শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১৬
পিথিউশা যন্ত্রমানবের মতো ঠোঁট নেড়ে বলে,
-“আমি আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম একটা বেগুনী সুতি শাড়ী পরা অবস্থায়। রাস্তার পাশে বাচ্চাদের আইসক্রিম কিনে দিচ্ছিলেন আপনি… প্রথম দেখাতেই আপনাকে ভীষণ পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো আমার।”
অতসীর মলিন বদনে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে, গম্ভীর স্বরে বলে,
-“আপনি প্রথমবার যাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সে মানুষটাও অরিত্রী ছিলো। আমি কখনো এসবে আগ্রহী ছিলামই না…”
আস্তে আস্তে পিথিউশার মাথার জট খুলতে শুরু করলো, যে মেয়েটাকে সে অতসী ভেবেছে তাকে বেশিরভাগ সময়েই অতি সাধারন সাজ পোশাকে দেখে অভ্যস্ত সে। কখনো ভাবেই নি, সে দুটো ভিন্ন মানুষকে দেখছে বা একজন সেলিব্রেটি এতঁ সাধারণ জীবনযাপন করতে পারে না। তাছাড়া যেদিন রাতে অমিত তাকে দুঃসংবাদটা দিলো সেদিন সারাদিন তো অরিত্রী তার সঙ্গে ছিলো, একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে অনেক আগেই ব্যাপারটা তার কাছে ধরা পড়তে পারতো। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকেই মনে মনে গালি দিলোো পিথিউশা। কিন্তু অরিত্রী সব জেনে চুপ রইলো কেনো? তাকে কিছু জানালো না কেনো? তবে কি অরিত্রীও সবার মতো ভাবছে যে পিথিউশা অতসীকে ভালোবাসে? পিথিউশা অতসীর মুখের কাছে ঝুঁকে ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-“অরিত্রী এখন কোথায়? ওনার সঙ্গে আমার কথা বলাটা ভীষণ জরুরি।”
চোখের জল মুছে অতসী বলে,
-“আপনাকে আমি অরিত্রীর কাছে নিয়ে যাবো। তার আগে বিয়ের পাকাকথা আটকাতে হবে…”
পিথিউশা আর অতসী দ্রুত নিচে নেমে আসে, কিন্তু ততোক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। বিয়ের তারিখ পাকা হয়ে গেছে… ওরা নিচে নামতেই আরজু হক অতসীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। নিজ হাতে মিষ্টি খাওয়ালেন। মুচকি হেসে বললেন,
-“ওয়েলকাম টু আওয়ার ফ্যামেলি অতসী, আগামী মাসের প্রথম শুক্রবার তোমাদের বিয়ে।”
২২
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সময় বয়ে চলে, বয়ে চলছে অরিত্রীর জীবন তরীও। ঢাকা ছাড়ার পর তার সঙ্গে পিথিউশার আর কথা হয় নি, তবে মনে মনে সে প্রতিনিয়ত পিথিউশার সঙ্গে কথা বলে… আজও অন্ধকার রাতে তার মনের জানলায় পিথিউশার আবছা মূর্তিটা বারংবার উঁকি দেয়, সে মুহূর্তে পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলোকে বেশ জীবন্ত মনে হয় অরিত্রীর। মনে হয় এইতো কিছুদিন আগের কথা, মানুষটা তাকে কতো গভীর দৃষ্টিতেই না পর্যবেক্ষণ করতো! পরমুহূর্তে মনের কার্ণিশে প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি তাকে দেখতো পিথিউশা? নাকি অতসী নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অরিত্রীর মনটা তাকে কখনো ছুঁতেই পারে নি! যদি পারতো তবে এতো সহজে অতসীকে বিয়ে করলো কি করে পিথিউশা? নাম না জানুক, মানুষটাকে তো সে জেনেছিলো, ভালোবেসেছিলো… থমকে যায় অরিত্রীর পৃথিবী, মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে, পিথিউশা কি তাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভালোবেসেছিলো? যদি ভালোই বাসবে তবে, দুটো মানুষের পার্থক্য কেনো তার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করলো না? পরমূহূর্তে নিজের চিন্তা দেখে বিদ্রুপের হাসি হাসে অরিত্রী। তাচ্ছিল্যের সুরে বিড়বিড় করে বলে, “এমনটা তো হবারই ছিলো, সে তো শুরু থেকেই অতসীকে চাইতো। তুমিই তো উপযাচক হয়ে বোনের ভালোবাসায় নিজের নামের সিলমোহর বসাতে গিয়েছিলে অরিত্রী। হলো তো এবার তোমার শিক্ষা? তুমি এতো নিচ অরিত্রী? শেষমেশ কিনা তোমায় ঠেকে শিখতে হলো! ধিক, তোমায় শত ধিক…”
সকালের নাস্তা শেষে নানাভাইকে পত্রিকা পড়ে শুনাচ্ছিলো অরিত্রী, মোসাদ্দেক হাওলাদারের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি লোপ পেলেও জানার ইচ্ছা বিন্দুমাত্র কমে নি। এখনো হাতের কাছে কোনো বই বা ম্যাগাজিন পেলে উল্টে পাল্টে দেখেন। নিয়ম করে কবিতা আবৃত্তি করেন, ডাক্তারের বারনও শোনেন না। অরিত্রী আসার পর যদিও তার রোজকার রুটিনে পরিবর্তন ঘটেছে, সকালের নাস্তার পর নানাভাইকে পত্রিকা পড়ে শোনানোর দায়িত্ব নিয়েছে সে। কাজটা করতে তার ভালো লাগে, বেশ কিছুটা সময়ের জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়। আজও প্রতিদিনের মতো পত্রিকা পড়ে শুনাচ্ছিলো সে কিন্তু যে মুহূর্তে অরিত্রীর দৃষ্টি আজকের তারিখটার দিকে পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে তার নিঃশ্বাস থেমে গেলো। অমিতের কাছে সে অতসী আর পিথিউশার বিয়ের তারিখটা শুনেছিলো, কিন্তু মন বারংবার চাইছিলো দিনটি না আসুক, ক্যালেন্ডার থেকে দিনটি মুছে যাক। এক মুহূর্তের জন্য অরিত্রীর মনে হলো সে পৃথিবীর বাহিরে অন্য কোনো গ্রহে আছে। যেখানে তার কানে কোনো শব্দ পৌঁছায় না, তার দৃষ্টি সীমানায় কোনোকিছু স্পষ্ট দেখায় না… সে থমকে গেলো এবং একসময় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
জ্ঞান ফেরার পর অরিত্রী কাউকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না, প্রতিদিনের মতো নানাভাই-নানুআপুর সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলো। বাড়ির সবাই ঘুমানোর পর ত্রস্ত পায়ে অরিত্রী বাড়ির পেছনের শিউলি গাছতলায় এসে বসলো। ছোটবেলায় নানাভাই তাকে এ গাছটা উপহার দিয়ে বলেছিলেন, “যতোবার তুমি এ গ্রামে আসবে ততোবার এ গাছটা তোমায় কুর্ণিশ করে স্বাগতম জানাবে। পৃথিবীর অন্য কোথাও তুমি রানীর সম্মান না পেলেও এ গাছটার মালিক তুমি, এ গাছটার জন্য তুমিই তার রানী।” এখন শরৎ এর মাঝামাঝি, শিউলি গাছটা আজ ফুলে ফুলে সুবাসিত। অথচ তার সুবাস, মাধুর্য, এই অপরূপ সৌন্দর্যের কিছুই অরিত্রীকে ছুঁতে পারলো না। এমনই এক শরৎ মাসে গতবছর পিথিউশার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিলো, সময় কতো দ্রুত বয়ে যায়… তখনও শরৎকাল ছিলো এখনও শরৎকাল তবে পার্থক্যটা এই তখন পিথিউশার পাশে গুপ্ত পরিচয়ে অরিত্রী ছিলো আর এখন নিজের সত্য পরিচয়ে অতসী আছে! সে সময়টায় অরিত্রী ছিলো সাতরঙ্গা অনুভূতিতে টইটুম্বুর আর আজ যন্ত্রমানবের মতো অনুভূতিশূণ্য…
হাতে ধরা কাঠের বাক্স থেকে একগুচ্ছ শুকনো শিউলি ফুল মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো অরিত্রী। সঙ্গে তার আর পিথিউশার কিছু ছবি, এ ছবিগুলো ওদের বাড়িতে আসার পর তুলেছিলো অমিত। পিথিউশার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাবতীয় সবকিছু মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো অরিত্রী। একের পর এক দিয়াশলাই এর কাঠি জ্বালিয়ে ফেলছিলো সে জিনিসগুলোর মধ্যে… চোখের সামনে জ্বলছিলো কিছু নির্জীব বস্তু কিন্তু বাস্তবে পুঁড়ছিলো অরিত্রীর মন। শোকাহত মানুষের মতো বিলাপ করে সে মাটিতে বসে কাঁদছিলো, একসময় আগুনের ধোঁয়া বাড়ির ভেতরের মানুষগুলোর নিদ্রাভঙ্গ করে। ছুটে আসে তারা, অরিত্রী তখনও কাঁদছে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের অগ্নিশিখার দিকে। তার আর পিথিউশার মাঝে যা ছিলো আজ যে তা অনন্তকালের জন্য চুকে গেলো! আজ থেকে পিথিউশা তার বোনের বর, তার ভগ্নীপতি। নিজের বোনের সংসারে তৃতীয় পক্ষ হতে সে কখনোই যাবে না, পিথিউশাকে নিয়ে তার ভাবনাটাও আজ থেকে নিষিদ্ধ হলো, এ তো পাপ… এ পাপমোচন করতেই তো সে সব স্মৃতি জ্বালালো, তার উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিলো না। তবে এমন মরণ কান্নায় পেলো কেনো তাকে? কেনো এক হৃদয় বিদারক হাহাকারে তার ভেতর বাহির নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে? কেনো মনে হচ্ছে বাঁচার আর কোনো কারনই বাকি রইলো না! কেনো?
অরিত্রীকে একপ্রকার জোর করেই বাড়ির ভেতরে আনা হলো, সে তখনও কাঁদছে। কান্নার দমকে একটু পরপর শরীর কেঁপে উঠছে… সে রাতে মর্জিনা অরিত্রীর পাশে শুলেন। সারারাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো অরিত্রী। অরিত্রী ঘুমানোর পর মর্জিনা নিজের ঘরে গেলেন। মোসাদ্দেক হাওলাদারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“আপনে মিনতিরে কন ছোড নাতিনে যা চায় তাই দিয়া দিতে। বড় নাতিনের জন্য আমরা না হয় ভালো পাত্র খুঁজবো… তাছাড়া আমাদের তো টাকা আছে, আইজকাইল কতো কিরিম আছে দাগ যাওনের… ঠিক ঠিক বড় নাতীনের মুখের দাগ যাইবো গা। বুঝতাছি না, মিনতির বুদ্ধি-সুদ্ধি এতো কমলো কেমনে! এক বইনের পেরেম আরেক বইনেরে দেয় কেউ? অরিত্রীডাও ছাগল, যার জন্য কাইন্দা মরোস তারে কেন দিল দরদী হইয়া বইনরে দিতে গেলি? কইতে পারলি না, আমার ভালোবাসা আমার।”
মোসাদ্দেক হাওলাদারের কপালে চিন্তার ভাজ, মর্জিনার কথা তিনি ফেলতে পারছেন না আবার অতি আদরের কন্যার সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও করতে পারছেন না। মা-বাবার সন্তানকে শাসন করার, তাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার নিঃসন্দেহে আছে তবে সে সন্তান যখন নিজে মা বা বাবা হয়ে যায় তখন কি অধিকার ফলানো খাটে বা তাদের ভুল ধরা সাজে? মোসাদ্দেক হাওলাদার মর্জিনাকে ইশারায় বসতে বললেন, নিজেও নড়েচড়ে বসলেন। দু’বার কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,
-“ছোড নাতিনের লগে যা হইতাছে তা আমারও পছন্দ না তবে মিনতি তো ওর মা… সে তার সন্তানদের ভালো চাইবো। সে তো সব জাইনাই সিদ্ধান্ত নিছে তাই না? মা-বাপ হিসাবে আমাদের উচিত তার উপর ভরসা রাখা, নিজের সন্তানের উপর ভরসা রাখতে না পারলে হইবো?”
-“পোলাডার জইন্য খারাপ লাগে, দুই বইনের মাঝখানে পইড়াতো চ্যাপ্টা হই যাইবো। না পারবো ডানে যাইতে, না পারবো বামে… মাঝখানে কাকতারুয়ার মতো খাড়াই থাকোন লাগবো। এ জন্যই কয়, পোলা মাইনশের বেশি ডকের হওন ভালো না। চৌদ্দ নারীর নজর পড়ে… নজর দোষ বড় দোষ, এই দুই নারীর মাঝখান থেইকা পোলাডারে বাইর করবো কে?”
চলবে…