শর্বরী অলিন্দ্রিয়া রুহি (৯)

#শর্বরী
অলিন্দ্রিয়া রুহি

(৯)

নয়ন বাড়ি ফিরলো অসংহত চিত্তে। স্নেহার নাম ও বাড়ির ঠিকানা জানার যে খুশিটুকু তার মধ্যে হওয়ার কথা ছিল, তার সিকিভাগও নেই। এর কারণ, স্নেহাকে তার প্রথম বিয়ের কথা জানানো হয়নি। অবশ্য জানাতে পারেনি! স্নেহা সময় দিলে তো! যে চঞ্চল মেয়েটা! নয়নকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিয়েছিল সে সময়ে। তাই কী বলবে আর কী করবে,বুঝে উঠতে পারেনি সে। এখন মনে হচ্ছে, স্নেহার সঙ্গে আরেকবার আলাদাভাবে দেখা করার প্রয়োজনীয়তা আছে। আগে তাকে জানাতে হবে নয়নের প্রথম বিবাহের কথা। এরপরে সিদ্ধান্ত স্নেহার। যদি তার কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে নয়ন তাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত। এর আগে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, আইনত শিমুলের সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেওয়া। এইসব অভিপ্রায় নিয়ে উতলা হয়ে উঠল মন। দুপুরের খাওয়ার কথাও ভুলে বসল প্রায়। শুয়ে রইলো উদোম গায়ে, জানালার দিকে পিঠ দিয়ে। মিষ্টি রোদ আসছে। নয়নের জ্বর শরীরে ভালো লাগছে তা ভীষণ। কড়া রোদে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়েই এই জ্বর বাঁধিয়েছে সে। তাও মাত্র একদিনেই! না জানি বাকী দিনগুলো কী নাজেহাল করে ছাড়বে স্নেহা! নয়ন একা একাই মিটমিট করে হাসল।
নেহাল স্নান সেড়েছে সবে। ভেজা শরীরে তোয়ালে হাতে প্রবেশ করল ছোট ভাইয়ের ঘরের ভেতর। নয়ন নেহালকে দেখামাত্র উঠে বসল। ডাকল একবার,

“ভাই?”

নেহাল মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে গিয়ে নয়নের পাশটা দখল করে নিলো। তোয়ালেটা একপাশে সরিয়ে রেখে কঠিন গলায় প্রশ্ন করল,

“খাসনি কেন?”

“ভুলে গিয়েছিলাম। খেয়ে নেবো।”

“আচ্ছা। খাওয়া শেষে আমি আসবো। কয়টা কথা আছে তোর সাথে।”

বলে উঠে চলে যেতে নিচ্ছিলো নেহাল,নয়ন চোখ ইশারায় থামতে বলল।

“তুমি কী বলতে চাও। বলো ভাই…আমি একটু পর খেয়ে নিচ্ছি।”

নেহাল অগত্যা বসল। কথাগুলো কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। নয়ন তো ছোট বাচ্চা নয়! সে যথেষ্ট বড় এবং ম্যাচিউর। তাকে বোঝাতে আসা ব্যাপারটা কেমন যেন দেখায়! তবুও বড় ভাবীর কথায় এসেছে। কিন্তু নিজেই গুলিয়ে বসে আছে বলবেটা কী! তবুও কিছু একটা বলতেই হয়, তাই নেহাল ইতস্ততভাবে বলল,

“দেখ নয়ন, তুই আমাদের সবার ছোট এবং আদরের। তুই আমার উপর রাগ করে আছিস নিশ্চয়ই। কিন্তু বিশ্বাস কর, শিমুলের সাথে আমি কিছুই করিনি! বরং কোন মোহে পড়ে ওর ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম,এটাই বুঝতে পারছি না। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস ভাই। তোর মনে আমি ক্ষত হিসেবে থাকতে চাই না।”

“না ভাই,তোমার প্রতি রাগ নেই আমার। আর শিমুল যেভাবে তোমাকে বশ করেছে,আমাকেও করেছে। আমি কী ভেবে ওকে হুট করে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম জানি না! এখন সবকিছু বাদ ভাই। যা হবার তা হয়ে গেছে। আমার তোমাকে অন্যকিছু বলার আছে।”

“কী? বল!”

নয়ন উশখুশ করল। মাত্র দু’দিন কেটেছে মাঝে শিমুলের চলে যাওয়ার। আর এখনি আবার যদি দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলে! কেমন দেখাবে ব্যাপারটা! আবার না বলেও উপায় নেই। শুক্রবার হতে মাত্র একদিন বাকী। আগামীকাল বৃহস্পতিবার, এরপরই শুক্রবার। আর এই শুক্রবারই স্নেহা ওদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যেতে বলেছে। তাহলে এখনি সবকিছু খুলে বলতে হবে পরিবারের সবাইকে। হালকা কেশে মনে সাহস সঞ্চার করল নয়ন। তার ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মনের ঘটনা নেহাল বুঝতে পারল অনেকাংশে। তাই আশ্বস্ত করার জন্যে নয়নকে বলল,

“তোর ভেতর যা আছে খুলে বল। আমি কিছুই মনে করব না।”

মাথা দোলালো নয়ন। চাপা গলায় ধীরকণ্ঠে স্নেহার ব্যাপারটা খুলে বলতেই নেহাল চমকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখমুখ দেখে আদতে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু নয়নের এহেন সিদ্ধান্তে সে ভীষণ খুশি হয়েছে। সে নিজেও চাচ্ছিলো, নয়ন আরেকটি বিয়ে করে থিতু হয় যেন। কথাটি কীভাবে নয়নকে বোঝাতো, তাই নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিল এতক্ষণ। যাক..এবার সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটেছে। নেহাল সহাস্যে সম্মতি জানালো। বাড়ির সবার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবে,তাও জানালো। তারপর চলে গেলে নয়ন পড়ল আরেক চিন্তায়। সে আগে থেকেই জানতো, তার পছন্দকে বাড়ির সবাই-ই পছন্দ করবে। যখন শিমুলকে বিয়ে করার কথা বাড়িতে জানিয়েছিল,তখনো কেউ বাঁধা প্রদান করেনি। হাসিমুখে বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছে। নয়নের সুখটাই তাদের কাছে বড়। এবারও স্নেহার বেলায় কেউ কার্পণ্য করবে না- জানে নয়ন। শুধু ভাবনা একটা জায়গাতেই। স্নেহা যদি নয়নের প্রথম বিবাহের কথা জানতে পারে,তখন? আদৌও সে নয়নকে বিয়ে করতে চাইবে? মন থেকে আপন করে নিতে পারবে তো নয়নকে? নয়ন আবার শুয়ে পড়ল। মাথার নিচে হাত গুঁজে ভাবতে লাগল, আগামীকাল তাকে আরও একবার স্নেহার কলেজের সামনে যেতে হবে। স্নেহাকে জানাতে হবে সবকিছু। এরপর স্নেহা যা সিদ্ধান্ত নিবে,তাই সই। যদি সে বিয়ে করতে মানা করে দেয়,তাহলে তাই হাসিমুখে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে সে। মনস্থির করল নয়ন…

____________

জয়নাল আজ একটু দ্রুতই বাড়ি ফিরে এলো। মার্কেটে তার নিজস্ব দুটি দোকান রয়েছে। একটায় সে বসে,অপরটায় একজন বিশ্বস্ত কর্মী রাখা। যদিও প্রতিদিন অপর দোকানে ঢু মারে জয়নাল, এবং সবকিছুর খোঁজ খবর রাখে। প্রতিদিন দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত একটা কী দেড়টা বেজে যায়। সেই তুলনায় আজ ব্যাপক জলদি চলে এসেছে। ঘড়িতে সবে মাত্র আটটা বাজে। এই জলদি আসার পেছনের কারণ হলো, জয়নাল অসুস্থ। শারীরিক ভাবে নয়,মানসিক ভাবে। মানসিক অসুস্থতাকে আমরা সহজ ভাবে দেখলেও এটি মোটেও সোজা কোনো বিষয় নয়। বরং শারীরিক রোগের চাইতেও ভয়াবহ! শিমুলের কর্মকান্ড, পরিবারের আচরণ- এইসব কিছু নিয়ে জয়নাল মোটামুটি চিন্তায় চিন্তায় শেষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি নতুন চিন্তাধারা। গতকাল রাতে সে যখন বাড়ি ফিরছিল,তার বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ তাকে ফলো করছে। জয়নাল যতবার পিছে তাকিয়েছে,কাউকেই দেখতে পায়নি। কিন্তু হাঁটতে শুরু করলেই কারও উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ঘাড়ের কাছটায় পেয়েছে। মনের ভুল ভেবে দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে একপ্রকার দৌড়ে বাসায় ফিরেছে জয়নাল। প্রতিদিন বাড়ি এসে গোসল সেড়ে খেয়ে দেয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে তিনটা বেজে গেলেও গতকাল সে গোসলও সাড়েনি। আর না খেয়েছে কিছু! অভুক্ত অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছে বিছানায়। ঘুম গাঢ় হবে হবে, এমন সময়ে সে শুনেছে ছাদে কেউ হাঁটছে। যে হাঁটছে সে খুবই রিল্যাক্স মুডে আছে। পায়ের শব্দতেই এমন ধারণা হয়েছে জয়নালের কাছে। ব্যাপার গুলো অতি আশ্চর্যের এবং বিস্ময়কর জয়নালের কাছে। এরপর থেকেই দুর্বলতা এবং অসুস্থতা। একটা আলস্য সারা তনুমনে… জয়নাল বিশ্বাস করে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার গুলো। নয়তো কোরআনে জ্বিনজাতির ব্যাপারে উল্লেখ থাকতো না! কিন্তু তার সাথে হঠাৎ এসব কী শুরু হয়েছে! এর আদ্যোপান্ত কিছুই জয়নালের কাছে বোধগম্য নয়। বিছানায় শুয়ে শুয়েই বিক্ষিপ্ত মেজাজে ভাবছিল এতসব কিছু। প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে জয়নাল খেয়াল করল বাড়িতে কেউ নেই। এই সময়ে তার বাবা সাধারণত চায়ের দোকানে মুরুব্বিদের সাথে খানিক আড্ডা দিয়ে কাটায়। মা নাটক দেখে। আজকে টিভি বন্ধ। দরজা বাহির থেকে চাপা দেওয়া। কোথাও গেছে হয়তো! জয়নাল শিমুলের নাম ধরে কয়েকবার উচ্চস্বরে ডাকলো। শিমুলের জবাব নেই। সেও কী নেই তবে? মায়ের সঙ্গে বেরিয়েছে? হবে হয়তো…
জয়নাল মাথা ঘামালো না। বাথরুম সেড়ে ভারযুক্ত মগজ নিয়ে যখন নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো, তখন সে খেয়াল করল, বিছানায় কেউ বসে রয়েছে। পেছন থেকে যতদূর বোঝা যায়, ব্যক্তিটি মেয়ে। জয়নাল হতবাক হয়ে পড়ল। তার কামড়ায় শিমুল ব্যতীত অন্য কে হতে পারে! আর এভাবে খালি বাড়িতে ঢুকেছেই বা কোন সাহসে! জয়নাল একবার ভাবলো,ধমক লাগাবে কী-না। পরমুহূর্তেই কে না কে, তা দেখার জন্য নরম সুরেই ডেকে উঠল। মেইন দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে ভেসে হাসছে শিমুলের উচ্চ শব্দের হাসি, মায়ের কথা। তারা কী যেন বলাবলি করছে আর হাসছে। জয়নাল রুমে না ঢুকে একবার পেছন ফিরে তাদেরকে দেখে নিলো। মা বললেন,

“এখানে দাঁড়িয়ে কীরে?”

জয়নাল জবাব দিলো,

“কিছু না।”

তারপর সামনে তাকাতেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে একফোঁটা শীতল ঘাম গড়িয়ে পড়ল। বিছানায় কেউ নেই! ঘর খালি! গলা শুকিয়ে কাঠ! এই মাত্রই তো দেখল মেয়েটিকে। বসে ছিল এইখানটায়! গেল কই? জয়নালের মনে হলো,তার মাথা ঘুরছে। সে কোনোক্রমেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। ভকভক করে একগাদা বমি দিয়ে মেঝে ভাসিয়ে ফেলল জয়নাল।

______________

কক্সবাজারের দুটো টিকিট কাটা হয়েছে অনলাইনে। মরিয়ম বেগম রাজী হয়েছেন নেহাল আর কুসুমকে এই মুহূর্তে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে দিতে। সেই নিয়ে উচ্ছ্বসিত কুসুম। বিয়ের পর এই প্রথম এতদূরে ঘুরতে যাবে তারা! মোট চার দিন পাঁচ রাত থাকবে কক্সবাজারে। এই চার দিন হবে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত,শ্রেষ্ঠ সময়। নেহাল বলল,

“ফোন বন্ধ করে রাখবো ভাবছি। এতে কেউ আর ডিস্টার্ব করতে পারবে না আমাদের।”

কুসুম ভ্রু কুঁচকে হাসলো। সে আলমারি খুলে শাড়ি বাছাই করছে। কোনটা কোনটা নিবে,কোনটা পরে যাবে,তাই ভাবছে। নেহালের একটা শার্ট আছে সাদা রঙের। কুসুম সেটা বের করে বলল,

“এটা নিয়ে যাবেন?”

“কেন? ওটা নিতে চাইছিলাম না আমি।”

“উঁহু,নিবেন। আপনাকে সাদায় ভীষণ সুন্দর লাগে।”

“তাহলে তুমি কালো শাড়িটা নাও। আমি সাদা,তুমি কালো। মানাবে,কী বলো?”

“নাহ, আমি লাল টুকটুকে শাড়িটা নিচ্ছি। ওটা পরব। আপনি সাদা,আমি লাল। আমার রক্তলালে আপনার সাদা শার্ট ডুবে যাবে প্রগাঢ় ভালোবাসায়…”

নেহাল স্মিত হেসে এগিয়ে এলো।

“আমাদের জীবনে সবকিছু কত সুন্দর যাচ্ছে! তাই না কুসুম? নয়নটাও অন্য একজনেতে বিভোর! আমরা ঘুরতে যাচ্ছি। পরিবারের সবাই খুশি। একটা আমেজ, রবরব ভাব।”

“আরও হবে। নয়ন ভাইয়ার বিয়েটা এবার আরও ধুমধাম করে দিবো কেমন? অনুষ্ঠানের আনন্দে সবাই পুরোনো শোক ভুলে যাবো।”

“সবসময় এমন খুশি থাকতে চাই কুসুম।”

“ইনশাআল্লাহ।”

কুসুম আশ্বাস দিলো। নেহাল আশ্বস্ত হলো। অথচ ওরা জানে না,কী দুর্ঘটনাটাই না অপেক্ষা করছে আগামীর জন্যে!

(চলবে)
[প্যানিক হবেন না!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here