শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ৪
অরিত্রী আর কথা বাড়ায় না, নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তার মাঝে মাঝে নিজেকে দেখে অবাক লাগে, মনে হয় আসলেই সে এ পরিবারেরই তো! পরিবারের কারো মাঝেই অন্যকে সাহায্য করার প্রবণতা খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না, অথচ অরিত্রীর কেবল অন্যের জন্য মন কাঁদে। ফোনের রিংটোনে ভাবনাচ্ছেদ ঘটে অরিত্রীর, স্ক্রিনে আয়ান নামটার দিকে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একসময় বাড়ির সবার আড়ালে গিয়ে কলটা রিসিভ করে…
কল রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে অরিত্রীই প্রথমে বলে,
-“আয়ান, কল করলে কেনো? আমি বাসায় থাকাবস্থায় কল করতে মানা করেছিলাম না?”
আয়ান কিছুটা বিব্রতভাবে বললো,
-“না পারতে কল করেছি অরিত্রী, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। তোমার সাহায্য লাগবে…”
কিছুটা শঙ্কা ও বিরক্তি নিয়েই অরিত্রী বললো,
-“আমি কিছুক্ষণ পর স্কুলে যাবার জন্য বের হবো, গলির মোড়ে দেখা করো। এখন দয়া করে ফোন রাখো…”
আয়ানকে আর কিছু না বলতে দিয়ে কলটা কেটে দিলো অরিত্রী, কল কেটে পেছন ফিরতেই অতসীকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে দু’পা পেছনে চলে গেলো সে। অতসী গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলো,
-“তোকে কতোবার বলেছি, আয়ানের থেকে দূরে থাকতে? ওর সঙ্গে কথা না বলতে? আর কোন ভাষায় বললে কথাটা তোর কানে যাবে? শোন, অন্যের উচ্ছিষ্ট কুঁড়ানোর অভ্যাস বাদ দে বুঝলি। দিন দিন মানুষের উন্নতি হয় আর তোর হচ্ছে অবনতি… রিডিকুলাস!”
অতসীর কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না অরিত্রী, কেবল তার শুভ্র মুখখানায় মেদুর ছায়া পড়ে। নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়ে অরিত্রী, গলির মোড়ে আয়ানকে দেখে মন খারাপের মেঘটা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“কেমন আছো? হঠাৎ এমন জরুরি তলব?”
মুচকি হাসে আয়ান, উষ্কখুষ্ক চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করে বলে,
-“না মানে মায়ের শরীরটা আবার খারাপ করেছে। হাতে যা টাকা ছিলো ডাক্তার দেখিয়ে তা শেষ, ঔষধ কিনতে টাকা লাগতো।”
প্রথম কথাগুলো স্বাভাবিকভাবে বললেও শেষ কথাটা বলার সময় আয়ানের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে এসেছিলো। অরিত্রী হয়তো বুঝলো, আয়ানের লজ্জা করছে… তাই কোনো উচ্চবাচ্য না করেই পার্স থেকে এক হাজার টাকার দু’টো নোট আয়ানের বুকপকেটে গুঁজে দিলো। তারপর বললো,
-“শুধু ঔষধে অসুখ সারে না, সঙ্গে ভালো খাবারও লাগে। আপাতত এটা রাখো, পরে লাগলে বলবে। আপন মানুষের কাছে কোনো সংকোচ রাখতে নেই বুঝলে?”
নতুন করে আর কিছুই বলতে পারলো না আয়ান, ধন্যবাদও দিতে পারলো না। কেবল বোকা বোকা দৃষ্টিতে অরিত্রীর চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। এ চেহারাটা দেখলে তার ভেতরটা খরার মাঠের মতো খাঁ খাঁ করে। অথচ বারংবার নিজের অপারগতার জন্য এ চেহারাটা দেখতে হয়… সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে আয়ান শ্রদ্ধা করে, পরম বন্ধু মনে করে তবুও তার চেহারাটা দেখতে চায় না। কারন চেহারাটা দেখলেই যে মনের মাঝে দাগ কেটে যাওয়া অতীতের ক্ষতটা মাথানাড়া দিয়ে ওঠে! আয়ানকে চুপ থাকতে দেখে অরিত্রী বললো,
-“তুমি তবে যাও, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
ভদ্রতাসূচকভাবে আয়ান জিজ্ঞেস করলো,
-“আমি একটা রিকশা ডেকে দেই?”
অরিত্রী মুচকি হেসে বললো,
-“তুমি দ্রুত বাসায় যাও, অসুস্থ অবস্থায় আন্টির একা থাকা ঠিক না। আমি রিকশা খুঁজে নেবো।”
আয়ান আর জোর করে না, এ মুহূর্তে তার ভেতরকার অতীতের ক্ষতটা মন ও মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ছে। একে আর বাড়তে দেয়া যায় না… পেছন ফিরে দ্রুত হাঁটা শুরু করলো আয়ান। আয়ানের যাবার পথে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিলো অরিত্রী, যখন ও চোখের আড়াল হলো তখন অরিত্রী স্বগতোক্তি করলো, “চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়, কথাটা সবসময় ঠিক নয়!”
৫
“তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্যগগনবিহারী।
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা-
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীম গগনবিহারী॥”
শরীরচর্চা করার সময় রবীন্দ্র সংগীতের পঙ্কতিমালা গুনগুন করছিলো পিথিউশা, ঈশানের আগমনে না চাইতেও থামতে হলো তাকে। তবে শেষ রক্ষা হলো না, ঈশান এসেই টিপ্পনী কেটে বললো,
-“ভাইয়া, বুঝলি আজকাল শরীরচর্চার সময়ও প্রেমের গান আসে… কি দিনকাল পড়লো তাই না?”
পিথিউশা চোখ পাঁকিয়ে তাকালো ঈশানের দিকে, তারপর গম্ভীরস্বরে বললো,
-“আজকাল যেমন চারদিকে প্রেমের গান বাজছে তেমনি হাত-পাও খুব বেশি নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে যাচ্ছে। এই ধর এখন যদি তোর নাক বরাবর একটা ঘুষি পড়ে বা কোমর বরাবর একটা লাথি পড়ে তবে কিন্তু আমাকে দোষ দিস না। আসলে দিনকাল বদলেছে তো, কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না!”
ঈশানের হাসি মুখটা মুহূর্তে চুপসে গেলো, আমতা আমতা করে বললো,
-“আম…মি তো একটা সুখবর দিতে এসেছিলাম ভাইয়া। আমার বন্ধু মিশাল আছে না? ওই যে, যার বাবার নিজের গার্মেন্টস আছে…”
-“তো?”
-“ওর গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিন আগামী বুধবার, তোকে বিশেষভাবে আমন্ত্রন জানিয়েছে। তুই কি যাবি আমার সঙ্গে?”
পিথিউশার মুখটা থমথমে হয়ে গেলো, ভরাট গলায় বললো,
-“ফ্রি ফটোশুট করার জন্য?”
-“না… কিসের ফ্রি ফটোশুট? এমন কিছু হলে কি আমি তোকে যেতে বলতাম নাকি? তুই কি এতো সস্তা নাকি? আসলে তোর অতসীর সঙ্গে মিশালের গার্লফ্রেন্ড বৈশাখীর ভালো বন্ধুত্ব আছে। তাই ভাবলাম যদি এই সুযোগে তোদের দ্বিতীয় দেখাটা…”
ঈশানকে কথা শেষ করতে না দিয়েই পিথিউশা বললো,
-“যাবার আগে আমাকে সময়টা জানিয়ে দিস।”
কথাটা বলেই তোয়ালে হাতে রুমের ভেতরে চলে গেলো পিথিউশা। ঈশান হো হো শব্দে ডাকাতিয়া হাসি হেসে চিৎকার করে বললো,
-“তোকে রাজি করার মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে গেছি ভাইয়া, এ মেয়েকে আমি নিশ্চিত ভাবী বানাবো দেখিস…”
পানির গ্লাসটা হাতে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো পিথিউশা, ঈশানের কথাটা তার মনে ধরেছে। মুচকি হেসে পিথিউশা স্বগতোক্তি করলো, “সুখ ফেরিওয়ালী, আমাদের দ্বিতীয় দেখাটা কেমন হবে বলো তো?” পিথিউশার মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগে, অতসীর সঙ্গে দেখা হবার পর তার প্রথম কথা কি হবে? কি বলবে সে? কি পোশাকে নিজেকে অতসীর সামনে উপস্থাপন করবে সে? ঠিক কি করলে অতসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে! আহা, কবে আসবে সেই বহু প্রতিক্ষীত মাহেন্দ্রক্ষণ! কবে, কবে, কবে?
অনেক জল্পনা কল্পনার পর অবশেষে সে বহু প্রতিক্ষীত মাহেন্দ্রক্ষণ এলো, পিথিউশা তার প্রিয়তমার দেখা পেল। আজ অতসী একটা সি-গ্রীন রঙের স্লিভলেস গাউন পরেছে। পিথিউশার কাছে অতসীকে প্রথমদিনের মতো আকর্ষণীয় মনে না হলেও মন্দ লাগলো না। তবে গায়ে পড়ে কথা বলা তার স্বভাববিরুদ্ধ হওয়ায় নিজ থেকে কথা বলা হলো না। প্রথম কথা বললো অতসী নিজে! একটা জুসের গ্লাস পিথিউশার দিকে এগিয়ে দিয়ে কোনো প্রকার ভণিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
-“বৈশাখীর কাছে শুনলাম আপনি খুব ভালো মানের ফটোজার্নালিস্ট, সাংবাদিক পাড়ায় নাকি বেশ নাম ডাক আছে আপনার?”
পিথিউশা হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে গমগম স্বরে বললো,
-“ভুল কিছু শুনেন নি, একটু নামডাক আছে বটে। কিন্তু এই বৈশাখীটা কে?”
অতসী মুচকি হাসলো, তারপর জুসের গ্লাসে আয়েশ করে চুমুক দিলো। হাসির ছটা তখনও তার ঠোঁটের কোনায় বিদ্যমান। বললো,
-“যার জন্মদিনে আসলেন তার নামটাই ভুলে গেলেন? আপনি কার দিকের গেস্ট বলুন তো? মেয়ের দিকের নাকি ছেলের দিকের?”
পিথিউশা বেশ বিব্রতবোধ করলো, ইতস্তত করে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য প্রশ্ন করলো,
-“জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ছেলের দিক, মেয়ের দিক আসছে কেনো!”
আবারও ঠোঁট টিপে হাসলো অতসী, পিথিউশার বোকামি দেখে তার পৃথিবী কাঁপিয়ে হাসতে মন চাচ্ছে। কিন্তু নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য আজকাল অনেক ইচ্ছেকে মনেই দাফন করতে হয় তার। নিজেকে সামলে কোনোরকমে বললো,
-“কখনো কাউকে নিজের প্রেমিকার জন্মদিন এতো ঘটা করে পালন করতে দেখেছেন?”
পিথিউশা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে না বললো, অতসী আবার বললো,
-“নিজ স্বার্থ ছাড়া কখনো কেউ কিছু করে না। বৈশাখীর স্বপ্ন অনেক বড় ডিজাইনার হওয়া, ও প্যারিসে যাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু মিশাল এ মুহূর্তে বিয়ে করে ওকে নিজের সাথে বেঁধে ফেলতে চাইছে। আজকের এই আয়োজন বৈশাখীকে বেঁধে ফেলার জন্য, কারন মিশাল জানে সবার সামনে বিয়ের প্রস্তাব দিলে বৈশাখী না বলবে না। বৈশাখী ওকে ভীষণ ভালোবাসে, আর সে ভালোবাসার সুযোগটাই মিশাল নিচ্ছে। মেয়েটা আজ বুঝতে পারছে না, যখন বুঝবে তখন নিজের স্বপ্ন হারিয়ে নিঃস্ব হবে।”
পিথিউশা মুচকি হেসে প্রশ্ন করলো,
-“এটাকে কি আমি পুরুষ বিদ্বেষ হিসেবে ধরে নেবো ম্যাডাম?”
-“এটা বাস্তবতা, কোনো বিদ্বেষ নয়। আজকাল মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে, সবার কেবল অপরকে বেঁধে ফেলার চিন্তা। সত্যিকারের ভালোবাসা বন্দির স্বাদ নয়, মুক্তির স্বাদ দেয়।”
পিথিউশা মুচকি হেসে কৌতুকের সুরে বললো,
-“তা আপনিও বুঝি কাউকে বেঁধে ফেলতে চান?”
অতসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মুখভাব স্বাভাবিক রেখে বলে,
-“না কাউকে বাঁধতে চাই, না কারো বন্ধনে বাঁধা পড়তে চাই। আমি নিজেকে নিয়েই সুখে আছি।”
চলবে…