লাভ রেইন পর্ব-৬

0
2629

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ০৬

১৩.
মৃদু সিক্ত নেত্রপল্লবের আড়ালের দৃষ্টিদ্বয় ঈষৎ ক্ষণের ব্যাবধানে বদ্ধরূপ ধারণ করলো।পাপড়ির ভাঁজে হতে নিচ অংশে বিদ্যমান কাজল ছড়িয়ে পড়লো টানা আঁখিদুটির আশপাশ। গাঢ় নিঃশ্বাস আঁকড়ে নিজের মধ্যে পুরে নিলো। কম্পিত ঠোঁটজোড়া বহুক্ষণের চর্চায় স্থির করলো। দাঁতের সাথে দাঁত শক্ত করে চেপে পেছনে ফিরলো।কিয়দংশ মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পর সিলিভিয়ার চক্ষুগোচর হলো এক ফেরীওয়ালার। যার মাথার পলিব্যাগে সিলভারের হাঁড়িপাতিল স্থান পেয়েছে। লোকটি অনায়াসে ‘সিলভারের হাঁড়িপাতিল নিবেন?’সিলভার’ বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। মৃদ্যু বৃষ্টির মাঝেও লোকটি কোথায় ঠাঁই নিচ্ছেনা।বাতাশের তালে তালে এগিয়ে আসতে লাগলো। পূনরায় ‘সিলভার’ ডাকটি কর্ণগোছর হতেই সিলিভিয়ার মস্তিষ্কে আঘাত হানলো। এতক্ষণ ধরে নিজের মধ্যে প্রতিয়মান সুপ্ত অনুভূতি ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো মুহূর্তে।সিলিভিয়া গভীর নিঃশ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগলো পূনরায়।
পেছন থেকে তখনো অনবরত সিলভার ডাকটা ভেসে ভেসে আসছে। সিলিভিয়া সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মাথা নুইয়ে নিচের দিকে চেয়ে পদযুগল সক্রিয় করলো। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির আমেজরূপ তখনো আচ্ছন্ন। কিয়ৎক্ষণ পর মাথার উপর ছায়ার মতো কিছু একটা উড়ে এসে স্থির হলো।সিলিভিয়া চট করে চোখ তুলে তাঁকালো।মাথার উপর জামরঙের একটা ছাতা। মাথা নামাতেই ছাতা ধরে রাখা একটা পুরুষ্ট হাত দৃশ্যমান হলো। মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর হাতটা দেখে বিমোহিত হলো সিলিভিয়া।পাশে কে আছে সেটা আর দেখার প্রয়োজন পড়লো না। তৎক্ষনাৎ পাশ থেকে বড়সড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে কেউ একজন বলল,

— সিলভার,কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমাকে।

এবার ছিঁটকে ছাতার নিচ থেকে বের হয়ে গেলো সিলিভিয়া। অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি কে দেখার পর মনটা আচানক শীতল হয়ে যায় সিলিভিয়ার।ব্যাক্তিটি পূনরায় গম্ভীর স্বরে বলল,

— কি হলো? ভেতরে এসো,ভিজে যাচ্ছো তুমি।
শরীর খারাপ করবে তো।

সিলিভিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে চোখ বড় করে তেহভীনের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারমানে তেহভীন সত্যিই তাকে ডেকেছিলো।আর ওই ফেরীওয়ালা? সিলিভিয়া গলা উঁচিয়ে তেহভীনের পেছনে তাঁকালো। লোকটা এখন অদৃশ্য। তেহভীন এগিয়ে এসে সিলিভিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে মাথার উপর ছাতা রেখে বলতে লাগলো,

— সিলভার,আমি রিস্ক নিয়ে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। আমার পারমিশন নেই সিলভার।আমি চাইলেও যেখানে সেখানে যেতে পারিনা। তবে তোমাকে অতিব গুরুত্বপূর্ন একটা কথা বলার জন্য এসেছি।

সিলিভিয়া দৃষ্টি তুলে ভিনদেশী যুবকটির পানে চাইলো। কতো অমায়িক চেহারার মানুষ।কথাবার্তায় কতো মিষ্টান্ন একটা ভাব। কিন্তু তেহভীন কেন এসেছে সেটা জানার তীব্র কৌতূহল এসে ঝেঁকো ধরলো তাকে। অস্পষ্ট স্বরে জানতে চাইলো,

— কেন? তোমরা না চলে গিয়েছিলে?
তাহলে এখানে?

তেহভীন জবাবে বলল,
— আমাদের আজকের ফ্লাইট আরো দুইদিন পর পিছিয়েছে সিলভার। আবাহাওয়ার অবস্থা ভালো নয়।সেজন্য আমাদের আজকের যাওয়াটা ক্যান্সেল হয়েছে।।

— তুমি এখানে কেন এসেছো?

— রাডিফ ছাতা নিয়ে তোমার কছে আসতে যাচ্ছিলো।আমি ভাবলাম ওর বদলে আমি চলে আসি।মম-ড্যাড কেউ জানেন না।উনারা বিশ্রাম নিচ্ছেন আমি সেই ফাঁকে চলে এসেছি।

সিলিভিয়ার জানতে মন চাইলো, তেহভীন একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক হয়েও কেন এতো বাঁধা তার।কিন্তু প্রশ্নটা ঠোঁটে আগায় এসেও পিছিয়ে যায়।ফলস্বরূপ সিলিভিয়া জিজ্ঞেস করতে পারলো না। তেহভীন সিলিভিয়াকে মৌন থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ হাসলো। এরপর বলল,

— সিলভার,আমি জানি তুমি কি ভাবছো।আমি সেটা বলতে চাইছিনা।আমার হাতে দুইদিন সময় আছে। কালকের দিনটা তুমি আমাকে দিতে পারবে? তোমাদের কান্ট্রিতে হয়তে এটা আমার শেষ আসা। আর কখনো হয়তো আসা হবে না।এজ এ ফ্রেন্ড,তুমি কি আমার কিছু ইচ্ছে পূর্ণ করবে?

সিলিভিয়া উপর-নিচ মাথা নাড়ালো।কোনো কিছু না ভেবে। সিলিভিয়া চাইলে অনেক প্রশ্নের ঝুড়ি মেলতে পারতো তেহভীনের সামনে। কিন্তু সেটা করবেনা,যেহেতু তেহভীনে সাথে এটা তার শেষ দেখা।সে মন থেকে উপভোগ করতে চায় তেহভীনের সঙ্গ। স্বল্পদিনের অপরিচিত যুবক,চোখের পলকে হৃদয়ের জায়গা করে ফেলেছে।এটা আদৌ উচিত ছিলো?

তেহভীন ম্লানমুখে সিলিভিয়ার চোখের দিকে তাকালো।রাজ্যের বিষন্নতা দেখতে পায় তেহভীন সিলিভিয়ার চোখে। শীতলচোখে অন্যকিছুর আভাসও লক্ষ করছে সে।যেটা কখনোই সম্ভব নয়।তেহভীন স্মিথ হেসে দু’পা পিছিয়ে গেলো। এরপর দৃঢ়প্রতিক্রিয়া পিছিয়ে যেতে যেতে বলল,

— তাহলে দেখা হচ্ছে কাল।অবশ্যই সারাদিন তোমাকে আমার সাথে থাকতে হবে। একটা ওয়ান্ডারফুল মোমেন্ট স্পেন্ড করবো আমরা।বি রেডি প্রিটি লেডি।

মাঝরাস্তায় সিলিভিয়াকে রেখে তেহভীন চলে গেলো।সিলিভিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে আওড়ালো,

— বন্ধু বলেছো,এতটুকু তোমার জন্য আমি করতে বাধ্য তেহভীন।

১৪.
তারপর সময় গড়ালো,সূচনা হলো নতুন পূর্বাহ্নের।
ব্যস্তনগরীতে পাখপাখালির হঠাৎ কলরব মনকে শীতল করে দেয়। কুহেলিকায় ডুবন্ত পূর্বাহ্নে কফির মগে ওষ্ঠ ছুঁয়ে চুমুক বসালো তেহভীন। আজকের দিনে একটু স্ট্রাগল করতে হবে। প্রয়োজন হবে কিছু মিথ্যে অভিনয়ের।জীবনের অভিনব মুহূর্তটাকে সে এই পর্যন্ত এসে উপভোগ না করে ফিরবে না।তার বাবা মেথেউ এ্যাসফোর্ড মনের দিক থেকে ভালো হলেও এদেশের প্রতি উনার বিরক্তি গগনচুম্বী। নিজ দেশকে যথেষ্ট ভালোবাসে,কিন্তু এদেশের ব্যাপারে উনাকে কখনো আগ্রহী স্রোতা হতে দেখেনি তেহভীন।
ঠিক উনারই বিপরীতমুখী হলো তেহভীন।কফির মগে শেষ চুমুক বসিয়ে তেহভীন মনে মনে বলল,

— বেংলাডেশের প্রতি আমার অদৃশ্য আকর্ষণের মূল গন্তব্য কি আমি জানি না।তবে আমার বিশ্বাস। এমন কিছু আছে যার জন্য আমার হৃদয়ের অবস্থা বারবার মরিমরি হয়ে উঠে।

সময়টা সাতটার ঘর ছাড়িয়ে আটটা ঘরে উঁকি দিলো তখন।তায়্যিবা তেহভীনের ঘরে এসে দেখলো সে এখনো বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।তায়্যিবা তেহভীনের শিয়রে দাঁড়ালো, মৃদু কন্ঠে ডাকলো বারকয়েক। কিন্তু তেহভীনের কোন সাড়াশব্দ ফেলো না। তায়্যিবা নিঃসংকোচে লেপ সরিয়ে তেহভীনের উন্মুক্ত পিঠের উপর হাত ছোঁয়ালো। আচমকা হাত সরিয়ে মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো তায়্যিবা। দ্রুত, রুভাইয়াত,মেথেউ, তামান্না সবাইকে ডাকলো।
তায়্যিবার আর্তনাদ মিশ্রিত কন্ঠস্বর শুনে সকলে ধড়মড়িয়ে রাদিফের কক্ষটিতে প্রবেশ করলো। মেথেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে? চিৎকার করেছো কেন?

— তেহভীনের শরীরে প্রচণ্ড জ্বর।

— হঠাৎ, জ্বর আসলো কি করে।কাল তো সুস্থ ছিলো।

রুভাইয়াত বলল,

— এই মৌসুমে এমনি হয়। তার উপর অবেলায় বৃষ্টি।কাল গাড়ি থেকে বের হওয়ার পর মাথায় বৃষ্টি পড়েছে হয়তো তেহভীনের।সেজন্য জ্বর এসেছে।

মি.মেথেউ সন্দিগ্ধ চোখে তেহভীনকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। এরপর বলল,

— তাহলে কি আমাদের যাওয়া ক্যান্সেল?

রুভাইয়াত দ্রুত বলল,

— না না,এটা তো সম্ভব নয়।এতোবড় মিলাদ সভা। আপনাদের জন্যেই সামনে আগানো হয়েছে। আপনারা না গেলে কেমন হয়।আমার মনে হয় তেহভীন না গেলে ভালো হয়।আমরা গিয়ে সন্ধ্যার আগে চলে আসবো।তাছাড়া রাদিফ আছে,ওকে বলবো তেহভীনের খেয়াল রাখতে।
তায়্যিবা আর তামান্না ও রুভাইয়াতের কথায় সায় জানালো।উপায়ন্তর না পেয়ে মি.মেথেউ রাজি হয়ে যায়। যাওয়ার আগে রুভাইয়াতকে বলল, বাইরে থেকে দরজা যেনো চাবি দিয়ে লকড করে দেয় রাদিফকে সহ।একটা দিন তারা ঘরবন্দী থাকলে কিছু হবে না। রুভাইয়াত ও তাতে সায় জানালো।

সবাই চলে যেতেই হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলো তেহভীন। রাদিফ ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে শয়তানি হাসলো। দু’জনের চোখাচোখি হয়।রাদিফ বলল,

— সেলিউট ব্রো।ইউ’আর যাস্ট এন এমেইজিং এক্টর।আই লাভ ইট।

তেহভীন মৃদু হাসলো। এরপর বলল,
— রাডিফ,তোমার ফোনটা দাও।

— আমার ফোন দিয়ে কি কাজ তোমার।

তেহভীন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।রাদিফের নিকটে গিয়ে প্যান্টের পকেট হাতরিয়ে ফোনটা নিয়ে নিলো।কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নির্দিষ্ট বার্তা প্রেরণ করেই রাদিফকে ফোনটা ফেরত দিয়ে দিলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here