শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১৪
অরিত্রী কাঁদছে, এ মুহূর্তে পিথিউশার নিজেকে মাঝ সমুদ্রে পথ হারানো নাবিক মনে হচ্ছে। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে অরিত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতে, বলতে, “আপনাকে অন্য কেউ ভালোবাসুক বা না বাসুক, আমি সারাজীবন আপনাকে ভালোবাসবো। আমার মনে কেবল আপনি রাজত্ব করবেন…” কিন্তু কিছুই বলা হলো না। অরিত্রী আবার প্রশ্ন করলো,
-“আমার দ্বিতীয় প্রেম কে শুনবেন? শুনবেন তার নামটা, যাকে মন উজাড় করে ভালোবাসা সত্ত্বেও ভালোবাসি বলতে পারছি না…”
বুকে হাজার মোন ওজনের পাথর চাপা দিয়ে পিথিউশা বহু কষ্টে বললো,
-“শুনবো।”
-“আমি যাকে ভালোবাসি, যে মানুষটা আমার বড়বোনের প্রেমে অন্ধ সে মানুষটা হলো আ…”
কথা শেষ করতে পারলো না অরিত্রী, তার আগেই মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রিনে অমিতের নাম দেখে থমকে গেল অরিত্রী, বুকের মধ্যে প্রথম যে চিন্তাটা এলো, “এসময় অমিতের ফোন! বাবার কিছু হয় নি তো?” কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করলো অরিত্রী। ফোনের ওপাশ থেকে অমিত কি বললো তা শুনতে পায় নি পিথিউশা, তবে অরিত্রীর ফ্যাকাশে চেহারা বলে দিচ্ছে, ওপাশের ব্যক্তিটি কোনো দুঃসংবাদই দিয়েছে। যন্ত্রমানবের ন্যায় উঠে দাঁড়ালো অরিত্রী, পিথিউশার চোখে চোখ রেখে গম্ভীরস্বরে বললো,
-“আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে, দয়া করে আপনি আমার সঙ্গে যেতে চাইবেন না। যদি কখনো সুযোগ হয় আমি আপনাকে সবটা বলবো, তবে এ মুহূর্তে আমার খুব কাছের মানুষের আমাকে ভীষণ প্রয়োজন।”
অরিত্রী দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়, পিথিউশাও কথা বাড়ায় না। ছাদের কার্ণিশ ঘেষে দাঁড়ায় সে, নিরব দর্শকের মতো অরিত্রীর চলে যাওয়া দেখে… তার কেনো যেনো মনে হচ্ছে, আজ যে মানুষটা অর্ধেক কথা বলে চলে গেলো, সে মানুষটা না ফেরার জন্য যাচ্ছে। সে আর কোনোদিনও ফিরবে না। ধীরে ধীরে পিথিউশার চোখ জ্বালা করতে লাগলো, চোখের কার্ণিশ বেয়ে দু’ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। “পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই” নিজেকেই নিজে প্রবোদ দেয় পিথিউশা। অথচ সে জানে, আজকের না পাওয়া তার জীবনের সমস্ত না পাওয়াকে ছাপিয়ে গেছে… নিজেকে বড্ড বেশি একা মনে হয় পিথিউশার। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট অভিযোগ জানায়, একজন একান্ত নিজের মানুষ পাবার অধিকারও কি তার নেই?
১৯
মুহূর্তেই ঘটনার পরিক্রমা ঘুরে যেতে পারে, কথাটার মাহাত্ম্য আজ খুব করে অনুভব করছে অরিত্রী। কতো ভেবে আজ সাহস করে পিথিউশাকে সবটা বলতে চেয়েছিলো, অথচ দিনের শেষটা হলো এক দুঃসংবাদ শুনে। সেট এ কাজ করার সময় উপর থেকে কাঁচ পড়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছে অতসী। সবচেয়ে ভয়ানক খবরটা অরিত্রী শুনেছে হাসপাতালে এসে। অতসীর শরীরের তেমন ক্ষতি না হলেও মুখের বেশ খানিকটা অংশ কেটে গেছে। ডাক্তারটা ইমিডিয়েট অপারেশন করেছে ঠিকই কিন্তু সুস্থ হয়ে যাবার পর দাগ থেকে যাবে বলে জানিয়েছেন। জ্ঞান ফেরার পর থেকে অতসী থম ধরে বসে আছে, কারো সঙ্গে কথা বলছে না। অরিত্রী সামনে যেতেই চিৎকার করে উঠলো, তারপর হাতের কাছে যা পাচ্ছিলো তা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলছিলো,
-“কেনো এসেছিস? মজা দেখতে? সবাই বলে আমি তোর থেকে সুন্দর, দেখ… আমার সৌন্দর্য্য আর নেই। আমার ক্যারিয়ার, আমার স্বপ্ন সব শেষ… কে কাজ দিবে আমাকে, বল, কে দিবে?”
অতসী পাগলপ্রায়, আজ তার আচরণে অরিত্রীর একটুও মন খারাপ হলো না। বোনের কাছে গিয়ে তাকে জাপটে ধরলো, মুহূর্তেই অতসীর সব রাগ গলে জল হয়ে গেলো। অঝর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই বসে পড়লো সে, অরিত্রীকে বললো,
-“তুই আমাকে ঘৃণা করিস তাই না? আমি কখনো তোর ক্ষতি চাই নি বিশ্বাস কর। নিজের বোনের ক্ষতি কেউ চায়? আমার শক্ত খোলসটা দেখে ঘৃণা করে গেলি? একটু ভেতরটা দেখলি না?”
অরিত্রীর কান্নার দমকে কথা আটকে আটকে আসছে, খুব কষ্টে ঠোঁট নাড়িয়ে সে বললো,
-“আমি তোরে ঘৃণা করি না আপু, আমার অভিমান হয়েছিলো। তোকে ঘৃণা করার প্রশ্নই আসে না। আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি আপু, বিশ্বাস কর…”
অতসী আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো, ও ঘুমিয়ে গেলে অরিত্রী কেবিনের বাহিরে বাবা-মায়ের কাছে গেলো। কিছুটা দূরে হাসপাতালের কার্নিশ ঘেষে অমিত দাঁড়িয়ে, অরিত্রীকে কেবিন থেকে বের হতে দেখে এগিয়ে এলে সে। অরিত্রী জানতো, বাবা-মা সন্তানের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। অরিত্রী কাছে আসতেই মিনতি রহমান বললেন,
-“অতসীর যে অবস্থা, ও তো চাইলেও আর ক্যামেরার সামনে যেতে পারবে না। ওর ক্যারিয়ার এখানেই শেষ… এ মুহূর্তে ওর যে জিনিসটা প্রয়োজন তা হলো মেন্টাল সাপোর্ট। আর এ মেন্টাল সাপোর্ট দিতে পারে কেবল একান্ত নিজের মানুষ। অরিত্রী, কিছু মনে করিস না। আমার কথাগুলো তোর কাছে স্বার্থপরের মতো মনে হতে পারে তাও বলছি। পিথিউশা অতসীকে ভালোবাসে, যদি তুই এখনো ওকে সত্যটা না বলে থাকিস তবে আর কোনোদিনও বলিস না মা। ওকে সেদিন যতোটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, ছেলেটা ভীষণ ভালো। তাই আমরা চাই ছেলেটা জানুক, ও যাকে ভালোবাসে সে বরাবরই অতসী। অরিত্রী নামের কাউকে ও কোনোদিন না চিনুক। ও জানুক, ওর ভালোবাসার মানুষ আজ বিপদে আছে, অসহনীয় যন্ত্রনা সহ্য করছে। সারাজীবনের জন্য ও অতসীর ঢাল হয়ে পাশে থাকুক।”
অরিত্রী যেনো কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, তার দৃষ্টিশূণ্য, মুখশ্রী ফ্যাকাশে। অমিত কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই আতিকুর রহমান বললেন,
-“সবসময় আমি অতসীর গুণের প্রশংসা করেছি, কোনো প্রয়োজনে সবার আগে ওকে বলেছি। আজ প্রথমবারের মতো অতসীর জন্য তোর কাছে কিছু চাইছি মা। তুই অতসীর সুখটুকু ওকে ভিক্ষে দে। তোর তো শারিরীক কোনো ত্রুটি নেই, শিক্ষাগত যোগ্যতাও আছে, তোকে আমরা চাইলেই ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারবো। অতসীর তো সব শেষ হয়ে গেছে। ওর একটা নিরাপদ ঘর পাবার সুযোগ আছে, সে সুযোগটা জেদ করে কেড়ে নিস না। পিথিউশাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ভুলে যা অরিত্রী।”
বাবা-মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে ভুলে গেছে অরিত্রী। নিজেকে এতোটা অসহায় কোনোদিন বোধ হয় নি তার। বরাবরই তার বাবা-মা অতসী অন্তঃপ্রাণ, আজ সে বাবা-মা তার কাছে কিছু চেয়েছে, এ মানুষ দুটোকে ফেরানোর সাধ্য কি তার আছে! বাবা-মায়ের পায়ের সামনে বসে ছিলো সে, এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো, গম্ভীর অথচ শান্তস্বরে বললো,
-“আমি আমার আর আপুর দুজন ব্যক্তি হবার কথা পিথিউশাকে জানাতে পারি নি। তবে আমার বিশ্বাস আমার অস্তিত্ব টের পেলে পিথিউশা কখনোই আপুকে বিয়ে করবে না। তবুও আমি চেষ্টা করবো, পিথিউশা যেন আমার কথা না জানে, উনি যেন ধরে নেন আমি আর অতসী একই মানুষ।”
কথাটা বলে দ্রুত পায়ে হাসপাতালের বাহিরে চলে যায় অরিত্রী, পেছন পেছন ছুটে অমিত। ফুটপাতে বসে কাঁদছে অরিত্রী, অমিত পাশে গিয়ে বসতেই বললো,
-“একটা সাহায্য করবি ভাই?”
-“ছোটপু, তুই এ কাজটা করিস না। আমি তো, জানি তুই ভাইয়াটাকে কতো পছন্দ করিস।”
অরিত্রী তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
-“শুনিস নি? আমার পছন্দের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপুর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা। আর তা পিথিউশার মতো মাটির মানুষের সান্নিধ্যেই সম্ভব।”
-“আর তুই?”
-“জানি না…”
চোখের জল মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে অরিত্রী, অমিতের হাতে নিজের ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
-“পিথিউশাকে ফোন করবি তুই, বলবি অতসী আপুর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপু হাসপাতালে… আমি দেখতে চাই, আপুর অসুস্থতার কথা শুনে উনি কিভাবে রিয়েক্ট করেন। আমি আপুর কাছে যাচ্ছি, আপুকে ছোট করে সব বুঝিয়ে বলতে হবে। আপু যেন কখনো আমার কথা ওনার সামনে না বলে তা’ও বলে দিতে হবে।”
কেবিনের ভেতর অতসীর সঙ্গে মিনতি রহমানকে দেখে অরিত্রী ম্লান হাসলো, অরিত্রীকে দেখে মিনতি রহমান বললেন,
-“আমি অতসীকে সবটা বুঝিয়ে দিয়েছি, ওর পিথিউশাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। তবে একটা ঝামেলা আছে…”
অরিত্রীর মা সবসময়ই বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিতে জানেন। তাই হয়তো অতসীকেও নিজের মতো বুঝিয়ে দিয়েছেন সবটা। অরিত্রী নির্বিকার ভঙিতে প্রশ্ন করলো,
-“কি ঝামেলা?”
চলবে…