লাল_ছাতি ৩য়_পর্ব

লাল_ছাতি
৩য়_পর্ব

রিদওয়ান বারান্দায় কথা বলছে। স্বর খাঁদে নামালেও তার রাগান্বিত স্বর বোঝা যাচ্ছে। নূর বারান্দার কাছে যেতেই শুনতে পায়,
“এই বাচ্চা এবোর্ট করার কথা মাথাতেও আনবে না পারমীতা। বাচ্চাটা তোমার একার নয়, তার বাবা বেঁচে আছে। সুতরাং তুমি একা কোনো ডিসেশন নিতে পারো না”

রিদওয়ানের কন্ঠে দৃঢ়তা স্পষ্ট। সে এমনভাবে কথা বলছে যেনো সে খুব ভালো করেই জানে বাচ্চাটির বাবা কে! নূর ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, তার মস্তিষ্ক যেনো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। মাথায় আসছে না কি হচ্ছে? এর মাঝেই রিদওয়ানের কঠিন কন্ঠে বলা কথাটি কানে আসলো,
“যদি তোমার বাচ্চাটি নাই চাই তবে তাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করা লাগবে না, দরকার হলে আমি এবং নূর তাকে পালবো। আমরাই তাকে দত্তক নিবো। তবুও এই বাচ্চা তুমি এবোর্ট করবে না। আমি এ নিয়ে দ্বিতীয় কোনো কথা শুনতে চাইছি না পারমীতা, আমি রাখছি”

রিদওয়ানের কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় নূর। পারমীতার বাচ্চার প্রতি কেনো রিদওয়ানের এতো দরদ? একবারের জন্য ভেবে নেওয়া হোক, বাচ্চাটি রিদওয়ানের সাথে জড়িত নয়; তাহলে তার বাবা কে? কে সে ব্যক্তি যার কথা পারমীতা রিদওয়ানকে বলতে পারছে অথচ নূরকে নয়। যেখানে নূর তার বান্ধবী। সেদিন কতোবার বলেছিলো নূর,
“আমাকে নিশ্চিন্তে বল দোস্ত, আমি তোকে সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করবো”

নূরের মনটা হুট করেই বিষিয়ে উঠলো পারমীতার প্রতি। কেমন বান্ধবী সে, নিজের বান্ধবী এবং তার স্বামীর সুখের সংসারে আগুন লাগাচ্ছে। এতো ঝড় তুলছে। আরোও বেশি বিষিয়ে উঠলো রিদওয়ানের প্রতি। একটা অন্য মানুষের বাচ্চা নিয়ে কিসের আদিক্ষেতা, কিসের এতো ঢং। কেনো তাকে এবং রিদওয়ানকে ওই বাচ্চা দত্তক নিতে হবে। পারমীতা বাচ্চা রাখবে, না রাখবে তার ব্যাপার। এখানে তার এতো উৎসাহ কেনো? সন্দেহের সূক্ষ্ণ রেখাটা এবার গাঢ় হলো, তীক্ষ্ণ রূপ নিলো। বুকটা হাহাকা করে উঠলো। রিদওয়ানের কাছে ঠকছে না তো সে! নাহ, আর ধৈর্য ধরতে পারছে না নূর। আজ এর একটা বিহিত করবে সে। ঠিক তখনই বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসে রিদওয়ান। তার চোয়াল শক্ত, চোখ লাল হয়ে আছে যেনো অনেক কষ্টে রাগ দমিয়ে রেখেছে। নূরকে দেখে ঈষৎ চমকালেও তেমন কোনো কথা বলে না রিদওয়ান। পাশ কাটিয়ে ডাইনিং রুমে চলে যায়। নূর তাকে জেরা করতে চাচ্ছিলো কিন্তু রিদওয়ানের মুখশ্রী এবং চাহনী দেখে প্রশ্নগুলো দমিয়ে রাখলো। কিন্তু আজ রিদওয়ানকে উত্তর দিতেই হবে, উত্তর যে নূরের চাই ই চাই।

রিদওয়ান থমথমে মুখেই খাবারটা শেষ করলো। নাজমা বেগম ছলে বলে দুবার জিজ্ঞেস করেছেন কিন্তু রিদওয়ানের উত্তর ছিলো,
“কিছু না”

খাওয়া শেষে রিদওয়ান বিছানায় শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তার অভ্যাসের মধ্যে আরেকটি অভ্যাস বেশ উদ্ভট, তা হলো বিছানা হতে হবে টানটান। তাই রিদওয়ান ঘুমানোর পুর্বে বিছানা টানটান করে তারপর শোয়। তাই আজ ও সেটাই করছে সে। ঠিক তখন ই নূর শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“পারমীতার বাচ্চার বাবা কে?”

প্রশ্নটা শুনে সরু দৃষ্টিতে তাকালো রিদওয়ান। তার চাহনীতে বিষ্ময়ের ছাপ। যেনো নূরের প্রশ্নটা নিছক বেমানান এবং অহেতুক। নুরের চাহনী স্থির, তার কন্ঠে কোনো জড়তা নেই। সে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিদওয়ানের দিকে। রিদওয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবারো মন দিলো বিছানা গুছাতে। নুর মিনিট বাদে আবারো একই প্রশ্ন করলো,
“রিদওয়ান তোমাকে আমি কিছু করেছি, পারমীতার বাচ্চার বাবা কে?”

এবার রিদওয়ান আর থামলো না, বিছানা ঝাড় দিতে দিতে বললো,
“সময় হলে সব জানতে পারবে, এখন ও সেই সময়টা আসে নি। আর পারমীতা নিজ থেকে তোমাকে না জানাতে চাইলে আমি নিজ থেকে তো তোমাকে জানাতে পারি না। তবে একটা কথা বলবো, একটু ধৈর্য্য ধরো আর আমার উপর বিশ্বাসটা রেখো। আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি না”

রিদওয়ান এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো, কিন্তু একবারো নূরের দিকে তাকালো না। রিদওয়ানের স্পষ্ট বক্তব্যের পর সত্যি কিছুই বলার থাকে না নূরের। কি বলবে সে? যেখানে রিদওয়ান নিজ থেকে বলছে তার উপর বিশ্বাস রাখতে, তাহলে অবিশ্বাসটা করবে কি করে? আবার সন্দেহের যে গাঢ় বীজ মনের আঙ্গিনায় বাড়ছে তাকে কমানোর উপায় ও সে পাচ্ছে না। দ্বিধার মাঝে আরো জড়িয়ে যাচ্ছে নূর। উচাটনে মনটা অস্থির হয়ে গিয়ছে। কেউ ঠিক বলেছিলো,
“সন্দেহ এমন এক স্ফুলিঙ্গ যা নিবৃত্ত হৃদয়কে ব্যাকুল করে তার শান্তিকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়”

তার নিবৃত্ত হৃদয়ে ঝড় তুলছে এই সন্দেহ। সেদিন রিদওয়ান এবং নূর দুজনের কেউ ই ঘুমালো না। একই বিছানায় দুদিক মুখ ফিরে রাত্রিযাপন করেছে তারা। মনের মাঝে হাজারো কথা কিন্তু বলতে পারছে না। এক অদৃশ্য বাঁধায় আটকে আছে দুজন। প্রকৃতির ন্যায় মনেও যখন ঝড় উঠে তখন শান্তি নামক প্রসন্নতা ছাই হয়ে যায়। লন্ডফন্ড করে দেয় অন্তরাত্নাকে। যেমনটা করছে রিদওয়ান এবং নূরকে____________

পরদিন,
সকাল এগারোটা,
অফিসের কাজে মন লাগছে না নূরের। মাথায় কুচিন্তা আসছে, আসবে নাই আ কেনো পরকীয়া ব্যাপারটা এখন এমন ই ডালভাত হয়ে গেছে যে ২০ শতাংশ দম্পতির ছাড়াছাড়ি হচ্ছে। সেদিন ই তো একটা ক্রাইম পেট্রোলের এপিসোড দেখছিলেন নাজমা বেগম। সুখে থাকলে যে মানুষকে ভুতে কিলায়, কথাটা ওই এপিসোডের মূল চরিত্রকে দেখলেই বোঝা যায়। সুখী সংসার ছেড়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হলো। শেষমেশ স্ত্রীকে খুন করতেও সে দুবার ভাবে নি। এসব মানসিক বিকৃতি দেখলে যে কারোর ই বুক কাঁপবে। আর কিছুদিন যাবৎ রিদওয়ানের সাথে পারমীতার যা কান্ডগুলো লক্ষ্ করছে নূর তাতে যে কারোর সন্দেহ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। নূর কাউকে বলতেও পারছে না, কাকে বলবে? পারমীতাকে? রিদওয়ানকে? এদের জন্যই তো মনটা এলোমেলো হয়ে আছে। আর রইলো নাজমা বেগম এবং তার মা শিউলি বেগম। এদের বললে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হবে। অহেতুক তিল থেকে তাল হবে। নিজের ডেস্কে মুখে হাত দিয়ে বসে রইলো নূর। নূরকে অন্যমনস্ক দেখে সিথি দিদি তার পিঠে আলতো করে চাপড় দিলেন। সিথি দিদি তাদের প্রজেক্ট ইনচার্জ। নূরের সাথে বেশ ভালো খাতির ও তার। মহিলা নূর থেকে আট বছরের বড়। কিন্তু নূরকে নিজের বোনের মতো স্নেহ করেন। চাপড় খেয়ে চমকে উঠলো নূর। চিন্তার ঘোর থেকে বের হলো সে। এর মাঝেই সিথি বলে উঠলো,
“বরের চিন্তায় অফিসেও তারা গুনছো নাকি?”
“না…না, কি যে বলেন দিদি?”

আমতা আমতা করে বললো নূর। নূরের জোর পূর্বক হাসি এবং চিন্তাটা চোখ এড়ালো না সিথির। কিন্তু সকলের সামনে হুট করেই কিছু প্রশ্ন করে নূরকে অপ্রস্তুত করে দেওয়াটা ঠিক হবে না। তাই সিথি কিছু জিজ্ঞেস না করে বললো,
“লান্চ টাইমে বাহিরে যাবি?”
“সময় কুলাতে পারবো?”
“আরে কেনো পারবো না, এখানে পাশেই ভালো বিরিয়ানির রেস্টুরেন্ট খুলেছে। আমার বেশ মাটন বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। মানা করিস না। মাসের প্রথম, বেতনের গরমটা যায় নি। তুই তো জানিস মাসের প্রথমে আমি বড়লোক থাকি”

বলেই হেসে দিলো সিথি। সিথির কথা শুনে নূর ও হাসলো। মিহি কন্ঠে বললো,
“বেশ লাঞ্চ এ ফাইনাল”

দুপুরে অফিসের পাশের রেস্টুরেন্টে লান্স করতে যায় সিথি এবং নূর। খাওয়ার মাঝে নানা বিষয় নিয়ে তাদের জম্পেস আড্ডা হয়। এর মাঝেই সিথি সুযোগ বুঝে কথাতা পাড়ে,
“তোর আর রিদওয়ানের মাঝে কি সব ঠিকঠাক?”

সিথির প্রশ্নে বিষয় খেয়ে উঠে নূর। সিথি পানিটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“না বলতে চাইলে সেটা অবশ্যি তোর ব্যাপার। স্বামী স্ত্রীর পার্সোনাল ব্যাপার। আমি একজন তৃতীয় ব্যাক্তি, তাই অহেতুক ইন্টারফেয়ার অনুচিত। কিন্তু আজ তোকে কেমন মনমরা লাগলো, খুব চিন্তিত লাগলো। বিয়ের ছয় মাসে একটা মেয়ের হাসিখুশি থাকার কথা। অফিসেও এতো কাজ নেই যে তুই এতো অন্যমনস্ক থাকবি। শেয়ার করতে চাইলে করতে পারিস, একজন বড় বোনের মতো হেল্প করার ট্রাই করবো।“

সিথির আশ্বস্ত কথায় নূর খানিকটা স্বস্তি পায়। এতোকিছু মনের মাঝে চাপিয়ে রাখতে রাখতে সে সত্যি ই ক্লান্ত। তাই সিথিকে সব খুলে বলে সে। সব শুনে সিথি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীর গলায় বলে,
“এমন নয় তো, তোর সাথে বিয়ের পূর্বে রিদওয়ানের পারমীতার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো? মানে প্রেম জাতীয়। তুই নিজেই বললি পারমীতা প্রেমে কষ্ট পেয়েছে। এমন নয়তো সেই প্রেমিক রিদওয়ান?”
“কি যা তা বলছো সিথি দিদি? অসম্ভব। যদি এমনটাই হতো তবে আমাকে কেনো বিয়ে করলো রিদওয়ান?”
“দেখ আই এম যাস্ট সেয়িং। কারন কিছুদিন পূর্বে এমনটা আমার কাজিনের সাথে হয়েছে। তার হাসবেন্ড এবং তার ফ্রেন্ডের প্রণয় ছিলো বেশ কিছুদিন। কিন্তু বাবা-মায়ের মন রাখতে বিয়ে করলো আমার বোনকে। আর কি ছেলে অনেক চেষ্টা করলো সংসার করতে। কিন্তু মন তো তার প্রেমিকার কাছেই রয়ে গেলো। আমার বোকা বোনটা বুঝেই পায় না অরিন্দম কেনো তাকে ভালোবাসে না। সেই দুমাস হলো সব রহস্য সমাধান ঘলো। আমার কাজিন জানতে পেরে তার ফ্রেন্ডকে ইচ্ছেমতো গাল্লালো। গাল্লাবে না কেনো? জেনে বুঝে নিজের বান্ধবীর কাছে থেকে এতো বড়ো সত্যটা লুকালো বোঝ”

সিথির কথায় বুকে কামড় পড়ে নূরের। সন্দেহের দাগটা আরোও নিবিড় হয়। এর পর কেমন যেনো মিয়ে যায় নূর। গলা থেকে খাবারটাও ভেতরে যায় না তার। খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়ায় তারা। রেসটুরেন্ট থেকে বের হতে নূর থমকে যায়। রেস্টুরেন্টের ঠিক অপজিটে একটা হাসপাতাল রয়েছে। এবং সেই হাসপাতাল থেকেই বের হচ্ছে রিদওয়ান এবং পারমীতা। নুরের চক্ষু চড়াকগাছ। নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলো না সে। ছুটে গেলো রিদওয়ানের কাছে। রিদওয়ান বলেছিলো তার একটা ইম্পোর্টেন্ট মিটিং আছে, এই কি তবে তার মিটিং?

নূর উপস্থিত হলো রিদওয়ানের সামনে। তার চোখ জ্বলছে। নূরকে দেখেও রিদওয়ান শান্ত। নূর ক্রুদ্ধ কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“তোমার মিটিং কি এখানে হচ্ছে রিদওয়ান?”
“নূর শান্ত হও, এটা তো পাবলিক প্লেস”
“নিকুচি করেছে তোমার পাবলিক প্লেস আগে আমার উত্তর চাই, কিসের সম্পর্ক তোমাদের?………

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। লেখার ভূল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিত দেখবেন দয়া করে এবং দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here