লাভ রেইন পর্ব-২৮

0
2010

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ২৮

৭২.
ইস্ট প্রিন্সেস স্ট্রিট গার্ডেনের সবচেয়ে নজরকাঁড়া ও সুন্দরতম স্থান গ্রীন’গার্ডেন। হালকা সবুজের জমিনের সাথে হালকা নীল-সাদা মিশ্রণের আকাশের সাথে গম্ভীর একটা ভাব। পিচঢালা রাস্তার কিনারায় নিরলসভাবে বসে রইলো তেহভীন। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ নিচে প্লে-গ্রাউন্ডে খেলা করতে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে। নিজের শৈশবের কিছু আবছা স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। তন্মধ্যে অভিজাত জুতার ঠকঠক শব্দ তুলে এগিয়ে আসলো শ্বেতাঙ্গের এক নারী। শরীর বেয়ে উপচে পড়ছে কৃত্রিম যৌবনা। রমণী গায়ের সাদা এপ্রোন খুলে হাতের উপর রেখে বসলো তেহভীনের পাশে। তেহভীন স্থির,অবিচলত ভঙ্গিতে আগের ন্যায় বসে রইলো।
ক্যাথরিন বসার পর দেখলো মাঝখানে একহাত দূরত্ব। এটা সে মানতে পারলো না। তেহভীনের শরীরের মিষ্টি এবং লোভনীয় সুঘ্রাণটা একদম তার মগজে গিয়ে বিঁধে। ক্যাথরিন দৃঢ় প্রতিক্রিয়াই এগিয়ে মাঝখানের দূরত্ব কিছুটা লাঘব করলো। তার জীবনে টাকার নেশা গগনচুম্বী হলেও,তেহভীনের মতো সৌষ্ঠবপূর্ণ পুরুষকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র তার। ক্যাথরিন নিজেও একটা ব্র্যান্ডেড পারফিউম ইউজ করেছে,যেটা যেকোন পুরুষকে আকৃষ্ট করে ফেলে। শুধুমাত্র তেহভীন ছাড়া।
ক্যাথরিন আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। চওড়া কাধে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুঁজলো। তারপর চোখ খুলে মসৃণ চোয়ালটায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলো। সাঁইসাঁই বাতাস বইছে। চুল এলোমেলো হলো ক্যাথরিনের। ক্যাথরিনকে অবাক করে দিয়ে আচমকা তেহভীন ক্যাথরিনের বামহাতটা ধরলো। আলতোভাবে তুলে সামনে এনে শ্বেত হাতটি দৃশ্যমান করলো। ক্যাথরিন তেহভীনের কাছ থেকে প্রথম স্পর্শ পেয়ে প্রথমে চমকালো,এরপর ভীষণ আমোদিত হলো। গোটা একটা বছর কোন সাড়া পায়নি সে এই পুরুষটির কাছ থেকে। আজ যেনো চাঁদ হাতে পেয়েছে। অধর এলিয়ে হাসে ক্যাথরিন,এই বুঝি তেহভীন ঠোঁটজোড়া চেপে তার হাতে একটা চুমু খাবে। তেহভীন সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্যাথরিনের অনামিকা আঙুলটিতে চোখ বুলালো। অকস্মাৎ, তীব্র বেগে হীরের আন্টিটা খুলে দু’আঙুলের সাহায্যে অদূরে ছুঁড়ে মারলো। বসে থাকা অবস্থায় ক্যাথরিন তৎক্ষনাৎ আঁতকে উঠলো।ছিঁটকে সরে দাঁড়িয়ে গেলো তেহভীনের কাছ থেকে। প্রচণ্ড রেগে চেঁচিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো,

— আমার রিং! আমার রিং!
ও মাই গড৷ কতো এক্সপেন্সিভ রিংটা আমার।
টেহভীন তুমি এটা কি করেছো?

তেহভীন স্মিত হাসলো। অতঃপর উঠে দাঁড়ালো। সামনের থেকে চোখ সরিয়ে রক্তিম চোখে তাঁঁকালো ক্যাথরিন, আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,

— হাউ ডেয়ার ইউ টেহভীন?
তুমি আমার রিংটা কেন ফেলে দিয়েছো?
এক্ষুনি গিয়ে আমার রিংটা খুঁজে নিয়ে আসবে তুমি।
যাও…!

তেহভীন একচোট ডানদিকে তাঁকালো। একজোড়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টি দেখে সে ক্ষীণ হাসলো। তেহভীন বলল,

— কাম অ’ন ক্যাথ। ইজ্ দ্যিজ্ রিং মোর
ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান মি?

— ইয়েস! মোর দ্যান ইউ!

তেহভীন অবাক হলো না।শ্লেষাত্মক হেসে হাতের ফাইলগুলো ক্যাথরিনের সামনে দৃশ্যমান করলো। ক্যাথরিন ভ্রুঁ কুঁচকে তাঁকালো। তেহভীন একটা মেডিকেল রিপোর্ট ক্যাথরিনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। ক্যাথরিন নিঃসংকোচে নিয়ে নিলো হাতে। রিপোর্ট মেলে সুগভীর চোখে দেখার পর হকচকিয়ে যায় সে। মুখের রঙ রক্তশূন্যরূপ ধারণ করলো। এটা তার-ই মেডিকেলের রিপোর্ট। যেখানে সে গত একবছরে দুইটা আ্যভর্শন করিয়েছিলো, তারই রিপোর্ট। ক্যাথরিন হতবম্ভ হয়ে তাঁকিয়ে রইলো তেহভীনের মুখপানে। অতি সন্তপর্ণে লুকায়িত গোপন তথ্য কে ফাঁস করলো সেটা ভাবতে লাগলো আপনমনে।
দ্বিতীয় চমকটা পেলো যখন দেখলো ওল্ডটাউনের সেই হাউজটি তেহভীন নিয়ে নিয়েছে। যেটার আশায় তানজিদকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো। প্রচণ্ড রেগে যায় ক্যাথরিন।শরীর অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে লাগে তার। ক্যাথরিন তানজিদের সমবয়সী,তেহভীন তার চেয়ে তিন বছরের ছোট সেটা জানা সত্ত্বেও সে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো। তেহভীনের অভিজাত্য,সৌম্যদর্শন রূপ দেখে। সবচেয়ে বড় কথা তেহভীন রাগহীন,শান্ত স্বভাবের। উগ্র নয়। কিন্তু আজ মনে হলো তিন বছরের ছোট এই ছেলেটাকে কষিয়ে চড় না মারলে রুহ শান্তি পাবে না। রাগের তোড়ে হাত উঠালো ক্যাথরিন,কিন্তু উল্টো সজোড়ে চরটা তার গালে গিয়ে পড়লো। দুই’পা পিছিয়ে গেলো সে। তখনি সামনে দাঁড়ানো তামান্না কে দেখতে পেলো। রক্তচক্ষু নিয়ে চেয়ে আছে সে। তামান্নাকে ক্যাথরিন একদম সহ্য করতে পারতো না আগে থেকেই। আর আজকের চড়টা তার ভেতরকার অগ্নিকুণ্ড দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো।

তামান্না ক্যাথরিনের হাত থেকে রিপোর্ট গুলো কেড়ে নিয়ে নিলো। মেলে মূল বিষয়টা কি দেখতে লাগলো। দেখার পর যারপরনাই, বিস্মিত চোখে ক্যাথরিনের রাগান্বিত চেহারার দিকে চাইলো,পরবর্তী দৃষ্টিপাত করলো তেহভীনের করুন মুখপানে। ভেতরটায় অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করলো তামান্না।ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে যার তার সাথে রা’ত কা’টা’নো,আ্যভর্শন,লি’ভ টুগেদার এসব অতি সহজলভ্য ব্যাপার। কিন্তু নিজের ভাইয়ের সাথে ঘটমান বিষয়টা সে কোনভাবে মানতে পারছে না। তামান্না প্রচণ্ড আক্রোশে আজ বাসায় গিয়ে সব বিষয়ের খোলাসা করবে ভেবে নিলো। তানজিদ যে এই মেয়েকে বিয়ে না করার জন্য তাদের ছেড়ে চলে গেছে সেটা ভেবেই মনটা তৃপ্ত হচ্ছে তামান্নার। তামান্না তেহভীনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। তেহভীন বাধ্য ছেলের মতো যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে ক্যাথরিনের দিকে তাঁকালো। ক্যাথরিন তখনো ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে ছিলো।চোখাচোখি হতেই তেহভীন ফিচেল হেসে ডান চোখ টিপ মেরে দিলো। ঠোঁটের কোণে ক্যাথরিনের শরীরে জ্বালা ধরে দেওয়ার মতো মিটমিট হাসি।

৭৩

বছরের শেষ তুষারপাত হলো দুইদিন আগে। সেদিন গ্রিক থিয়েটরে বিশাল কনসার্টের আয়োজন ছিলো। জাইমার সাথে কনসার্ট দেখতে যাওয়ার ফল আজ ভুগছে সিলিভিয়া। মাত্রাতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে সেদিনের কনসার্ট স্থগিত রাখা হয়। যার ফলে কাঙ্খিত অর্থাৎ পাকিস্তানি ব্যান্ডের পারফর্ম দেখার সুযোগ হয়নি।জাইমা অত্যন্ত মন খারাপ করেছিলো। পরে বৃষ্টির কঠিনরূপের ধমকের কাছে হার মেনে ফিরতে হয় নিজেদের নীড়ে। সে সাথে তীব্র শরীর খারাবি ঝেঁকে বসলো সিলিভিয়ার উপর। জ্বর,সর্দি,কাশি, নাক টকটকে লাল হয়ে আছে তার।

ঘটা করে সন্ধ্যে নেমেছে একটু আগে। উত্তপ্ত, উষ্ণ শরীর বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলো সিলিভিয়ার দেহ। নাকমুখ দিয়ে আগুনের তাপ বের হচ্ছে যেনো। থেমে থেমে শরীর কাঁপছে। গতদিনের হীমপ্রভাহের করুণ দশা সিলিভিয়াকে মিঁইয়ে দিয়েছে।

ঘড়িতে সময় তখন রাত আটটা। হাত-পা গুটিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলো সিলিভিয়া। কিন্তু ভেতর ভেতর অদ্ভুত ভাবে হাঁসফাঁস করতে লাগলো।অবচেতন মন বলছে কেউ তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আগত অসুস্থতার কারণ আবিষ্কার করছে। সিলিভিয়া মাথার উপর থেকে লেপ সরিয়ে চোখদুটো মেললো। মৃদু অন্ধকারে একটা পুরুষালি অবয়ব দেখে ভয় পেলো। ভয়ের তাড়নায় মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দ বেরুলো। অবয়বটি সিলিভিয়ার অস্থিরতা বুঝতে পারলো। আচমকা সিলিভিয়ার মাথার পেছনে চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দিয়ে শোয়া থেকে তুলে কাছে টেনে আনলো ‘সিলিভিয়াকে। শক্তসমর্থ পুরুষ্ট উষ্ণ প্রসস্তবুকের আড়ালে মিলিয়ে গেলো সে। পিঠের উপর ভারী হাতের স্পর্শ পেলো তৎক্ষনাৎ। সিলিভিয়ার চোখ পূনরায় বুঁজে এলো। এক বা দুই মাস নয়,সম্পূর্ণ পাঁচটি মাস পর সে এসেছে। তাও তীব্র শরীর খারাপের সময়ে। এমন পাষাণ্ড মানুষের আসার কোন অধিকার নেই এখানে।

— সিলভার কি অবস্থা করেছো নিজের?
এতোটা সিক হওয়ার কারণ? বৃষ্টিতে ভিজেছিলে?

সিলিভিয়া উত্তর দিলো না। তেহভীন সিলিভিয়াকে শুয়ে দিলো। সোজা হয়ে বসে বলল,

— তোমার জন্য কতো ঝামেলা পুহিয়ে, এবং মিটিয়ে এখানে এসেছি।আর তুমি কথা বলছো না।

সিলিভিয়া চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— কিসের ঝামেলা?

— তুমি সুস্থ হও,তারপর সব বলবো।
এখন বলো মেডিসিন নিয়েছো? নাকি শুধু শুয়ে
শুয়ে অসুস্থতা বাড়িয়েছো।

— খেয়েছি।

— কিছু খাবে আর, বলো আমি বানিয়ে আনছি।

— তুমি কখন এসেছো?

— বিকালে।

সিলিভিয়া চমকে উঠলো। বিকালে এসেছে অথচ সে টেরও পায়নি।আশ্চর্য! তেহভীন নিজে থেকে বলল,

— আমি ভেবেছি তুমি ঘুমাচ্ছো। তাই বিরক্ত করিনি। সন্ধ্যায় এসে বুঝলাম তুমি সিক। এখন কেমন বোধ করছো?

— জানি না।

তেহভীন মৃদু হাসলো। সিলিভিয়ার হাত ধরে টেনে তুলে বসালো। ঘুমের আর দুর্বলতার রেশের কারণে শরীর ঢুলুঢুলু অবস্থা সিলিভিয়ার তেহভীন আপাদমস্তক সিলিভিয়াকে দেখে হাসলো। সিলিভিয়ার দীর্ঘকায় চুল জট বেঁধে গিয়েছে। হেয়ার ব্রাশ হাতে সিলিভিয়ার এলোমেলো চুলের জট খুলতে লাগলো। তেহভীনের প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিলো সিলিভিয়ার চুল দেখে।সবশেষে না পারতে সে হাসি সমেত বলে উঠলো,

— দ্যা ক্রো উইল থিংক ইট্ ইজ্ হিজ্ হোম,
এন্ড উইল ক্রাউল ইন’টু ইউর হেয়ার।

সিলিভিয়া রেগে গেলো। তারপরও রাগ না দেখিয়ে চুপ থাকলো। যত যাই হোক তেহভীনের সামনে বাঘিনী রূপ ধারণ সে করতে পারে না। সিলিভিয়ার রাগ দেখে তেহভীনও আর হাসলে না।

(চলবে)

কিছু অসংলগ্ন শব্দ ব্যবহার করেছি তারজন্য ক্ষমাপ্রার্থী! সবাই একটু রেসপন্স করুন, রিচ একদম ডাউন। যার টাইমলাইনে পৌছাবে একটা ছোট করে মন্তব্য ছুঁড়বেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here