শরতের বৃষ্টি পর্ব-৩

0
3232

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩

সাজ্জাদের বাবার কাছে বিচার দিয়ে নাচতে নাচতে তিনতলায় উঠছে আঁখি। আজ তো ওর দারুন মজার দিন। ভাগ্যটা এত ভালো যে আজ ওর বাবাকে পেয়ে গেছে। সাজ্জাদের মা তো ছেলেকে কিছুই বলে না। আঁখি একপাশের সিড়ি শেষ করআরেক পাশের সিড়িতে পা দিতে যাবে তার আগেই সামনে কেউ দাড়ালো। আঁখি চোখতুলে তাকিয়ে দেখলো নিচের ফ্লাটের নিপা। এবার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে আপাতত পড়ালেখা বন্ধ। নিপার বাবা একজন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। সেই সুত্রেও ওর বড় ভাইও পুলিশে জয়েন করেছে। নিপার সাথে আখির অনেক ভালো সম্পর্ক। নিপা আঁখি কে দেখে মুচকি হেসে বললো।

“কি ব্যাপার আঁখি? কলেজ থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? টাইম দেখেতো মনে হয় ক্লাসেই যাওনি।”

আখি জোর পূর্বক হেসে বললো।

“আসলে ভালো লাগছিলো না আপু। তাই চলে এসেছি।”

“এই দেখি দেখি তোমার চুলে এগুলো কি?”

নিপা আঁখির চুলে হাত দিয়ে একথা বললো। আঁখি চুল গুলো হাত দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে বললো।

“কিছুনা আপু এমনি!”

নিপা চোখ ছোট ছোট করে আঁখির দিকে তাকিয়ে বললো।

“কিছুনা তাইনা? আমার থেকে লুকাচ্ছো? তোমার শরীরেও তো আছে দেখছি। এগুলো কে দিয়েছে?”

আঁখি কি বলবে ভেবেই পাচ্ছেনা। সাজ্জাদের কথা বললে ওর মান সম্মানের ফালুদা হয়ে যাবে। তাই মুচকি হেসে আমতা আমতা করে বললো।

“বান্ধবীরা মিলে মজা করছে আপু।”

নিপা রেগে গিয়ে বললো।

“এটা কি ধরনের মজা? চার তলার নাদিয়াও ছিলো নাকি?”

আঁখি এবার ভয় পেয়ে গেলো। যদি নাদিয়াকে জিজ্ঞাসা করে? নাদিয়া আঁখির ক্লাসমেট প্লাস বন্ধু। ওদের বিল্ডিংয়ে চার তলায় থাকে। যদি ওকে জিজ্ঞাসা করে তো ও শেষ তাই তাড়াতাড়ি করে বললো।

“না না আপু। নাদিয়া ছিলো না। আজ আমার অনেক লেট হয়েছিলো। তাই নাদিয়া আমায় রেখেই একাই কলেজে চলে গিয়েছিলো।”

নিপা কিছুই বললো না। আঁখি মুচকি হেসে নিপাকে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি করে চলে গেলো। নিপা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের ফ্লাটে চললো।

আঁখি নিজের ফ্লাটে গিয়ে ভয়ে ভয়ে কলিংবেল দিলো। ওর মাকে নিয়ে খুব ভয়ে আছে। তিনি উকিলের মতো শুধুই জেরা করেন। মিসেস রোকেয়া রহমান রাগারাগি করতে করতে দরজা খুলতে এসেছে। দরজা খুলেই হা করে তাকিয়ে রইলেন নিজের মেয়ের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর রেগে বললেন।

“তুই? কলেজে তো সবে মাত্র গেলি এখনি চলে এলি? কলেজে চেহারা দেখাতে গিয়েছিলি? কেনো চলে এলি?”

আঁখি চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। কি বলবে এবার? কিছুক্ষন ভাবার পর বললো।

“আম্মু আমার একটু খারাপ লেগেছিলো তাই চলে এসেছি।”

মিসেস রোকেয়া রহমান আঁখির দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। আঁখি লুকিয়ে লুকিয়ে রাখছে যেনো সেন্টারফ্রুট ওর মা দেখতে না পারে। আঁখির মা ওর দিকে এগিয়ে মাথায় হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে বললো।

“কোথায় জ্বর তো আসেনি। শরীর তো একদম ঠিক আছে। মিথ্যা বললি কেনো?”

আঁখি এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। কিছুক্ষন ভেবে রেগে বললো।

“আম্মু! জ্বর ছাড়া কি আর কেনো রোগ নেই? ”

“তো? কি হয়েছে তোর বল? জ্বর ছাড়া কি হয়েছে তাহলে বল?”

আঁখি আমতা আমতা করতে লাগলো। দরজাটা বন্ধ করে মিসেস রোকেয়া রহমান আঁখির দিকে এগিয়ে বললো।

“কিরে? কথা বলছিস না কেনো? কথা বল!”

“আম্মু! পেট ব্যাথা করেছিলো তাই চলে এসেছি।”

“এখন করছেনা? বাড়িতে আসতেই শেষ হয়ে গেলো? ছোট বেলার অভ্যাস এখনও যায়নি? স্কুল ফাকি দেওয়া শেষে এখন কলেজও ফাঁকি দেওয়া শুরু করেছো?”

আঁখি আমতা আমতা করতে লাগলো। মিসেস রোকেয়া রহমান আঁখির চুলে হাত দিয়ে চুলগুলো টেনে ধরে বললো।

“এগুলো কি? এগুলোর জন্য এত মিথ্যা? কি করে হলো এসব?”

আঁখি এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। ধরা পড়ে গেছে এবার কি হবে? চুপচাপ ভাবতে লাগলো। মিসেস রোকেয়া রহমান জোরে এক ধমক দিলো। আঁখি ধমক খেয়ে কেঁপে উঠলো। আমতা আমতা করে বললো।

“আম্মু! বান্ধবীরা মিলে একটু মজা করেছে!”

“কি? এটা কি ধরনের মজা? এমন মজা করে কেউ? কে করেছে? আমি এখনি কলেজে যাবো।”

মিসেস রোকেয়া রহমান রেগে কথাটা বললেন। আঁখি এবার ভয় পেয়ে গেলো। কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজের রুমে যেতে যেতে বললো।

“আম্মু! চুপচাপ নিজের কাজে যাও তো!”

“হ্যাঁ ওই একেই কাজ পারো। দরজা আটকে ঘরে বসে থাকতেই পারো। বাইরে কারো সাথে তো পারোনা।”

রেগে কথাটা বলে মিসেস রোকেয়া রহমান নিজের কাজে গেলেন। আঁখি রুমে এসে দরজা আটকে রেগে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। রেগে বিছানায় বসে সাজ্জাদকে গলাগাল করতে লাগলো। ” শালা সাজগাজ! তোকে আমি কি যে করবো নিজেও জানিনা। এর শোধ তো নিয়েই ছাড়বো আমি। যেদিন থেকে এসেছি সেদিন থেকে জ্বালাচ্ছিস বেটা। তোকেও আমি ছাড়বো না।” আঁখি আর ওর পরিবার ছয়মাস আগে এই ফ্লাটে এসেছিলো। আঁখি অনার্সে ভর্তি হয় তখনেই এখানে ওর কলেজের কাছে এই ফ্লাটটা কিনে। প্রথম দিন এসে আঁখি অবাক হয়ে গিয়েছিলো।

—————————

সাদা রঙের পাঁচতলা বাড়িটির সামনে এসে ওদের গাড়ি থেমেছিলো। আঁখি নেমে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। কারন বাড়িটি বাইরে থেকেই দেখতে অনেক সুন্দর ছিলো। বাড়িটির সামনে একটু খানি জায়গায় অনেক সুন্দর ফুলের বাগান ছিলো। সেখানে বেলী, গাদা, নয়নতারা, সূর্যমুখী ফুলের গাছ ছিলো। আঁখির পরিবার ওকে রেখেই উপরে চলে গেলো। আঁখি ওগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। হঠাৎ ওর চোখ গেলো পাশের একটা গোলাপ গাছের দিকে। গাছটা সুন্দর করে পরিস্কার করে বেষ্টনি দিয়ে রেখেছে। গাছে একটা বড় লাল টকটকে গোলাপ ফুল ছিলো। আঁখির গোলাপ ফুল খুব পছন্দ। ও ফুলটা দেখে নিজেকে আটকে রাখতে পারলোনা। পাশে গিয়ে ঘ্রাণ শুকলো। ঘ্রাণ শুকতেই কোমরে হাত দিয়ে নিজে নিজেই বললো। ” কি করবো এবার? গোলাপ ফুলের যেই ঘ্রাণ একে রেখে গেলে আজ আমি থাকতেই পারবোনা। ছিড়ে নেই, যার গাছ তাকে বুঝিয়ে বলবো।” কথাটা বলেই হাসি মুখে আঁখি গোলাপ ফুলটা ছিড়লো। নাকের কাছে নিয়ে একটু ঘ্রান শুকলো।

“এই! এই মেয়ে এটা তুমি কি করলে?”

আঁখি হঠাৎ করেই কথাটা শুনতে পেলো। ভয় পেয়ে সামনে ফিরে ফুলটা পিছনে লুকালো। সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো একটা ছেলে ওর দিকে রেগে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি সাদা গেঞ্জি পরেছে তার উপর কালো শার্ট পড়ে আছে। চুলগুলো একটু বড় বড় সিল্কি। চেহারা দেখতে খুবেই সুন্দর। আঁখি মনে মনে ভাবলো ছেলেটি দেখতে এত সুন্দর এর ব্যবহার হয়তো খুব ভালো। কিন্তু আফসোস পরক্ষনেই ওর এই ভুল, নাহ মহা ভুলটা ভেঙে গেলো। ছেলেটি রেগে বললো।

“এভাবে হা করে তাকিয়ে কি দেখছো? স্মার্ট ছেলে কোনো দিন দেখোনি? ফালতু মেয়ে কোথাকার! কোথাথেকে সব এখানে চলে আসে কে জানে?”

আঁখি এবার অপমানিত বোধ করলো। ওকে ফালতু মেয়ে বলছে? ফালতু মেয়ে কাকে বলে তা ও দেখাবে। তাই রেগে ছেলেটির সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো।

“এই আপনি নিজেকে কি মনে করেন? আপনি অনেক সুন্দর? আয়নায় কখনও নিজেকে দেখেছেন? যেইনা চেহারা নাম রাখছে পেয়ারা। আপনি ফালতু বললেন কাকে হুম? ভদ্রতা তো আপনি জানেন না। প্রথম দেখেই তুমি করে বলা শুরু করে দিয়েছেন। জানেনা প্রথমে জনকে আপনি বলুন। জ্ঞানের অভাব আছে আপনার!”

“আমার নাম পেয়ারা না বুঝলে? আমি সাজ্জাদ নিশান্ত খান। তুমি জানো আমি কে? আমি এই বাড়ির ছেলে। কে তুমি হুম? আমাকে জ্ঞান দিচ্ছো? এতই যখন জ্ঞান আছে তখন এটা জানোনা কারো অনুমতি ছাড়া তার গাছ থেকে কিছু ছেঁড়া ঠিক না? আর তুমি তো আমার গাছের প্রথম ফুলটাই ছিড়ে নিলে। আহারে! আমার কত শখের ফুল!”

আফসোসের সুরে কথাটা বললো সাজ্জাদ। বাড়িওলার ছেলের কথা শুনে আঁখি আরও ভয় পেলো। এবার কি হবে? ওকে তো সবসময় এই ছেলেটার বকা খেতে হবে। আঁখি জোর পূর্বক দাঁত কেলিয়ে নরম স্বরে বললো।

“ভাইয়া আমি তো জানতাম এটা আপনার গাছ। আমরা আজেই তিনতলার ফ্লাটে উঠেছি। আমার গোলাপ ফুল খুবেই পছন্দ তাই ভুলে ছিঁড়েছি। সরি ভাইয়া!”

আঁখির নরম স্বরে কথা সুনে সাজ্জাদের মন গললো না। ধমক দিয়ে বললো।

“ভুল করে যখন ছিড়েছো তখন এটা লাগিয়ে দাও!”

আখি আকাশ থেকে পড়ার মতো অবাক হলো। ফুল কি করে লাগাবে? ও কি জাদু জানে? কি করে লাগাবে? মুচকি হেসে বললো।

“ভাইয়া কি করে লাগাবো?”

সাজ্জাদ গম্ভীর মুখে বললো।

“কি করে লাগাবে সেটা তোমার ব্যাপার লাগাও। সময় দুই মিনিট!”

আঁখি আরও অবাক হয়ে তাকালো। কি করবে ভেবে না পেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সাজ্জাদ হঠাৎ করে পাশের বালতিতে পানি ছিলো তা আঁখির গায়ে ঢেলে দিলো। আঁখি চমকে গিয়ে অবাক হয়ে তাকালো। সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে চিল্লায়ে বললো।

“এটা কি করলেন আপনি?”

সাজ্জাদ কিছু না বলে নিচের থেকে একমুঠ মাটি উঠিয়ে আঁখির মুরো চেহারায় মেখে দিলো। আঁখি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনেই রেগে সাজ্জাদের দিকে তাকালো। সাজ্জাদ ওর দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে চলে গেলো। আখি রেগে পুরো বোম হয়ে গেছে। কি করবে ভেবেই পাচ্ছেনা। এদিক ওদিক তাকিয়ে সাজ্জাদের গোলাপ গাছটা একটানে মাটি থেকে পুরো তুলে ফিক্কে মেরে ফেলে দিলো। ওই দিন থেকেই একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকে। একজন আরেকজনের উপর প্রতিশোধ নিতেই প্রস্তুত থাকে সবসময়। দুজনে যেনো সাপে নেউলে সম্পর্ক।

————————–

এসব ভেবে আঁখির রাগ আরও বেড়ে গেলো। টেনে সেন্টারফ্রুট গুলো ছুটাতে লাগলো। সব ছুটাতে পারলেও চুলের থেকে কিছুতেই ছুটাতে পারলোনা। জীবনে চুলে তেল দেয়না আঁখি। ওর সাধের চুলের জন্য তেলও দিয়েছে কিন্তু ছুটাতে পারেনি। শেষে বাধ্য হয়ে চুলগুলোই কেটে ফেলতে হলো। আঁখি চুলগুলোর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো। ওর এত সাধের চুল কেটে ফেলতে হলো। ওই সাজ্জাদকে ও কিছুতেই ছাড়বেনা। সারারুম পাইচারি করে ভাবতে লাগলো কি করবে? পরক্ষনেই একটা কথা মনে পরতেই লাফিয়ে উঠলো। খুশিতে নাচতে লাগলে আঁখি।

ইনশাআল্লাহ চলবে……

(রি চেইক করিনি। শুভ রাত্রি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here