শিউলিবেলা পর্বঃ৭

0
506

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ৭

১০
ফটোশ্যুটের সময় সামনে দাঁড়ানো ঈশানকে দেখে বেশ বিরক্ত হলো অতসী, মনে মনে কয়েকটা বাজে গালিও দিলো সে। এই ছেলেটার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় সুখের ছিলো না, আজ আবার কোন ঝামেলা পাকাতে এখানে এসেছে কে জানে! কয়েকটা শট নেবার পরও অতসীর অন্যমনষ্কতার জন্য কাজ আগালো না। অতসীকে শর্ট ব্রেক নিতে বলে ফটোগ্রাফার অন্য কাজে চলে গেলো। ফটোগ্রাফার যাবার পর অতসী উঠে ঈশানের কাছে গেলো, বিরক্তিভাবটা লুকানোর চেষ্টা করে বললো,

-“আপনি এখানে কেনো?”

ঈশান খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে শুরু করলো, অতসীর তখন প্রচণ্ড গা জ্বালা করছে। এমন করে হাসছে কেনো ছেলেটা! অতসীর রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে ঈশান হাসি থামাতে গিয়ে আরেক দফা হেসে ফেললো। চোখ টিপে বললো,

-“টমেটোরও আবার মেকাপ লাগে?”

অতসী ভ্রু কুঁচকে ঈশানের দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে করে জিজ্ঞেস করলো,

-“কি বলতে চাইছেন?”
-“আপনি তো এমনিতেই টমটোর মতো লাল, শুধু শুধু মেকাপ দিয়ে আর্টিফিশিয়াল লাল বানাচ্ছেন কেনো নিজেকে?”

তারপর আবার আফসোস করে বললো,

-“হায়, বাঙালী জাতি… বুঝলেন, এটাই বাঙালী জাতির দোষ। ভালো জিনিসকে ফরমালিন দিয়ে আরো ভালো বানানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জিনিসটা ভালোর বদলে হয় মন্দ, মহা মন্দ…”

অতসী নিজের রাগ সংবরণ করার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো, কিছুটা চিৎকার করে বললো,

-“আপনার মতো নমুনা এ বাংলায় আছে বলেই বাংলাদেশের এ দশা… বাঙালীর নিন্দা করছেন, আপনি কি ফরাসি নাকি? নিজেকে কি ভাবেন হুঁ? রাজা-মহারাজা? একা আপনি সঠিক আর দুনিয়ার সব মানুষ ভুল? সবাই আসতে যেতে আপনাকে কুর্ণিশ করবে আর বলবে, “জাহাপনা, আমাদের অন্যায় ক্ষমা করুন!” এমন কিছু আশা করেন আপনি?”

অতসীর হঠাৎ চিৎকারে ঈশান কিছুটা ভঁড়কে গেলো, তার কাঁচুমাচু চেহারা দেখে আনন্দ হচ্ছে অতসীর… হাসি সংবরন করে চেহারায় গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,

-“সত্যি করে বলুন তো, কি চাই আপনার? আমার পেছনে পড়েছেন কেনো?”

অতসী ভেবেছিলো ঈশান তাকে নিজের ভালোবাসার কথা বলবে, তার কাছে এসব ব্যাপার নতুন নয়। আগেও এমন অনেকেই প্রথম দেখায় তার প্রেমে পড়ে গেছে। সে খুব দক্ষতার সঙ্গে এ জাতীয় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে জানে। ঈশান প্রেম প্রস্তাব দিলে তা কি করে নাকচ করবে তাও মনে মনে এক প্রকার ঠিক করে নিলো অতসী। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ঈশান হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো, মিনমিন করে বললো,

-“আপনি আমার ভাবী হবেন?”

বিষম খেলো অতসী, তার ফ্যাকাশে চেহারা দেখে মনে হলো এমন অদ্ভুত কথা সে শোনে নি বহু বছর। কিছু একটা বলতে গিয়ে দেখলো বিস্ময়ে তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, কোনোরকমে নিজেকে সামলে বললো,

-“আমার ব্রেক শেষ, আমি ব্যস্ত। আপনার সঙ্গে পরে এ নিয়ে কথা বলবো।”

কথাটা বলে আর দাঁড়ালো না অতসী, পেছন ঘুরে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো। যেতে যেতে হঠাৎ তার মনে হলো পরে কি কথা বলবে সে? আসলেই কি বলার মতো কিছু আছে! প্রথমবারের মতো তাকে কেউ প্রেম প্রস্তাব না দিয়ে নিজের বাড়ির বউ করবার প্রস্তাব দিয়েছে, কেনো? একজন মডেলকেও কেউ বাড়ির বউ করার কথা ভাবতে পারে! ঈশানকে কিছুক্ষণ আগেও একজন বিরক্তিকর মানুষ মনে হলেও এখন তাকে নিখাদ ভালো মানুষ মনে হচ্ছে অতসীর। না, ছেলেটাকে তার জানতে হবে। যে মানুষগুলো সাধারণের মাঝে থেকেও অসাধারণ হয় তাদের জানতে ও বুঝতে ভালো লাগে অতসীর, মনের মাঝে ঈশানকে কাছ থেকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করছে অতসী…

১১
মঈনুল হক আজ আশ্রমে আসার সময় পিথিউশাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের প্রতি পিথিউশার গভীর টান তিনি বরাবরই উপলব্ধি করেছেন, তার অবর্তমানে এ আশ্রমের মানুষগুলোকে সাহায্য করবার দায়িত্ব তিনি পিথিউশার উপর ন্যস্ত করতে চান। তাই এখন থেকেই ছেলেকে এখানকার পরিবেশ ও মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আশ্রমের চারপাশ নিজে ঘুরিয়ে দেখালেন তিনি পিথিউশাকে, ফান্ডের ব্যাপারটাও বুঝিয়ে দিলেন, যাবার সময় পিথিউশা গাড়ীতে উঠতে নিলে বললেন,

-“তুমি কোথায় যাচ্ছ? এখানে থাকো, মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচিত হও, একাত্মতা বাড়াও। তুমি এমনিতেও মানুষের সঙ্গে কম মেলামেশা করো, ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না। অতীত ভুলে যাও পিথিউশা, তুমি, তোমার পরিবার, তোমার বর্তমান এটাই তোমার সত্য। অতীতকে তোমার অর্ধাঙ্গিনীর জন্য তুলে রাখো, একমাত্র তার সামনেই উন্মোচিত করো তোমার অতীত নামক লুকানো সত্যের… তার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি এবং তোমার বর্তমানই তোমার জীবনের ধ্রুব সত্য।”

মঈনুল হকের কথা শুনতে পিথিউশার ভালো লাগে, মানুষটার কথা শুনে চলেছিলো বলে তার জীবনের কঠিন সময় খুব সহজেই পার করতে পেরেছিলো সে। আজও অন্যদের সঙ্গে মিশতে কষ্ট হয় তার, নিজেকে ভীষণ আলাদা মনে হয়। কিন্তু এ মানুষটা তাকে বারংবার বুঝিয়ে দেয়, সে আলাদা নয়। সে এদের মতোই সাধারণ মানুষ। শ্রদ্ধা করে সে তার পিতাকে, তবে পিতা হিসেবে নয় বন্ধু হিসেবে। পিথিউশা বিড়বিড় করে বলে, “বাবা নামক বন্ধুর বন্ধুত্বর সামনে পৃথিবীর সকল বন্ধুত্ব বড্ড ফিকে লাগে।” আশ্রমের ভেতরে পা বাড়ায় পিথিউশা, পূর্ব দিক থেকে বাচ্চাদের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে, হাসির শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে যায় সে। বিস্ময়, মুগ্ধতা, স্নিগ্ধতা সকল অনুভূতি একবারে এসে ভর করে তার উপর। অরিত্রীকে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে দেখে পিথিউশা বিড়বিড় করে বলে, “অতসী, তোমার আর কতো রূপ দেখবো!” এগিয়ে যায় পিথিউশা, অরিত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“আপনার সঙ্গে আবারও দেখা হয়ে গেলো অতসী।”

পিথিউশাকে অরিত্রী চেনে, কিছুক্ষণ আগেই জেবুন্নেসার কাছে মঈনুল হক আর পিথিউশার ব্যাপারে শুনেছে সে। লোকটা তাকে দেখে অতসীর নাম নিয়েছে মানে লোকটা অতসীকে চেনে, যেহেতু পিথিউশা আশ্রমের ফান্ডের ব্যাপারে সাহায্য করবে সেহেতু নিজের পরিচয় দিয়ে আশ্রমের প্রতি লোকটার আগ্রহ কমালো না সে। নিজের পরিচয় গোপন রাখতে ক্ষীণস্বরে বললো,

-“আমাকে আশ্রমে অতসী ডাকবেন না, এখানে সবাই আমাকে অরিত্রী বলে ডাকে, আপনিও তা’ই ডাকবেন। তাছাড়া সেলিব্রেটিদের আসল পরিচয় বাইরে দিলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় না।”

কথাটা ভালো লাগলো পিথিউশার, মেহেদী রঙের শাড়ী পরা অরিত্রীকে ভালো লাগছে তার। আগের দিনের গাউন পরা গ্লামারাস অতসীর তুলনায় আজকের অতসী তার চোখে অপরূপা। কিন্তু সে জানেও না, সে দুটো ভিন্ন মানুষের সঙ্গে ভিন্ন সময়ে কথা বলছে। এই ভুল বোঝাবুঝির শেষ কোথায়?

বাড়ি ফিরে পিথিউশার মনে হলো, অতসী একই শরীরে দুটো ভিন্ন জীবন যাপন করছে। বাহিরে সে মমতাময়ী আর কর্মক্ষেত্রে সে অভিনেত্রী। বাহিরে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখার কি নিখুঁত চেষ্টা তার, অথচ আশ্রমে তাকে দেখে মনে হলো সে নিজের জীবন নিয়ে কতোই না সন্তুষ্ট! আজকে অতসীকে দেখে পিথিউশা নিশ্চিত যে তার অর্ধাঙ্গিনী হবার যোগ্যতা কেবল অতসীরই আছে। শাড়ী পরা, খোলা চুলের বউ বউ অতসীকেই সে চায়… গাউন পরা, মুখে মেকি হাসি আঁকা অতসীকে তার চাই না। সে চায় সত্য অতসীকে, যে অচেনা-অজানা মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তৃপ্ত হয়, যে মুখে রঙ মেখে সং সাজে না, প্রকৃতি যার রূপের আয়না তাকে নকল সাজে মানায় না। সে তার প্রাকৃতিক রূপেই অপরূপা!

অন্যদিকে অরিত্রীর মনটা খচখচ করছে, পিথিউশার কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখায় তার মন ছটফট করছে। মিথ্যা পরিচয়, মিথ্যা জীবন সে চায় না। অতসীর প্রতি পিথিউশার আগ্রহ আছে তা প্রথম দেখাতেই বুঝেছে অরিত্রী, আশ্রমে তাকে অতসী ভেবেই হয়তো পিথিউশা আশ্রমের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। পিথিউশা যদি জানে সে অতসী নয়, সামান্য কেউ তবে কি পিথিউশা আশ্রমের প্রতি জন্মানো আগ্রহ হারাবে না! পিথিউশাকে সত্য জানাবে ভেবেও সিদ্ধান্ত বদলালো অরিত্রী, সে তো আর নিজে থেকে পিথিউশাকে মিথ্যে পরিচয় দেয় নি, সে কেবল সত্য জানায় নি। একটা মিথ্যার জন্য যদি আশ্রমের এতোগুলো মানুষের ভালো হয় তবে হোক না। তার তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না… মানুষের একটা অদ্ভুত গুণ হলো, সে কোনো ভুল করলে তাকে শোধরানোর পরিবর্তে তাকে সঠিক প্রমান করার জন্য একের পর এক যুক্তি দাঁড় করাতে থাকে। অরিত্রীর ক্ষেত্রেও ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। তার অবচেতন মন জানে সে ভুল করছে, কিন্তু তার জাগ্রত মন তাকে বলছে সে যা করছে ঠিক করছে, আশ্রমের ভালোর জন্য করছে। ওই মানুষটার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, এ মিথ্যা তার বা পিথিউশার জন্য কোনো ক্ষতি বয়ে আনবে না। অথচ নিয়তির খেলা সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন সে, অরিত্রী ধারনা নেই তার ভবিষ্যত জীবন কোন দিকে মোড় নিবে…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here