#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৭২
আফনান লারা
.
জুথির সাথে কথা বলে মনের অনেকাংশ জায়গা ভাল হয়ে গিয়েছিল কুসুমের।প্রথম প্রথম মুখে হাসি ফুটে ছিল।মনে মনে ভাবছিল উনি খুব ভাল মানুষ।যদি তার সঙ্গে আমার উনার বিয়ে হতো তবে উনি খুবই সুখী হতেন।
সব কিছু মনে করার পর হঠাৎ আবারও মন খারাপ হয়ে গেলো অর্ণব কাঁদছে ব্যাপারটা মন পড়ে।রুমে কেউ ছিলনা তখন।সে নিজে নিজেই উঠে বসেছে।গায়ে সেই পরিমাণ শক্তি নেই যেটা দিয়ে সে কাউকে জোটগলায় ডাক দেবে।
উপায়ান্তর না পেয়ে হাতের ক্যানোলাটাকে ওলটপালট করে দেখছিল সে।অর্ণব মুখে পানি দিয়ে মুখটা ভাল করে মুছে এদিকেই আসছে।সে কান্নার কথা জানতে দিবেনা কুসুমকে।রুমে ঢুকতেই কুুসুম ওর দিকে তাকালো।
ওকে বসে থাকতে দেখে সে ছুটে এসে ওকে ধরে শোয়াতে শোয়াতে বললো,’তোমায় না বলেছি হুটহাট উঠে পড়বেনা।হাতে এটা থাকলে এরকম উঠা যায়না।’
কুসুমের মলিন মুখ ওকে আর একটা শব্দও বলতে দেয়নি।মাঝপথে যেন তারকাটার আবরণে থামিয়ে দিয়েছে।সেটার যন্ত্রনায় চুপ হয়ে আছে সে।কুসুম ওর হাত ধরে ফেললো।জিজ্ঞেস করলো কাঁদছিল কেন।
‘আমি কেন কাঁদতে যাব?’
‘আপনার চোখ লাল হয়ে আছে,ফুলে গেছে।কান্না না করলে এমনটা হবার কথা না’
‘চোখ অনেক চুলকাচ্ছিল।ওসব বাদ দাও।তোমার অনেক খিধে পেয়েছে তাইনা?আমি ডাক্তারকে বলে এই ঔষুধটা অফ রেখে তোমায় খাওয়াতে পারবো।খাবে কিছু?’
‘নাহ।একটু বসবেন এখানে?নাকি আবার চলে যাবেন?’
কুসুমের আবদারটা ফেলার মতন না বলে সে বসেছে এক পাশে।ওর চোখ কেবল অর্ণবের দিকে।অথচ অর্ণবের সাহস হয়না একবার ওকে দেখার।ইচ্ছে হয় হাত শক্ত করে ধরে রাখতে।
কেন রোগ আসে।কেন এত অসহায়ত্ব সঙ্গতা চায়।
রাগ হয় এসব কিছুর ওপর।রাগে বিছানার চাদর খাঁমছে ধরে রেখেছে অর্ণব।
কুসুম ওর ডান হাতটা ধরে রেখেছিল।অর্ণব এই রুমটায় আসায় এখন তার আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে।ইচ্ছে করে উঠে বাহিরে গিয়ে দম ফেলতে।কেমন যেন লাগছে মনের ভেতর।কুসুমের হাত ধরে রাখা আরও খারাপ লাগার সৃষ্টি করে।বাধ্য হয়ে ওর হাতটা ছাড়িয়ে রুম থেকে চলে আসলো সে।পেছনে তাকালো না আর।
—-
রাতের ১০টা বাজে।হাসপাতালে রুগী,রুগীর পরিবারের আনাগোনা ক্রমে বাড়ছে।ব্যস্ত করিডোর।সাজিয়ে রাখা সারি সারি চেয়ারের কিণারার একটি চেয়ার দখল করে বসে আছে অর্ণব।এই মনে হয় কুসুমের পাশে বসে থাকতে আর এই মনে হয় দূরে চলে আসতে।
‘রোগটা একটা স্বপ্ন কেন হতে পারেনা?কেন সব সত্যি হয়ে আসছে?আমি তো এই সত্যি চাইনি।আমি চাই সব মিথ্যে প্রমাণ হোক।তবে কেন বারবার সব খারাপের চেয়ে গুরুতর হয়ে গেলো।’
নার্স এসে বলেছে কুসুম নাকি ওকে ডাকছে।
কথাটা দুইবার বলে গেছিল।অথচ অর্ণব যাবার সাহস কুলিয়ে পাচ্ছেনা।কুসুমের কাছে গেলে তার বুকে আরও বেশি ব্যাথা হয়।
শুকনো ঠোঁটটাকে জিভ দিয়ে ভিজিয়ে মনের সাথে যুদ্ধে মেতে রুমের দিকে চললো আপাততর জন্যে।
‘মনে সাহস থাকুক,কিংবা না থাকুক।ভবিষ্যত মনে করে বুক পুড়ুক তাও তার কাছে আমার থাকা চাই।সে একা,অনেক একা।তার একটা আমি’র দরকার।’
দরজায় হাত রেখে ধীরে সুস্থে ভেতরে ঢুকলো সে।কুসুম যেন ওর অপেক্ষাতেই চোখ দুটোকে ব্যস্ত রেখেছিল এই যাবত ওকে দেখেই।
ওকে ভেতরে আসতে দেখে এখন চোখ তার ঝলমল করছে।
অর্ণব পাশে এসে বসতেই সে বললো,’আমাকে একবার উঠাবেন?’
‘আচ্ছা’
অর্ণব ওর হাত ধরে বসালো শোয়া থেকে।এরপর একটা মূহুর্ত ও দেরি না করে কুসুম ওকে জড়িয়ে ধরে ফেলেছে। অর্ণব আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলোনা।চোখ ঝাপসা হয়ে অশ্রুর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে তার দুচোখে।
কুসুমকে ওর মত করে ধরে সে কেঁদে ফেললো।
সেসময়ে মৃদুল হাতে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে ঢুকেছিল।ওদের এমন অবস্থায় দেখে আবার পিছিয়ে গেছে বাহিরের দিকে।
এখন খাবার হাতে চেয়ারে গিয়ে বসে অপেক্ষা করছে দশ মিনিট হবার।ততক্ষণ তার কাছে অতি দীর্ঘ, এর কারণে যাকে জ্বালাতন করলে মিনিটটা সেকেন্ডে পরিণত হবে তাকে জ্বালাতে ফোন হাতে কল দিলো সে।
জুথি তখন মোরকোর সাথে বাড়ির সামনের রোডটাতে সাইকেলিং করছিল।ছোটকালে অনেক সময় তারা এভাবে দুজনে সাইকেল চালাতে চালাতে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যেতো।এখন চালানো হলেও আগে কার মতন দুজনে এখন আর দুষ্টুমি করেনা।জুথি মুখে হাসি ফুটিয়ে নিরবে চালাচ্ছে।
মোরকো ওকে বললো দেশে ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড হয়েছিল কিনা।ওর প্রশ্ন শুনে জুথি অবাক হলো প্রথমে।কারণ মোরকো ওকে কখনও পার্সোনাল প্রশ্ন করেনা।সবসময় লেখাপড়া আর স্পোর্টস নিয়ে তার যত আলাপ ছিল।
এখন তার এই প্রশ্নে জুথি জানালো “”না সূচক””।
মোরকো আবার প্রশ্ন করেছে জুথি কি তাহলে আর প্রেমই করবেনা।
জুথি এর উত্তর দেইনি।সবসময় দ্বিতীয় লাইনের উত্তর সে দেয়না।এখনও তাই। মৃদুলের সাথেও এমন করে সে।
মোরকোকে পিছনে পেলে জুথি অনেকদূর চলে এসেছে।ঠিক সেসময়ে মৃদুলের কল দেখে থামলো।মৃদুল ভাইয়ার কি টাকা বেশি হয়ে গেলো?বিদেশী নাম্বারে এতবার কল করলে ফোনের টাকা সব যে কি পরিমাণে কাটে তা কি উনি বোঝেননা?
কল কেটে জুথি নিজে ব্যাক করেছে এবার।মৃদুল বললো,’কাটলে কেন?আমার ফোনে অনেক টাকা আছে।বাপের একমাত্র ছেলে আমি।টাকার কোনো অভাব নাই’
‘অভাব নাই নাকি আছে সেটা তো এক পাঞ্জাবি পরে আমার সাথে ১০বার মিট করাতেই বুঝেছি’
‘আসলে সেটা না,আমার পাঞ্জাবি হাজারটা আছে।কিন্তু ঐ পাঞ্জাবিটা অনেক লাকি।ওটা পরে বের হলে তোমার সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটানো হয়, বুঝলে?’
‘কিসের জন্য ফোন করেছিলেন?’
‘আমার বোরিং লাগছে।কুসুমকে যেমন মন ভাল করে দিয়েছিলে ভিডিও কল করে।আমাকেও দেও না প্লিজজজজ’
‘আপনার অসুখ?’
‘হ্যাঁ।আমার মনে বিশাল বড় অসুখ।এই অসুখে আমার বুকের ভেতর খালি খালি লাগে।মনে হয় কলিজা,আঁত সব কোথায় যেন চলে গেছে।মাঝে মাঝে ঐ কলিজা আঁতের ঠিকানাও মেলে। ঐ ঠিকানা হলো তুমি।ডাক্তার বলেছে ঐ ঠিকানায় এক তলা বাড়ি করে নিতে।তারপর সেটাতে বসবাস করতে।তবেই অসুখ সারবে।তুমি এখন ভিডিও কল করে আমাকে বিল্ডিং তৈরির সিমেন্ট,রডের ব্যবস্থা করে দাও।আমি নিজেই বাড়ি বানিয়ে দেবো।তারপর ওখানে আমরা থাকবো’
‘আপনি না…!!!’
‘কি?’
‘আপনাকে কি বললে সঠিক হবে তাই বুঝতেছিনা আসলে।’
‘জামাই বলো।আমি কিছু মনে করবোনা’
জুথি লাইনটা কেটে দিয়েছে।মৃদুল ঘড়িতে চেয়ে দেখলো দশ মিনিট পেরিয়ে বারো মিনিট হয়ে গেছে।তাই খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে আবারে রুমে ঢুকেছে।অর্ণব কুসুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।ও হয়ত ঘুমে।
মৃদুল ওর পাশে প্যাকেটটা রেখে ফিসফিস করে বললো,’কিছু খেয়ে নে’
‘খিধে নেই’
‘সকালে আমার সাথে পাউরুটি, চা খেয়েছিলি।আর কিছু মুখে দেসনি।তোকে খেতেই হবে।আয় বোস এখানে।দে আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি পিচ্চি ভাবীর মাথায়’
‘তোর যে শক্ত হাত।কুসুমের কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাবে।আচ্ছা,তুই খেয়েছিস?’
মৃদুল টুল একটা টেনে বসে বললো,’আমারটা বাদ দে।ডাক্তার কিছু বলেছিল?’
‘ডাক্তারকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করবোনা।খালি মরার কথা বলে।লাস্ট স্টেজে এসে সবাই মারা যায়?এটা উনাকে বুঝাতেই পারছিনা।ভয় দেখায় খালি’
অর্ণবের কথা শুনে মনে হলো আধাপাগল হয়ে গেছে।মৃদুল কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলো।এই কি সেই অর্ণব?
আর এই সেই কুসুম?সেই ছোট্ট মেয়েটা।যাকে অর্ণব পছন্দ করত না।যাকে বিয়ে করার ভয়ে তিনটা বছর বাড়ি ছাড়া ছিল।আর আজ তার জন্য অর্ণবের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
অর্ণবের মাথায় এবার মৃদুল হাত বুলিয়ে বললো,’তোর অবস্থা বুঝতে পারছি।কিছু খেয়ে নে।কুসুমের খাওয়া আরও দেরিতে হবে।অন্তত ওর খেয়াল রাখতে তোকে শক্ত থাকতে হবে।
ওরে কোলে নিতে দিবি আমায়?দিবি না তো?তাহলে তুই এখন খাবি।তোর বউকে কোলে নিতে হলেও অন্তত গায়ে শক্তি আন।বুঝলি?’
চলবে♥
(কালকের পর্ব বড় করে দেবো।জার্নি করে অসুস্থ হয়ে গেছি🤧)