#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ০২
৪.
মনটা বড্ড নেতিয়ে আছে সিলিভিয়ার। সবকিছু বিরক্ত লাগছে।তলপেটের ব্যাথাটা আজ একটু কম লাগছে বিধায় পড়াতে এসেছিলো।মাঝখানে দুইদিন ছুটিতে ছিলো। মৃদুগতিতে হেঁটে লিফটের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো সে।ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে রুভাইয়াতের কণ্ঠধ্বনি শুনে চলন্ত পদযুগল থেমে গেলো সিলিভিয়ার।লিফটে পা রাখা হলো না তার। সিলিভিয়া পেছন ফিরে দেখলো রাদিফের হাসকিটা দৌড়ে দৌড়ে আসছে।এখুনি এসে তার কামিজের কোণাটা দাঁতের সাথে চেপে ধরে টান লাগাবে।এটা এই হাসকির রোজকার কাজ। সিলিভিয়া ভীষন পরিচ্ছন্ন মানুষ।এসব জন্তু- জানোয়ার থেকে দূর দূর থাকে। কিন্তু এই প্রাণী নাছোড়বান্দা। রুভাইয়াত এগিয়ে এসে বলল,
— চলে যাচ্ছিলে যে আমাকে না বলে।
এখন যেতে হবেনা।বৃষ্টি থামুক তারপর যেও।
— না আন্টি।মা টেনশন করবে আমার জন্য।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাওয়া ভালো।
— তোমার মাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দাও এখন ফিরছো না। দুপুরের খাবারটা এখানে খাচ্ছো তুমি। এসো।
রুভাইয়াত সিলিভিয়ার হাত ধরে টেনে বাসার মধ্যে ঢুকিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। রুভাইয়াত সিলিভিয়াকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। তৎক্ষনাৎ একটা রুমের দিকে চোখ পড়লো সিলিভিয়ার। ফরেনার লোকটা কেমন যেনো চোখ রাঙিয়ে আঙুল তুলে ‘তেহভীন’ নামের ছেলেটিকে শাসাচ্ছে।সিলিভিয়া অবাক হলো। এইটুকু সময়ের মধ্যে কি এমন হয়েছে যে তেহভিনকে এভাবে বকছে। অনেক ভাবনা মনেরঘরে এসে কড়া নাড়তে লাগলো। তেহভীনের দৃষ্টি দরজার বাইরে ছিলো,সিলিভিয়াকে দেখে চোখাচোখি হলো একটু। এরপর সিলিভিয়া নিজের দৃষ্টি সামনে স্থাপন করলো। তেহভিন তখনো গম্ভীরচোখে সিলিভিয়ার গমন পথে চেয়ে থাকলো।
রুভাইয়াত সিলিভিয়াকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন।ওখানে তামান্না,আর তার মা তায়্যিবা বসে টিভি দেখছিলো। রাইসাও সেখানে বসেছিলো।সিলিভিয়াকে ফেরত আসতে দেখে বলল,
— সিলি আপু তুমি আবারও পড়াবে?
আমার তো আর পড়তে ইচ্ছে করছেনা।
সিলিভিয়া রাইসার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিয়ৎক্ষণ। রাইসার দিকে চেয়ে স্মিথ হেসে বলল,
— না রাইসা আমি এখন আর পড়াবোনা।
বাইরে রেইন হচ্ছে।আমি ছাতা আনিনি তাই যেতে
পারছিনা।
সিলিভিয়ার কথায় রাইসা স্বস্তি পেলো। নিজ স্থান থেকে কিছুটা সরে বসে সিলিভিয়াকে বসতে দিলো।
সিলিভিয়া বসলো। তামান্না,আর তার মা ইংলিশ মুভি দেখতে ব্যস্ত।দিনদুনিয়ার খেয়াল তাদের নেই হয়তো।সিলিভিয়া একটা জিনিস খেয়াল করলো রাদিফের ফুফি থেকে শুরু করে তাদের ছেলে-মেয়ে, তাদের বাবা সকলে কথাবার্তা একদম সীমিত। দুইঘন্টা পড়ানোর মাঝাে তাদের কারো কণ্ঠধ্বনি শুনতে পায়নি। নিজের ভাবনায় নিজে বিরক্ত হয়। এদের নিয়ে এতো কিউরিসিটি কেন মনে আসছে সেটাই বুঝে আসছেনা।দুই ঠোঁটে চাপ প্রয়োগ করে নিজে ফাউল ভাবনাদের বিদায় জানালো সিলিভিয়া। এরপর ফোন বের করে তার ভাই সায়মনের ফোনে তার না বিকেলে ফেরার বার্তাটা পাঠালো। ফোন ব্যাগে রেখে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো।
তৎক্ষনাৎ হৃদয়ের স্পন্দনের গতিবেগ পরিবর্তন হয়ে গেলো সিলিভিয়ার। তেহভীন হাতের ইশারায় সিলিভিয়াকে ডাকছে।অন্য হাত পকেটে গুঁজা।বলিষ্ট দেহ সটান করে রেখে দৃষ্টির জোয়ার সিলিভিয়ার উপরে ফেলে রাখলো। সিলিভিয়া কিছুক্ষণ থম মেরে তেহভীনের ইশারা-কৃত হাতের সক্রিয়তা অবলোকন করছিলো।মস্তিষ্ক জানালো,তেহভীন নামের ছেলেটা তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ডাকছে।।তখনের ভুলটা আসলেই তার।নিজেকে স্পেশাল কেউ মনে হলো তার। সিলিভিয়া গভীর শ্বাস টেনে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। এক কদম বাড়ানোর আগে,হঠাৎ রাইসা সিলিভিয়াকে ক্রস করে তেহভীনের কাছে চলে গেলো। তেহভীন নিজের পেশিবহুল হাতজোড়া বাড়িয়ে দিয়ে রাইসাকে কোলে তুলে নিলো। চলে যাওয়ার পূর্বে সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে মিটমিট হাসলো।
এতবড় ধোঁকা! এতোবড় লজ্জা! এতোবড় অপমান।
আল্লাহ! সিলিভিয়া চক্ষুদ্বয়ের নির্গত বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো তাদের যাওয়ার পানে। ছেলেটা না আমার দিকে তাকিয়েছিলো? রাইসার দিকে তাকালে আমি বুঝতাম না? আমি এতো অবুঝ কখন হলাম?
দুপুরের লাঞ্চের আগে বাড়ি চলে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করলো সিলিভিয়া।উনারা পয়সাওয়ালা মানুষ।একটা ছাতা সিলিভিয়াকে ধার দিলে কি এমন ক্ষতি হতো? উপরন্তু সেটা তো করলো ও না।উল্টা দুপুরে লাঞ্চ করার জন্য জোরাজোরি। সিলিভিয়া মূলত তেহভীনের সামনে পড়তে চাইছেনা।তার সাথে বাকিরা তে আছেই।লজ্জায় মিঁইয়ে যাচ্ছে সিলিভিয়া। উপায় না পেয়ে চেয়ার টেনে বসলো। খাবারের পদে হরেক রকম আয়োজন। ভুলবসত সিলিভিয়ার চোখ পড়লো তেহভীনের প্লেটে। ভাতের বদলে আস্ত দু’টো বার্গার রাখা।তারমানে সে ভাত খায় না।সিলিভিয়া চোরাচোখে তায়্যিবা,তামান্না, আর ওই ভদ্রলোকটার নাম কি যেন? ওহ হ্যাঁ
‘মেথেউ এ্যাসফোর্ড’ বেশ কঠিন নাম। রাদিফ বলেছিলো তখন।তিনি পেশায় একজন ‘এয়ার চিফ মার্শাল’। উনার প্লেটেও বার্গার। তামান্নাকে ভাতের অভ্যাস করতে পেরেছে বিদায় সে অল্প করে ফ্রাইড রাইস নিয়েছে।বাপরে! খানাপিনার কি বাহার।আমি আবার বেগুন ভর্তাতেই তুষ্ট।রুভাইয়াত আন্টি অবশ্যই বেগুনের ভর্তাটা আইটেম হিসেবে রেখেছেন।
উফফ! বিকেল পর্যন্ত হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে ভীষণ অস্বস্তিবোধ করছিলো সিলিভিয়া।এমন না যে সে এই প্রথম থাকছে। আগেও বেশ ক’বার ছিলো।রাইসার জন্মদিনের সময়।অন্যান্য ওকেশনেও।
অবশেষে,মুক্তি মিললো অপেক্ষার প্রহর থেকে। উনারা সবাই যাচ্ছেন নারায়নগঞ্জে।আর আমি আমার বাসায় চলে যাবো। রুভাইয়াত আন্টি উনাদের সাথে যেতে বললেন আমাকে।কিন্তু আমি রাজি হয়নি।বাড়িতে আমার অনেক কাজ।
সিলিভিয়া বের হওয়ার সময় দুইমিনিট সময় ব্যয় করে জুতা জোড়া পায়ে গুঁজলো। চলে যেতে উদ্যত হলো,তখনি ঠাস করে দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। সিলিভিয়া হকচকিয়ে পেছনে ফিরলো।তখনি মাথায় বজ্রপাত হওয়ার মতো অনুভূতি হয় তার।এইটুকু সময়ের মধ্যে তার লম্বা চুলের বেণুনিটা দরজার হাতলের সাথে গিট লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। এটা কখন হলো? করলো কে? এটা তো হাসকির কাজ নয়। তাহলে?
মনের মধ্যে অনেক ভাবনা আসতে লাগলো সিলিভিয়ার।আজকের দিনটা, পঁচিশ তারিখ,সোমবার।দিনটা কেমন যেনো।সকাল থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের মুখোমুখি হচ্ছে সে।
তেহভীন রুমে আসতেই দেখলো রাদিফ দু’হাত কোমরে রেখে সন্দিহান চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তেহভিন ফিচেল হাসলো। বলল,।
— আম লুকিং হ্যান্ডসাম? এভাবে কেন দেখছো?
— ভাইয়া,আমি কি মেথেউ-মামুকে বলবো? তুমি এখান এসেও মানুষকে জ্বালাচ্ছো?
তহভীন চোখ পিটপিট করে তাকালো,বলল,
— নো রাডিফ,আজ অনেক বকা খেয়েছি।নো মোর!
— তো মামুর-ছেলে, বকা খাও তারপরও কেন এমন করছো? সিলি আপুকে কেন ডিস্টার্ব করছো?
— তোমাদের কান্ট্রির মেয়েরা চুলকে দড়ি বানিয়ে রাখে কেন? কাজের জন্যই তো।আমি দড়িটাকে কাজে লাগিয়ে এসেছি।এখানে আমার কোন ফল্থ নেই।
তেহভীন নিজের ফোনটা বের করে বিছানায় বসলো। ফোনের মধ্যে পার্সনাল নোটে গিয়ে লিখলো,
—” ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট থিংক ইন লাইফ।এন্ড আই লাইক অলসো হার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন! ডেটঃ 25-12-21.
রাদিফ আবারও বলল,
— ভাইয়া, সিলি আপুকে ডিস্টার্ব করোনা। উনাকে কেউ ডিস্টার্ব করলে আমার ভালো লাগে না।
৫.
বাসায় প্রবেশ করে সিলিভিয়ার তার বাবাকে দেখতে পেলো। মুচকি হেসে তার পাশে গিয়ে বসলো সে। সিলিভিয়ার বাবা আকবর হাসান মেয়েকে দেখে হাতের পেপার ভাঁজ করে টেবিলে রাখলেন। বললেন,
— তোর বান্ধবী রামিশা ফোন করেছে আমার কাছে।
— রামিশা? কেন বাবা? কি বলেছে ও?
— বলেছে ওরা সবাই ট্যুরে যাচ্ছে। তোকে যেতে দেওয়ার পার্মিশন চাইছিলো?
সিলিভিয়া কন্ঠ শক্ত করে বলল,
— না বাবা, আমি কোন ট্যুরে যেতে আগ্রহী নয়।
দ্বিতীয় বার ফোন করলে সাফ সাফ জানিয়ে দিও।
সিলিভিয়া বসা থেকে উঠে নিজের রুমে যাওয়ার আগে রান্নাঘরে ঢুকলো তার মায়ের সাথে দেখা করতে। মুখোমুখি দু’টো রুমে রান্নাঘর। জুলিয়া সিলিভিয়াদের সাথে একসাথে খেতে নারাজ।যারফলে সায়মন নিজে দাঁড়িয়ে জুলিয়াকে আলাদা রান্নাঘরে শিফট করেল। শশুড়-শাশুড়ির সাথে একসাথে থাকতে খেতে কোন মেয়ে যদি নকোচ করে।তাহলে তাকে অবশ্যই আলাদা করে দেওয়া উচিৎ। সায়মন চায় না তার মা-বাবাকে, বোনকে কেউ করুণা করে রেঁধে বেড়ে খাওয়াক।এবং সে নিজেও তার মা-বাবার সাথে এক টেবিলে খায়।জুলিয়ার রান্নাটা সে নিজে নিজে করে।অনেক শখ করে সায়মনের জন্য রাঁধে।কিন্তু সায়মন তা আজ অবধি মুখেও তুলেনি।তাদের হাঁড়ি আলাদা হওয়ার বয়স মাত্র একসপ্তাহ।
সন্ধ্যার দিকে সায়মন ফিরে আসে হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে। জুলিয়া তখন টিভি দেখছিলো নিজের রুমে। জুবান তার পাশে ফোন দেখছে। মা-ছেলে অবস্থা দেখে প্রচণ্ড রাগ হয় সায়মনে। নামায কালাম নেই।শুধু টিভি আর ফোন। সায়মন প্যাকেটটা খাটে ছুঁড়ে মেরে রেখে দেয়।এরপর অন্য ওয়াসরুমে গিয়ে ওযু করে মসজিদে চলে যায়। জুলিয়া প্যাকেটটা খুলে দেখলো প্রাপ্তবয়স্কদর ডায়পার। একটা স্বস্তির নিঃশ্বান ফেললো সে।হঠাৎ চোখ বড় বড় হয়ে যায় জুলিয়ার।সায়মন কি তাহলে তার ব্যাপারে এসব জানে? বলার সাথে সাথে নিয়ে এসেছে? কোন সন্দেহ করেনি,আর না কোন জিজ্ঞাসাবাদ।
(চলবে)
নায়িকার নাম নিয়ে কারো সমস্যা আছে?