শিউলিবেলা পর্বঃ ৫

0
538

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ৫

-“সুখ বড় আপেক্ষিক ম্যাডাম, এতো সহজে সুখে আছি বলবেন না। দেখা গেলো শেষমেশ নিজের কথায় নিজেই স্ট্যান্ড করতে পারছেন না…”

কথাটা বলে এক চুমুকে হাতের গ্লাসের পুরোটা জুস শেষ করে খালি গ্লাসটা অতসীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে পিথিউশা আবার বললো,

-“জীবনটাকে এতো কঠিন করে ভাববেন না ম্যাডাম, জীবন বড়ই সুন্দর। একটু উপভোগ করার চেষ্টা করেই দেখুন না…”

কথাটা বলে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো পিথিউশা, বিড়বিড় করে বললো, “আপনার সঙ্গে বাক্যালাপ আমার দীর্ঘদিন মনে থাকবে।” পিথিউশার প্রস্থানের পর অতসীর মনে হলো, দীর্ঘ অনেক বছর পর সে প্রথমবারের মতো এতোটা সময় নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু… মানুষটা কি তাকে চেনে! যদি চেনে তবে নিজে থেকে কথা বললো না কেনো? আর যদি না চেনে তবে নাম জানতে চাইলো না কেনো? তাছাড়া লোকটা ছেলে পক্ষের না মেয়ে পক্ষের সে প্রশ্নটাও কৌশলে এড়িয়ে গেছে। অতসী আপনমনে বিড়বিড় করলো, “এমন অদ্ভুতও মানুষ হয়! কেমন যেনো…”

আনমনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কারো সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে গেলো অতসী, একটা চেয়ারের কোনায় লেগে তার গাউনের একটা কোনা ছিঁড়ে গেলো, রাগে বিরক্তিতে সামনে তাকাতেই ঈশান তার ক্যাবলাকান্ত হাসিটা দিলো। তার হাসি দেখে অতসীর রাগ তখন আকাশচুম্বি, কোনোমতে দাঁড়িয়ে সামনের টেবিলের ওপর থেকে এক গ্লাস পানি ঈশানের গায়ে ছুঁড়ে মারলো সে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা ভড়কে গেল ঈশান, আধভেজা চুলগুলোকে হাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বললো,

-“এমন রেগে যাচ্ছেন কেনো আপনি? রাগ তো আমার করার কথা, বিনাদোষে কাকভেজা হলাম! দোষটা কিন্তু আপনার ছিলো…”

অতসী চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

-“আমার এতো দামী গাউনটা আপনার কারনে ছিঁড়ে গেলো, আর আপনি বলছেন বিনাদোষে হাঙ্গামা করছি আমি? এই পার্টিতে এখন আমার ছেঁড়া জামা পরে ঘুরতে হবে, ব্যাপারটা আমার জন্য কতোটা লজ্জার বুঝতে পারছেন?”

ইশান কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভাবলো, তারপর অতসীর গাউনের ছেঁড়া কোনাটা হাতে তুলে বললো,

-“আরে এ তেমন কিছু না, রাস্তায় হাঁটার সময় আমার টি-শার্ট কতোবার এমন করে ছিঁড়েছে… তারপরও কিন্তু আমি সেই টি-শার্ট পরেছি। আপনি হাঁটলে তো এটুকু ছেঁড়া কারো চোখেই পড়বে না। আরে ছেঁড়া জামা পরায় একটা রাজা রাজা ভাব আছে বুঝলেন? সবাইকে দেখাবেন, আপনার সামর্থ্য আছে তাও আপনি ছেঁড়া জামা পরছেন। কারন আপনি এটুকু ছেঁড়ার জন্য জামাটা ফেলে দেন নি, আপনি বিলাশবহুল জীবন যাপন করেন না, আপনি মিতব্যয়ী। আপনাকে সবাই তখন অন্যচোখে দেখবে, ভাববে…”

ঈশানকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো অতসী। বিড়বিড় করে বললো, “বাসায় অরিত্রীর সমাজসেবা আর বাহিরে এ ছেলের মিতব্যয়ীতা… আজকের দিনটা এতো জঘন্য কেনো!”


আশ্রমের বাচ্চাদের ছড়া পড়াচ্ছে অরিত্রী, তার মুক্তোদানার মতো সাদা দাঁতগুলো বের করে হাসছে অনবরত। দূর থেকে দাঁড়িয়ে এক মধ্য বয়স্ক লোক সে দৃশ্য দেখছে। আশ্রমের দেখাশুনা করেন জেবুন্নেসা বেগম নামের এক মহিলা, মধ্য বয়স্ক লোকটার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

-“হক সাহেব, এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন?”

হাতের ইশারায় অরিত্রীকে দেখিয়ে মঈনুল হক বললেন,

-“মেয়েটা ভারি মিষ্টি তো, কি সুন্দর বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে নিজেও বাচ্চা হয়ে গেছে। আগে কখনো আশ্রমে দেখি নি তো, নতুন নতুন আসছে নাকি?”
-“না, না… নতুন না। প্রায়ই আসে, এদিকেরই একটা হাইস্কুলে চাকরি করে। প্রায়ই স্কুলের পর এখানে এসে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করে, বুড়ো মানুষগুলোর সঙ্গে গল্প করে। বাচ্চা বুড়ো সকলেই ওকে চোখে হারায়…”
-“তাই নাকি!”

মুচকি হাসলেন মঈনুল হক, ছোট ছেলেটার জন্য তিনি তো এমন প্রাঞ্জল মেয়েই খুঁজছেন। বড় ছেলেটাকে নিয়ে তার ভাবনার কারন নেই, সে সব দিক দিয়েই পরিপক্ক। কিন্তু ছোটটা তো ছন্নছাড়া, তার জন্য এই মেয়েটির মতো সুবোধ বালিকা হলে মন্দ হয় না। জেবুন্নেসার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“মেয়েটার সঙ্গে পরে একদিন আলাপ করিয়ে দেবেন আপা, এখন চলুন ডোনেশনের ব্যাপারে কথা বলা যাক। আজ আবার আমার একটু তাড়া আছে…”

জেবুন্নেসা অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, মেয়েটাকে দেখলে তার নিজের পাঁচ বছরের মেয়ে অবনীর কথা মনে পড়ে। মেয়েটা ওই বয়সে এক নরপশুর পৈচাশিকতার স্বীকার হয়েছিলো। বিয়ের দুই বছর পর স্বামী মারা যায় জেবুন্নেসার, তারপর ওই অবনীই ছিলো তার একমাত্র সম্বল। কিন্তু তাকেও অকালে হারাতে হয়। ঠিক সে সময় আল্লাহর পাঠানো দূত এর মতো মঈনুল হকের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। আশ্রয়হীন জেবুন্নেসাকে তিনি এ আশ্রমে এনে চাকুরি দেন। প্রথম প্রথম জেবুন্নেসার মরে যেতে ইচ্ছা করতো, মনে হতো কি লাভ এই জীবন রেখে! কিন্তু এখানে আসার পর মনে হলো আল্লাহ তার কাছ থেকে তার নির্ধারিত ভালোবাসার মানুষগুলোকে কেড়ে নিয়ে তার বিনিময়ে এক আকাশ সমান ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন। সত্যিই সৃষ্টিকর্তা মহান, তাইতো তার পরিকল্পনা আমাদের স্বল্প মস্তিষ্কে ধরা দেয় না। আজ অবনী বেঁচে থাকলে অরিত্রীর বয়সেরই হতো, তাইতো মেয়েটাকে দেখলে জেবুন্নেসার চোখদুটো ভিজে ওঠে। মন চায় কাছে টেনে গালে হাত রাখতে, কপালে চুমু খেতে, গভীর মমতায় আলিঙ্গন করতে। কিন্তু মনের বাসনা মনেই চাপা পড়ে যায়, সব ইচ্ছেকে তো আর আশকারা দেয়া যায় না…


বসার ঘরের টেবিলের উপর এক ঝুড়ি নেতিয়ে পড়া শিউলি ফুল দেখে মুখটা মলিন হয়ে গেলো অরিত্রীর। ঝুড়িটা হাতে নিয়ে অমিতের ঘরে উঁকি দিলো সে, দরজায় দু’বার টোকা দিয়ে মুচকি হেসে বললো,

-“এই ফুল কে দিলো রে অমিত?”

অমিত হতাশ ভঙ্গিতে বললো,

-“এসব তোর জন্য না, বড়পুর জন্য। সকালে কেউ একজন দরজার বাহিরে রেখে গেছে। চিরকুটও আছে দেখ…”

অরিত্রী ঝুড়িটা হাতড়ে একটা সবুজ রঙের চিরকুট পেলো। চিরকুটটায় লেখা, “আপনার সৌন্দর্যে নয়, আপনার চারিত্রিক গুণে মুগ্ধ আমি… শরৎের প্রথম শিউলি দিয়ে আপনাকে সম্ভাষণ জানালাম।” লেখাটা পড়ে অরিত্রী মুচকি হাসলো, অমিতকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,

-“কাল দিলে ফুলগুলো ফ্রিজে রেখে দিস তো, আমি আসা অবধি যদি তাজা থাকে…”

অমিত বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

-“বড়পুর ফুল তুই নিয়ে কি করবি?”
-“আপুর ফুল নিলে ক্ষতি কি? তুই জানিস না, শিউলি ফুল আমার কতো প্রিয়? আচ্ছা, যে ফুল পাঠালো সে তার নাম লিখলো না কেনো বলতো?”

চিরকুটটা আবারো উল্টেপাল্টে দেখলো অরিত্রী, অমিত একটা অংক করতে করতে বললো,

-“সিক্রেট এডমায়ারার… নাম লিখলে তো পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যাবে।”

অরিত্রী আর কিছু বলে না, মুখ ভার করে বাসি ফুলের ঝুড়িটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সে রাতে অরিত্রী চোখের পাতা এক করতে পারলো না, বারংবার মনে হলো, কে এই ফুল প্রেরক? কি তার পরিচয়? অরিত্রীর সঙ্গে কি করে মানুষটার পছন্দ মিলে গেলো! অরিত্রী ভেবেছিলো, সে তার ভালোবাসার মানুষকে শিউলি ফুল দিয়ে ভালোবাসার কথা জানাবে… কিন্তু তার আগেই তো কেউ একই নিয়ম ব্যবহার করে ফেললো। কে এই অচেনা প্রেরক? যার চিন্তা-চেতনায় অরিত্রীর ভাবনার ছাপ আছে!

ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির পেছনের শিউলি গাছটার নিচে গেলো অরিত্রী। গাছতলায় চাদর বিছিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে ছিলো সে, হঠাৎ বাইকের শব্দে তার ধ্যান ভাঙ্গে। যেদিক থেকে শব্দ আসছে সেদিকে ছুটে যায়, দেখে কেউ একজন বাইক চালিয়ে চলে যাচ্ছে। চেহারাটা দেখা হয় না অরিত্রীর, তবে গেটের সামনে এক ঝুড়ি শিউলি ফুল দেখে মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। অজ্ঞাত লোকটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে ওঠে। অরিত্রী পেয়েছে, এ বছরের প্রথম সদ্য ফোটা শিউলি ফুলের দেখা পেয়েছে। আজও ঝুড়িতে একটা চিরকুট পেলো অরিত্রী। তাতে লেখা, “অতসী, প্রথম দেখায় মনের আদান-প্রদান হওয়া কি সম্ভব? আপনার খবর জানি না, তবে আমার মনে আপনার জন্য একটা কুটির গড়ে উঠেছে। এ কুটিরের স্থানটা বিশেষ, এ স্থানে আপনি ব্যাতীত অন্য কারো জায়গা হবে না।” হঠাৎই অরিত্রীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো, যে ফুল আর চিরকুট তাকে গতরাত ঘুমাতে দেয় নি, আজ সকালে ব্যকুল করে তুলেছে তার কিছুই তার জন্য নয়… সবটা অতসীর! প্রথমবারের মতো অতসীকে হিংসে হলো অরিত্রীর, কেনো অন্য সবার মতো এই মানুষটাও অতসীতে মত্ত হলো? কেনো কেউ অরিত্রীকে দেখে না? কেনো সবাই অতসীর গুণমুগ্ধ? কেনো, কেনো, কেনো?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here