাছে আসতে বলল। রৌদ্র আরশির একদম কাছে তার মুখ নিয়ে গেল। আরশির নিজের মাথাটা হাল্কা উঁচু করে রৌদ্র কানের কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে বলল-

“তোমাকে ভালোবাসি রোদ।”

আরশি ছেড়ে দিল রৌদ্রর হাত। আরশিকে ওটিতে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। রৌদ্র আগের জায়গাতেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আরশি তাকে এই রকম পরিস্থিতিতে প্রথম বার তুমি সম্মোধন করে বলবে সেটা রৌদ্র কখনো কল্পনা করেনি। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার। অসহ্য ব্যথা, হাহাকার। কান্না করতে চাইলেও কান্না আসছে না। চুপচাপ দরজার পাশে মেঝেতে বসে পরলো। দু হাটুতে হাত রেখে মাথাটা হাল্কা নিচু করে রেখেছে। মিনিট পাঁচেক সময় পেরুতেই নীল, আদ্রাফ, কাসফিয়া, নীলা আর নির্বান আসলো। সবাই অস্থিরতার সাথে রৌদ্রকে নানানরকম কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। কিন্তু রৌদ্র কোনো কথা বলল না। মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করেনি। আর মাথা তুলেও তাকায়নি কারও দিকে। সকলের মুখে চিন্তার ছাপ। কাসফিয়া চেয়ারে বসে আছে। তার পাশেই নীলা সাদাফকে কোলে নিয়ে বসে আছে। নীল আর আদ্রাফ অস্থিরতার সাথে পায়চারি করছে। খানিকটা সময় পর ধ্রুব আসলো। ধ্রুবর মাও তার পেছন পেছন আসছে।

“আরুদি’র কি অবস্থা? কখন বের হবে আরুদি?”

প্রচন্ড অস্থির হয়েই জিজ্ঞেস করলো ধ্রুব। নীল চিন্তিত গলায় বলল-

“কিছুই বুঝতে পারছি না৷ রৌদ্র ভাই তো কোনো কথাই বলছে না।”

ধ্রুব এক ঝলক রৌদ্রর দিকে তাকালো। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ চেয়ারে বসে পরলো। অপেক্ষা করছে সবাই। ঘন্টাখানে সময় পর সকলের অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটিয়ে ডক্টর বেরিয়ে আসলো। এবার রৌদ্র নড়েচড়ে উঠেছে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল-

“আমার আরু কেমন আছে?”

ডক্টর হাসি মুখে বলল-

“আপনার মেয়ে হয়েছে ড.রৌদ্র।”

রৌদ্র আবারও শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো-

“আমার আরু কেমম আছে ডক্টর?”

“মিসেস আরুর ভাগ্য খুবই ভালো হাই রিস্ক প্রেগ্ন্যাসি থাকা শর্তেও সিজারের সময় আমাদের তেমন কোনো প্রব্লেম হয়নি। তবে…”

“তবে কি?”

রৌদ্র উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো। রৌদ্রর উত্তেজনা দেখে ডক্টর কিছুটা ভড়ে উঠলো।

“আসলে বাচ্চার অবস্থা বেশি একটা ভালো না তাই বাচ্চাকে কিছুদিনের জন্য হসপিটালেই রাখতে হবে। তবে চিন্তার কিছু নেই অল্প কয়েক দিনেই আপনাদের বাচ্চা সুস্থসবল হয়ে উঠেবে।”

রৌদ্র কোনো কথা বললো না। নীল, আদ্রাফ, নির্বান আর ধ্রুব একে একে রৌদ্রকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাচ্ছে। কাসফিয়া আর নীলা খুশিতে প্রায় কেঁদেকেটে একাকার। ধ্রুবর মা সাদাফকে কোলে নিয়ে হাসি মুখে কাসফিয়া আর নীলাকে দেখছে। সবাই খুশিতে প্রায় নাচানাচি করছে। কিন্তু রৌদ্র নির্বাকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। আর হাসছেও না। ঘন্টা খানেক পর আরশিকে কেবিনে শিফট করা হয়। রৌদ্র এক মুহূর্ত দেরি না করে হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ছুটে আসে। আরশির সামনে এসেই রৌদ্র থমকে দাঁড়ায়। আরশির চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া নোনাপানির দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আরশি। রৌদ্র আর দেরি করলো না। তৎক্ষনাৎ আরশিকে জড়িয়ে ধরলো আলতো করে। আরশি চোখে মেলে তাকায়। রৌদ্রর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আরশি গলার কাছে গরম তরল পদার্থ জাতীয় কিছু অনুভব করলো। রৌদ্র কান্না করছে! আরশি রৌদ্রকে ছাড়ানো চেষ্টা করে মিহি কন্ঠে বললো-

“আমরা ঠিক আছি রৌদ্র কান্না করছেন কেন!”

রৌদ্র কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে৷ কয়েক মিনিট পাড় হতেই রৌদ্র সোজা হয়ে আরশির পাশে বসে। বিশ্বজয়ী এক হাসি দিয়ে বলল-

“তুমি জানো! আমাদের মেয়ে হয়েছে আরু।”

আরশি হাল্কা হাসলো। রৌদ্র আবারও বলল-

“আর মাত্র কয়েকদিন পর তুলতুলকে কোলে নিতে পারবো। তুলতুল হাসবে। কান্না করবে। ছোট ছোট হাতে আমার আঙুল আঁকড়ে ধরবে। একদম তোমার মতো হবে ছোট্ট একটা পরি।”

আরশি আবারও হাসলো। রৌদ্রর বাচ্চাদের মতো কথা শুনে আরশি সকল ব্যথা যন্ত্রণা নিমিষেই ভুলে গেল। অপলকভাবে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। রৌদ্রর চোখ খুশিতে চিকচিক করছে। উৎসাহিত হয়ে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। আরশি মনোযোগ দিয়ে রৌদ্রর কথা শুনছে। দু’জনের মুখেই হাসি। তৃপ্তিদায়ক হাসি। রৌদ্রর রুদ্রাণীর শহরে আবারও রোদের আলো দেখা দিলো। রোদের ঝিলমিলি আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পুরো শহর।

——————————

আজ প্রায় সাত দিন পর তুলতুলকে সাধারণ কেবিনে সিফট করেছে। আরশির পাশেই রাখা হয়েছে তাদের ছোট্ট তুলতুলকে। রৌদ্র একটু পর পর এসে তুলতুলের হাত ধরছে, গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো বিহেব করছে রৌদ্র। খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে গেছে। হঠাৎই কেবিনের ধরজা খোলার শব্দ পেল। আরশি আর রৌদ্র কৌতুহলী চোখে দরজার দিকে তাকালো। নীল, নির্বান, নীলা, কাসফিয়া, আদ্রাফ দাঁড়িয়ে আছে দল বেধে। হঠাৎই তাদের পেছন থেকে ধ্রুব বড় একটা কালো রঙের বোর্ড নিয়ে বেরিয়ে আসলো। বোর্ডের মধ্যে বড় বড় করে হলুদ রঙের লেখা “YOU ARE MY SUNFLOWER” “ধ্রুবর তুলতুল পাখি” লেখাগুলোর পাশে অনেক গুলো সূর্যমুখী ফুলের ছবি।

চলবে…

[কালকেই গল্পের সমাপ্তি হবে। আপনাদের কথা মতো হ্যাপি এন্ডিং দিলাম। তবে খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে গত কয়েক পর্বে আপনাদের রেসপন্স খুবই কম ছিলো। যাই হোক অবশেষে গল্পটা শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে এটাই অনেক। হ্যাপি রিডিং। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here