লাভ রেইন পর্ব-১০

0
2463

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ১০

২৩.
বৃষ্টির কঠিন রূপ,যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে স্ফটিকের আকারে বিরাজ করে তা হলো ‘তুষার’। এটি প্রকৃতপক্ষে পানির কঠিন রূপ অর্থাৎ বরফ।শীতকালে তাপমাত্রা যেখানে শূন্য ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায় সেখানে মেঘ থেকে তুষার পতিত হয়।মেঘ হতে নিঃসারিত পানি বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে নিম্ন তাপমাত্রায় জমে বরফে পরিণত হয় এবং তা পতিত হয় ভূমিতে।

স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের ‘নিউ টাউন’ অর্থাৎ নিজ জন্মস্থানে গতকাল ফিরে এসেছে তেহভীন,সাথে তার পরিবার। অদূর প্রান্তে তুষার পতিত পিচঢালা রাস্তা,এবং বাড়িঘর গুলের দিকে দৃষ্টি তাক করে রেখেছে তেহভীন। গভীন সূঁচালো দৃষ্টিতে নিঃসৃত বৃষ্টির কঠিরূপের আগমন দেখছে। মনে মনে এরূপকে ‘হার্ড রেইন’ বলে অখ্যায়িত করলো তেহভীন। একদম নিজের জীবনের অনুরূপ। ঠকঠক শব্দ তুলে কেউ একজন তেহভীনের কামরায় প্রবেশ করলো। তেহভীন সেদিকে নজর রাখলো না।মৌন থেকে চেয়ে আছে উইন্ডোর দিকে। মি.মেথেউ তেহভীনের দিকে একপলক চেয়ে ইশারা করলো। তামান্না হালকা কেশে তেহভীনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তেহভীন তাঁকালো না। ছেলেকে ভাবলেশহীন হয়ে বসে থাকতে দেখে মেথেউ এ্যাসফোর্ড গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

— টামান্না-টেহভীন তোমাদের ছুটি গতকাল শেষ। আজ রাতে তোমরা দু’জনে কাজে ব্যাক করছো।
আমি কোনরূপ এক্সকিউজ শুনবো না। আগামী ছয়মাসে তোমরা আর কোন ছুটির আবেদন করতে পারবে না। তাহলে তোমাদের লাইসেন্স আমি বাতিল করে দিবো,উইথ আউট এ্যানি নোটিফিকেশন।

সাদা একটা খাম তেহভীনের বেডের উপর রেখে চলে যান মি.মেথেউ। তামান্না চিন্তিত দৃষ্টি ছুঁড়লো তেহভীনের দিকে। দুইদিন ধরে কেমন চুপ হয়ে আছে সে। প্রয়োজনের বাইরে কথাও বলছে না। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তামান্না জানে তেহভীন কতো দুরন্ত স্বভাবের ছেলে। তেহভীনের পাশে ডিভাইনে বসলো তামান্না। তেহভীনের বাহুতে দৃঢ়ভাবে হাত রেখে মালিশ করলো।এরপর বলল,

— কি হয়েছে তোমার? এমন চুপচাপ কেন?
এনিথিং রং?

তামান্নার কথায় মৃদ্যুু হাসলো। বলল,

— এভরিথিং ওকে সিস,ডোন্ট ওয়ারি।

— রিফ্রেশমেন্ট কাটাতে তুমি বেংলাডেশে যেতে চেয়েছো।সীমিত সময় কাটানোর পর অবশ্যই তোমার চেহারা আমোদিত আমেজ থাকার কথা।তুমি এমন মনমরা কেন?হুয়াট’স ইউর প্রবলেম?

তেহভীন তাচ্ছিল্য হাসলো,বলল,

— ইউ নোউ সিস,আই এম এনগেজড।

— ইয়েস! উইথ ক্যাথরিন।

তেহভীন ক্রুর স্বরে বলল,
—-ইট’স যাস্ট দ্যা বিগেস্ট প্রবলেম ইন মাই লাইফ!

তামান্না বিস্ময়বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলো তেহভীনের মুখপানে। এনগেজমেন্ট হওয়ার আগে তেহভীনের মতামত ছিলো না। পরবর্তী সময়ে তেহভীনকে আর অমান্য করতে দেখা যায় নি আজ অবধি। মূলত ড্যাডের কথায় ক্যাথরিনকে রিং পড়াতে বাধ্য হয়েছিলো তেহভীন। বিগ-ব্রো চলে যাওয়ার পর তেহভীনের উপর ভীষণ চাপ দিতে শুরু করেছিলো ড্যাড। সে চাপ এখনো বিধ্যমান। তামান্না স্মিথ হেসে বলল,

— তোমার যদি এই সম্পর্কে আপত্তি থাকে তুমি নাকচ করে দাও। শুধু শুধু মন খারাপ করে রেখেছো।ড্যাডকে বলো। উনি রাজি হবেন।

— বলেছিলাম, তখনো মানেনি,আজও মানবে না।

তেহভীন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উইন্টার জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।সন্ধ্যায় এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে দু’জনকে। রাত জেগে থাকতে হবে আজ। পর্যাপ্ত ঘুমটা ভীষণ প্রয়োজন এখন তাদের। কিন্তু তেহভীন সেসব তোয়াক্কা না করে নিঃসৃত তুষারের মধ্যে বেরিয়ে গেলো। তামান্না তেহভীনের চলে যাওয়া দেখে হতাশ হলো।

২৪.
রাত নয়টা, সায়মন আর সিলিভিয়া খাবার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথাবার্তা বলছে। জুবান সায়মনের হাত থেকে ভাতের লোকমা মুখে পুরছে। আকবর সাহেব নিশ্বব্দে খাচ্ছেন।দিন-দুনিয়ার খবর উনি কম রাখেন।রুজিনার নজর জুলিয়ার কক্ষের দিকে। মেয়েটা অদ্ভুত অসুখের কারণে একেবারে মিঁইয়ে গেছে। কোন সাড়াশব্দ অবধি নেই। রান্নাটাও হয়তো আজ করেনি। সায়মনের আচরণেও রুজিনা ভীষণ ব্যাস্ত। রুজিনার খেতে বসতে মন সায় দিচ্ছিলো না।

পরশুদিন ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে আসার পর মেয়েটা কেমন চুপসে গিয়েছে। জুলিয়া নিজের মাকে ফোন করে জানিয়েছিলো নিজের সমস্যাটা।উনি কানেও তুললেন না সেটা।বাধ্য হয়ে রুজিনা আগ বাড়িয়ে জুলিয়াকে বলল সে নিয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে। তখন জুলিয়ার মুখে অবস্থা যা ছিলো সেটা মনে পড়লে রুজিনার হাসি পায় মনে মনে।কেমন আচম্বিত চেহারা। রুজিনা খাবার শুরু করার আগে উঠে দাঁড়ালো, এরপর জুলিয়ার রুমের দিকে পা অগ্রসর করলো।
মিনিট পাঁচেক অতিক্রম করার পর রুজিনা জুলিয়াকে নিয়ে বের হলো।সায়মন আর সিলিভিয়া চোখাচোখি হলো একবার,এরপর অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। রুজিনা সেসবে পাত্তা দিলো না।জুলিয়াকে ইশারায় বসতে বললো। ক্ষুদার্ত পেটের আহাজারি থামাতে জুলিয়াও বসে পড়লো খাবারের পাতে। অনুতপ্ত বোধের কারণে গত একদিন কিছু মুখে দিতে পারেনি সে। আজ পেটে যন্ত্রণা, আর শাশুড়ি আদরমাখা বাক্যবাণী শুনে নিভৃতে মজে গেলো জুলিয়া।

২৫.

হাজারও যাত্রীদের নিজেদের গন্তব্য পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে ওয়েটিং রুমে ফিরলো তেহভীন।
টানা ছয়ঘন্টা এয়ারপ্লেন চালানো জার্নি শেষ করার পর শরীরে ভীষণভাবে ক্লান্তি অনুভব করলো তেহভীন।এর আগে কখনো এমনটা হয়নি তার সাথে। টানা দিনরাত প্লেন চালাতো, সে ফুরফুরে মন মেজাজ নিয়ে। আর আজ হাত-পা অসাড়তায় ঝেঁকে ধরছে যেনো তাকে। এটা হওয়ার মূল কারণ দুশ্চিন্তা এবং অপরিপূর্ণ ঘুম। তেহভীন চুপচাপ ওয়েটিং রুমে অল্প মুহূর্ত অপেক্ষা করলো।আধঘন্টা পর তামান্না ওয়েটিং রুমে আসলো। দু’জনে এখন সেইম ডিজাইনের ইউনির্ফম পরিহিত।ব্ল্যাক এন্ড হুয়াইট,যেটা মূলত পাইলটদের গায়ে জড়ানো থাকে।
তামান্না এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

— হ্যাঁ তেহভীন বলো।

তেহভীন ক্লান্তস্বরে বলল,

— আই নিড এয়াপোর্ট লেওভার সিস। তুমি যাবে?

— না, তুমি যাও লেওভারে। ফ্রেস হয়ে একটা স্ট্রং কফি নাও,এরপর ঘুমাও। দেখবে এরপর তোমার শরীরের সব ক্লান্তি দূর।

তেহভীন তামান্নার কথায় স্মিথ হাসলো। বলল,

— মনের ক্লান্তিতে জব্দ হয়ে আছি সিস,সেখানে শরীরের ক্লান্তি কিভাবে দূর হবে?

তামান্না আলতো ভাবে তেহভীনে মাথায়
চড় মেরে বলল,

— ফিল্মের ডায়লগ দেওয়া বন্ধ করো।

তেহভীন উঠে দাঁড়ালো। ফোন পকেটে রেখে নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো স্পেশাল কামরার দিকে। বর্তমানে সে এখন কানাডা এয়ারপোর্টে আছে। ক্লান্ত হওয়ার কারণে কানাডা এয়ারপোর্টে লেওভার নিলো সে।

২৬.

নতুন বছরের সূচনাটা মন খারাপ রেখে করতে চাইলো না আজ সিলিভিয়া। যেহেতু বছরের প্রথম দিন, হাসিখুশী ভাবে কাটাতে চাইলো সে। আহামরি রূপে কোন আয়োজন নেই। শুধু অনাকাঙ্খিত ভাবে আগমন হওয়া ব্যাক্তিটিকে ভুলে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাবে ভাবলো সে। নিজেকে নিজে খুশী রাখবে। নিজেকে স্টেবলিশ দেখার অভিসন্ধি প্রখর সিলিভিয়ার। মাস্টার্স টা কম্পলিট করবে বলে সিন্ধান্ত গ্রহণ সিলিভিয়া।

কিন্তু তার আশায় পানি ঢেলে দিতে, রামিশ উপস্থিত হলো তার স্ব-পরিবার নিয়ে। অপরিচিত মানুষের কন্ঠস্বর শুনে রুম থেকে বের হয়েছিলো সিলিভিয়া। রামিশ আর তার পরিবার কে একসাথে ড্রয়িংরুমে বসে আলাপ আলোচনা করতে দেখে মাথা ঘুরে উঠলো সিলিভিয়া। মা -বাবা কেও কেমন হাসিখুশি দেখাচ্ছে। সিলিভিয়া এগিয়ে আসতে চাইলে,হঠাৎ রামিশ মাঝখান থেকে উঠে এসে সিলিভিয়া সামনে এসে বাঁধা প্রধান করলে। সিলিভিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাঁকালো রামিশের দিকে। রামিশ সিলিভিয়ার হাত ধরে ঠেলে ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,

— খবরদার কোন জামেলা করবি না। সব ঠিকমতো হতে দে।নইলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।

সিলিভিয়া কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে ব্রেক কষার মতো দাঁড়িয়ে গেলো। রামিশের দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে নিজের হাতদ্বয় দিয়ে খোলা চুল খোঁপা করে নিলো। এরপর রামিশের দিকে এগিয়ে গিয়ে চোখের দিকে চেয়ে বলল,

— কিন্তু তুই তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর রূপ দেখবি আমার ‘রামিশ।আমি অনেকবার না করেছি তোকে।তোর কানে আমার কথা ঢুকে না? নাকি কানে গরম সীসা ঢেলে দিবো?

রামিশ অবাক হয়ে সিলিভিয়ার দিকে তাকালো।সিলিভিয়ার সাথে সে ক্লাস ফাইভ থেকে পরিচিত।এরপর বন্ধুত্ব।কিন্তু কখনো এতোটা রুষ্ট আচরণ করতে দেখেনি সে।

(চলবে)
আমার লেখাটা নিউজফিডে দেখা গেলে অবশ্যই রিয়েক্ট করবেন।পেজে রিচ কমে গিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here