লাভ রেইন পর্ব-৯

0
2182

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ০৯

১৯.
মিঁইয়ে যাওয়া মনকে সন্তপর্ণে সামলে নিতে ব্যর্থ হলো সিলিভিয়া। দৃষ্টি নিবদ্ধ রইলো অদূরদর্শী শ্বেত যুবকটির গমনপথের দিকে। লম্বা পা ফেলে ফেলে ফিরে যাচ্ছে নিজের গন্তব্যের দিকে। একটিবার পেছনে ফিরে তাঁকালো না। যার জন্য সিলিভিয়ার মন এতো পুড়ছে,তার উচিত ছিলো না একটি বার পেছনে ফিরে দেখার।

কাঁধে কারো রুষ্ট স্পর্শ পেলো সিলিভিয়া।স্পর্শদাতাকে দেখার অভিসন্ধি পূর্ণ করতে পেছনে ফিরে তাকালো সিলিভিয়া। অনাকাঙ্খিত ব্যাক্তিটিকে দেখে মন খারাপের মাঝেও মেজাজ কুপিত হয় সিলিভিয়ার। ঠোঁটদ্বয় ফাঁকা করে কিছু বলতে গেলো সিলিভিয়া, তার আগে রামিশ বলে উঠলো,

— তোর জন্য আমিই পারফেক্ট সিলি। ওইসব বিদেশী পোলা তোর মন বুঝবে না। তো,এই অধ্যায়ের অন্তিম পর্ব এতটুকুই হোক।

সিলিভিয়া ঝট করে কাঁধ থেকে হাত নামালো।মিঁইয়ে যাওয়া কন্ঠস্বরে জোর দিয়ে বলল,

— আমার অন্তিম-সূচনা কোথায়,কার সাথে, কিভাবে হবে সেটা তোকে ভাবতে হবে না।তোকে কে দেখতে বলেছে? যা দূর’হ এখান থেকে।

রামিশ চোখে হাসলো,বলল,

— সকাল থেকেই দেখে আসছি দোস্ত।তুই ওই পোলাডার উপর মজে আছিস। শুধু শুধু তোরে দিয়ে গাধারখাটুনি খাটাইছে সারাদিন।আমি ভাবছি তোর এতো ধৈর্য উদয় হলো কখন থেকে?

রামিশের কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে সিলিভিয়া বলল,

— তুই আমাদের অনুসরণ করেছিস?

— করেছি তো৷ চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে তো তোকে।তুই ভেবেছিস আমি তোর খবর রাখি না।আমি তোর সব খবর রাখি। এখন মোদ্দা কথায় আসি। আমি একটা ভালো বেতনের জব পেয়েছি। তোকে বিয়ে করতে চাই। এবার আর বলিস না দোস্ত। আমার কষ্ট হবে।

সিলিভিয়া নিশ্চুপ রইলো। মুখ দিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করছে না এখন।রামিশকে বুঝ দেওয়ার,অথবা না বলার কোন শব্দবাক্য খরচ করার সামর্থ্য অবশিষ্ট রইলো না সিলিভিয়া। হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে ঠাণ্ডায়। মৌন থেকে সিলিভিয়া রামিশের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। সিলিভিয়ার চলে যাওয়া দেখে রামিশ পূনরায় বলে উঠলো,

— মৌনতায় সম্মতি লক্ষণ সিলি। মনে রাখিস

সিলিভিয়া জবাব দিলোনা,পেছন ফিরেও তাকালো না। দৃঢ় থেকে হাঁটার গতি আগের তুলনায় বাড়ালো।সিলিভিয়ার গমনপথের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে রামিশ আনমনে বলে উঠলো,

— না সে তোকে বুঝলো,আর না তুই আমাকে। মাঝখানে অবাধ্য হৃদয়ের কোলাহল থামার
নামগন্ধ নেই। একটু স্বার্থপর হলে কি আমি পাপী হবো?

২০.
আযানের অনেক্ষণ পর বাড়িতে প্রবেশ করলো সিলিভিয়া। সিলিভিয়াকে দেখে জুবান হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে আসলো। জুবান কোলে উঠতে নিলে সিলিভিয়া হাত বাড়িয়ে থেমে যেতে বলল। শাড়ি ভিজে আছে,এই অবস্থায় জুবানকে কোলে নিলে জুবানের কাপড়ও ভিজে যাবে। এই ভরসন্ধ্যায় জুবানের কাপড় ভেজানোর ইচ্ছে নেই তার।

— জুবান তোর দাদু কোথায়?

— দাদু আম্মুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে।
আমি টিভি দেখছি ফুফি।

সিলিভিয়ার কপালে চিন্তার চাপ পড়লো। হঠাৎ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার মতো কি হলো বুঝতে পারলো না সে। তাও আবার জুলিয়াকে নিয়ে। প্রশ্নবিদ্ধ মস্তিষ্ক নিয়ে নিজে ঘরে চলে সিলিভিয়া। শাড়ি বদলে সুতির থ্রী-পিছ পড়ে নিলো সে।পার্সটা হাতে নিয়ে ফোনটা বের করলো। হঠাৎ ফোনের সাথে সাথে একটা চিরকুট বেরিয়ে এলো পার্স থেকে। কৌতূহলী হয়ে চিরকুটটা মেঝ থেকে তুলল সিলিভিয়া। ভাঁজ খুলে লেখাটায় চোখ বুলালো। আকস্মিক ভাবে হাতের ফোনটা পড়ে গেলো সিলিভিয়ার। লেখাটা পূনরায় পড়লো।

‘ সিলভার,তোমার সেন্স ওফ হিউমার দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। তোমার সেন্স যেটা আবিষ্কার করেছে,আমার ড্যাড ও আজ অবধি আবিষ্কার করতে পারেনি। ‘এন্ড দ্যা হার্ট’ মুভিটার মেইল ক্যারেক্টারটা আমাকে দেওয়া হয়েছিলো। তখন আমার বয়স ছিলো একুশ। ‘এন্ড দ্যা হার্ট’ মুভিটা আমার প্রথম এবং শেষ মুভি ছিলো। তুমি কিভাবে আমাকে চিনতে পেরেছো জানি না।তবে,অবশ্যই এই রহস্যের উদ্ঘাটনের ব্যাখ্যা আমি তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে আসবো।’

উক্ত চিরকুটটি পড়ার পর উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে সিলিভিয়ার। তিনবছর আগে তার কাজিন রোদের ল্যাপটপ থেকে মুভিটা দেখেছিলো। রোদের মামা রোদের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ল্যাপটপ পাঠিয়েছিলো। পেনড্রাইভে ছিলো কয়েক’শ হলিউড মুভি। বিরক্তিকর সময় কাটাতে ‘এন্ড দ্যা হার্ট’ মুভিটা প্লে করেছিলো সে। সোনালি চুলের একজন নায়িকার বিপরীতে নায়ক হিসেবে এ্যালসন নামের ক্যারেক্টারের আঁড়ালে যে তেহভীন থাকবে সেটা ভাবতেই শরীর উৎকন্ঠিত হয়ে কেঁপে উঠছে সিলিভিয়ার। আর সে নায়কের সাথে আজ সারাদিন ছিলো।সিলিভিয়ার শ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম। কোনমতে নিজেকে সামলাতে পারছে না। ফলস্বরূপ হালকা শব্দে কেঁদে ফেললো সিলিভিয়া। অনেক কিছু জানার আছে তেহভীনের কাছ থেকে।অনেক প্রশ্ন,অনেক কিছু। সিলিভিয়ার মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে যায়।তেহভীনের সাথে পূনরায় সাক্ষাৎ করার প্রবল ইচ্ছে জাগলো মনে। কিন্তু হাত-পা জোড়া যেনো শিকলে বাঁধা। এই মুহূর্ত ওখানে যাওয়া অসম্ভব, এবং গিয়ে কিছু প্রশ্ন করাও অসম্ভব।

২১.
রুভাইয়াত নিজের শশুড়ের মিলাদ সভা থেকে ফিরলেন রাত নয়টায়।যদিও বা বিকেলের আগে ফিরে আসার কথা ছিলো,কিন্তু হয়ে উঠেনি।তার উপর ঢাকা শহরের যানজট তো আছেই। তায়্যিবা এবং উনার স্বামী আসলেন তেহভীনের রুমে। সম্পূর্ণ কক্ষ কেমন নিস্তব্ধ, অন্ধকার,ভুতুরে বানিয়ে রেখেছে তেহভীন। মেথেউ মনে মনে হাসলেন ছেলের কাণ্ডে। তিনি নিজে অন্ধকার থাকতে পারেন না।অন্ধকারে উনার ফোবিয়া আছে।অথচ,উনার দ্বিতীয় ছেলে নির্ভয়ে অন্ধকারচ্ছন্ন কক্ষে ঘুমিয়ে আছেন।

ঘুমন্ত তেহভীনকে বিরক্ত না করে তায়্যিবা এবং মেথেউ কক্ষ প্রস্থান করলেন। সুযোগসন্ধানী তামান্না তখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। মা-বাবাকে চলে যেতে দেখে তামান্না ভেতরে প্রবেশ করলো।
দৃঢ়কণ্ঠে ডাকলো,

— তেহভীন! আমি জানি তুমি জেগে
আছো। উঠো,মম-ড্যাড আর আসবেনা।

বারকয়েক ডাকা পর তেহভীন কম্বলের নিচ থেকে মাথা বের করে বলল,

— সিস, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি,লিভ মি এলোন।

তামান্না সেটা না শুনে বলল,

— তোমার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কল আছে।
প্লিজ কথা বলো।

— আমি কোন কল এটেন্ড করবো না এখন সিস।
প্লিজ যাস্ট লিভ।

তামান্না একটু অবাকই হলো তেহভীনের ব্যবহারে। বয়সে সে তেহভীনের বড় হলেও দু’জনে যতেষ্ট ফ্রী। তেহভীনের মন খারাপ থাকলে সে কখনো কথার পিঠে কথা বলেনা। চুপচাপ থাকে। অভিমান হলে তো আর তেহভীনের দেখা সাক্ষাৎ ও পাওয়া যায়না।আর রাগলে,তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে তুলার মতো হয় তখন।কিন্তু তামান্না ভাইয়ের আচরণটা বুঝতে পারলো না। ফোনে কথা বলাটা জরুরী ছিলো বলে বলেছিলো।নাহলে সেও সর্বদা তেহভীনকে বিরক্ত করে না।

২২.
ধূসরবর্ণ,পাংশুটে মেঘের চাদর সরিয়ে, গাঢ় নীল রঙের চাদর বিছানো হয়েছে বিশাল গগনের বক্ষে। গাঢ় নীল আকাশের নিচে গাঢ় সবুজ ঘাসের উপরে বাচ্চা এবং যুবক ছেলেরা ফুটবল খেলায় মত্ত। সিলিভিয়া আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে এ্যাপার্টমেন্টের দিকে এগোচ্ছিলো। হঠাৎ একটা বল উড়ে এসে সিলিভিয়ার সামনের পড়লো। সিলিভিয়া বলটির উপরে পা রেখে মাঠের দিকে তাকালো। রাদিফকে দেখা যাচ্ছে দৌড়ে আসতে। তার ঠিক পেছনে কয়েক হাত দূরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তেহভীন। তবে দৃষ্টি অন্যদিকে।
সিলিভিয়া দৃষ্টি ঘুরিয়ে, রাদিফের দিকে বলটা কিক মেরে রাইসাকে পড়াতে চলে গেলো। রাদিফের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয় সিলিভিয়া।ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি শুরু হবে।আর সে দিব্যি ফুটখেলায় মত্ত।

ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো রাইসা আগে থেকে বসে আছে।সিলিভিয়াকে দেখে হেসে সালাম দিলো। রুভাইয়াত তখন উপস্থিত ছিলো সেখানে, সেজন্য সিলিভিয়া তাঁকে সালাম দিলো। পড়ানোর মাঝখানে রাদিফ এসে বসলো সোফায়। তেহভীনকে দেখলো না আর সিলিভিয়া। হয়তো রুমেই ব্যস্ত। সিলিভিয়া শ্লেষাত্মক নিঃশ্বাস ফেললো।রাদিফের কাছে শুনলো আজ রাত দশটায় ফ্লাইট কনফার্ম তাদের।সেজন্য ফাইনাল গোছগাছ টা সেরে নিচ্ছে সবাই।

(চলবে)
গল্পের কিছু কিছু অংশ কাল্পনিক। তাই কেউ বাস্তবের সাথে মিলাবেন না। এখন কমেন্ট করে ফেলুন দেখি আমার পাঠকরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here