#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮৪
আফনান লারা
.
পাসপোর্ট রেডি হয়ে আসতে কত দিন যে লেগে যাবে।কিন্তু কুসুমের হাবভাবে মনে হয় সে মোটামুটি সুস্থ।
এটা অবশ্য বাকি সকলের ধারণা।অর্ণব তো নিজের অবুঝ মনকে শান্ত করেছে কেবল এই ভুল ধারণটাকে আঁকড়ে।
আয়নার সামনে কুসুম সকালবেলায় যখন চুল আঁচড়াচ্ছিল তখন গাছের শুকনো পাতার মতন সব ঝরে পড়ছিল।মনে হয় মাথায় আজ আর চুল থাকবেনা,তাও জেদ করে সে জট ছাড়া অবধি আঁচড়ে গেলো।এখন এমন হাল হয়েছে যে মাথায় মুঠো করে ধরার মতন চুল আর নেই।
মেঝেতে পড়ে থাকা সুন্দর,ঝকঝকে কোঁকড়া চুলগুলোর দিকে সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল।ছোট থেকে কত মায়া তার এই চুলের প্রতি,জীবনের একটা সময়ে এসে নিজের সবচাইতে দামি বস্তু,মানুষকে হারাতে হয়।হারাতে দিতে বাধ্য হতে হয়।
এই চুলগুলোর সাথে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে,সব সিনেমার পর্দার মতন চোখের সামনে ভাসছে।
নিচে বসে চুলগুলোকে সে তুলে নিলো।নিজের গয়না রাখার কৌটোটা খুঁজে সেটাতে পুরে রেখে দিয়েছে সব।বাহিরের রুম থেকে সবার হাসির আওয়াজ শোনা যায়।কুসুম একটু সুস্থ হলেই পরিবারের সবাই মেতে ওঠে আনন্দে।কে জানে এই রোগ কত শক্তিশালী!
কুসুম জানে।তার দেহের পরিবর্তন সে দেখে।সকাল থেকে হাতে গোনা তিনবার বমি করা হয়েছে।কেউ দেখেনি।কুসুম জানে।তার মাথার চুল সব ঝরে গেছে কেউ হয়ত এখন পর্যন্ত জানেনি।কিন্তু কুসুম জানে।
মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে একটা খাতা নিলো হাতে।আজ তার পরীক্ষা। অর্ণবের শেখানো অক্ষরগুলোকে বাক্যে রুপান্তরিত করবে সে।এরপর বাক্যগুলোকে সাজিয়ে একটা চিঠি লিখবে,অর্ণবের কাছে।
এখন তো বেশি আপন বলতে ঐ মানুষটাই আছে।জীবনটাও তো বেইমানি করলো।কে জানে আর কত সময় আছে হাতে।
‘থাকি আর না থাকি তাঁর জন্য কিছু লেখা উচিত।আমার অনুপস্থিতিতে তার পাশে থাকবে এই চিঠি।’
—–
অর্ণব সাগরের সাথে বাজারে গেছে।ভাল কিছু কেনাকাটা করবে।দুপুরের খাবার জমজমাট হওয়ার কথা।মৃদুলদের আজ দাওয়াত করেছে মা।তাই সাগরের সাথে তাকে যেতেই হতো,অবশ্য যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না তার।
ভাইয়ার জোরাজুরিতে বাহিরে পা ফেলতেই হলো।এদিকে বাজারে সে এসেছে কিন্তু মনের সব চিন্তাভাবনা রেখে এসেছে কুসুম যে রুমে থাকে সে রুমে।
তাজা মাছ,তাজা তরকারি ভর্তি ব্যাগ নিয়ে যখন সে ফিরছিল তখন সে দেখতে পেলো একটা দৃশ্য।একটি দোকানের দৃশ্য।
ভাইয়ার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে থেমে দেখতে লাগলো সেই দৃশ্যখানা।
—
চিঠি লিখতে অনেক কষ্ট হয়েছে কুসুমের।নিজের কাঁচা হাতের লেখায় সব কিছু লেখা সম্ভব হচ্ছিলো না বলে কলিকে একবার ডেকেছিল।পুরো চিঠিতে কি কি লেখা আছে তা কলি জানেনা।কারণ কেবল শেষের দিকেই ওকে ডেকেছিল কুসুম।শুরুর দিকের কিছুই তাকে পড়তে দেয়নি সে।হাত দিয়ে চেপে ঢেকে রেখেছিল।
চিঠিটাকে তার উপর্যুক্ত জায়গায় রেখে বারান্দায় বসে পা দোলাচ্ছে সে এখন।
আচমকা চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেলো।পেছন থেকে কেউ একজন কাপড়ের টুকরো দিয়ে ওর চোখজোড়াকে বন্দী করে দিয়েছে।হাতের স্পর্শ বলে দিলো এটা অর্ণব।তাই বেশি হাতাহাতি করেনি সে।চুপ করে রইলো।
অর্ণব কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’একটা জিনিস দেবো,চাইতে বলেছিলাম উত্তরে বলেছিলে কবরের কথা।আর তাই নিজ থেকেই নিয়ে আসলাম উপহার’
‘কই দেখি’
‘উহু।অপেক্ষার ফল মিষ্টি’
কথাটা বলে অর্ণব ওর হাত ধরে দাঁড় করালো।টেনে নিয়ে গেলো রুমের দিকে।কুসুমের হাত নিয়ে একটা জায়গায় রাখলো,ওকে আন্দাজ করতে বলতে বললো এটা কি।
সে দুহাত দিয়ে ধরেও কিছু আন্দাজ করতে পারেনি শেষে অর্ণব ওর চোখের বাঁধনটি খুলেই দিলো।
চোখ ডলে কুসুম চেয়ে দেখলো তার সামনে একটা দোলনা। পাটের দড়ি দিয়ে বানানো।দোলানটা লাগানো হয়েছে ছাদের সাথে।সেখানে বাঁধা রড ছিল আগে থেকেই।
কুসুমের বিশ্বাস হচ্ছিলো না এগুলো।অর্ণব এত অল্প সময়ে এসব কি করে করলো,পাশেই সে ছিল অথচ কিছুই টের পেলোনা!
অর্ণব হাত ভাঁজ করে বললো,’আমি আন্টির থেকে শুনেছি,তোমার নাকি দোলনায় দোলার অনেক শখ।তোমাদের বাড়ির পাশের বটগাছটার কাছে গিয়ে নাকি দোলনা বানানোর চেষ্টায় ঘন্টার পর ঘন্টা নষ্ট করতে।তাই তোমার এই ইচ্ছেটা আমি জানা মূহুর্তেই পূরণ করে দিলাম’
কথাটা বলে সে ওকে ধরে দোলনায় বসিয়ে দিয়ে ঘুরিয়ে দিলো।কুসুম হাসছে মন খুলে।এটা সত্যি যে দোলনাতে দোলা তার অনেক ইচ্ছে ছিল।চেয়েও সম্ভব হচ্ছিলো না।দোলনা বানাতে দুটো গাছ কাছাকাছি হতে হয়।কিন্তু তাদের বাড়ির আশেপাশের সব গাছ একটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে দূরে।
একটাই উপায় ছিল সেটা হলো বটগাছের মোটা ঢাল।কিন্তু সেটা অনেক উঁচুতে থাকায় ওখানেও দোলনা বানানো হয়ে উঠলোনা তার।আর আজ ইচ্ছেটা হুট করে পূর্ণতা পেলো।
কুসুমের হাসি দেখে অর্ণবের খুব ভাল লাগলো।কাজটা করে স্বার্থকতা পেয়েছে এর চেয়ে বেশি আর পাওনা নেই।
কলি দূর থেকে দোলনা দেখে ছুটে এসে বললো সেও দুলবে।কুসুম তাই উঠে ওকে বসতে দিলো।
—-
জুথিদের বাসার সামনে ব্যাগপত্র সব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর আম্মু আর নানু।জুথির অপেক্ষা করছেন।বারান্দাতে মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ফরহাদ।চোখ বন্ধ করে সকালের হাওয়া নিচ্ছিল।সিএনজির আওয়াজ শুনতে পেয়ে বাম চোখ খুলে তাকালো নিচে।
নিচে নিজের মা আর নানুকে দেখে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি।আবারও চোখ বুজে ধ্যানে মগ্ন হলো।
জুথির আম্মু ওর নানুকে বললেন ফেসবুকে আপাতত কোনো পোস্ট না করতে।জুথি যেহেতু এটা পছন্দ করেনা তাই এটা বন্ধই থাকুক।
মায়ের গলা শুনে এবার ফরহাদ নিশ্চিত হলো নিচে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা এই মহিলা তার নিজের মা।
মুখের ব্রাশ ফেলে এক ছুট লাগালো দরজার দিকো।বাবা রান্নাঘরে পাউরুটিতে জেলি লাগাচ্ছিলেন।ওকে এমন ছুটতে দেখে অবাক হলেন না।কারণ আইস্ক্রিমের ভ্রাম্যমাণ দোকান দেখলে সে এমন ছোটে।এটা তার জানা আছে।
ফরহাদ দরজা খুলে ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছে।মা তো আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু দিলেন ওর সারা মুখে।এদিকে নানু ও জড়িয়ে ধরেছেন ওকে।
তবে কেউ কোনো আওয়াজ করেনি বলে করিমের কানে কথা যায়নি এখনও।জুথি ও এসে পড়েছে।সিএনজি থেকে নেমে ফরহাদকে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো সেদিকে।তার পিছু পিছু মিরাজ ও আসছে।
জুথিকে দেখে মা ভেতরের দিকে গেলেন।ওর বাবা দরজার কাছে এসে ফরহাদকে ডাকতে যেয়ে দেখলেন নিজের স্ত্রীকে।প্রথমে তিনিও সারপ্রাইজড্ হয়ে গেছিলেন,পরে সব সত্য বুঝতে পেরে আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়লেন।
হট্টগোলের মাঝে জুথি আর নানু,মিরাজ বাসায় ঢুকেছে।জুথি ঘাঁড়ে হাত রেখে বারবার চাপছিল।তার ঘাঁড় প্রচণ্ড ব্যাথা করছে।চাপতে চাপতে নিজের রুমে এসে দরজাটা লাগাতে গিয়ে দেখলো মিরাজ ও ঢুকে পড়েছে।এবং ওর আগেই সে ছিটকিনি লাগিয়েও ফেলেছে।
‘আশ্চর্য! মিরাজ ভাইয়া এটা কোন ধরনের ব্যবহার?দরজা লাগালেন কেন?সরুন!আমি কিন্তু বাবাকে ডাক দিবো,বাবা!!’
জুথি আর কিছু বলতে পারেনি,সামনের মানুষটা ওর মুখ চেপে ধরে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ধরেছে ওকে।
চোখ দিয়ে জুথি ওনাকে গিলে খাচ্ছে এখন।তাকে এক হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে মাথার কালো ক্যাপটা খুললো মিরাজ নামের ছেলেটা।চোখ দেখে জুথির নড়াচড়া বন্ধ হয়েছে।
এটা তো মৃদুল!!!
মৃদুল তার গালের নকল দাঁড়িটাও খুলে ফেলেছে।জুথি ওকে চিনতে পেরে চোখ বড় করে শুধু তাকিয়ে দেখছে
‘কি?চিল্লাও।ডাকো তোমার বাবাকে।কেমন ঝটকা দিলাম?আমাকে না জানিয়ে দেশে ফিরার সাহস হলো কি করে তোমার সেটাই ভাবতেছি।আমি মরিয়া হয়ে ছিলাম একটিবার তাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য।আর তিনি কোনো রেস্পন্স তো করেইনি উল্টো দেশে ফিরবে বলে আমাকে জানানোর সব ওয়ে বন্ধ রেখেছে।কি ভাবো নিজেকে?তুমি একাই চালাক?
আমিও যে চালাক তার প্রমাণ দিলাম।আর প্রমাণ লাগবে?? কতটুকু ভালবাসি সেটার???’
মৃদুল ওর মুখ থেকে হাত সরালো এবার।জুথি ঘাঁড়ে হাত দিয়ে সরতে যেতেই ও হাত দেয়ালে রেখে বললো,’কথা বলতে বলেছি।সরে যেতে বলিনি’
‘এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে রাখলে সবাই সন্দেহ করবে।কি চাইছেন টা কি আপনি?’
‘তোমাকে চাই’
‘পাবেন না।আন্সার পেয়েছেন?এবার যান’
‘তোমার “”না”” তে আমি হাজারটা সম্মতি দেখি।বলো কেন!!কেন এমন হয়?’
‘আপনি যাবেন নাকি বাবাকে ডাকবো?’
মৃদুল এবার বাকি হাতটাও দেয়ালে রাখলো তারপর মুখটা একটু এগিয়ে বললো,’কতটাদিন পর এই পারফিউমের গন্ধ পেলাম।প্রাণভরে নিতে তো দিবা!!তুমি বাসোনা বুঝতেছি,আমি তো বাসি!আমাকে আমার অধিকার টা তো নিয়ে নিতে দিবা।সেটাতেও কিপটামি করো।টাকা যাচ্ছে তোমার?কি যাচ্ছে হুম?বলো!’
‘আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড?নাকি হাসবেন্ড?দু হাত দুপাশে রেখে এমন কাছে এসে কি বোঝাতে চাইছেন?’
‘আচ্ছা তুমি বলে দাও এমন একটা মোমেন্টে আমি ঠিক কি বোঝাতে চাইতেছি?
বলো!!’বলো না!’
জুথি দেয়ালের সাথে লেগে গেছে।আস্তে করে বললো,’আর একটু কাছে আসলে আমার ড্রেসে লেগে থাকা সেফটিপিন ঢুকিয়ে দিব আপনার বুকে।চিনেননা আমাকে’
‘ দাও!তোমার আঘাত পেলে আমার রোমান্টিকতা আরও বেড়ে যাবে’
চলবে♥