শর্বরী অলিন্দ্রিয়া রুহি (১১)

#শর্বরী
অলিন্দ্রিয়া রুহি

(১১)

“একটা মায়াজাল সৃষ্টি হয়েছে তোমার ঘরে। শুধু তুমিই না,তোমার পরিবারের আরও অনেকেই এই মায়াজালে বন্দী। কিন্তু,যেটা শুনে তুমি সবচাইতে বেশি চমকে উঠবে তা হলো, তোমার পরিবারেরই কেউ এই মায়াজালের সূচনা ঘটিয়েছে। তুমিসহ আরও অনেককেই নিজের আয়ত্তে আনার জন্য চালিয়ে যাচ্ছে একের পর এক অপচেষ্টা। যদি এই জাল ছিন্ন না করতে পারো, তবে জীবন ধ্বংস হবে। একটি,দুটি নয়- অনেক ক’টি। আর যদি এই জাল তোমার দ্বারা বিভক্ত হয়,তবে সেই অভেদ্য জালের নকীবের মৃত্যু অবধারিত। মনে রাখবে, কালো জাদু ভীষণ ভয়ংকর! এখানে আর যাইহোক, জীবনের ধ্বংস অনিবার্য। হবে সেটা যার প্রতি কালো জাদু করা হয়েছে তার,নইলে যে করেছে সে। শয়তান কখনো খালি হাতে ফিরে যেতে চায় না।”

হুজুর থামলেন। জয়নালের গলা শুকিয়ে কাঠ। সে পরাপর বেশ কয়েকটি ফাঁকা ঢোক গিললো। হুজুর বিষয়টি খেয়াল করে বললেন,

“পানি খাবে?”

জয়নাল মাথা নাড়লো। আঙুলের ইশারায় রুমের এক পাশে রাখা জগ ও স্টিলের পানির গ্লাসটি দেখিয়ে দিলেন তিনি। জয়নাল উঠে গিয়ে পানি ঢাললো তবে খেলো না। তার সারা শরীর শিউরে উঠছে বারে বারে। জীবন তাকে কীসের সাথে দেখা করাতে চলেছে,কে জানে! কিন্তু কে হতে পারে,যে এরকমটা করল? তাও পরিবারের কেউ? বাবা? মা! নাকি শিমুল? হুজুর ডাক দিলে জয়নালের ধ্যান ভাঙলো। সে দ্রুত পানি খেয়ে আবার মুখোমুখি এসে বসল। প্রশ্ন করল অস্থির চিত্তে,

“আমার বাসায় আব্বা,আম্মা আর একটা বোনই আছে। এদের ভেতরই কেউ এসব করেছে হুজুর! বিশ্বাস হতে চায় না। বাবা-মা কী করে নিজ সন্তানকে মারতে চাইবে? কী ক্ষতি করেছি আমি তাদের?”

“আমি তো বলিনি তোমার বাবা-মা-ই এসবের জন্য দায়ী! আরও একজন আছে। তাকে ভুলে যাচ্ছো কেন?”

জয়নাল স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। হুজুর বললেন,

“চোখ,কান খোলা রেখো। জাদুর প্রচরণা ঘটে গভীর রাতে। যখন ঘুমিয়ে থাকে এই পাড়ের সবাই,তখন জাগ্রত হয় ওরা। গভীর রাতে খেয়াল রেখো,কী কী ঘটে। কোথায় ঘটে। ভয় পাবে না একদম। শয়তানকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওরা নর্দমার কীট, আর তুমি আশরাফুল মাখলুকাত। তুমি সর্বোত্তম, বিশুদ্ধ।”

“অথচ যে এই কাজ করেছে,সেও তো মানুষ!”

“মানুষে মানুষে ভেদাভেদ রয়েছে বাবা। হতাশ হয়ো না। নিজের পরিবারকে এই মায়াজাল থেকে রক্ষা করো। আমি আছি। সর্বাত্মক সাহায্য করবো। নামায পড়ো?”

জয়নাল মাথা কাত করে বলল,

“জি।”

“নিয়মিত কোর-আন পড়বে। প্রতিদিন সকালে.. জোরে জোরে, চেঁচিয়ে। যে ঘরে সূর্য ঢোকার আগে কোর-আনের আয়াত উচ্চারিত হয়, সেই ঘর পবিত্র,উত্তম। আর পবিত্র জায়গায় অপবিত্র কিছুই টিকতে পারে না। মনে থাকবে?”

“জি হুজুর।”

বাস চলছে নিজস্ব গতিতে। মসৃণ পথ, ভীড়ও তেমন নেই রাস্তায়। জয়নাল জানালায় হেলান দিয়ে আনমনে ভেবে চলেছে হুজুরের কথাগুলো। তাকে একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই দায়িত্ব পালনে যা করা প্রয়োজন তাই করবে সে। কিন্তু একটা জিনিসই ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে,এসবের পেছনে রয়েছে শিমুল! সে জয়নালকে পছন্দ করে না,কেননা জয়নালের পরিশুদ্ধ মন ও আচরণ ভঙ্গি তার ভালো লাগে না। শিমুলের অশুদ্ধ কাজকর্মে জয়নালের সম্মতি নেই, এই কারণে! জয়নালের মনে বিষাদের মেদুর ছায়া। শিমুল তার এক মায়ের পেটের আপন বোন। অথচ দু’জনের ভেতর পার্থক্য কত বিস্তর! কত আলাদা…

কলিংবেল বাজলে শিমুলই দরজাটা খুলে দিলো। জয়নাল তাকে দেখে স্মিত হাসলো। ভেতরে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো শিমুলের উদ্বিগ্ন ভরা প্রশ্নের।

“ভাইয়া, তোমার শরীর কেমন এখন?”

ঠোঁটে চিলিক দিলো ক্রুর হাসি। বিদ্রুপ খেলা করছে। যার জন্য এতকিছু,সেই কী-না তার স্বাস্থ্য বিষয়ক চিন্তায় চিন্তিত! হাস্যকর বটে… জয়নাল প্রশ্নের কোনো জবাবই দিলো না। গটগট পায়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ঢোকার মুহূর্তে বিড়বিড়িয়ে পড়ল কিছু। আকীর্ণ কনীনিকা ঘুরছে এদিক ওদিক। চঞ্চুদ্বয় গোল হয়ে ভেতর থেকে বাতাস বেরিয়ে এলো। নিজের বক্ষ:স্থলে তিনবার ফুঁ দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল জয়নাল। বসতেই নজরে এলো,শিমুল তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
এই ঘরে দুটো জানালা। দুটোই বন্ধ করা। জয়নাল প্রতিদিন সকালে যাওয়ার সময় জানালা বন্ধ করে যায়। এসে খোলে। সে যেভাবে ঘর রেখে যায়,সেভাবেই পড়ে থাকে। কেউ গুছায় না। মা-ও না। শুধু নিচটুকু ঝাঁট দেওয়া- ওই পর্যন্তই। শিমুল এসে দ্রুত হস্তে জানালা দুটি খুলে দিলো। ফ্যান ছেড়ে দিলো। লাইট জ্বালিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো জয়নালের দিকে। জয়নাল চেয়ে চেয়ে সবটা দেখলো। কিছু বলল না। পানির গ্লাস সঙ্গে করে কখন আনলো! খেয়াল করেনি সে।
শিমুল বলল,

“ভাইয়া,পানি খাও। বাহির থেকে এসেছো।”

“এর আগেও আমি বাহির থেকেই আসতাম। হঠাৎ এত উদ্বিগ্নতা আমায় নিয়ে! কী ব্যাপার?”

পাল্টা প্রশ্নের বাণে জর্জরিত শিমুল অধর মিশিয়ে হাসলো।

“উঁহু, তেমন কিছু না। মাঝে মাঝে আপনজনদের খেয়াল রাখতে হয়। এই পৃথিবীতে কেউ চিরস্থায়ী না। কে কখন চলে যায়,কে জানে!”

“ও! হুম, তা ঠিক। আচ্ছা রেখে যা পানিটা। খেয়ে নিবো।”

“খেও কিন্তু। আমি যাই…”

জয়নাল ঘাড় কাত করে,শিমুল চপল পায়ে বেরিয়ে যায়। জয়নাল উঠে গিয়ে পানির গ্লাসটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। মাথায় কিছু নতুন চিন্তাভাবনা খেলা করছে। গ্লাসের পানিটুকুন বাথরুমে ফেলে দিয়ে গ্লাসটা ধুঁয়ে নেয় জয়নাল। রেখে দেয় টেবিলের উপর। আফসোস হয় তখন,পানিটা না ফেলে হুজুরের কাছে নিয়ে গেলে আরও ভালো হতো। আসলেই এসবের পেছনে শিমুল কী-না,তা জানা যেতো বিশেষ ভাবে।

***

বিছানায় শুয়ে এক হাতে মাথা ধরে রেখেছে কুসুম। ভীষণ ক্লান্ত সে। নেহাল বারে বারে বলছে,আসা ঠিক হয়নি। কুসুম ও অনাগত সন্তানের কোনো ক্ষতি হলে এই দায়ভার আজীবন তার থেকে যাবে। কুসুম বলল,

“আরে,তুমি চিন্তা করছো কেন? আমি ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”

“আমি খাবার অর্ডার দিবো। কী খাবে তুমি?”

“আমি কিছুই খাবো না। প্লিজ,একটুও ক্ষিদে নেই। জোর করবে না একদম।”

নেহাল কিছু বলতে গিয়েও বলল না। অনেকবার বমি করেছে আসার পথে কুসুম। চোখমুখ ফ্যাকাশে। এখন একটু ঘুমালেও ভালো হবে। সকালে উঠে না হয় ঝরঝরে মন নিয়ে খাবে। কুসুমকে বিছানায় ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে নেহাল দরজা বাহির থেকে লক করে নিচে নেমে এলো। ভাত খেতে তারও ইচ্ছে করছে না। হালকা কিছু খাবে।

কুসুম গাঢ় ঘুমের ভেতরই শুনলো,দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নেহাল এসেছে? কুসুমের পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। নেহালের কাছে চাইবে ভেবে চোখজোড়া পিটপিট করে চাইতেই চমকে উঠল। আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলো দরজার সামনে কালো আলখেল্লা পরিহিতা একটি মেয়ের দিকে। এই মেয়েটি কে?

(চলবে)
[ছোটো পর্ব হলেও প্রতিদিন দিবো। গল্পটা প্রায় শেষের পথে…]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here