লাভ রেইন পর্ব-১৪

0
2144

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ১৪

৩৫
ক্যাফের বাইরে এসে এলোমেলো দৃষ্টি ছুঁড়তে লাগলো সিলিভিয়া। বুকের স্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক কায়দায় বেড়ে গিয়েছে। যেনো নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি অসাবধানতার জন্য হারিয়ে ফেলেছে। ঘোর অভিমানে টলমলিয়ে উঠলো সিলিভিয়ার দৃষ্টি। মানুষটিকে দেখছে না প্রায় অনেক দিন হলো। হৃদয়ে আঁকুপাঁকু যন্ত্রণা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে।
সিলিভিয়া অদূরে দৃষ্টি ছুঁড়তেই মনে হলো তার প্রিয় পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছে। সিলিভিয়া নিজের পদযুগলের গতি বাড়ালো। পেছন থেকে ভেসে আসা ডাক কানে তুললো না।মরিয়া হয়ে উঠলো কাউকে দেখার আশায়।

তেহভীন কে দাঁড় করিয়ে রেখে তানজিদে একটা শফে ঢুকে পড়লো,কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটার জন্য। তেহভীন নিজের ভেতরকার যন্ত্রণাকে চেপে রেখে এদিক-ওদিক চোখ রাখছে। কি মনে করে পেছন ফিরলো তেহভীন।তখনি দীঘল খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকা সিলিভিয়াকে দেখতে পেলো সে। ভেবেছিলো সিলিভিয়ার সাথে কখনো সাক্ষাৎ করবে না সে। কিন্তু মন আর মুখ মানলো না,ফট করে বলে ফেললো,

— মে আই নোউ ইউ?

সিলিভিয়া তব্দা খাওয়া দৃষ্টিতে তাঁকালো তেহভীনের দিকে। এরপর আশেপাশে তাঁকালো। কেমন যেনো জড়তা কাজ করছে এবার তার মধ্যে। তেহভীন তো ‘সিলভার’ ডাকতো। নাকি এতদিন পর দেখা হওয়ায় চিনতে পারছে না।না চেনারই কথা,নামীদামী মানুষ।
সিলিভিয়া দৃঢ়ভাবে এক’পা পিছিয়ে এলো। তখনি ক্যাডি,আমারা,ড্যাবিয়ান, গ্যাটলি এসে দাঁড়ালো।সিলিভিয়ার দুপাশে এসে দাঁড়ালো। ড্যাবিয়ান চিন্তিত স্বরে জানতে চাইলো,

— কি ব্যাপার সিলিইইভিয়া,এভাবে দৌড়ে
এখানে এসেছো কেন?

সিলিভিয়া তাদের আগমনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো হঠাৎ। আমারা আর ক্যাডি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তেহভীনের দিকে তাঁকালো। চেনা চেনা লাগছে,আবার সম্পূর্ণ অচেনা। কে হতে পারে সেটা মনে করতে পারলো না। তেহভীনের স্মিথ হাসিতে দৃষ্টি আঁটকে গেলো দু’জনের।
তেহভীন হালকা হেসে সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে বলল,

— কেমন আছো সিলভার? তোমার সাথে হঠাৎ এখানে দেখা হবে কল্পনা করিনি।

তেহভীনের কথায় সিলিভিয়ার আঁটকে যাওয়া শ্বাস ফিরে এলো। সে হাসিমাখা স্বরে বলল,

— আমি ভালো আছি। তুমি? আর এখানে?

— একি প্রশ্ন আমারও।

মাঝখানে ড্যাবিয়ান আবারও বাঁ হাত ঢুকিয়ে বলল,

— সিলিইইভিয়া, তুমি চেনো উনাকে?
পূর্বপরিচিত তোমরা? নাহলে চলে এসো অপরিচিতদের সাথে কথা না বলা ভালো

গ্যাটলি বলে উঠলো,

— দেখছো না উনারা পূর্বপরিচিত।আমরা ফিরে চলি এসো,সিলিইইভিয়া তুমি কনভার্সেশন শেষ করে এসো।

গ্যাটলি আমারা আর ক্যাডিকেও তাড়া দিলো চলে আসার জন্য।দুজনে হা করে তাকিয়ে ছিলো তেহভীনের দিকে। গ্যাটলির কথায় ধ্যান ভগ্ন হয় তাদের। মৃদ্যু হেসে তারাও সেখান থেকে সরে গেলো
তেহভীন শান্ত চোখে ড্যাবিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো।ড্যাবিয়ান বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। সেটা তেহভীনের সহ্য হচ্ছিলো না। সিলিভিয়াকে চুপ দেখে বিরক্তবোধ করলো সে। মুখে বলল,

— আমেরিকায় এসেছো কতদিন?

—- আজ ছয়দিন।

— এম.ফিল কোর্স করতে এসেছো?

সিলিভিয়া মাথা নেড়ে সায় জানালো। তেহভীন শফের দিকে তাঁকালো। তানজিদ এখনো আসছে না।এরপর হাত ঘড়ির দিকে তাকালো। হাতে সময় আছে প্রচুর।তেহভীন সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে বলল,

— চলো ক্যাফে তে গিয়ে বসি।

সিলিভিয়া না করলো না। তার নিজেরও ইচ্ছে করছে তেহভীনের সাথে থাকতে। এতদিন পর আশ্চর্য ভাবে দেখা। একদম অপ্রত্যাশিত ছিলো তার জন্য।
বিদেশীয় পরিবেশে এ কয়দিনে অনেকটা মিশে গিয়েছে সিলিভিয়া। প্রথমদিনের মতো জড়তা কাজ করছে আজ। ফাঁকা চেয়ারে জায়গা দখল করে বসে পড়ল দু’জনে। তেহভীন কফি অর্ডার দিলো,টুকটাক অপ্রয়োজনীয় কথা বলছে। তেহভীনের নিজেরই হঠাৎ কেমন অস্তিত্ব লাগছে। সিলিভিয়ার সামনে বসে আছে,অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। আবার বলতে পারছে না।
কথাবার্তার ফাঁকে তানজিদ মেসেজ পাঠালো তেহভীনের ফোনে। তাতে লেখা,

— তেহভীন, এলসা এসেছে এখানে। আমরা সব ঠিকঠাক করে ফেলেছি।তোমার সাথে মিট করতে চাইছে এলসা। শফের সামনে চলে এসো।

তেহভীন মেসেজটা তর্জনি স্পর্শ করে সরিয়ে দিলো।এরপর সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে বলল,

— তোমার ফ্যামিলির সবাই কেমন আছেন?
রাডিফের কি খবর।ব্যস্ততার কারণে খবর নেওয়া হয়নি।

সিলিভিয়া হেসে বলল,

— সবাই ভালো আছে।রাডিফের এক্সাম চলছে।
তবে এক্সামের আগে ভালোভাবে পড়িয়েছি ওকে। তারপর আমাকে এখানে চলে আসতে হলো। কথা হয়নি।

— কোথায় থাকছো?

— ডরমিটরি তে।তুমি এখানে? স্কটল্যান্ড থেকে এখানে?

— আমার ব্রাদারের কাছে এসেছি।

— উনি এখানে? কি করেন?

তেহভীন হালকা কেশে বলল,

— মুভিতে কাজ করছেন। আগে স্কোয়াড্রন লিডার ছিলেন। স্কোয়াড্রন লিডার মানে বুঝো?

সিলিভিয়ার এসব সম্পর্কে ধারণা খুব একটা বেশি নেই।তাই সে বলল,

— স্যরি,আমি জানিনা এর কাজ কি?

— এটি সামরিক পদবি,মূলত ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর। এই পদবি ফ্লাইট ল্যাফট্যান্ট পদের উপরে। এবং উইং কমান্ডার পদের নিচে।

সিলিভিয়া কৌতূহল মনে জিজ্ঞেস করলো,

— তাহলে এই পেশা ছেড়ে মুভিতে?

তেহভীন দৃষ্টি শান্ত ভঙ্গিতে রেখে ছোট করে হাসলো,

— সবার একটা হবি থাকে সিলভার। আমারও ছিলো,এবং আছে। সবাই সবার হবি পূর্ণ করতে পারেনা।যেমন আমি পারছিনা। ড্যাড মূলত এসব পছন্দ করেন না। আর দুর্ভাগ্যবসত আমরা দুইভাই এই হবির দিকে ঝুঁকে পড়েছি।

এবার কিছু বিষয় বুঝতে পারলো সিলিভিয়া।একদিকে মুভি,অন্যদিকে পাইলট। দু’টো একসাথে কান্টিনিউ রাখা পসিবল নয়।তেহভীনের প্রথম ও -সর্বশেষ মুভিটা হয়তো পাইলটের জব নেওয়ার আগে করেছিলো।

তেহভীনের সংকুচ লাগছে। ফিরে আসার সময় যে চিরকুটটা সিলিভিয়ার ব্যাগে রেখেছিলো সব অস্বস্তি যেনো সেকারণেই ঝেঁকে ধরছে তাকে।ফেরার কথা বলেছিলো বেংলাডেশে।অথচ ইউএস এ দেখা। তেহভীনের ভাবনার মাঝে হুট করে সিলিভিয়া প্রশ্ন ছুঁড়লো,

— আমেরিকায় আর কতদিন আছেন তেহভীন?

— পাঁচদিন মত,কেন?

—- এমনি..!

অনেক্ষণ চুপ থাকলো দুজনে। তেহভীন বলল,

— আমি ফ্রী থাকবো সিলভার।

সিলিভিয়ার মুখের মলিনতা সরে গেলো তেহভীনের কথায়। এটাই শুনতে চেয়েছিলো সে।অন্তত যতদিন আছে ততদিন চোখের দেখাটা দেখবে। তারপরের সময়টা যা ভাগ্যে লেখা তাই হবে। তেহভীন সিলিভিয়ার মুখভঙ্গি দেখে নিজের মনের কথাটা কাল জানাবে বলে স্থির করলো।

৩৬
সায়মন সবেমাত্র ভাতের পাতে বসেছিলো। আকবর সাহেব আগেবাগে খেয়ে চলে গেলেন। রুজিনা ম্লানমুখে ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগলো।জুলিয়া সবার মুখের দিকে চেয়ে মৌন থাকলো। মনে মনে নিজের আচরণের জন্য খুব মন খারাপ হয় ইদানীং তার। সিলিভিয়া যাওয়ার সময় একবারের জন্য তার সাথে দেখা করে যায়নি।জুলিয়া আশায় ছিলো সিলিভিয়া অন্তত বিদায়বেলায় ভাবি হিসেবে দেখা করে যাবে। মেয়েটার আত্মসম্মান বোধ বেশি। রুজিনা ভাতে দানা চিবুতে চিবুতে বলল,

— সায়মন আমরা আসলেই কাজটা ঠিক করেছি?
রামিশকে জানানো উচিত ছিলো আমাদের।

— মা সিলিভিয়া নিজেই তো চায়না এই সম্পর্ক।বলা না বলার কথা আসছে কেন?

— তোর বাবা-ই তো কথা দিয়েছিলো।শেষ মুহূর্তে মেয়েটা এমন করবে কে জানতো।রামিশ শহরের বাইরে থাকায় সিলিভিয়ার আরো সহজে চলে যেতে পেরেছে। এখন রামিশ আর রামিশের মা ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন সিলিভিয়ার আচরণে।

— মা রামিশ যদি মানে তাহলে অন্তত দু’বছর অপেক্ষা করতে বলবো। আর না মানলে সে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিক।এখানে আমরা কেউ দায়বদ্ধ নই। সিলি ফিরে আসুক তারপর নাহয় দেখা যাবে।

সায়মন ভাত খাওয়া মনোযোগ দিলো। রুজিনা ছেলের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর পূনরায় ভাতের লোকমা মুখে তুললেন।

৩৭.
অনেকটা হাসিখুশি মনোভাব নিয়ে ডরমিটরিতে ফিরলো সিলিভিয়া।ক্যাডি আর আমারা অনবরত তেহভীনের ব্যাপারে প্রশ্ন করে কাহিল করে তুলছিলো সিলিভিয়াকে। উপায় না পেয়ে তাদের বলতে হয় তেহভীনের ব্যাপারে। সিলিভিয়া তেহভীনকে বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছে। তাদের এটাও জানালো যে,কালকে তেহভীনের সাথে ঘুরাঘুরি করবে। একান্তে।

তেহভীন ফ্ল্যাটে ফিরলো রাতের দিকে। তানজিদ চিন্তিত মুখে সোফায় বসেছিলো। তেহভীনকে দেখে দ্রুত দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসলো।তেহভীনকে একটু অগোছালো লাগলো তার। সব সময়ের পরিপাটি তেহভীনের চোখমুখে কেমন হতাশা।

— কি ব্যাপার তেহভীন।আজ তোমাকে এমন
লাগছে কেন?

তেহভীন সোফায় বসলো। তানজিদের কথা তার মস্তিষ্কে ঢুকেই যেনো।

— তেহভীন,এমন অন্যমনষ্ক হয়ে আছো কেন?

— ব্রাদার,আমার কিছু ভালো লাগছেনা।ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে কোথাও চলে যায়। ড্যাড কেন আমাকে সবকিছুতে ফোর্স করে।

তানজিদ চুপ থেকে তেহভীনের কথা শুনলো।
এরপর বলল,

— ড্রিংকস করবে তেহভীন? মাইন্ড ফ্রেস লাগবে।

তেহভীন রেগে গেলো,

— তোমাকে কে বলেছে ড্রিংকস করলে মাইন্ড ফ্রেস হয়। আই ডোন্ট লাইক ড্রিংকস! আর কখনো আমাকে ড্রিংক করার অফার করবে না।

কথাগুলো বলে চোখ বুঁজে ফেললো সে।তানজিদ হা করে তেহভীনকে আপাদমস্তক দেখতে লাগলো। তানজিদের অনুমান শক্তি বলছে তেহভীন কোন বিষয় নিয়ে ভীষণ আপসেট।কিন্তু কি?

(চলবে)

জ্বরসর্দি মেরে ফেলছে আমাকে।একটু দোয়া করবেন সবাই। রেসপন্স প্লিজ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here