লাভ রেইন পর্ব-২৯

0
1614

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ২৯

৭৪.
মিঁইয়ে যাওয়া স্বর নিয়ে কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে সিলিভিয়ার। তেহভীন এ নিয়ে দুইবার গরম গরম স্পাইসি’টি করে দিয়েছে যাতে সিলিভিয়ার একটু ভালো লাগে। বাইরের হীমপ্রভাহ এখন অবধি বিরাজমান। গতকালের একাকিত্ব বোধ এখন ঘুচে গিয়েছে তেহভীনের জন্য। সিলিভিয়া ডিভাইনে আরাম করে বসে আছে।মগে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে। এখান থেকে কিচেন রুম স্পষ্ট দৃশ্যমান।

সেদিকে দৃঢ়চোখে চেয়ে আছে সিলিভিয়া। ব্ল্যাকশার্টের উপর ধবধবে সাদা কিচেন এপ্রনটা বেশ মানিয়েছে তেহভীনকে। আজকের ডিনারের আয়োজনটা তেহভীন করবে বলেছে। কি কুক করছে কে জানে। সিলিভিয়া কৌতুহলী চোখে চেয়ে আছে। না জানে কোন অখাদ্য রাঁধছে সে।

অনেকদিন হচ্ছে ভাত খাওয়া হচ্ছে না সিলিভিয়ার। বাঙালিদের আর যাই হোক দুইবেলা ভাত খেতেই হয়।সেখানে সাড়ে ছয়মাসের কাছাকাছি হচ্ছে সিলিভিয়া ভাত খাচ্ছে না। ভাতের বদলে, ইতালিয়ান,থাই, চায়নিজ এসব খাবার খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। আজ হঠাৎ ভাতের কথা মনে পড়াতে ভীষণ মন খারাপ হয় সিলিভিয়ার।

কিচেন টাওয়ালে হাত মুছতে মুছতে তেহভীন লিভিংরুমে আসলো।সিলিভিয়া স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তেহভীন সিলিভিয়ার পাশে বসে কপাল ছুঁয়ে শরীরের তাপমাত্রা দেখলো। আগের চেয়ে একটু কমেছে উষ্ণ তাপ। কিন্তু পুরোপুরি নয়।তেহভীন দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
— খেয়ারলেস! বলেছিলাম নিজের খেয়াল রাখো।
রেখেছো? এখন কষ্ট কে পাচ্ছে?

সিলিভিয়া মৃদু হেসে বলল,
— আমি!

— হাহ! শোন এখন গিয়ে একটু রেস্ট করো।
আমার এখানে কাজ আছে।

— কি কাজ?

— পরে বলি? এখন যাও।

সিলিভিয়া উঠলো না,ভাবলেশহীন হয়ে বসে রইলো।তেহভীন শান্ত চোখে চেয়ে থাকলো সিলিভিয়ার দিকে।সিলিভিয়া ডানহাতের তর্জনী তুলে তেহভীনের পুরুষ্টু চোয়ালে মৃদু স্পর্শ দিলো।তেহভীন ছোট করে হাসলো। এরপর সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে বলল,

— বেংলাডেশে থাকাকালীন সময়ে আমি একবার তোমার চুলের ব্রেইড দরজার সাথে গিঁট মেরে দিয়েছিলাম। মনে আছে?

সিলিভিয়ার সাথে সাথে মনে পড়ে গেলো।ভারী অবাক হয়ে বলল,

— তুমি গিঁট মেরেছিলে?

— ইয়েস!

— কেনো?

— এমনিই, ইচ্ছে করেছিলো তাই।
ফান করেছিলাম। তুমি বোধহয় বুঝতে পারোনি?

— না আমি জানতাম-ই না।ভেবেছি ভুলবশত হয়েছে।

তেহভীন হাসলো। তারপর বলল,

— তোমার জন্য আজকে স্পেশাল ডিস রান্না
করেছি। প্রথমবারের মতো। খারাপ হলেও প্রশংসা
করবে কিন্তু, আগেবাগে জানিয়ে দিয়েছি।

সিলিভিয়া শব্দ করে হাসলো তেহভীনের কথায়। তারপর বলল,

— এতদিন কিসের ঝামেলায় ছিলে?

সিলিভিয়ার কথায় তেহভীন মৃদু হাসলো। এরপর বলল,
— দ্যা এনগেজমেন্ট ইজ্ ব্রোকেন সিলভার।

— ব্রোকেন? কিভাবে?

—- ইজি ছিলো না সিলভার। ক্যাথের ফ্রেন্ড এমিলি,তাদের কোন এক ইস্যু নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। তাদের বন্ধুত্ব ভেঙে গিয়েছে। তখন এমিলি আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করলো।ক্যাথরিনের সম্পর্কে কিছু গোপন তথ্য আমাকে দিয়েছিলো।

—- কি গোপন তথ্য?

তেহভীন একটু চুপ থেকে বলল,

— সেটা বলতে চাইছিনা। তবে ড্যাড ক্যাথের
করা অপরাধে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। নিজের মেয়ের চোখে দেখতো ক্যাথকে,কিন্তু সে চিটিং করে এসেছে আমাদের সাথে। এজন্য ড্যাড যেমন কষ্ট পেয়েছেন তেমন রেগেও আছে। কালচার অনুযায়ী এসব স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও মমের কাছে এটা একটা বিরাট ব্যাপার ছিলো। যারজন্য,এখন আমি এখানে।

— তুমি বলেছো সব আঙ্কেলকে?

—নো, তামান্না সিস বলেছে সব।সেদিন প্রিন্সেস গার্ডেনে সিস আর আমি একসাথে গিয়েছিলাম।ক্যাথের আচরণ সম্পূর্ণ নিজ চক্ষে দেখেছে সে।এরপর তামান্না ড্যাডকে সব বলে দেয়।এখানে একটা ব্যাপার আছে আমি অথবা তানজিদ ব্রো যদি কথাগুলো বলতাম,তাহলে ড্যাড কখনো বিশ্বাস করতেন না।উল্টো আমাদের ধমকাতেন,রাগ দেখাতেন।এজন্য আমি সময় নিয়ে সিসকে দিয়ে সব করিয়েছি। ড্যাড সিসকে একমাত্র মেয়ে হিসেবে ভীষণ ভালোবাসেন।

তেহভীনের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সিলিভিয়ার মিনমিন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— কি করেছে সে? ক্লিয়ারলি বলছো না কেন?

তেহভীন বাঁকা চোখে তাঁকালো সিলিভিয়ার দিকে।এরপর ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—- ক্যাথরিনের একাধিক লোকের সাথে ফিজিঃ রিলেশন,এ্যাবর্শন। সব।

সিলিভিয়া মস্তিষ্ক এবার ক্ষ্যান্ত হলো।এতক্ষণ অদ্ভুত ভাবে মাথা ব্যাথা করছিলো প্রবল আগ্রহে ক্যাথরিন কি করেছে সেটা জানার জন্য। সে যে ভালো কিছু করেনি সেটা আগেই আন্দাজ করেছে।কিন্তু কি করেছে সেটা জানার জন্য মস্তিষ্ক ছটফট করছিলো।
অবশেষে শুনার পর শান্ত হলো।এটা সিলিভিয়ার একধরনের সমস্যা।

৭৫.

সচরাচর ক্যান্ডেলাইট ডিনারের ভিউটা হয় সন্ধ্যা অথবা রাতের আঁধারের খোলা আকাশের নিচে। তেহভীন আয়োজনটা করলো করিডোরে। খোলামেলা কোরিডরে। ছোট একটা টেবিলে ফুল দিয়ে সাজালো, তারপর ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে মাঝখানে রাখলো। বাইরে নিঃসৃত তুষারপাতও এই মুহূর্তে ভীষণ দৃষ্টি কাড়ছে তেহভীনের। শ্বেত বরফের মাঝে ক্যান্ডেলের সোনালি আলো জ্বলজ্বল করছে।
টেবিলের উপর দু’টো সাদা প্লেট রেখে তারমধ্যেে রাখা খাবারগুলো ঢেকে রেখে সিলিভিয়াকে ডাকতে গেল তেহভীন। ভেতরে ভেতরে হাঁপাচ্ছে সে। সিলিভিয়াকে বাথরুমে পাঠিয়ে এতটুকু সময়ের মাঝে সে এসব করেছে।শুধুমাত্র সিলিভিয়ার ভেতরের মন খারাপের রেশটা দূর করতে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সিলিভিয়াকে নিয়ে কোরিডোরে চলে আসলো তেহভীন। সিলিভিয়া প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। পরে সবকিছু ভালোভাবে লক্ষ করার পর বুঝলো ; এটা একটা ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজিত পরিবেশ।সুন্দর ওয়েদারে সুন্দর একটা আয়োজন। সিলিভিয়ার, শুষ্ক ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলো। ম্লানমুখের গম্ভীর ভাব কেটে গেলো। সিলিভিয়াকে হাসতে দেখে তেহভীনও হাসলো।পবিত্র, বিশুদ্ধ, কোমল, মোহনীয় দৃষ্টিতে সিলিভিয়ার হাসিটাকে দৃষ্টিবন্দি করলো সে।

তেহভীন চেয়ার টেনে বসলো,এরপর সিলিভিয়ার হাত ধরে টেনে বসালো। দু’জনে পাশাপাশি বসা। তেহভীন ছোট একটা সাদা গোলাপ সিলিভিয়ার কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বলল,

—- এখন ঠিক লাগছে তোমাকে!

সিলিভিয়া ছোট করে হাসলো। তেহভীন আবার বলল,

— দেখো তোমার জন্য ‘বিফ বিরিয়ানী’
কুক করেছি আমি। খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে।

সিলিভিয়া অবাক হলো না। বিরিয়ানীর ঘ্রাণটা সে অনেক আগেই পেয়েছে। কি তীব্র ঘ্রাণ।সর্দির সাথে নাক বন্ধ ছিলো, তারপরও ঘ্রাণটা চিনতে পেরেছিলো সিলিভিয়া। সময় নষ্ট না করে এক চামচ মুখে নিলো। সবাই সবকিছুতে পারদর্শী হয়না। জলজ্যান্ত প্রমাণ তেহভীনের এই বিরিয়ানী রান্নাটা।কিন্তু চেষ্টা তো করেছে। সিলিভিয়া চামচ নামিয়ে রেখে তেহভীনের দিকে তাকালো। তেহভীন বেশ উৎসুখ দৃষ্টিতে সিলিভিয়ার দিকে তাকিয়েছিলো।

—- কেমন হয়েছে? নিশ্চয় খারাপ?
প্লিজ খারাপ হয়েছে বলো না। আমি কষ্ট পাবো।

সিলিভিয়া ফিক করে হেসে দিলো। এরপর পূনরায় খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। খেতে খেতে প্রশ্ন করলো,
—- কার কাছে থেকে শিখেছো এটা?

—- মম নিজের জন্য কুক করতো।সেখান থেকে
শেখা। কেমন হয়েছে?

— ভালো হয়েছে। চিলি কয়টা দিয়েছে ঝাল কম লাগছে।

— কম হয়েছে?আটটা দিয়েছি। পারফেক্ট
ঝাল হওয়ার কথা হয়নি কেন?

সিলিভিয়া কিছু বললো না আর।ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকালো শুধু। খাওয়া শেষে টিস্যুতে মুখ মুছে বলল,

—- তুমি খেতে পারবে না এটা রেখে দাও।

—- পারবো,তুমি বসে থাকো আমি খেয়ে নিই। তারপর কালকের প্ল্যানিং আছে।তুমি সুস্থ হয়ে যাও আজ। কাল খুব সুন্দর একটা জায়গায় যাবো।

—- কোথায়?

—- সিক্রেট,বলা যাবে না।

— ফাইন।

৭৬.

বিগত দিন গুলোর তুলনায় আজ অনেকটা সুস্থ সিলিভিয়া। ঠিক মতো খাবার,ওষুধ শরীরের অসুস্থতাকে ঠেলে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধ গগন আর তুষার পাহাড় মিলে একাকার হয়ে আছে। আকাশ আর তুষারপাহার কোনটা তা আলাদা করা যাচ্ছে না। তেমনিই একটা জায়গায় আজ ক্যাম্পিং করতে এসেছে তেহভীন-সিলিভিয়া,সাথে আরো একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা।

রিজি মারিন কাউন্টি এর,নাপা ওয়াইনারি এর কিছুটা কাছে অবস্থিত ‘পয়েন্ট রেয়েস ন্যাশনাল সিশোর। তেহভীন সিলিভিয়ার হাত ধরে একটা সবুজ পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। চোখে সামনে দৃশ্যমান সৈকত হাতির সীল ঘূর্নায়মানের দৃশ্য। তাদের ঠিক পেছনে একটা বড়সড় দু’টো তাঁবু টাঙানো আছে। একটা সিলিভিয়া আর এলসা,অন্যটাতে তেহভীন আর তানজিদ থাকবে। মূলত তারা এখানে ক্যাম্পিং করত এসেছে। আশপাশ ঘুরবে,খাবে,আড্ডা দিবে। হলিডে কাটানোর মোক্ষম সুযোগ হাতে পাওয়ার পর তারা ছুটে চলে আসলো এই পার্কে। শীতের আমেজটা এদিকে নেহাৎই কম। নাহলে এই বাইরের খোলামেলা পরিবেশে ঠিকে থাকা দায় হয়ে পড়তো তার। সিলিভিয়া সবুজ পরিচ্ছন্ন ঘাসের উপর বসে পড়লো নাম না জানা কতোগুলো ফুল আশেপাশে রয়েছে। সিলিভিয়ার হাতের তালুতে ফুলগুলো স্পর্শ করছে।সুরসুরি লাগছে বেশ,তারপরও থামছে না সিলিভিয়া।সন্ধ্যার নামার পূর্বমুহূর্ত।সূর্যাস্তের সময়। বেশ আকর্ষনীয় একটা পরিবেশ এবং আবহাওয়া। এসময়টাকে রোমেন্টিক মোমেন্ট বলা হয়।তানজিদ আর এলসা তাঁবুতে গল্প করছে। তেহভীন সিলিভিয়া কাধে মাথা রাখলো। নীলাভ সৈকতের পানির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ তার। মোহনীয় এক সন্ধ্যা।অকস্মাৎ, তেহভীন বলল,

— রোমেন্সের জন্য কাপলরা এই পার্কে চলে আসে। আরামদায়ক উপকূলের এই ক্যাম্পগ্রাউন্ডের ঘাস পাহাড়ের উপর তাঁবু বসানোর উপযুক্ত জায়গা। তোমার কেমন লাগছে?

— খুব ভালো লাগছে।

তেহভীন সিলিভিয়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো। তারপর হাতটা টেনে এনে ছোট করে একটা চুমু বসিয়ে দিলো। সাথে সাথে সিলিভিয়ার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো।তেহভীন ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে তাঁকালো,বাইরে থেকে তাঁবুর ভেতরের মানব-মানবীর ছায়া দেখা যাচ্ছে।তারা ব্যাস্ত খুব। তেহভীন সিলিভিয়ার দিকে ফিরে কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে গভীর একটা চুমু বসালো। এরপর সরে এসে আগের ন্যায় সিলিভিয়ার কাধে মাথা রাখলো। সিলিভিয়া তখন আঁড়চোখে তেহভীনের মুখের দিকে তাঁকালো। কেমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চেয়ে আছে সামনের দিকে যেনো কিছু হয়নি।এদিকে সিলিভিয়ার হাত পা অসাড় হয়ে আসছিলো। তাই সে তেহভীনকে রেখে ঝট করে উঠে তাঁবুতে ফিরে গেলো। সিলিভিয়ার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলো তেহভীন।

(চলবে)
এ গল্পে আমি কোন টুইস্ট রাখবো না। এভাবেই ধীরে ধীরে এন্ডিংয়ের কাছে আগাবো।কিন্তু গল্পে টুইস্ট না থাকলে নাকি গল্প হয়না৷ একজন আমাকে বলেছে। আপনারা কি বলবেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here