শিউলিবেলা পর্বঃ১৭

0
1011

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১৭

মোসাদ্দেক হওলাদার বিরক্ত হয়ে বলেন,

-“তুমি নিজের মেয়ে আর নাতিনদের কথা না ভেবে ওই বাইরের ছেলের কথা ভাবতে যাচ্ছো কেনো? ঘরের খেয়ে বনের মশা তাড়ানোর অভ্যাস বাদ দাও তো।”
-“বাদ দিতাম মানে? আমার মাইয়া, আমার দুই নাতিন একটা মানুষরে ঠকাইবো আর আমি চুপচাপ দেখমু আর সইয়া যামু? এমন অধর্ম নিজ চোক্ষে দেইখা মুখে কুলপ আটতে কন আপনে আমারে? এই আপনের তিরিশ বছরের শিক্ষকতার ফল? যার নিজের জ্ঞান সংক্ষিপ্ত সে অন্যরে কোন ঘোড়ার ডিমটা শিখাইবো? নিজের ভালো তো সকলেই বুঝে পরের ভালো কয়জনে বুঝে শুনি? পরের ভালো চায় যে জন, সদা সর্বদা তার ভালো হবে এ তো বাণী চিরন্তন। বুঝছেন?”

মোসাদ্দেক হাওলাদার বিরক্তির চরম পর্যায়ে গেছেন, তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললেন,

-“বুঝলাম, এবার চুপ করে ঘুমাও। পারলে আজ রাতটা অরিত্রীর সঙ্গে থাকো, ওর একা থাকাটা ঠিক মনে হচ্ছে না। আর দয়া করে নিজের অদ্ভুত যুক্তিগুলো দেয়া বন্ধ করো। আমার আর ভালো লাগছে না…”

মর্জিনা আর কথা বাড়ায় না, ধীর পায়ে অরিত্রীর ঘরের দিকে রওনা দেয়… এ মুহূর্তে সে কিছুতেই অরিত্রীকে একা ছাড়তে পারবে না। তার অনেক কষ্টের সন্তান মিনতি, সেই মিনতির মেয়ে অরিত্রী। তাকে কষ্ট পেতে দেখলে তো মর্জিনারও হৃদয় হাহাকার করে… মর্জিনা সারারাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে, আল্লাহর দরবারে আঁচল পেতে অরিত্রীর মানসিক প্রশান্তি কামনা করে, সুখ ও সমৃদ্ধি চায়…

২৩
খোলা জানলা দিয়ে ভোরের আলো প্রবেশ করে অরিত্রীর মুখস্পর্শ করছে… আধো ঘুম, আধো জাগরণে অরিত্রী পাশ ফিরে শুলো। পিটপিট করে চোখ খুলে অরিত্রী দেখলো জানলার কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে পিথিউশা, তার হাতে একগুচ্ছ শিউলি ফুল। প্রশান্তিতে অরিত্রীর মন ভরে গেলো, সে এখন শিউলি ফুলের সুবাস পাচ্ছে, চোখের সামনে পিথিউশাকে দেখতে পাচ্ছে, আর কি চাই! এ যদি স্বপ্ন হয় তবে সে এই স্বপ্নে সারাজীবন থাকতে চায়। যেখানে পিথিউশা তার ভগ্নীপতি নয়, নিজের মানুষ, একান্ত নিজের। যে প্রতিদিন সকালে অরিত্রীর ঘুম ভাঙার জন্য একমুঠো শিউলি ফুল হাতে অপেক্ষা করে…

অরিত্রী সিদ্ধান্ত নিলো সে আর কাঁদবে না, সে তার মনের পিথিউশাকে সারাজীবন ভালোবাসবে, কারন বাস্তবের পিথিউশার চেয়ে তার কল্পনার পিথিউশা অনেক বেশি জীবন্ত এবং আপন।

অরিত্রী হাত-মুখ ধুয়ে বাড়ির পেছনে গেলো, শিউলি গাছতলা ফুলে ফুলে সমাদৃত… অরিত্রী হাত বাড়িয়ে একগুচ্ছ শিউলি ফুল তুলে নিলো। তখন ভোরের নরম আলো বাড়ির ঘাটবাঁধা পুকুরের পানিতে দোল খাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে অরিত্রীর ভারি অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হলো, একটা কলা গাছ থেকে পাতা কেটে সেগুলোকে টুকরো টুকরো করে নিলো। তারপর এই খন্ড খন্ড কলা পাতায় শিউলিগুচ্ছ নিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দিতে লাগলো। ক্ষণিকের মাঝেই পুকুর জুড়ে শিউলি ভাসতে লাগলো, সূর্যরশ্মি সেই শিউলিগুলোকে বারংবার ছুঁয়ে দিচ্ছিলো… অরিত্রীর মনে হলো, এ দৃশ্য পৃথিবী নামক ভূখন্ডের হতেই পারে না। এ দৃশ্য দৈবিক, এ দৃশ্য স্বর্গীয়…

সে মুহূর্তে অরিত্রী নিজের পাশে একটা ছায়ামূর্তি টের পেলো, তার ঠিক পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। ভূতগ্রস্তের মতো অরিত্রী ঘুরে তাকালো, সামনের মানুষটাকে দেখামাত্র সে স্তব্ধ, নির্বাক হয়ে গেলো। মৃগী রোগীর মতো তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগলো… ছুটে এসে তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো পিথিউশা। ছিটকে দু’হাত পিছিয়ে গেলো অরিত্রী। বিড়বিড় করে বললো, “আমাকে স্পর্শ করবেন না, এ পাপ। ঘোর পাপ…” অরিত্রীর কথা পিথিউশার কানে গেলো কি না ঠিক বুঝা গেলো না, সে শেখানো বুলির মতো প্রশ্ন করলো,

-“আমার সঙ্গে যার দেখা হয়েছিলো সে অতসী নয় অরিত্রী এ সত্যটা গোপন করলে কেনো? এটা জানার অধিকার কি আমার ছিলো না?”

মানুষ কোনো অন্যায় করলে সে অন্যায়ের জবাবদিহিও তাকে এই এক জীবনেই করে যেতে হয়। অরিত্রী মনে মনে জানতো, কখনো না কখনো এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে, তবে সে দিনটা যে এতো দ্রুত তার জীবনে আসবে তা জানা ছিলো না তার। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে অরিত্রী বললো,

-“আপনাকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয় নি তাই জানাই নি। তাছাড়া আমি তো মিথ্যা বলি নি, কেবল সত্যটা প্রকাশ করি নি…”

পিথিউশা তার স্বাভাবসুলভ গম্ভীর স্বরে বললো,

-“আমার স্পর্শে যদি পাপ থাকে তবে সত্য লুকানোও তো পাপ।”
-“আমার অন্যায় হয়ে গেছে, ক্ষমা করবেন ভাইয়া।”

পিথিউশা রহস্যময় হাসে, তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা গালে সুন্দর ভাজ পড়ে। আলতো হাতে গাল চুলকে বলে,

-“তোমার ভাইয়া হতে আমার বয়েই গেছে, আমার যে ক্ষতি হলো তার ক্ষতিপূরণ না নিয়ে আমি কোথাও যাবো না, তোমাকেও যেতে দেবো না।”

অরিত্রী কি বুঝলো কে জানে, হাতে ধরা কলাপাতা ফেলে বাড়ির দিকে দৌঁড়ে চলে গেলো। দিগ্বিদিক শূণ্য হয়ে দৌঁড়াচ্ছে অরিত্রী, হঠাৎ ধাক্কায় তার হুঁশ হলো। সামনে মূর্তিমান অতসীকে দেখে ভয়ে ঢোক গিললো সে, এখন যদি অতসী জানে অরিত্রী পিথিউশার সঙ্গে ছিলো এতোক্ষণ তবে নির্ঘাত যা তা বলবে। অতসীকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো অরিত্রী, অতসীই পথ আটকালো। খুব সাবধানি গলায় বললো,

-“বিয়েটা হয় নি অরিত্রী, আমরা একটা মিথ্যা সম্পর্ককে বিয়ে অবধি টেনে নিতে পারি নি।”

মুহূর্তেই অরিত্রীর বুকে চেপে বসা পাথরটা সরে গেলো, যে ভাবনাটাকে কিছুক্ষণ আগেও সে পাপ ভাবছিলো সে ভাবটাকেই এখন তার স্বর্গীয় মনে হতে লাগলো। অতসীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অরিত্রী ছুটে গেলো পুকুর পাড়ে। ঘাটলা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখলো তার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করছে পিথিউশা। মুঠোভর্তি শিউলি ফুল কলাপাতায় নিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে পুকুরের জলে। অতসীর মনে হলো, সামনের মানুষটা কোনো অচিন রাজ্যের রাজপুত্র। যার ভেতর বাহির সবটাতেই মাধুর্যের ছড়াছড়ি। অরিত্রী খুব সাবধানে পিথিউশার পাশে গিয়ে সিঁড়িতে বসলো। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,

-“আপনি যে আপুকে বিয়ে করেন নি সে কথাটা আমায় জানালেন না কেনো?”
-“তোমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয় নি তাই জানাই নি। তাছাড়া আমি তো মিথ্যা বলি নি, কেবল সত্যটা প্রকাশ করি নি…”

অরিত্রীর কিছুক্ষণ আগের কথাটাই তাকে ব্যঙ্গবাণীর মতো করে শোনালো পিথিউশা, তবে তাতে তার বিশেষ কষ্ট হলো না। বরং এ মুহূর্তে তার সুখই হচ্ছে… ওই যে, হারাতে হারাতেও পেয়ে যাবার সুখ, ঠিক তেমন। অরিত্রী মুখ টিপে হেসে আবার প্রশ্ন করলো,

-“যদি সত্যিটা না জানানোরই হবে তবে এতোটা পথ জার্নি করে এলেন কেনো?”

পিথিউশা গমগম স্বরে বললো,

-“একজন আমার অনেক বড় ক্ষতি করে কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছে। আমি আমার ক্ষতির ক্ষতিপূরণ নিতে এসেছি।”

অরিত্রী বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,

-“কি ক্ষতিপূরণ চাই আপনার মহামান্য পিথিউশা?”
-“ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমার একটা রানী আর একজোড়া রাজকন্যা বা রাজপুত্র চাই। যে আমার রাজ্য খালি করে পালিয়ে এসেছে তাকে সারাজীবনের জন্য আমার বন্দিনী বানাতে চাই…”

এবার শব্দ করে হাসে অরিত্রী, পিথিউশার হাত থেকে কলাপাতা নিয়ে তাতে একমুঠো শিউলি ফুল দিয়ে পানিতে ভাসাতে ভাসাতে বলে,

-“এ শিউলিবেলায় কথা দিচ্ছি, আমি আপনার যে ক্ষতি করেছি তার ক্ষতিপূরণ আমার বাকি জীবন দিয়ে দেবো…”

পিথিউশা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করে,

-“শিউলিবেলা!”

অরিত্রী মুচকি হাসে, তার সে হাসির ঝলক চোখে মুখে পড়ে, বেশ ভূমিকা করে বলে,

-“এই যে সকালের নরম রদ্দুর পানিতে ভাসতে থাকা শিউলি ফুলে পড়ছে এ সময়টা কি স্বর্গীয় নয়? এ স্বর্গীয় মুহূর্তের নাম আমি দিলাম শিউলিবেলা। এ স্বর্গীয় মুহূর্তে কথা দিচ্ছি, আমার বাকি জীবনটা আমি আপনার নামে সঁপে দিলাম।”

একটু থেমে দম নেয় অরিত্রী, তারপর শিউলি গাছটার দিকে আঙুল তাক করে বলে,

-“এ গাছটা যেদিন নানাভাই রোপণ করেছিলেন, সেদিন নানাভাই বলেছিলেন আমি এ গাছটার রানী। আমি এ গ্রামে আসলেই এ গাছটা আমায় কুর্ণিশ করবে। আজ, এ মুহূর্ত থেকে আপনি এ গাছটার রাজা, দেখুন না কেমন কুর্ণিশ করে স্বাগতম জানাচ্ছে গাছটা আপনাকে…”

মুচকি হেসে সামনে এগিয়ে যায় পিথিউশা, গাছ তলা থেকে একমুঠো শিউলি ফুল তুলে অরিত্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

-“আজ থেকে তোমার চোখে সুখের অশ্রু ঝরবে অরিত্রী, তোমার দুঃখের অশ্রুরা আজ এই স্বর্গীয় মুহূ্র্তে চির বিদায় নিলো…”

অরিত্রী প্রত্যুত্তরে কিছুই বলতে পারলো না, কেবল হাত বাড়িয়ে শিউলি ফুলগুলো নিলো। তারপর বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলো। পিথিউশা ধীর পায়ে তার পিছু পিছু হাঁটছে, অরিত্রীর ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, এটুকু সুখই তো সে সারাজীবন চেয়েছে… তবে কি বিধাতা তার প্রতি সুপ্রসন্ন? এই যে যা কখনো পাবে না ভেবেছিলো, তা হুট করেই পেয়ে গেলো! জীবনটা এতো সুখের কেনো?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here