লীলাবালি🌺 পর্ব-৭১

0
1098

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৭১
আফনান লারা
.
আজকের পর্বের দৃশ্যটা শুরু হয়েছিলো হাসপাতাল থেকে।
ভেতরে গুনে গুনে তিনজন সার্জন।আর বাহিরে দুটি পরিবার।
একটি মৃদুলদের আর অন্যটি মৃদুলদের পাশের বাসার পরিবার।
প্রায় এক ঘন্টা হলো তারা এখানে এসেছে।
অর্ণবের সারা শরীর ঘেমে গেছে।মৃদুল মুখটা ফ্যাকাসে করে একটা শক্ত ম্যাগাজিন দিয়ে ওকে বাতাস করছিল।এসি চালু করা তার পরেও অর্ণব টেনসনে ঘামছে কেবল।
এই তো সকাল সকাল কত ভাল ছিল কুসুম।কিন্তু হুট করে তার শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাকে নিয়ে সবাই এখানে চলে আসতে বাধ্য হলো।
তার এখনও জ্ঞানটা ফেরেনি।অর্ণবের চেনা ডাক্তার ওকে বলেছেন দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করাতে।এই ব্যাপারে বাবার সাথে আলাপ হবার পর বাবা বললেন টাকার ব্যবস্থা হলে জানাবে।চিন্তার কিছু নেই।দরকার হলে জমি বিক্রি করবে তাও কুসুমের কিছু হতে দেবেননা।
এতসব চিন্তাকে দূরে হটিয়ে কুসুমের ভাবনা তাকে গ্রাস করছে।সকালেই তো কত মিষ্টিভাবে লজ্জা পাচ্ছিল।কি থেকে কি হয়ে গেলো।মৃদুলকে বাতাস করতে মানা করে উঠে দাঁড়িয়ে রুমটার কাছাকাছি গেলো।কুুসুমকে একবার দেখতে ইচ্ছে হয়,কেমন আছে চোখ খুলেছে কিনা সেসব জানতে ইচ্ছে হয়।মৃদুল ওর অবস্থাটা বুঝতে পারছে।কিন্তু তার হাতে করার মত কিছু নেই।ওকে একা থাকতে দেওয়া ঠিক মনে করে সরে আছে।
হঠাৎ এমন কেন হলো তা কেউ বুঝে উঠতে পারেনি।ডাক্তার এসে বললেন জ্ঞান ফিরেছে।কথাটা উনি এমন ভাবে বললেন যেন জ্ঞান ফিরে কোনো ভাল কিছু হয়নি।মুখটা গোমড়া করে চলে গেলেন কথাটা বলেই।অর্ণব দিশেহারা হয়ে ছিল,ডাক্তার যাবার পরপরই ছুটে ওর কাছে চলে এসেছে সে।কুুসুম ওকে দেখেই কান্না করে ফেললো।
অর্ণব ওর মুখে দুহাত দিয়ে ধরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’বোকা মেয়ে!কাঁদছো কেন?আমি সামনে তো তোমার।
আমরা আজই বাসায় ফিরে যাব।তুমি সুস্থ হয়ে যাবে’

কুসুমের এক হাতে আগের মতন ক্যানোলা লাগানো ছিল, অন্য হাতে চোখ মুছে সে বললো,’আমি জানি,আমি বাঁচবোনা’

‘এসব বলতে নেই।কান্না বন্ধ করো।এখনই কান্না বন্ধ করবে তুমি নাহলে ধমক দেবো’

‘ডাক্তার বলেছে আমি আর বাঁচবোনা,আমি শুনেছি।ডাক্তার মিথ্যে কেন বলবেন?’

অর্ণবের চোখে পানি চলে আসলো।বুকের ভেতর আগের মতন সব পুড়ে যাচ্ছে। কুসুমের মাথা থেকে হাত সরিয়ে সে বেরিয়ে আসলো।সোজা ডাক্তারের কাছে এসে জানতে চাইছে কুসুম যা বলেছে তা সত্যি কিনা।ডাক্তার প্রথমে বলতে চাননি।পরে জোরাজুরিতে বললেন,’যদিও দেরি হয়ে গেছে তার পরেও বাহিরের চিকিৎসায় সমস্যার সমাধান মিলতে পারে।’

মিজুয়ানা কুসুমের পাশেই বসেছিলেন।ওর দিকে চেয়ে পান চিবোচ্ছিলেন।চিবোতে চিবোতে বললেন,’তুমি বুঝি তোমার স্বামীর খুব প্রিয়?প্রথম যেদিন বলেছিলে অশিক্ষিত,কম বয়সী হবার পরেও তোমায় এই ছেলে বিয়ে করেছে তখনই বুঝেছি সে তোমায় মন দিয়ে ভালোবাসে।
আহারে!এমন একটা ছেলের সংসারে এই বিপদ আসতে হলো?
দোয়া করি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।জানো? ছেলেটা সকাল থেকে কিছু মুখে তোলেনি।এখন বিকাল হতে চললো।ভয়ে খাওয়ার কথাও বলিনি আমরা কেউ।কারণ তার অবস্থা ছিল অনেক খারাপ।হাজার বার উঁকি দিয়ে দেখেছে তুমি চোখ খুললে কিনা,তোমার ভাল খবর এলো কিনা।তোমার হাতে এই যে এই সিরিঞ্জ লাগানোর সময় তার কি যে দশা হয়েছিল।দূর থেকে দেখে বারবার হাত মুঠো করছিল।তুমি তো অজ্ঞান ছিলে।কিন্তু সে এমন ভাব করছিল যেন সুই তার হাতে ফোটানো হচ্ছে।
ছেলেটা তোমায় বড্ড ভালোবাসে।বলেনি বুঝি??’

কুসুম কাঁপা স্বরে বললো,’আপনি জানলেন কি করে?’

‘ভালবাসার কথা না বললে সেটা প্রকাশ পায় অনেক বেশি।বললে সেটা প্রকাশ হবার ধরণ বদলে যায়।অর্ণবের আজকের অবস্থা দেখে মনে হলো সে এখনও তোমায় বলেনি তার অনুভূতির কথা।কেমন পাগলাটে আচরণ করে বেড়ায় সারাক্ষণ। বলে ফেললে আজ তার আচরণে অন্য কিছু ফলিত হতো।যাই হোক,ছেলে মানুষ তো।তার উপর শিক্ষিত।বুঝে শুনে বলে দেবে একদিন।ধরেই বলা হয়ত সে পছন্দ করেনা।আর বললেও কি!
তোমায় যে পরিমাণ ভালবাসে সে, এটাতে তোমার তো ওর মুখ থেকে কথা না শুনলেও চলবে’

মিজুয়ানা চলে যাবার পর কুসুম দরজার দিকে চেয়ে রইলো।
‘উনি হয়ত জানেন না, এসব আমার তিনি কেন করছেন।
দায়িত্ব হই কিনা!!’
—-
অর্ণব মৃদুলকে ধরে কাঁদছে।তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সব কিছু।এত জলদি কেন হলো এসব।মৃদুল ওকে বোঝানোর যত যুক্তি লাগে সেসব যুক্তি পেশ করবার পরেও হেরে বসে আছে।অর্ণব ভাবছে আজই কুসুমকে হারিয়ে ফেলবে।

‘তুই তো ওরে ভালবাসিস না,দু চোখে দেখতে পারিস না,তবে এখন এত পাগল হয়ে যাচ্ছিস কেন?’

‘বাসিনা তো কি কাঁদা যাবেনা?মা বাবা কেউ আসছেনা।আমি একা আর কত সহ্য করবো?’

‘আসবে।শান্ত হ।তোকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখতে পারছিনা।আয় বোস’

মৃদুল ওকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে।তারপর ওর চোখ মুছে দিয়ে বললো,’বয়স কম ওর।এত জলদি কছু হবেনা দেখিস।ভাল হয়ে যাবে’

‘ভাল হতে টাকার বৃষ্টি ঝরাতে হবে।’
—-
‘আসবো?’

মৃদুলের কণ্ঠস্বর শুনে কুসুম জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকিয়েছে।
মৃদুল মুচকি হেসে টুল টেনে বসলো পাশে।কুসুম বললো,’উনি কোথায়?’

‘ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে করিডোরে।দেখবে?’

‘নাহ’

‘তোমার সাথে একজনের কথা বলিয়ে দেবো।বলবে?’

‘কে?’

‘অপেক্ষা করো।

মৃদুল ফোনে কিছুক্ষণ টিপাটিপি করে ফোনটা কুসুমের দিকে ধরেছে।ওপারে জুথি বসে আছে।টেবিলে ফোন রেখে চেয়ারে বসা।গায়ে লেডিস টি -শার্ট আর চুলগুলোকে খোঁপা করে রাখা।কুসুমকে দেখে হাত নাড়িয়ে সে বললো,’হাই!!কেমন আছো?’

‘ভাল।আপনি মিননয়ি আপু না?’

‘হ্যাঁ।চিনতে পেরেছো?’

‘ভুললাম কবে?’

‘জানো হাসপাতালে যেতে আমার অনেক ভাল লাগে।তোমার ভাল লাগছে?
কেন ভাল লাগে জানো?কারণ আমার পরিবারের সবাই কত কত সেবা করে আমার।আরাম আয়াশে দিন কাটে।শুয়ে থাকা যায় সারাটাদিন।এসবে তোমার অনূভূতি কেমন?’

‘আমার কোনো অনুভূতি নেই’

‘আচ্ছা ওসব ছাড়ো।আমি, তুমি আর মৃদুল ভাইয়া এখন একটা খেলা খেলবো।রাজি?’

‘কি খেলা?’

‘সবাই সবার একটা করে ইচ্ছে বলবে।তারপর সেই ইচ্ছেটা পূরণ না হবার কারণ বলবে।
এরপর বলবে ইচ্ছে আদৌ পূরণ হবার কোন উপায় আছে কিনা।ঠিক আছে?’

‘আচ্ছা’

‘তো আগে মৃদুল ভাইয়া বলেন।আপনাকে দিয়ে শুরু করি’

‘আমার ইচ্ছে পুলিশ হবো।তারপর যাকে ভালবাসি তাকে গুলির ভয় দেখিয়ে বিয়ে করে নেবো।হাহা!!
এই ইচ্ছে পূরণ হবেনা জানি।অনামিকার জন্য হাত কেটেছিলাম অনেকবার।ঐ দাগ দেখলে আমায় পুলিশে নেবেনা।বাদ দিয়ে দিবে ট্রেনিংয়েই।
তো আমার ইচ্ছে অন্য ভাবে পূরণ হতে পারে।যেমন ধরো যাকে ভালবাসি সে যদি নিজে থেকে এসে ধরা দেয় আর কি।’

‘স্টুপিড! আচ্ছা এবার আমি বলি।আমার ইচ্ছে হলো জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত নিজের খেয়াল রাখবো।কটাদিন ধরে নিজের খেয়াল রাখা হয় না।আগে আমি আমাকে অনেক ভালবাসতাম।এখন আর বাসা হয়না।তাই চাই বোধ থাকা অবধি নিজেকে ভালবেসে যাব।এখন আমার ইচ্ছে পূরণ হবে কিনা জানিনা।তবে জীবনসঙ্গী হলে যদি সে আমার খেয়াল রাখে তবে আমার ইচ্ছেটা আমার স্পর্শ ছাড়াই পূরণ হয়ে যাবে ‘

‘আমার ইচ্ছে যিনি আমার জন্য কাঁদছেন তাকে যেন আর কাঁদতে না হয়।
জানিনা এই ইচ্ছে পূরণ হবে কিনা।পূরণ হতো হয়ত যদি আমার অসুখ সেরে যেতো অথবা আমি মরে যেতাম।একদিন কেঁদে আর কাঁদতেন না তিনি তাহলে।ইচ্ছের সমাপ্তি ঘটতো তখন’

‘এসব বলেনা কুুসুম।তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে।তবে পজিটিভলি।তুমি সুস্থ হয়ে যাবে,অর্ণব ভাইয়া ও আর কাঁদবেননা তাহলে।তোমাদের একটা হ্যাপি ফ্যামিলি হবে,ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চায় ভরে উঠবে গোটা পরিবার’

মৃদুল ভেংচি কেটে বললো,’বাচ্চাকাচ্চা ছোটই হয়।যেভাবে বললে যেন বড় ও হয়’

‘বিশ্বাস করেন!আপনার মতন ত্যাড়া মানুষটাকে আমি বিয়ে করবোনা,কোনোদিন ও না।’

‘সারাজীবনের জন্য একদিন আমি তোমার হয়ে যাবো🙈চেয়েও আমাকে পাশ থেকে সরাতে পারবেনা।’

চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://facebook.com/groups/676436250036874/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here