শরতের বৃষ্টি পর্ব-১৭

0
2587

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–১৭

প্রিয় মানুষকে দেখার অপেক্ষায় কে না থাকে? দু’চোখ ভরে ভালোবাসার মানুষকে দেখার তৃষ্ণা কখনও শেষ হয় না। এটা এমন একটা ইচ্ছা যা প্রতিটা মানুষের মনেই থাকে। যে তার প্রিয় মানুষটাকে এক পলক দেখার জন্য অপেক্ষা করে না, তার মনে কখনই ওই মানুষটার জন্য ভালোবাসা থাকেনা। অর্নবের চোখ সেই প্রথম থেকেই আনিকাকে খুজে যাচ্ছে কিন্তু পাচ্ছেনা। ওর চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে কিন্তু তবুও ওর চোখ আশা নিয়ে খুঁজে যাচ্ছে। কলেজের গেটের কাছে বসে আশিক আর রনির সাথে আড্ডা দিচ্ছে অর্নব আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সাজ্জাদ আসার পরেই কোথায় যেনো উধাও হয়ে গিয়েছে। ওরা তিন জনে বসে হাসি ঠাট্টা করছে। হঠাৎ করে সামনে তাকাতেই অর্নব থমকে গেলো। ওর হাসি স্থিরতায় বদলে গেলো। ওর হৃদপিণ্ড জোরে জোরে বিট করতে লাগলো। আনিকা সাদিয়ার সাথে হাসি মুখে কথা বলতে বলতে ওদের দিকে আসছে। শাড়িতে আনিকাকে এই প্রথম দেখেছে। লাল শাড়িতে ওকে অপ্সরার মতো লাগছে। আনিকা হাত নাড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। অর্নবের মনে হচ্ছে ওর হাসিতে যেনো আকাশ বাতাস হাসছে। ও মুগ্ধ হয়ে আঁখির দিকে তাকিয়ে আছে। আনিকা ওদের কাছে এসে বললো।

“ভাইয়া! আপনারা কি আঁখি কে দেখেছেন?”

আনিকার কথা শুনে অর্নবের ধ্যান ভাঙলো৷ ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ও কখন ওদের কাছে চলে এসেছে বুঝতেই পারেনি। পাশে তাকাতেই দেখলো আনিকা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে তাকাতে দেখেই আনিকা চোখ ফিরিয়ে নিলো। অর্নব কাছ থেকে আরও মুগ্ধ হয়ে আনিকাকে দেখছে। আনিকারখুব লজ্জা লাগছে। ও বুঝেনা না করার পড়েও কেনো এই ছেলে ওর পিছনে পড়ে আছে। আনিকা অস্বস্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। কিন্তু তাতে অর্নবের কিচুই যায় আসে না। কে জানে কবে সারাদিন বৈধ ভাবে দেখার সার্টিফিকেট পাবে ও। অর্নবের দিকে তাকিয়ে রনি আর আশিক দুষ্ট হাসি দিচ্ছে। এতে আনিকা আরও অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। সাদিয়া ওর বিষয় বুঝতে পেরে সবার দিকে তাকিয়ে বললো।

“ভাইয়া কে আপনাদের সাথে দেখছি না কোনো? কোথায় গেছে? আবার কোন জায়গায় ঝামেলা পাকাতে গেছ? নাকি এখনও আসেই নি?”

সাদিয়ার কতা শুনে আশিক বললো।

“তোমার বাবাকে ইনভাইট করা হয়েছে। সে আসেনি তাই ও নিজেই সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে গেছে।”

“ওহ! আঁখি আপুকে দেখছেন ভিতরে যেতে?”

আশিকের কথার পৃষ্ঠাে কতাটা বললো সাদিয়া। রনি ওদের দিকে তাকিয়ে বললো।

“আঁখি একটু আগেই এখানে ছিলো। ও হয়তো ভিতরে গিয়েছে। তবে তোমরা এসে ভালোই এসে ভালোই করেছো। একজনকে বাঁচিয়ে দিলে।”

কথাটা বলে রনি আড় চোখে অর্নবের দিকে তাকালো। অর্নব রাগি চোখে ওর দিকে তাকালো। আনিকা আর সাদিয়া অপেক্ষা না করে প্রস্থান করলো। ওরা সামনে আগাতেই অর্নব রনিকে আচ্ছা করে ধোলাই দিলো। যেতে যেতে পিছন থেকে ওদের মারামারি শুনে হেসে ফেললো আনিকা আর সাদিয়া।

————————-

সাজ্জাদ আঁখির কানের কাছে কথাটা বলেই সামনে চলে গেলো। আঁখি থমকে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কি হলো তা এখনও ওর মস্তিষ্ক বুঝতে পারলো না। বাসায় থাকতেই খেয়াল করেছে ওর ব্লাউজের পিছনের অংশ অনেকটা খালি। হিজাব পড়বে ভেবেও পড়লোনা। তাহলে কেউ বাজে দৃষ্টিতে তাকাতো না। বাজে ছেলেরা ওর দিকে বাজে ভাবে তাকাচ্ছিল। কিন্তু সাজ্জাদ ওকে এভাবে সেইফ করছে কেনো? আঁখি এর কারন বুঝতে পারলো। কয়েক বার চোখের পলক ফেলে সামনে তাকালো। দেখলো সাজ্জাদ বড় বড় পা ফেলে স্টেজের দিকে যাচ্ছে। আজ আসার সময়েও সাজ্জাদ নিরবের থেকে ওকে সড়িয়ে দিয়েছিলো কেনো করলো এমন? তবে যা করেছে তাতে ওর ভালোই হয়েছে। কিন্তু কোনো শত্রুকে ও ককনও উপকার করতে দেখেনি আজ প্রথম দেখছে। আঁখি সামনে তাকিয়ে একমনে এটা ওটা ভেবে চলেছে।

“কিরে এখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”

কারো কন্ঠস্বর পেয়ে আঁখি ভাবনা থেকে বের হলো। সজাগ দৃষ্টিতে পাশে তাকিয়ে দেখলো আনিকা আর সাদিয়া। ও আনিকার কথা শুনে ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত করে ওর দিকে তাকালো। ওর মন চাইলো আনিকাকে কিছু মহাবানী শুনিয়ে দিতে। আঁখি স্বযত্নে মুখ থেকে কথা বের করতে উদ্যত হলো। কিন্তু সাদিয়া ওকে বাধা দিলো। ও কিছু বলার আগেই সাদিয়া হাসি মাখা মুখ নিয়ে আঁখির দিকে তাকিয়ে বললো।

“ওয়াও আপু! তোমাকে দারুন লাগছে। কি যে সুন্দর লাগছে আপু বলতে পারবো না। আমি তো পুরো ফিদা হয়ে গেছি।”

আঁখি সাদিয়ার কথা শুনে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। আজ আখির মনে হচ্ছে ও লজ্জায় মরে যাবে। সত্যি কি ওকে এত সুন্দর লাগছে? আঁখি মাখা হাসি দিয়ে মাথা নুইয়ে ফেললো। আনিকা আঁখির দিকে তাকিয়ে মুখ কালো বললো।

“দুজনে একেই শাড়ি পড়েছি। কিন্তু দেখ তোকে কত বেশি সুন্দর লাগছে আর আমাকে দেখ ভিখারির মতো লাগছে।”

আঁখি আনিকার কথা শুনে রেগে ওর দিকে তাকালো। ওর গালে ছোট্ট করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো।

“এই বেয়াদ্দব মেয়ে বেশি ঢং করিছ না তো! তোকে সুন্দর লাগছে তা শোনার জন্য এমন করেছিস তো? তোকে আমার থেকেও অনেক সুন্দর লাগছে। তাইনা বলো সাদিয়া?”

সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কথাটা বললো সাদিয়া। সাদিয়া ভীষণ রকম হেসে বললো।

“আমি তো প্রথম দেখেই বলছি আপুকে অনেক সুন্দর লাগছে। কিন্তু আপু মানছেই না।”

আঁখি সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আনিকা ওদের দিকে তাকিয়ে বললো।

“হইছে! দূজনে মিলে আমাকে আর পক দিতে হবে না। আমি জানি আমায় কত সুন্দর লাগছে। হুহ! চল অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।”

কথাটা বলেই আনিকা মুখ বাকিয়ে সামনে চললো। আঁখি আর সাদিয়া দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসলো। অগত্যা কথা না বলে দুজনেই আনিকাকে অনুসরন করলো।

————————–

অনুষ্ঠান কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হয়েছে। সাজ্জাদ ওর বাবার পক্ষ থেকে এসেছে। তাই সামনের সারিতেই বসেছে। ওর পিছনের সারিতেি অর্নব রনি আর আশিক বসেছে। ওখানে বসেও চার জনে দুষ্টামী করছে। রনি শুধু এদিক ওদিক সুন্দরী মেয়ে খুঁজে যাচ্ছে। মেয়ে পেলেই জুটিয়ে প্রেম করবে সেই আশায়। সকল স্টুডেন্ট অনুষ্ঠানে নিরব হয়ে বসেছে। সাজ্জাদ শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে ও জানেনা কি খুঁজছে তবুও বারবার ওর চোখ এদিক ওদিক চলে যচ্ছে। কোরআন তেলোওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। এরপরেই উপস্থাপক সাজ্জাদের নাম ঘোষনা করলেন। ওর নাম গোষনা করতেই সবাই চিল্লিয়ে উঠলো। হাতি তালি দিয়ে জোরে জোরে ওর নাম ধরে চেচাতে লাগলো। সাজ্জাদ ঠোঁট বাকিয়ে হেসে নিজের জ্যাকেটটা ঠিক করে উঠে দাড়ালো। ভাব নিয়ে হেটে স্টেজে উঠলো। সাজ্জাদ স্টেজে উঠেই হাত দিয়ে চুলটা ঠিক করলো সবাই জোরে চিল্লিয়ে উঠলো। আঁখি বিরক্ত নিয়ে তাকালো। ও বুঝেনা ওরা সবাই সাজ্জাদকে নিয়ে এত লাফায় কেনো? ওকি কোনো নামকরা গায়ক নাকি? আঁখি মুখ বাকিয়ে বসে রইলো। সাজ্জাদ মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে হাত উচিয়ে মুচকি হেসে বললো।

“আমি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রোদ্ধা জানাচ্ছি। সালাম করছি আমার স্যার ও সুনামধন্য ব্যক্তিবর্গদের। তোমাদের সবাইকে জানাচ্ছি শুভকামনা।”

সবাই ওর কথা শুনে জোরে হাততালি দিলো। সাজ্জাদ মাইক্রোফেন হাতে নিয়ে গাইতে লাগলো।

“হো হো হো ও.. হো হো হো…
জ্বলে উঠো বাংলাদেশ, গর্জে উঠো বাংলাদেশ।
স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ব জয়ে, যাও দূরে, এগিয়ে যাও!
জ্বলে উঠো বাংলাদেশ, গর্জে উঠো বাংলাদেশ।
কোটি জনের আশা পূরণ করে দাও!
লাল সবুজের বিজয় নিশান, হাতে হাতে ছড়িয়ে দাও!
লাল সবুজের বিজয় নিশান, হাতে হাতে ছড়িয়ে দাও!
(পুরোটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন)

সাজ্জাদের গান শেষ হতেই সবাই জোরে হাততালি দিলো। কেউ কেউ শিষ বাজাচ্ছে আবার কেউ ওর নাম ধরে জোরে চিল্লাচ্ছে। ওর গান শুনে সবাই মুগ্ধ হলো। আকি বুঝতেি পারেনি ও এত ভালো গাইবে৷ সবসময় আজে বাজে গান গায়। আঁখি ভেবেছিলো সাজ্জাদ আজও আলতু ফালতু গান গাইবে। ওকে ওসব গান ছাড়া মান সম্মত গান গাইতে শুনেনি আঁখি। তবুও সাজ্জাদের একটু হলেও বুদ্ধি আছে। আজ ওইরকম গান গায়নি৷ দেশাত্মবোধক গানেই গেয়েছে। সাজ্জাদ গান গেয়ে সবাইকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে মুচকি হেসে নেমে গেলো। ও ওর আসনে আসতেই রনি বললো।

” মামা! ফাটিয়ে দিয়েছিস!”

সাজ্জাদ কিছুই বললো না। চেয়ারে বসে সামনে তাকিয়ে নিশ্চুপ হাসি দিলো। ওর হাসির স্টাইলটায়েই আলাদা। অন্যরকম ভাবে ঠোঁট আর ভ্রু বাকিয়ে হাসে। সাজ্জাদের গান শেষ হতে স্যারেরা একে একে মূল্যবান বক্তব্য দিলেন। প্রধান অতিথির বিশেষ বক্তব্যের মাধ্যমে বক্তব্যের পর্ব শেষ হলো। সবাই ২১ফেব্রুয়ারী সম্পর্কে বক্তব্য দিলো৷ অনেক অজানা বিষয় সবার জানা হলো। এবার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান শুরু হলো। প্রতিযোগিতা শুরুর প্রথমে গানের প্রতিযোগিতা শুরু হলো। প্রতিযোগিতা শুরু হতেই আঁখি ড্রেস চেঞ্জ করতে চলে গেলো। আতিককে দিয়ে ড্রেসটা এখানে আনিয়েছে ও। গানের প্রতিযোগিতা শেষ হতেই নাচের প্রতিযোগিতা শেষ হলো। সাজ্জাদ এদিক ওদিক তাকিয়ে আঁখিকে খুঁজছে। ওই সময়ের পর একবারও দেখেনি কোথায় গেছে কে জানে৷ পরক্ষনেই ও নিজেকে ধিক্কার দিলো। ও নিজের শত্রুকে কেনো খুঁজছে? সাজ্জাদ নিজেকেই চিনতে পারছেনা। ও এসব মাথা থেকে ফেলে চুপ করে বসে রইলো। হঠাৎ করেই আঁখির নাম এনাউন্স হলো। সাজ্জাদের চোখ ওর অজান্তেই স্টেজে চলে গেলো। প্রথমেই আঁখির পিছন দিক দেখা গেলো। আঁখি গোলাপি একটা লেহেঙ্গা পড়েছে। কোমড় পর্যন্ত চুলগুলো পুরো পিঠ জুড়ে আছে। সাজ্জাদ এক দৃষ্টিতে স্টেজের দিকেই তাকিয়ে আছে। আঁখি নাচতে নাচতে সামনে তাকালো। সামনে তাকাতেই সাজ্জাদের দিকে ওর চোখ পড়লো। দেখলো সাজ্জাদকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আঁখি ওসবে খেয়াল না দিয়ে মন দিয়ে নাচতে লাগলো। সাউন্ড বক্সে Piya ji kitna jor lale aaj to nachu gi jarur এই গানটি চলছে। আঁখি খুব সুন্দর করে কোমর দুলিয়ে এই গানে নাচছে। নাচের সাথে ওর মুখ আর চোখের ভঙ্গিও অমায়িক। ওর নাচ দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলো। সবার হাতের তালির শব্দে সাজ্জাদের ধ্যান ভাঙলো। এত তাড়াতাড়ি নাচ কিভাবে শেষ হলো ও বুঝতেই পারলোনা। ও আমতা আমতা করে আশে পাশে তাকালো। দেখলো কেউ ওকে দেখছে কিনা? রনি ওর পিঠে থাপ্পড় দিয়ে বললো।

“শালা হারামী! সবসময় তুই শুধু শুধু মেয়েটার নামে বদনাম করোছ। বলোছ ও নাকি নাচ পারেনা, শুধু লাফায়। আর লাফিয়ে তোর ঘুম ভাঙে। আজ দেখলি কি নাচলো? পুরো ফিদা হয়ে গেছি। আমি শিউর এই অনুষ্ঠানের সব ছেলেরাই ফিদা হয়েছে৷ চোখের ভেলকি দেখেছিস তুই? আমি শিউর নাচে ও অনেক প্রাইজ পেয়েছে।”

রনির কথার সাথে আশিক আর অর্নবও তাল মিলালো। সাজ্জাদ রেগে জায়গা ছেড়ে চলে গেলো। ওরা সবাই হা করে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদ এত রেগে গেলো কেনো কিছুই বুঝলো না।

ইনশাআল্লাহ চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here