#শুকতারা (পর্ব-১৫)
#হালিমা রহমান
হুমায়রার টিয়া পাখির নাম মানিক। হুমায়রার ছোট টিনের ঘরে ঢুকলেই সবার আগে চোখ যায় মানিকের উপর।মাঝারি আকারের লোহার খাঁচার ভিতর চুপচাপ বসে থাকে পাখিটা।খুঁটির সাথে খাঁচাটা ঝুলিয়ে রাখে হুমায়রা। এখানে রাখলে সহজেই নজর রাখা যায় মানিকের উপর।রান্নাঘরে বসলেও দেখা যায়। সবুজ দেহের ছোট্ট পাখিটাকে সন্তানের মতোই ভালোবাসে হুমায়রা। এই ঘর নামের নির্জন দ্বীপের একমাত্র সঙ্গী সে। মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে মানিককে কিনে দিয়েছে আফজাল। বরিশাল থেকে কিনে এনে পাখিটা হুমায়রার হাতে ধরিয়ে দিলো।বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললোঃ” কালরাতে ঘুমানোর আগে আরেকটা মানিকের কথা বলছিলে।এই নাও, তোমার মানিক এনে দিলাম।”
হুমায়রা গাল ফুলায়।অভিমান করে বলেঃ” আমি এই মানিক চাইছি?”
” আমার ভয় করে হুমায়রা।গতবার আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে প্রাণ যাচ্ছিলো আমার।কী অবস্থা হয়েছিল মনে নাই? আমার মনে আছে। এবার আমি দেশে থাকব না।আগের বারের মতো যদি হয়? আর কোনো মানিকের দরকার নাই।এটা নিয়ে খুশি থাকো।”—- শেষদিকে ক্লান্ত শোনায় আফজালের কন্ঠ।হুমায়রার কন্ঠ ভারী হয়ে আসে।নিজের প্রতি আফজালের ওতো আহ্লাদ ভালো লাগে না।এতো কথা ভাবে কেন লোকটা? এতো ভাবলে দুনিয়া চলে? একটা ফুটফুটে মানিকের শখ হুমায়রার।ঘরে খিলখিলিয়ে হাসবে মানিক,ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটবে মানিক, রান্নার সময় গলা জড়িয়ে বসে থাকবে মানিক। পুকুরের ওদিকে সারি সারি আমগাছের পাশে যেই মানিকটাকে লুকিয়ে রেখেছিল,ঠিক সেরকম একটা মানিকের শখ।আফজাল বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকে।লোকটা একটা পাষাণ। “বাবা” ডাক শোনার ইচ্ছাই নেই তার।
এই পাখিটাকে ভীষণ ভালোবাসে হুমায়রা।পাতের শেষ ভাতটুকু মানিককে খেতে দেয়।পাখিটা অবলীলায় খেয়ে নেয় তা।শীতের কনকনে রাতে খাঁচার উপরে গায়ের চাদরটা দিয়ে রাখে।এ যেন মায়ের গায়ের উষ্ণতা।মানিক চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকে।যখন অনেক শীত পড়ে,তখন মানিককে নিয়ে জ্বলন্ত চুলার পাশে বসে থাকে হুমায়রা।মানিকের গায়ে তাপ লাগে, হুমায়রার শরীরেও তাপ লাগে।মা-বাচ্চা একসাথে আগুন পোহায়।পাখিটাও ভালোবাসার মান দিতে জানে।হুমায়রাকে দেখলেই ” হুমু মা ” বলে চেঁচিয়ে উঠে।তীক্ষ্ণ স্বর ঝনঝন করে বাজে হুমায়রার কানে। তবুও বেশ লাগে শুনতে।মানিক আগে কথা বলতে জানতো না।আফজাল শিখিয়ে গেছে।হুমায়রাকে আদর করে হুমু বলে ডাকে সে।মানিককেও তাই ওভাবেই শিখিয়েছে।প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা বলে আফজাল।কথার শেষে এক ফাঁকে মানিককে দেখতে চায়। দূর দেশে বসে আবদার করেঃ” আমার মানিকরে একটু দেখাও,হুমু।”
রাতে ভাত খাওয়ার ইচ্ছা নেই হুমায়রার।ক্ষুধাও নেই অবশ্য।ও বাড়িতে যা খেয়েছে, তা হজম হতে সকাল হবে। নয়টা বাজে ঘড়িতে।আপাতত ভারী কোনো কাজ নেই।শুয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু শুয়ে পড়লে চলবে না।হুমায়রা ভাত মেখে মানিকের খাঁচায় খাবার দেয়। মানিক ঝিমাচ্ছে। খাঁচার মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মানিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় হুমায়রা। দু-মিনিট আদর করে হাত বের করে।খাঁচার উপরে গায়ের চাদরটা মেলে দেয় ভালো করে। এদিক-ওদিক একটুও ফাঁক রাখে না। টিনের ঘর,ফাঁক-ফোকড় দিয়ে শীতের বাতাস আসে। দুপুরের তরকারী ছিল মিটসেফে।কুঁচো চিংড়ি দিয়ে মিষ্টিকুমড়োর তরকারী। রান্নাঘরে ঢুকে চুলা জ্বালায় হুমায়রা।হুটহাট কিছু রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার এনে দিয়েছে আফজাল।রাতের খাবারটা ওখানেই গরম করে হুমায়রা।দুপুরের ভারী রান্না মাটির চুলায় করলেও খাবার গরমের কাজটা গ্যাসেই করে।এটুকু কাজ করতে মাটির চুলা জ্বালাতে ইচ্ছা করে না।
হুমায়রা রান্নাঘরে এসে বসে।ফ্রিজ থাকলে চুলার কাছে আসতো না। তরকারীটা ফ্রিজেই রেখে দিতো।ও ঘরের ফ্রিজটা আফজালের কেনা।কিন্তু আলাদা হওয়ার সময় কিছুই আনেনি আফজাল।একটা ভাতের পাতিল পর্যন্ত না।শুধু খাট ও কাঠের আলমারিটা এনেছে।এ দুটো বিয়ের সময় হুমায়রার বাবার বাড়ি থেকে দিয়েছিল উপহারের নাম করে।
তরকারী চুলায় দিয়ে চুপচাপ বসে হুমায়রা।ও ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে।রোমেলা বানু শাসন করছেন ফয়সালকে। আড়িপাতা লাগে না।রান্নাঘরে বসলে এমনিই সব কানে আসে।এরা আস্তে কথা বলতে পারে না। হুমায়রার হাসি পায় শাসন দেখে।ফয়সালের হঠাৎ বিয়ে দেখেই আন্দাজ করেছিল এখানে অন্য কাহিনী আছে।হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ নয় রোমেলা বানু । হুমায়রা জানতো এখানে ঝামেলা আছে। কিন্তু এতোটাও আশা করেনি। ফয়সাল নাকি রাজিই না বিয়েতে।অথচ মায়ের আদেশে বিয়েটা সেড়ে ফেললো।কি অদ্ভুত! সূচিকে আজ খুব ভালোভাবে খেয়াল করেছে হুমায়রা।হাসিখুশি একটা মেয়ে।এই এলোমেলো সংসারে এসে ফুটফুটে মেয়েটা টিকবে কী করে?
______________________
আত্মীয়ের সামনে তৃতীয় চড়টা ডান গালে পড়লো। হাত-পা কাঁপছে ছেলেটার।মাথা নিচু করে ফেললো ফয়সাল।ব্যাথায় নয়, অপমানে চোখে জল চলে এলো। মা আজ এমন করছে কেন? আজকের দিনটা একদম মনে রাখার মতো।পৃথিবীর সব অঘটন আজকেই কেন ঘটছে?
চতুর্থবারের মত হাত উঁচু করতেই রমিজ শিকদার ধরে ফেললেন বোনের হাত।রোমেলা বানুর চোখ জ্বলে ধিকধিক করে। রাগে কাঁপে তার ছোট-খাটো ভারী শরীর। বাধা দেওয়ায় আরো ক্ষেপে গেলেন।ভাইকে ধমক দিয়ে বলেনঃ” হাত ছাড়,রমিজ।”
” পাগলামি করছো কেন, বুবু? বন্ধ করো এসব।চল,খাটে বসবে। এসো তাড়াতাড়ি।”
রোমেলা বানু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।তবে রমিজ শিকদারের শক্তির সাথে পারবে কেন? হার মানেন রোমেলা বানু। জ্বলন্ত চোখে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে। রাগ কমছে না।এই দু-তিনটে চড়ে মনের শান্তি মিলবে না।ঠাটিয়ে আরো তিন-চারটে চড় মারতে পারলে ভালো লাগতো। রাগে পাগল পাগল লাগতো না এমন।
” ফয়সাল, তুই পালাতে চেয়েছিস কেন? পছন্দ না হলে বুবুকে বলতে পারতি। পালানোর মতো জঘন্য বুদ্ধি তোর মাথায় এলো কী করে?”
ফয়সাল মাথা তোলে না।মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।মাকে তো বলেছিল অনেক আগেই।সূচিকে যে পছন্দ না,তা তো সোজাসাপ্টা বলেছিল। কিন্তু মায়ই মানলো না।মারের ভয় অবধি দেখিয়েছে।এরপরে আর কী করার থাকে? পালানো ছাড়া আর কোনো রাস্তা আছে?
” উত্তর দে, ফয়সাল।চুপ করে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না।”
” আমি আম্মাকে বলেছিলাম, মামা।তুমি জিজ্ঞেস করো আম্মাকে।”
রোমেলা বানু চোখ-মুখ খিঁচে লাফিয়ে উঠেন।আরো রেগে গেছেন।আঙুল নেড়ে শাসিয়ে বলেনঃ” তোর পছন্দ হইব না ক্যান? আমার চাইতে তুই ভালো বুঝোছ? আবার মুখে মুখে কথা কছ।”
” আহ,বুবু।বসো তুমি।আমিই তো কথা বলছি।”— রমিজ শিকদারের কন্ঠে বিরক্তি।সত্যিই এদের চক্করে বিরক্ত তিনি।বোন,ভাগ্নে — দুটোই পাগল।এরা পানিকে ঘোলা করছে আরো। মাথা ঠান্ডা করে দু-মিনিট কথা বলতে জানে না।বিরক্তিকর।
” ফয়সাল, তুই মন খুলে কথা বল।সূচিকে তোর পছন্দ নয় কেন? মেয়েটা তো খারাপ নয়।”
মামার কথায় একটু সাহস পায় ফয়সাল।নিচু মাথা খানিকটা উঁচু করে মায়ের দিকে তাকায়।একবার মাত্র।তারপর শক্ত গলায় বলেঃ” সূচিকে আমার ভালো লাগে না, মামা।এখনো ভালো লাগে না।আমি আম্মাকে আগেই বলেছিলাম এই কথা। যেদিন প্রথমবারের মতো দেখতে গেছিলাম, সেদিনও বলেছিলাম।আমার কি পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে না? মেয়েটার গায়ের রঙটা চাপা।তাছাড়া, আহামরি রূপবতীও নয়। মানুষ ঘরে ঢুকে আগে কী দেখে? ঘরের সৌন্দর্যই তো একটা ঘরশোভা বউ। সূচিকে হুমায়রা ভাবির পাশে দাঁড় করাও তো।মানা যায়? আফজাল ভাইয়ের সময় আম্মা সুন্দর খুঁজতে খুঁজতে গ্রাম উজাড় করলো।আর আমার বেলায়? আমার সাথেই কেন এমন হলো মামা?”
মামার কাছে মায়ের নামে এক দফা বিচার দিলো। ফয়সালের কন্ঠ ভেঙে আসে। অনেক কথা বলে ফেলেছে।
” দেখছোছ,কেমন বেলেহাজ? মুরুব্বিগো সামনে সুন্দর বউয়ের আশা করে।অমানুষ। এহনি এমন।সুন্দর বউ কপালে জুটলে কী করতো? তুই ক, রমিজ? কী করতো জানোয়ারটায়? লাটসাব হইতো একদম।বড়টার বেশ ধরছোছ? মাইরা সোজা করুম ফয়সাল তোরে।”
” আহ,বুবু। চুপ করো।এখন তুমি বলো।ওর অপছন্দ জেনেও বিয়ে দিয়েছো কেন? ও তো তোমাকে বলেছিল সব।”
তেতে উঠলেন রোমেলা বানু।দাঁত কিড়মিড় করে বলেনঃ” ক্যান,এতো কৈফিয়ত দিতে হইব ক্যান? আমি কি খারাপ চাই ওর? আমি কি কম বুঝি? আবারো সাদা চামড়ার বউ আনুম আমি? আমার শিক্ষা হইছে।সুন্দর বউ পাইলে পোলারা এক্কেরে আসমানে চইড়া বসে।কথা ছোঁয়ান যায় শরীলে? একবারে লাট-বেলাটের ভাব নিয়া বসে।”
কথাগুলো বড় ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলা।নিজের ভুল কে দেখতে পায়? রোমেলা বানুও দেখেন না।তিনি মা, আফজালের দোষটাও চোখে পড়ে কম।সব দোষ যেয়ে বর্তায় হুমায়রার উপর। ঘরের দরজা এঁটে স্বামীর কানে সব কথা দিতে হবে কেন? একটু সহ্য করতে না পারলে সে আবার কেমন মেয়ে মানুষ? বউ মানুষ এতো আহ্লাদী হবে কেন? ছেলেটারই বা কী দোষ? নাকের জল,চোখের জল এক করে নালিশ করলে ছেলে তো মায়ের বিরুদ্ধে যাবেই। পুরুষ মানুষ সুন্দরী বউয়ের কান্না সহ্য করতে পারে? আফজালের তো দোষ নেই।সব ওই ন্যাকা মেয়ের দোষ। মনে মনে হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য দু-তিনটে গালি দেন রোমেলা বানু।দুই চোখে দেখতে ইচ্ছা করে না।
” বুবু,তুমি কিন্তু এখনো বলোনি। ”
” কী কমু?”
” ফয়সালের অপছন্দ জেনেও কেন বিয়েটা এখানেই ঠিক করলে?”
” আমি কি তোগো মতো বলদ? আমি শুধু বর্তমানটাই দেখি না,ভবিষ্যতের দিকেও চোখ দেই।নাইলে এই গ্রামে এই কুত্তার ছাও দুইটা নিয়া টিকতে পারতাম? আমি মরলে ওর গার্জেন আছে? আফজাল নিজেরটা ছাড়া আর কিছু দেখে? আজকে আমি দুই চোখ খাটি,কালকে দুই ভাই জায়গা নিয়া কামড়াকামড়ি করব। আফজালের লগে পারব ওয়? মমিন ভাইয়ের দুই মাইয়া।জায়গা-জমিও আছে ভালোই।বড়টারে তো পরিচয় দেয় না। ওইদিকে কোনো ঝামেলা নাই।এই পরিবারে ফয়সাল আদর পাইব।আফজালের থেকা কিছু না পাইলেও শ্বশুরের থেকা পাইব।সূচির বাপের সবকিছু সূচির নামেই।রতন ভাইয়ে কইছিলো একদিন। তারপরেই বুদ্ধিটা মাথায় আসে। একটা জামাইয়ের পিছনে ঢালতে গায়ে লাগে? মমিন ভাই একটা জামাইয়ের পিছে হাত খুইল্লা ঢালব।ঘরশোভা বউ আবার কী জিনিস? লাভের অঙ্ক ওই কমাক্কলে বুঝে? খালি সুন্দর বউ,সুন্দর বউ।বেয়াক্কেল।”
এতোক্ষণে বিষয়টা খোলামেলা হলো। সূচিকে এক পাল্লায় বসিয়ে আরেক পাল্লায় সূচির বাবাকে বসানো হয়েছে। লাভের অঙ্কটা ভারী বলেই ফয়সালের মতামত এখানে কিছুই না। রমিজ শিকদারের ঘৃণা হয়।বোনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন।বুবু এতোটা বাণিজ্যিক কবে হলো? ছেলের বিয়েতেও ব্যবসা! ছিঃ!
” কাজটা তুমি ঠিক করোনি,বুবু। সবার রুচি আলাদা।বিয়ে-শাদিতে আবার কীসের লাভ-ক্ষতি? সংসার তোমার ছেলে করবে।ওর পছন্দ-অপছন্দ মাথায় রাখা দরকার ছিল।”
” আমার পোলার ভবিষ্যতের চিন্তা আমার।তুই এগুলি বুঝবি না।”
” আমার বুঝার দরকারও নেই।এ নিয়ে তোমার সাথে ঝগড়া করতেও আমার রুচিতে লাগে।”
রমিজ শিকদার মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকেন।ভাগ্যিস বোন জামাই নেই এখানে।বাইরের লোক, এসব শুনলে কেমন হতো? বোনের লজ্জা না লাগলেও রমিজ শিকদারের লজ্জা করে।বাশার হক, আপন বোনের স্বামী নয়।পাতানো বোনের স্বামী।তার সামনে এসব বিষয়ে ঝগড়া হলে মান-ইজ্জতের রফা-দফা হয়ে যেতো একদম।
ফয়সাল কাঠের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।এতো বছরের জীবনে একটা প্রেম করা হলো না মায়ের দিকে চেয়ে।সবাই বলে আঠারো বছর বয়স নাকি বিপজ্জনক বয়স। এসময়ে যা দেখে তাই নতুন লাগে।ফয়সাল বিপদসীমা পার করে এসেছে বহুবছর আগে। ফয়সালের চোখে কি কিছু নতুন লাগেনি?লেগেছিলো। আঠারোর ভয়াল হাওয়া তাকেও ছুঁয়েছিলো। এককালে সুন্দরীদের দেখে সেও ছন্দ লিখতো। ক্লাসের সুন্দরীদের পদচারণ তার হৃদয়েও কম্পন তুলতো।সাইন্সের ফার্স্ট গার্ল, রানীকে ভীষণ পছন্দ ছিল।দরজায় খিল এঁটে কতো রাত প্রেমপত্র লিখেছে ফয়সাল! রানীকে কল্পনা করে একলা রাতে হাবিজাবি কত কথা বলেছে! মেয়েদের সারির প্রথম বেঞ্চে রানী বসতো।ছুটির সময় টুকটুক করে ব্যাগ কাঁধে হেঁটে চলে যেতো।ফয়সাল এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো রানীর পায়ের দিকে।মেয়েটার পায়ের ছন্দ যেন ফয়সালের হৃৎপিণ্ডের কাঁপুনি। সবার শেষে ক্লাস থেকে বেরোতো ফয়সাল।যাওয়ার আগে নির্জন দুপুরে রানীর হাইবেঞ্চে একটা আদুরে চুমু দিতে ভুলতো না। কলেজের দুটো বছর তো এসব করেই কেটে গেল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর রানীর বিয়ে হয়ে গেল। সেই দুপুরে পশ্চিমের পুকুরপাড়ে বসে কেঁদে গাল-গলা ভাসিয়ে ফেললো ফয়সাল।চুপিচুপি ভালোবাসতো রানীকে।তবে মায়ের ভয়ে কোনোদিন বলা হয়নি।যদি কখনো মায়ের কানে যায়,তবে পিঠে আর চামড়া থাকবে না।এতো গেল এক বয়সের কথা।রতন কাকার মেয়ে রত্নাকেও ভালো লাগে ফয়সালের।কি সুন্দর মেয়েটা! একদম দুধে আলতা গায়ের রঙ। কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ে।একগাছা পাতলা চুলে ঝুঁটি বেঁধে রাখে সবসময়।এমনি এমনি কি যখন-তখন রত্নাকে খামারে ঢুকতে দেয় ফয়সাল? খামারের সাথের বাড়িটা দিলশাদদের।ও বাড়ির মুরগীগুলোকেও খামারে ঢুকতে দেয় না ফয়সাল।সেখানে দু’দিন পর পর রত্না যেয়ে ঘুরে আসে পুরো খামার।সব কি এমনি এমনি? মোটেও না।রত্না যখন প্রজাপতির মতো এ মাথা-ও মাথা ঘুরে ঘুরে ভিডিও করে, ফয়সাল তখন দূর থেকে আড়চোখে দেখে।মেয়েটা সুন্দর,ফড়িংড়ের মতো তিড়িংবিড়িং করে।ফয়সাল গাই দোহনের নাম করে বসে বসে রত্নাকে দেখে। সে সৌন্দর্যপিপাসু।রত্নার ওই লতানো দেহের সৌন্দর্য দেখতে ভালো লাগে। ওই আগুন রূপ,ফর্সা চামড়া,লালচে-কালো চুল,লম্বা-লম্বা আঙুল সব ভালো লাগে। অথবা হুমায়রার চাচাতো বোন শশীর কথাই ধরা যাক।শশীকে ভীষণ পছন্দ ফয়সালের। আফজালের বিয়ের সময় শশী ছিল একটুখানি মেয়ে।বিয়ের দিন বোনের সাথে সুতির ফ্রক গায়ে দিয়ে এবাড়িতে এসেছিল শশী।ছোট শশীকে দেখে তখন আদর আদর ভাব জাগতো মনে। ফয়সাল ছোট বাচ্চাদের মতো গাল টিপে দিতো।সেই শশীকে এখন চেনাই যায় না।বয়স সবে ষোলো-সতেরো।অথচ, কি রূপ! কি হাসি! শশীর হাসির শব্দ শুনলেও ফয়সালের শরীরে কাঁপুনি ধরে।হাসি তো নয় যেন নূপুরের ঝংকার। মেয়েটার চোখ দুটোকে সহজেই ঐশ্বরিয়া রায়ের চোখের সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়। চলন-বলন ভারী পছন্দ ফয়সালের। এখনো শশীকে দেখলে আদর আদরভাব জাগে মনে।তবে সেই আদি কালের আদরের সাথে বর্তমানের আদরের বড় তফাৎ। শশীকে একদম বিড়ালছানার মতো লাগে। দেখলেই আদর করে বুকে চেপে ধরতে ইচ্ছা করে।
রানী,রত্না,শশী– এরা তো উদাহরণ মাত্র।এরকম আরো কতো সুন্দরীরা মনের অলিগলিতে চুপটি করে বসে আছে! ফেসবুক ফ্রেন্ড এঞ্জেল শ্রাবনী থেকে শুরু করে তপুর বোন তনু,হাজার হাজার সুন্দরীরা রাত নামতেই নৃত্য জুড়ে দেয় ফয়সালের মন গহীনে।ঘুমানোর আগ অবধি কেবল তুলনা করে ফয়সাল।কার চেয়ে কে বেশি সুন্দর? রত্নার হাত দুটো বেশি সুন্দর নাকি শশীর হাত? শশীর হাসি বেশি সুন্দর নাকি তপুর বোন তনুর হাসি সুন্দর? তনুর চোখ দুটোর চাইতে ফেসবুকে পরিচিত শ্রাবনীর চোখ দুটো বেশি সুন্দর না? অবশ্য আজকাল আসল ছবিকে ঘসে-মেজে অনেককিছু করা যায়। শ্রাবনীর চাইতে তনুই এগিয়ে থাকে বেশি।এতোদিন বদ্ধ ঘরে এসব বিশ্লেষণ করতো ফয়সাল।চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতো,কে বেশি সুন্দর? কে ফয়সালের বউ হওয়ার যোগ্য? ফয়সালের বিশ্বাস ছিল,বিয়ের আগে মা পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে জানতে চাইবে।তখন সবচেয়ে বেশি সুন্দরীর নামটাই বলে দেবে ফয়সাল। তাছাড়া, মায়ের রুচির উপর শতভাগ বিশ্বাস ছিল।হুমায়রা ভাবি এ বাড়িতে আসার পর বিশ্বাস আরো গাঢ় হলো।হুমায়রা ভাবির মতো সুন্দর একটা মেয়ে হলেও চলবে। মা সমঝদার, সৌন্দর্যের কদর করতে জানে।কিন্তু কী হলো? আজকের বিয়েটা ঠিক তীরে এসে তরী ডুবার মতো ঘটনা। ফয়সালের এতোদিনের আশা-ভরসা সব মাটি করে দিয়ে মা বিয়ে দিয়ে দিলো সূচির সাথে।সৌন্দর্যপ্রিয় ফয়সালের ভাগ্যেই কেন সূচি জুটলো? সূচির দুধে-আলতা গায়ের রঙ নেই। নেই চেয়ে থাকার মতো কোনো সৌন্দর্য। হাসিটা ফয়সাল দেখলো না,অবশ্য দেখার ইচ্ছাও নেই। আজ ঘোমটার বাইরে দু-একটা চুল দেখেছিল। কুচকুচে কালো চুল,এ আর কী এমন? চোখদুটোও কেমন যেন বড় বড়। ভালো লাগে না।ফয়সাল হতাশ হয়। আতিপাতি করে খুঁজেও নতুন বউয়ের কোনো সৌন্দর্য খুঁজে পায় না। দিন-দুনিয়া অন্ধকার করে কাঁধতে ইচ্ছা করে।মেয়েটা জাদু করেছে।নিশ্চিত আম্মাকে তাবিজ করেছে।নাহয় শুধু ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবেই আম্মা বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল? অসম্ভব। সময় করে একদিন কবিরাজের বাড়ি গেলে কেমন হয়? জাদু-টোনা,তাবিজ-কবচের শক্তি এক নিমিষেই নষ্ট করতে পারেন তিনি।ফয়সালের ঘোলাটে মস্তিষ্কে এলোমেলো চিন্তারা ভর করে।বিয়েটা হয়ে গেছে।এখন আর কিছুই করার নেই। তবুও এলোমেলো চিন্তা করে ফয়সাল। ঘুম পাচ্ছে খুব।একটু ঘুমাতে পারলে মাথার জটগুলো খুলতো।
” ফয়সাল,কিছু কথা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনবি।”
ফয়সাল কান পেতে রাখে।কী বলবে মামা? ফয়সালের অপছন্দের কথা শুনে ডিভোর্সের কথা বলবে? বেশ হয় তবে। মনের আশঙ্ক্ষা সত্যি হলে মসজিদের দানবাক্সে পুরো এক হাজার টাকা ফেলার মানত করে।
” তোর বিষয়টা খুব জটিল, ফয়সাল। তোর পছন্দ না,তাই তুই বিয়েতে রাজি ছিলি না।তোর মাকেও এ কথা জানিয়েছিস।এ পর্যন্ত তোর দোষ দেওয়া যায় না।প্রত্যেকের পছন্দ আলাদা,রুচিবোধ আলাদা।সূচিকে অপছন্দ হতেই পারে,অস্বাভাবিক কিছু না।কিন্তু পালানোর সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল।তুই ও বাড়িতে যাওয়ার আগেও আমাকে পুরো বিষয়টা খুলে বলতে পারতি।অথবা প্রথমবার দেখে এসেই ফোনে আমাকে বলতে পারতি। তখন হয়তো কিছু করতে পারতাম।কিন্তু এখন?”
রমিজ শিকদার থামেন।ফয়সাল কান পেতে রয়।এরপর? এখন কী করতে বলবে মামা?
” ফয়সাল, তোর বিয়েটা হয়ে গেছে।সূচিকে তোর অপছন্দ,এমনকি এখনো অপছন্দ।তুই নিজেই বলেছিস। অপছন্দ হলেও কিছু করার নেই।সূচি তোর বউ। বিষয়টা শুধু তোর আর সূচির মধ্যেই আঁটকে নেই।এই বিয়েতে দুটো পরিবার এক হয়েছে।তুই বুঝতে পারছিস বিষয়টা? বিয়েটা কয়েকদিনের জন্য করিসনি তুই। বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে তাই আর কিছুই করার নেই।এই পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে যা বলেছিস,তা আজকে রাতের মাঝেই কবর দে।এসব চিন্তাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে একদম।সামনে একটাই রাস্তা খোলা আছে। সবকিছু মেনে নে।সূচিকে তোর অপছন্দ,এটা যেমন সত্যি; তেমনি সূচি তোর বউ, এটাও সত্যি। মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। তাছাড়া, মেয়েটা ততোটাও খারাপ নয় যতোটা তুই বলছিস।আমার কাছে ভালোই লাগলো।কিছুদিন সংসার কর,দেখবি তোরও ভালো লাগবে।সূচি একসময় অভ্যাস হয়ে যাবে দেখবি। এরেঞ্জ ম্যারেজগুলোতে…..
ফয়সাল ঝাপসা চোখে মামার দিকে চেয়ে থাকে।মামার কথা কানে ঢুকে না। মামা বললো, অভ্যাস হয়ে যাবে। তার আগে মেনে নিতে হবে,মানিয়ে নিতে হবে। মানিয়ে নিতে নিতেই হয়তো একসময় সূচি অভ্যাস হবে। প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হবে।সূচি-ফয়সালের পরবর্তী প্রজন্ম এ ঘরেই বড় হবে। জীবন চলে যাবে, সূচির সাথেই ফয়সাল বুড়ো হবে। এসব হবে মেনে নিতে পারলে,মানিয়ে নিতে পারলে। মানিয়ে নেওয়ার অনেক গুণ।কিন্তু,আক্ষেপ? এ জীবনে ফয়সালের আক্ষেপ মিটবে? বয়সের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়েও হয়তো আক্ষেপ থেকে যাবে। আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর পরেও হয়তো এমনই এক রাতেরবেলা, শুয়ে শুয়ে আক্ষেপ করবে ফয়সাল। সূচিকে তার পছন্দ ছিল না,একটুও পছন্দ ছিল না। অথচ এই অপছন্দের মানুষটার সাথেই যুগ কাটাতে হলো। আজ থেকে আক্ষেপের শুরু। এ আক্ষেপের রেশ বোধহয় এ জীবনে কাটবে না।
মামার ঠোঁট নড়ছে।তারমানে আরো লেকচার দিচ্ছেন তিনি।ফয়সালের আর ভালো লাগছে না এসব।পা দুটো খুব ভারী লাগছে।চোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম। ফয়সালের মাতাল মাতাল লাগে নিজেকে।আশেপাশে আর নজর দিতে পারে না।গ্রামের যাত্রাপালার শেষ দৃশ্যে যেমন ধীরে ধীরে পর্দা নামে,তেমনি ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় ফয়সাল।আজ আক্ষেপের প্রথম রাত। ফয়সালের বালিশটা আজ বৃষ্টিতে ভিজবে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবে হয়ে যাবে একদম।এই পানির স্বাদ কেমন? খুব নোনতা, তাই না?
চলবে….