লাভ রেইন পর্ব-৫

0
2533

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ০৫

১১.
কোলাহলহীন নিভৃত মুহূর্ত। থেমে থেমে ছোট্ট শিশুর কান্না কর্ণভেদ করছে। রাঁধুনিঘর থেকে টুংটাং থালাবসনের শব্দ এগিয়ে আসছে। একজোড়া শীতল চোখের দৃষ্টি জিনিয়ার ফোনের স্ক্রিনের উপর ভাসছে। অবাক হলো নারীমূর্তিটির প্রকাশিত সাহস দেখে। সায়মন ফোন থেকে চোখ সরিয়ে জিনিয়ার দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লো। জিনিয়া নিজের রঙিন অধরজোড়া ফাঁক করে শ্লেষপূর্ণ হাসলো। বলল,

— দেখেছেন তো দুলাভাই? আপনার বোন
কতো ভালো?

রুজিনা বাসন আলগা করে টেবিলে রাখলো।যাতে সোফা রুমের উচ্চারিত কথা তার কর্ণ ভেদ করে। সায়মন জিনিয়ার ফোনটা ফেরত দিলো। এরপর ক্ষীণ হেসে নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। গ্যালারি থেকে কিছু ছবি স্ক্রিনের সামনে এনে জিনিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো। জিনিয়া ভ্রুঁদ্বয় কুঁচকে ফোন হাতে নিলো। হঠাৎ ফোনের দিকে তাকিয়ে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় জিনিয়ার।চোরাচোখে একবার জুলিয়ার রুমের দিকে তাঁকালো। এখন জুলিয়াই শেষ ভরসা।কিন্তু এখনো রুম থেকে বেরোচ্ছে না। জিনিয়া হালকা কাশি দিলো।এরপর মৃদ্যু হেসে সায়মনকে বলল,

— আরে দুলাভাই ও তো আমার বন্ধু।আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি। এখন মাঝেমধ্যে দেখা হলে একটু আধটু আড্ডা আর ছবি তুলা হয়।

সায়মন নিজের ক্রুধ চাপিয়ে বলল,
— বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে এভাবে ছবি তুলা হয় আজ জানলাম জিনিয়া।

জিনিয়া অপ্রস্তুত হাসলো।মনে মনে রোষানলে ফেটে পড়লো। এই ছবি প্রেরণকারীকে হাতের নাগালে ফেলে চুরি মেরে খুন করতো জিনিয়া।

— হয়েছে কি…

— সাট আপ! এখন এক্সকিউজ দিতে যাচ্ছো?
একটু আগে আমার বোনকে নিয়ে কি মন্তব্য করতে যাচ্ছিলে তুমি? নিজে বেহায়া একটা মেয়ে।নেহাৎ, আমি সম্পর্কের কদর করতে জানি।তাই উল্টাপাল্টা কিছু বলে মুখ খারাপ করতে চাইছিনা। এখন বের হও আমার বাড়ি থেকে।

সায়মনের ধমক,চিৎকার শুনে হুড়মুড়িয়ে রুম থেকে বের হয় জুলিয়া।সে ভেবেছে সায়মন হয়তো সিলিভিয়াকে কোন কারণে ধমকাচ্ছে।একটু মজা নিতে বের হয় সে।কিন্তু সিলিভিয়ার জায়গায় নিজের বোনকে দেখে তেতে উঠে জুলিয়া। সায়মনের কাছে এগিয়ে এসে বলল,

— কি হচ্ছে এটা,তুমি আমার বোনকে এভাবে ধমকাচ্ছো কোন?

সায়মনে গলার স্বর আরো বাড়িয়ে বলল,
— তোমার বোনের সাহস কি করে হয়?
আমার বোনকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করার।

জিনিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,

— আমি বাজে মন্তব্য করিনি আফা। দুলাভাইকে দেখাতে এসেছিলাম তার বোন রাস্তাঘাটে পরপুরুষের সাথে হাত ধরাধরি করছিলো।

জুলিয়া অবাক হয়ে যায় জিনিয়ার কথায়। এটা কি করলো জিনিয়া।এটা বলার আগে জিনিয়ার উচিত ছিলো আমাকে জানানোর।বোনের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা যার তার দোষত্রুটি কিভাবে দেখবে সায়মন। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ার আগে জুলিয়া গলা উঁচিয়ে বলল,

— জিনিয়া তুই কি দেখতে কি দেখেছিস বলতো। আমাদের সিলি এমন কাজ কখনোই করতে পারেনা।এটা আমার বিশ্বাস তাই না সায়মন।

সায়মব আঁড়চোখে জুলিয়ার দিকে তাঁকালো। ভাগ্য সহায় ছিলো, তার বোনের হয়ে বললে আজ এ বাড়িতে তার শেষ দিন হতো।আর সায়মন চাচ্ছে জুলিয়াকে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে। ওর মতো মেয়ের যোগ্য নেই তাদের বাড়িতে বউ হয়ে থাকার।

জুলিয়া হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে জিনিয়ার পাশে দাঁড়ালো। সায়মনের দিকে চেয়ে বলল,

— সায়মন,ও ছোট মানুষ। কি বলতে কি বলে ফেলেছে, তুমি ক্ষমা করে দাও ওকে।

সায়মন কিছু বললো না।কারণ এ দুজনকে কথায় বলে কিছু হয়নি।যা করার অন্যভাবে করতে হবে। যাতে সাপ ও মরবে,লাঠিও ভাঙবেনা। সায়মন চলে যাওয়ার পর জুলিয়া আর জিনিয়ার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সিলিভিয়ার রুমের দিকে। সিলিভিয়া সবেমাত্র গোসল সেরে বের হয়েছিলো।সায়মনের কন্ঠস্বর শুনে সে রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো।মূল বিষয়টা তখনি বোধগম্য হয় তার। সিলিভিয়া তাদের দুইবোনের দিকে চেয়ে শ্লেষাত্মক হাসলো। এরপর নিজের ভেজা লম্বা চুল ডানহাতের সাথে পেঁচিয়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো। এ দুইবোনের সমস্যা একটা,সেটা হচ্ছে সিলিভিয়া। জুলিয়া এমন একটা অবিবাহিত যুবতি ননদ বাড়ি রাখতে নারাজ। ইনিয়েবিনিয়ে সায়মনকে অনেকবার সিলিভিয়ার বিয়ের কথা বলতো,সায়মন উল্টো সেসবে পাত্তা না দিয়ে জিনিয়াকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখতো। ব্যস,তখনি জুলিয়ার মুখে কুলুপ এঁটে ফেলতো।

১২.

মাঝেরদিনটি বাদ রেখে পরদিন অপরাহ্ন বেলায় সিলিভিয়া চললো রাদিফদের পড়ানোর উদ্দেশ্যে। মনমরা রূপ ত্যাগ করে সিলিভিয়া আচমকা হয়ে উঠলো চঞ্চল যুবতি।ঠোঁটে কোণে হাসি হাসি ভাবটা এঁটে রেখেছে। যতো এগিয়ে যাচ্ছে ততই বুকটা ধড়ফড় করতে লাগলো সিলিভিয়ার।অটোর পেছনের সিটে বসে বারকয়েক আয়নায় চোখ রাখলো। আজ ক্রিমের সাথে হালকা ফেসপাউডার, আর চোখে কাজল পড়েছে সে।দেখতে আহামরি রূপবতী না লাগলেও মন্দ লাগছে না দেখে ছোট করে হাসলো সিলিভিয়া। চরপাশের বিষাক্ত কিংবা কলুষিত পরিবেশেও কেমন রঙিন রঙধনুর ছোঁয়া।

ডরবেল দেওয়ার সাথে সাথে রাদিফ দরজা খুলে সিলিভিয়াকে সালাম দিলো,এরপর বলল,

— এখন কেমন আছো আপু?

— ভালো আছি,তুমি?

— ভালো,ভেতরে এসো।

সিলিভিয়া স্মিথ হেসে ভেতরে প্রবেশ করলো। রাইসাকে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসতে দেখে আজ একটু অবাক হলো সে। পরমুহূর্তে নিজের বিস্মিতরূপ সামলে সোফায় বসলো।বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাইসা বললো,

— আসসালামু আলাইকুম, আপু।

— ওয়ালাইকুম আসসালাম।

রাদিফ এসে বসলো। সামনে তার এসএসসি পরীক্ষার। যথাসাধ্য সম্ভব পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টায় রত।আর সিলিভিয়ার এসএসসি এবং এইসএসসি রেজাল্ট গোল্ডেন ফাইভ।পড়াশোনায় তুখোড় মেধাবী সে।যারজন্য রুভাইয়াত রাদিফের জন্য সিলিভিয়াকে টিউটর হিসেবে রেখেছিলো। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে সিলিভিয়া আঁড়নজরে রাদিফের রুম,রুভাইয়াতের রুম, কিচেন সবখানে তাঁকালো। ঘরদোর কেমন যেনো ফাঁকা,নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে সিলিভিয়ার। তেহভীন নামক যুবকের দেখা এতক্ষণ তো পেয়ে যাওয়ার কথা। অজানা আশঙ্কায় মনটা দুমড়ে উঠে সিলিভিয়ার। বারবার সিলিভিয়াকে অমনোযোগী দেখে রাদিফ ডাকলো।

— আপু?

তৎক্ষনাৎ চমকে তাকালো সিলিভিয়া।রাদিফের ডাকটা কেমন যেনো ভয়ংকর শুনালো তার কান দিয়ে। রাদিফ নিজেও হকচকিয়ে যায় সিলিভিয়ার আচরণে। সে বলল,

— আপু তুমি কি অসুস্থ বোধ করছে আবার?

— ন না,না,অসুস্থ বোধ করছি না।আসলে আমার গলাটা শুঁকিয়ে গেছে খুব।আন্টিকে খুঁজছিলাম।

রাদিফ বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
— মা তো এখন বাসায় নেই।তুমি অপেক্ষা করো আমি আনছি।
রাদিফকে চলে যেতে দেখে সিলিভিয়া রাইসার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে নিচু স্বরে বলল,

— রাইসা তোমার ফুফি কোথায়?দেখছি না যে।

রাইসা মাথা তুলে বলল,

— আপু ফুফিরা তো চলে গেছে।

— চলে গেছে মানে? কোথায় চলে গেছে?

— ফুফিদের দেশে,সটলেন্ডে(স্কটল্যান্ড)।

শেষ কথাটায় সিলিভিয়ার কানে বর্জ্যনির্ঘোষিত হওয়ার ন্যায় অনুভব হলো।এইতো পরশুদিন ও তো তারা ছিলো।আর তেহভীন? সে তাহলে এজন্যই সেদিন এমন অদ্ভুত কথা বলছিলো। কিন্তু যাওয়ার কথাটা বললে কি হতো? নাকি আমিই এক্সপেকটেশন বেশি রেখে ফেলেছি? মানুষটার কাছে হয়তো আমিই বিশেষ কেউ নই।যারজন্য আশানুরূপ ব্যবহার পায়নি।অন্ততপক্ষে আমাকে জানিয়ে যেতে পারতো।
দুই দিনের অপরিচিত ব্যাক্তি,স্বল্প পরিচয়ে বিশেষ কেউ হয়ে উঠেছে। সে চলে গেলো,ঠিকই।কিন্তু সিলিভিয়া অনুভব করছে তার মনের একটা অংশ সে কেড়ে নিয়ে চলে গেছে।
মনের উত্তাল পাতাল ঢেউকে সংযত রেখে সিলিভিয়া নিজেকে সামলালো।ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় নিজেকে মত্ত রাখতে রাখতে বলল,’ আমি তোমায় ভুলে যেতে চাই ভিনদেশী পাষাণ্ড লোক।’

রাস্তায় নামার সাথে সাথে মৃদু মৃদু বৃষ্টি আরম্ভ হলো। সিলিভিয়া ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চোখ তুলে ম্লান আকাশটার দিকে চাইলো। আজ নিশ্চয় আকাশেরও মন খারাপ।হয়তো কষ্টও জমে আছে আকাশের বক্ষপিঞ্জরে।ম্লান, ধূসর আকাশ পথিমধ্যে নিজের সঙ্গী পেয়ে আকাশের চক্ষদ্বয় ভেদ করে জমিনে গড়িয়ে পড়লো।সিলিভিয়া শরীর চিপচিপে ভেজা
কামিজের অবস্থা করুন হয়ে যায়।পানি ছটা শরীরের সংস্পর্শে এসে কামিজ একদম শরীরের সাথে এঁটে যায়। ব্যাগ থেকে কালো রঙের হুডিটা বের করলো সিলিভিয়া। হুডিটা ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাগে রেখেছিলো।কিন্তু উদ্দেশ্য অসফল হয়।হঠাৎ জল তরঙ্গের ন্যায় বাতাশের সাথে একটা অস্পষ্ট কন্ঠ ভেসে আসলো।শব্দটা ছিলো,’সিলভার’…

(চলবে)
যাদের কাছে পোস্ট পৌছাবে,একটু মন্তব্য করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here