#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ০৮
১৭.
ছিঁটকে নিপাতিত স্থান থেকে সড়ে গেলো জিনিয়া।কি আজব! তার কামিজের নিচের অংশ ভিজে জুবুথুবু অবস্থা।জিনিয়া বিচলিত দৃষ্টিতে মুখ হা করে শুয়ে থাকা জুলিয়ার দিকে থাকালো।এক ধরনের ভেজা স্যাঁতস্যাঁত ভাব বিছানাজুরে। ছিঃ!
জিনিয়া জুলিয়ার গায়ে জোরে চাপর মেরে বলল,
— এই আফা,উঠ! বিছানায় মুতেছিস কেন?
এতবড় দামড়া বেডি। এই আফা। এই মুতানি উঠ্।
কথাগুলো অনেকটা জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল জিনিয়া। রান্নাঘরে কাছাকাছি হওয়ায় রুজিনা সম্পূর্ণ কথাটা শুনে নিলো।সায়মন তখন সবেমাত্র চায়ের কাপে চুমুক বসিয়েছিলো। তার ওষ্ঠপুটে ক্ষীণ হাসির আবির্ভাব। রুজিনা থমথম দৃষ্টিতে সায়মনের দিকে তাকালো।এরপর হাতের কাজ রেখে এগিয়ে এসে বলল,
— এটা কি শুনছি আমি সায়মন? বিছানায়?
সায়মন ভাবলেশহীন দৃষ্টি ছুঁড়ে চায়ে চুমুক বসালো।
জুবানের কান্না তখনি কর্ণগোচর হয়। মায়ের দিকে নিষ্পল চাহনি ছুঁড়ে সায়মন বলল,
— কথা সত্য মা। জুলিয়া বিছানায় প্রস্রাব করে।
এবং সেটা একসপ্তাহ ধরে। আমার কাছ থেকে কয়েকদিন লুকিয়েছে।এরপর কয়দিন ডায়পার ইউস করেছে। কাল জিনিয়া এসেছে তাই আমি প্যাকেটটা লুকিয়ে ফেলেছি।
রুজিনা অসন্তোষ্ট দৃষ্টি ছেলের দিকে ছুঁড়ে বললেন,
— এটা ঠিক করিস নি সায়মন।ওর কোন সমস্যা হয়নি তো আবার?
সায়মন গম্ভীর স্বরে বলল,
— মা ওর ঘুম ও বেশি আর নামায কালাম তো নেই।সেজন্যই এমনটা হচ্ছে।
রুজিনা বললেন,
— জটিল কোন সমস্যা নয়তো?
মানে আগে পরে কিছু হবে না তো?
সায়মন কিছুক্ষণ চুপ থাকলো।এরপর বলল,
— জানিনা।
— তাহলে তুই চুপ আছিস কেন? ওকে বল,এভাবে কতোদিন।আমি তো এইমাত্র শুনলাম।দেখ, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা।
সায়মন বিরক্ত হয়ে বলল,
— তুমি এতো ভাবছো কেন? ওর মা আর বোন আছে এসব ভাবার জন্য।বুঝলে তো মা বাস্তবতা বড়-ই কঠিন। একটা প্রবাদ আছে মা,
‘সু-সময়ে বন্ধু বটে,অসময়ে হায় হায়!’
রুজিনা ছেলের মতিগতি কিছুই আঁচ করতে পারেন না। উনি চান ঝামেলাহীনভাবে একটা সংসার।সেখানে এতো প্যাচাল অসহ্যকর।রুজিনা চলে যেতে নেয়,তখন সায়মন আবারও বলল,
— বাবা আসেনি মা?
— না আরো দু’দিন থাকবেন জানালেন।
সায়মন বলল,
— বাবা ও পারে মা।কিছুদিন আগেই না বড়চাচার সাথে ঝগড়া হয়েছে। এখন আবার ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে চলে গেছেন।আশ্চর্য!
_______
জিনিয়ার চেঁচামেচি আর ডাকাডাকিতে বিছানা থেকে উঠে বসলো জুলিয়া। ভয়ার্ত কন্ঠে নিচের দিকে তাঁকালো, শেষ রক্ষা হয়নি আজ। জুলিয়া বলল,
— প্লিজ বোন! চুপ কর বাইরে তোর মইমা,আর দুলাভাই আছে। ওরা শুনে ফেলবে?
জিনিয়া কপট রাগ নিয়ে বলল,
— তো? আমি কি করবো? তুই আমার কাপড়ে মুতেছিস? লজ্জা করে না।
— আরে আচ্ছা মুশকিল তো। আমি ইচ্ছে করে তো আর করছি না।হয়ে যাচ্ছে।
জিনিয়া নাক ছিঁটকে বলল,
— হয়ে যাচ্ছে মানে? কতোদিন ধরে হচ্ছে?
কাউকে জানাসনি? দুলাভাইকে বল। ডাক্তারের কাছে যা। তা না করে চাপিয়ে রেখেছিস কেন?
— খবরদার জিনিয়া,ওরা এসব না জানে মতো।
আমার মান-সম্মান থাকবে না।
— তোর আবার মান-সম্মাহ হুঁহ! এখন তোর থেকে ড্রেস দে আমারটা নষ্ট করে ফেলেছিস তুই।ইয়াক!
জুলিয়ার চোখে পানি চলে আসলো জিনিয়ার কথায়। এতোটা অসহায় আগে কখনো হয়নি। জুলিয়া চাপা কন্ঠে বলল,
— এখান থেকে বাড়িতে গিয়ে মাকে বলিা আসতে।আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
— আর ইউ ম্যাড।ডাক্তারের কাছে তোকে নিয়ে গেলে কতো খরচ হবে জানিস? আর দুইদিন পর আমার একটা ট্যুর আছে। সেখানে অনেক খরচ।তোর প্রয়োজনটা তোর জামাইকে দিয়ে মিটমাট কর।আমার বাপ নেই, যে তোর খরচও বহন করবে।পারলে আমাকে হাজার পাঁচেক টাকা দুলাভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে দে।
জুলিয়া বিস্ময়বিমূঢ় চোখে জিনিয়ার দিকে চেয়ে, তার কথাটা হজম করলো। বাপ নেই? কিন্তু প্রতিমাসে সায়মনের থেকে নিয়ে যত পারে তত জিনিয়াকে দিয়ে দিতো।শুধু,ওর শৌখিনতা বেশি বলে।আর আজ?
১৮.
ধোঁয়া উঠা গরম গরম স্যুপ ঠোঁট চোকা করে ফুঁ দিয়ে খাচ্ছে তেহভীন। ঠাণ্ডাচ্ছন্ন পরিবেশে গরম স্যুপ অমৃতের ন্যায় স্বাদ দিচ্ছে যেনো।যেটা তেহভীনের মুখশ্রী দেখে টের পাচ্ছে সিলিভিয়া। সিলিভিয়ার স্বল্প বিচক্ষণ মন তেহভীনকে একটা প্রশ্ন করার জন্য আনচান করতে লাগলো হঠাৎ। অবশেষে নিজেকে থামাতে না পেরে বলল,
— তেহভীন ক্যান আই আস্ক ইউ এ কুয়েশ্চন?
এক চাম স্যুপ মুখে তুলে তেহভীন জবাবে বলল,
— ইয়েস! ইউ ক্যান.
— ‘এন্ড দ্যা হার্ট’ হলিউড মুভিটা দেখেছেন?
সিলিভিয়ার কথায় ঝট করে হাতে চামচটা পড়ে যায় তেহভীনের হাত থেকে। অপর হাত শক্তভাবে মুঠো বেঁধে ফেলে। কিয়দংশ মুহূর্ত স্যুপের বাটিতে চোখ ডুবিয়ে রাখে।তারপর দৃঢ়তার সহে চোখ তুলে সিলিভিয়ার দিকে তাঁকালো। আকস্মিক মুহূর্তে শব্দহীন হাসলো তেহভীন।চামচ পূনরায় হাতে তুলে বলল,
— না দেখা হয়নি। কেন জিজ্ঞেস করছো?
প্রশ্নানু্যায়ে জবাব না পেয়ে আশাহত হলো সিলিভিয়া।তাহলে কি ধারণা ভুল? সিলিভিয়া হালকা হাসলো।এরপর বলল,
— খুব চমৎকার মুভিটা।আই সাজেস্ট ইউ, মুভিটা দেখলে আপনার ভালো লাগবে।
এতক্ষণ সময়ের ব্যবধানে এই প্রথম তেহভীনের দৃষ্টির নড়চড় হয়। সে আশেপাশে কিছু কাপল দের দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিতে লাগলো সন্তপর্ণে। এরপর তেহভীন সরাসরি সিলিভিয়ার চোখের দিকে তাকালো। সিলিভিয়ার চোখে অদৃশ্য আত্মবিশ্বাসের চাপ দেখে তেহভীন নিজেকে ধাতস্ত করলো। হালকা কেশে বলল,
— সিউর প্রিটি লেডি!
তারপরের সময়টা খুব দ্রুত আসলো। রেসট্রন থেকে বেরিয়ে তেহভীন একটা ফাস্টফুডের দোকানে নিয়ে যেতে বললো সিলিভিয়াকে।প্রায় দশহাজার টাকার ফাস্টফুড জাতীয় খাবার ক্রয় করলো। সিলিভিয়া শুধু হা করে চেয়ে থাকলো। বলাড মতো কোন কথা শব্দভাণ্ডার খুঁজে পেলো না। দোকান থেকে সব প্যাকেট নিয়ে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়ালো তারা। চেহারায় বিস্মিতভাব ফুটিয়ে রেখেই সিলিভিয়া বলল,
— এতো এতো ফাস্টফুড? এসব কেন তেহভীন?
তেহভীন সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
— ওয়েল! আজ তুমি আমাকে তোমাদের কান্ট্রির সুন্দর জায়গা গুলো দেখাবে!
সিলিভিয়া মাথা নেড়ে সায় জানালো। তারপর তেহভীন আবারও বলল,
— আমরা সব জায়গা দেখবো-ঘুরবো ঠিক, সাথে এই খাবার গুলো তাদের হাতে তুলে দিবো যারা খুবই কষ্টে খাবারের জন্য পরিশ্রম করে। আমি একটা ভিডিও তে দেখেছিলাম, তোমাদর কান্ট্রিতে মানুষ শ্রম অনুযায়ে পারিশ্রমিক পায় না। এমনকি তারা অভুক্ত থেকে ও নিজেদের কাজ যতার্থ করে যায়।
“দ্যে’ আর পো’য়ার, সো,হুয়াট হ্যাপেন্ড?
দ্যে,এলসো হ্যাভ মাইন্ড’স!!
সিলিভিয়া বাকরূদ্ধ হয়ে তেহভীনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এই ছেলেটাকে সৃষ্টিকর্তার নিশ্চয় অনেক যত্নে বানিয়েছেন।যার দরুণ,তার মধ্যে এতো গুনবলি অবশিষ্ট! এ দেশ তো তার নয়,তারপরও এদেশের জন্য ভাবছে।কাল বাদে পরশু চলেই তো যাবে। তাহলে এসব?
শহরের সু-পরিচিত জায়গা,পার্ক,উদ্যান, অলগলি যতটুক সম্ভব হয় সিলিভিয়া সব তেহভীনকে দেখালো। তেহভীন নিজ হাতে যাকে পেয়েছে, হাসিমুখে খাবার তুলে দিয়েছে।বৃদ্ধ নারী-পুরুষ ,মাঝবয়সি নারী-পুরুষ ,বাচ্চারা সবার হাতে তুলে দিয়ে সে আত্মতুষ্টির হাসি হেসে সিলিভিয়ার দিকে তাকালো। সিলিভিয়া তখন আমোদিত,মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে তেহভীনকে দেখছিলো।সময়টা তখন অপরাহ্ন বেলা। মেঘমেদুরে স্নিগ্ধ গগন পাংশুটে রূপ বহন করছে তখন। তেহভীন আর সিলিভিয়া মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলো। বিদায় প্রহর।তখনি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে লাগলো। বৃষ্টির ছটা দু’জনের শরীর ভিজিয়ে দিতে ব্যস্ত। তেহভীন নিভু নিভু চোখে উপরে চেয়ে বলল,
— সিলভার,আই লাভ দ্যা রেইন ইন ইউর কান্ট্রি।
সিলিভিয়া তেহভীনের কথায় স্মিথহাস্য চোখে তাঁকালো। আজকের মতো দিন হয়তো আর কখনো তার জীবনে আসবে না।তবে তাদের অবস্থান অবশ্যই এক আকাশের নিচে হবে।এতেই সিলিভিয়া তুষ্ট। আর যায় হোক জীবনে সবকিছু পরিপূর্ণ ভাবে পাওয়া হয় না।আর হয় সকল চাওয়া পূর্ণ। তেহভীন নিজের জীবনের একটা বিশেষ অংশের পৃষ্ঠায় স্মৃতি হয়ে থাকবে শুধু।
তেহভীন হাতের ওয়াটারপ্রুফ ঘড়িটার দিকে
চেয়ে বলল,
— সিলভার,আমাকে যেতে হবে।
তোমাকে অনেক বিরক্ত করেছি। কিন্তু আমি
আজ অনেক খুশিও।আমার এই ইচ্ছেটা আজ পূর্ণ হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ দিতে চাই না। ভালো থেকো। গুডবায়।
সিলিভিয়া জবাব দিতে পারলো না।গলার কন্ঠস্বর যেনো বসে গিয়েছে। বুক ধড়পড় করছে ভীষণ।চোখে জ্বালা করছে খুব।এটা হয়তো শেষ।যদিও আজকের দিনে অন্য কিছু চেয়েছিলো সিলিভিয়া।
তেহভীন যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গেলো। পেছন ফিরে চট করে সিলিভিয়ার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
— সিলভার, শ্যাল আই হাগ ইউ এজ এ ফ্রেন্ড।
সিলিভিয়ার বলার জন্য অপেক্ষা করলো না তেহভীন। আলতো ভাবে সিলিভিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।সিলিভিয়ার অজান্তে মাথার ডানপাশের চুলে মৃদুভাবে ঠোঁট বসিয়ে চুমু দিলো। যেটা সিলিভিয়ার অজানা থেকে যায়। এরপরের সময়টা খুবই কঠিন,শ্বাসরুদ্ধকর কাটে।তেহভীন আর পেছন ফিরেনি। যেতে যেতে বলল,
— আই এম হেল্ফল্যাস সিলভার,
আই কান’ট লাভ ইউ।”
(চলবে)
কার কি মন্তব্য? টুপ করে করে ফেলো দেখি।