শুকতারা পর্ব-১৬

0
1055

#শুকতারা (পর্ব-১৬)
#হালিমা রহমান।

উঠোনে গাঢ় অন্ধকার। চাঁদের আলোতে চারপাশ আলোকিত হয় না বরং অন্ধকারকেই আরো স্পষ্ট করে। ছোট কাঁচামরিচের গাছের নিচে জমাট বাঁধা অন্ধকার। নিঝুম রাতে পরিচিত পরিবেশটাকেও বড্ড অপরিচিত লাগে। ঘরের পাশের পুঁইলতা অথবা কুমড়োফুলে ভরা লতাটা,রঙচটা টিউবওয়েল, কবুতরের খালি খোপ— সবকিছুই অপরিচিত। অন্ধকারে স্পষ্ট বুঝা যায় না।শুধু অবয়বটাই দেখা যায়। অন্ধকারে অবয়বগুলো ঘাড় নেড়ে ভয় দেখায়।মাথা ঝুকিয়ে ভয় দেখায়। এই শীতের রাতে ঘরে চলে যাওয়ার হুকুম দেয়।ভূমি ভয় পেয়ে হুকুম তামিল করে না।জানলা খুলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
উঠোনের কোনের হিজল গাছটাকে বড় ভালো লাগে ভূমির।গাছের মাথায় চাঁদ সুন্দরী। একদম মাথায়।মগডালে চড়ে বসলেই মেঘের কোলের চাঁদটাকে হাত বাড়িয়ে ধরা যাবে। ভূমির লোভ হয়,সাথে একটু একটু আফসোসও হয়।শরীরটা আগের মতো পাঠকাঠি হলে ভূমি গাছে চড়ে বসতো। হাত বাড়িয়ে সুন্দরীকে ছুঁয়ে দিতো।শূন্য আকাশে রূপালি চাঁদ,ভূমির বড্ড লোভ হয়।
নির্নিমেষ চেয়ে থাকে ভূমি।চাঁদটা মনে হলো হাসলো।ভূমি দু-হাতে চোখ রগড়ে তাকায়।হ্যাঁ, চাঁদটা সত্যি হাসছে।অবাক হওয়ার কথা ছিল,তবে ভূমি অবাক হয় না।এই মাঝরাতে সবকিছুই কেমন স্বাভাবিক লাগছে।চাঁদের বদলে হিজল গাছ থেকে যদি কোনো শাকচুন্নি হাসতো,তবেও হয়তো অবাক হতো না ভূমি। শাকচুন্নির হাসির বিপরীতে নিজেও হাসতো।মাঝরাতে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক।
চাঁদ সুন্দরী আবার হাসলো।বিনিময়ে ভূমিও হাসলো।ফিসফিসিয়ে বললোঃ” হাসো কেন?”

” তুমি হাসো কেন?”

” তুমি হেসেছো তাই। তোমার ঘুম ধরে না?”

” উহুঁ,আমি দিনে ঘুমাই। রাত আমার জন্যে দিন।তুমি ঘুমাও না কেন?”

” ঘুম পালিয়ে গেছে।ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না। জানো, আজ আমার মন খারাপ।”

” কেন?”

কাঁধ থেকে গড়িয়ে পড়া চাদরটা তুলে দিলো ইশতিয়াক।ভূমির গায়ে সুন্দর করে জড়িয়ে দিলো চাদর।খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। হতচ্ছাড়া বাতাস হাঁড়ে কাঁপন ধরায়।ইশতিয়াক কিছুই বলে না।ভূমির পিছনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ভাঙা শিকের জানলা দিয়ে চাঁদ দেখে।
ইশতিয়াকের উপস্থিতিতে বিরক্ত হয় ভূমি। ওকে দেখেই মুখ বন্ধ করেছে চাঁদ।কথাও বলছে না,হাসছেও না। বোবার মতো হিজল গাছের মাথায় ঝুলে আছে। তবে চাঁদের চোখদুটো স্পষ্ট দেখতে পেল ভূমি।কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি ওদের দিকেই।ভঙ্গিটা এমন,” তোমার স্বামী দেখছি বড়ই হিংসুক। ও ব্যাটা পিছে দাঁড়িয়ে কী করছে? ওকে তাড়াও তো,আমরা আরেকটু কথা বলি।”

” ভূমি, ঠান্ডা লাগবে তোমার।”

ইশতিয়াকের কন্ঠে বাস্তবে ফিরে ভূমি। পুরুষালি গলা বাস্তবের ডাক।ভূমি কল্পনা থেকে যোজন দূরের বাস্তবে ছিটকে পড়ে।চিরপরিচিত গাছ-গাছালিকে আবার আপন লাগছে।গাঢ় কালো অবয়বগুলোকে এখন আর অপরিচিত মনে হচ্ছে না। দৈনিক ছুঁয়ে দেওয়া গাছ-গাছালি এখন আর ভয় দেখাচ্ছে না।ভূমি স্বস্তি পায়। ইদানিং অদ্ভুত এক অভ্যাস হয়েছে। একা থাকলেই কাল্পনিক জগৎ তৈরি করতে ইচ্ছা করে। অবশ্য কল্পনার জগৎ ভূমির অনুমতি নেয় না,নিজেই তৈরি হয়ে ভূমির চোখে ধরা দেয়। ভূমি প্রশ্রয় দিয়ে রাজ্যে প্রবেশ করে। তারপর সে ও প্রকৃতি একে-অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যায়।

” ভূমি ”

” হুম। ”

” ঘুমাবে না?”

” উঁহু, ঘুম আসছে না। ”

” কেন?”

” তোমার ছানা-পোনা ঘুমাতে দিচ্ছে না।তুমি ঘুমাওনি কেন?”

ইশতিয়াক জানলার পাল্লা বন্ধ করে ঘরের লাইট জ্বালায়। ভূমির চাদরটাকে আরো ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে দেয়। চেয়ার টেনে স্ত্রীকে বসায় সযত্নে।

” হাত বাড়িয়ে দেখলাম তুমি নেই। ওমনি ঘুম ছুটে গেল। তোমার পা দুটো আরো ফুলে গেছে না?”

ইশতিয়াক পিঁড়ি পেতে বসে ভূমির পা দুটো পর্যবেক্ষণ করে।হ্যাঁ, পা দুটো সত্যি আগের চেয়ে বেশি ফুলে গেছে। আগে এমন ছিল না। ভূমির সবকিছুই দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।পা ফুলে যাচ্ছে,নাক ফুলে যাচ্ছে, শরীর ভারী হচ্ছে।হাঁটলে থপথপ শব্দ হয়।ইশতিয়াকের ভয় করে।একা বাড়িতে বউকে রাখতে ইচ্ছা করে না।ভূমির একটা সঙ্গী থাকলে বেশ হতো।

” ভূমি,আজকে তোমার মন খারাপ?”

ইশতিয়াকের সামনে মনের অবস্থা মেলে ধরে না ভূমি।ঠোঁটের কোনে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে বলেঃ” না।শুধু শুধু মন খারাপ হবে কেন?”

” আমি জানি, তোমার আজকে মন খারাপ।”

” তুমি ঘোড়ার ডিম জানো।কয়টা বাজে?”

” একটা।”

” ওহ,চলো ঘুমাই। আমার চুলগুলো একটু টেনে দিতে হবে, ইশতি। মাথা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।”

ইশতিয়াক উঠে না।হাত বাড়িয়ে ভূমির গাল ছুঁইয়ে দেয়।মরা মানুষের মতো ঠান্ডা দুটো গাল।সব শীতের হাওয়ার অবদান।

” সূচির হলুদের খবর শুনে মন খারাপ? এমন জানলে আমি কখনোই খবরটা দিতাম না।”

” আরে না,কীসের মন খারাপ? ভালো খবর শুনলে কারো মন খারাপ হয়?”

” মিথ্যা বললে পাপ হয়,পাপী রমনী।”

” আর আন্দাজে কথা বললে? পাপ হয় না?”

” আমি আন্দাজে বলছি না।মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে মন খারাপ। যাবে একবার বাড়িতে? চলো চুপিচুপি তোমাদের সুপারি বাগানে যাই।কলতলার পাশে দাঁড়িয়ে সূচিকে ডেকে একবার কথা বলে আসি।যাবে?”

লোভনীয় প্রস্তাব। কতদিন বাড়ি যাওয়া হয় না! ভূমির চোখ চকচক করে।গেলে মন্দ হয় না।কিছুক্ষণের জন্য উল্লাসে ভরে গেল ভূমির মন।তবে কিচুক্ষণের জন্যই।পরক্ষণে উল্লাসকে হটিয়ে জায়গা করে নেয় একগাদা বিশ্রি অভিমান।অনাহুতের মতো কেন যাবে ভূমি? বিয়ে নাকি হয়েছে সেই কবে।কাল অনুষ্ঠান। ভূমি জানতে পারলো আজকে।ইশতিয়াক ঔষধ আনতে গিয়েছিল রায়হানের দোকানে।বৃহস্পতিবারে তাড়াতাড়ি ছুটি হয় ইশতিয়াকের।ঔষধ আনার সময়েই খবরটা দিলো রায়হান। ইশতিয়াক বাড়ি ফিরে ভূমিকে খবর দিলো।আজ সূচির গায়ে হলুদ। বাসি বিয়ের আয়োজন চলছে বাড়িতে।সবাই ব্যস্ত। হলুদে একশ জনের আয়োজন,বিয়েতে বরপক্ষসহ দেড়শো। গ্রামের চেনা-জানা অনেকেই যাবে বিয়েতে।শুধু ভূমি ছাড়া।ভূমি ও-বাড়িতে নিষিদ্ধ ব্যাক্তি। শুধু ভূমি নয়,ভূমির সাথে ইশতিয়াকও নিষিদ্ধ। ও-বাড়িতে দুজনের ছায়াও প্রবেশ করতে পারে না। খবরটা শোনার পর থেকেই ভূমির মন খারাপ।সূচি বড় আদরের ধন। সূচি হওয়ার পর সাহিদা বেগম অনেকদিন অসুস্থ ছিলেন। নড়তে-চড়তে কষ্ট হতো।সাহিদা বেগমের বরাবর দুর্বল স্বাস্থ্য। সূচির ধাক্কাটা সামলাতে বেগ পেতে হয়েছে।শরীরের পাশাপাশি মনের অবস্থাও ছিল নাজুক।একটা ছেলের শখ ছিল সেই আদিকাল থেকে। প্রথমবার শখ মাটি হলো ভূমির সময়। মোনাজাতে কান্নাকাটি করে ছেলে চাওয়ার পরে আল্লাহ ভূমিকে দিলেন। শখ মাটি হলো,সাহিদা বেগমের বুক ভাঙলো।প্রথম প্রথম ভূমিকে দুই চোখেও দেখতে ইচ্ছা করতো না সাহিদা বেগমের।ভূমির দাদি বেঁচে ছিলো তখন।ভূমিকে লালন-পালন তিনিই করেছেন বেশি।ভূমি একটু বড় হতেই সাহিদা বেগমের রাগ ভাঙলো।ভূমি ছোট বেলায় মা-ভক্ত ছিল খুব। দুচ্ছাই করার পরেও আঁচল ধরেই থাকতো সারাদিন।সাহিদা বেগম রাগ ধরে রাখতে পারলেন না।মন-প্রাণ উজার করে মেয়েকে আদর করতেন।এরপর সূচির পালা।সূচি আসার আগ থেকেই স্বাস্থ্য ভেঙে গেল।কিছুই খেতে পারতেন না। ঘরের কাজ-কর্ম করলেই হাত-পা ভেঙে আসতো। আলেয়া খাতুন মুখ টিপে হেসে বলতেনঃ” ওই যে পোলা আইতাছে।পোলাগুলি জন্মের আগের থেকাই জ্বালায়।”

সাহিদা বেগম দিন-রাত আল্লাহকে ডাকেন।একটা ছেলে,শুধু একটা ছেলে চাই তার। বংশের একটা বাতির খুব দরকার। নির্দিষ্ট সময়ে বংশের বাতি এলো ঠিকই,সাহিদা বেগম দেখলেন না। তিনি অন্ধ মানুষ।বংশের আলোকে ছেলে-মেয়ে, এই দুইভাগে ভাগ করে ফেললেন। এবারেও মেয়ে। আবার ভেঙে পড়লেন তিনি। মেয়ে যদি হতো ফুটফুটে সুন্দর, তবেও হয়তো চলতো।গায়ের রঙ দেখলেও গা শিরশির করতো সাহিদা বেগমের।আল্লাহ এবারেও ইচ্ছা পূরণ করলো না। ছেলের বদলে একটা কালো মেয়ে দান করলো। সাহিদা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। দিন-রাত আল্লাহর কাছে তীব্র ফরিয়াদ চলেঃ” আমি কী পাপ করছি, খোদা? আমার দোয়া কবুল হয় না ক্যান?”

জন্ম থেকেই সূচিকে বেশ পছন্দ ছিল ভূমির।মায়ের পাশে শুয়ে সারাদিন ট্যা ট্যা করে কাঁদে।মা ফিরেও তাকায় না।অসুস্থতায় চোখ বুজে শুয়ে থাকে। তবুও বোকা মেয়ে কাঁদে। ভূমি পাশে বসে সূচির মুখে আঙুল চেপে ধরে।ধমক দিয়ে বলেঃ” চুপ কর,চুপ কর।ট্যা ট্যা করবি না,চুপ কর। ”

সূচি চুপ করে।জ্বিভ দিয়ে চুকচুক করে ভূমির আঙুল চেটে দেয়। মস্ত এক খেলার আবিষ্কার হলো।এরপর যতবার সূচি কাঁদতো, ততোবার ভূমি আঙুল চেপে ধরতো।কখনো কখনো আঙুলে চিনি মিশিয়ে নিতো।সূচি কান্না ভূলে আঙুল চাটতো,ভূমি খিলখিল করে হাসতো।বোকা মেয়ে।আঙুল খাওয়ার জিনিস?

সূচির জন্মের আগেই দাদি মরেছে।মা অসুস্থ। সূচির ষোলআনা দায়িত্ব ভূমির উপর পড়লো। প্রস্রাবের কাঁথা পাল্টে দেওয়া, কাঁদলে চুপ করানো,কৌটার দুধ গুলে ফিডার মুখে চেপে ধরা, পায়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়ানো— সবকিছু ভূমিই করেছে। কখনো কখনো প্রস্রাব-পায়খানার কাঁথাটাও ভূমিকেই ধুতে হতো। ঘাট ভাঙা,মা অসুস্থ শরীরে পুকুরে যেতে পারে না।ঘরের পাশের কলতলাটা ছিল না তখন।গোসলের আগে ভূমিই কাঁথা-কাপড় ধুয়ে দিতো।শুরুর দিকে সূচিকে কোলে নিতে পারতো না। একটু শক্ত-পোক্ত হতেই ভূমির কোল সূচির দখলে।পানি ভরা কলসির মতো কোমড়ে নিলে ছোট্ট ভূমি বেঁকে যেত একদম। বাঁকা হয়েই হেঁটে বেড়াতো পুরো উঠোন। সূচি রাতেরবেলা বিরক্ত করতো বেশি।বড় হওয়ার পরেও রাতে কাঁদতো।সাহিদা বেগমের কাজের অভাব নেই।রান্নাঘরের কাজ সামলে সূচিকে নিয়ে আহ্লাদ করার সময় নেই। ভূমিকেই পড়া থেকে উঠতে হতো।বোনকে কোলে নিয়ে পুরো উঠোন হাঁটতো।এক হাতে থাকতো দুধের ফিডার।হেঁটে হেঁটে বোনের মুখে ফিডার গুজে চেঁচিয়ে আবৃত্তি করতো,
” আয় আয় চাঁদ মামা
টিপ দিয়ে যা,
চাঁদের কপালে চাঁদ
টিপ দিয়ে যা।”

সে আর কতদিন আগের কথা! ভূমির চোখ ভরে আসে।ধাক্কা দিয়ে জানলার পাল্লা খুলে দেয়।সব বদলেছে।সময় বদলেছে,সূচি বদলেছে।কিছুদিন আগেও এই উঠোনে বসে চোটপাট করেছে মাতৃসম বোনের সাথে। ফয়সালের সম্পর্কে দুটো কথা বলেছে বলে আকারে-ইঙ্গিতে সূচি বুঝিয়ে গেছে,ফয়সাল যে-সে নয়। সেদিনের বিকালটা ভূমি ভুলতে পারে না।কথার শেষেই কিরকম ঝট করে উঠে চলে গেল মেয়েটা! রেগেমেগে গটগট করে হেঁটে চলে গেছে।
হিজল গাছের মাথায় ঝুলে থাকা চাঁদকে দেখে ভূমি।মন ভরে দেখে।সব বদলেছে। শুধু ঐ চাঁদটা বাদে।আগে সূচিকে কোলে নিয়ে হাঁটার সময় ঐ চাঁদের দিকে চেয়ে চেয়ে আবৃত্তি করতো ভূমি। তখন তেঁতুল গাছের মাথায় ঝুলে থাকতো চাঁদ।এখনো গাছের মাথায় ঝুলে থাকে। সূচি ঐ চাঁদের উল্টো পিঠ।চাঁদকে দেখলেই সূচিকে মনে পড়ে।

” ভূমি, চলো ঘুমাই।”— ভূমির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি দু-আঙুলে মুছে দেয় ইশতিয়াক।

” সূচিকে খুব মনে পড়ছে ইশতি।সেদিনের সূচি আজ বিয়ের কনে! এতুটুকু ছিল ঠিক।এই যে আমার এক হাতের সমান। আমি কাঁথায় মুড়িয়ে ওর ছোট শরীরটাকে কোলে নিতাম। সারাদিন কাঁদতো, জানো। ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতো।আলেয়া দাদী বলতো ছাগলের ছাও।সত্যি ছাগলের মতোই কাঁদতো। আমি ওর মুখে আঙুল চেপে ধরতাম।ওর কোনো খেলনা লাগতো না।আমার আঙুল চেটে থেমে যেতো।”

ভূমি কাঁদে আর কাঁদে।ইশতিয়াক আবারো পানি মুছে দেয়। সাধ্য থাকলে এই রাতেই ভূমিকে ও-বাড়ি রেখে আসতো।সাধ্য নেই,তাই পারে না। ইশতিয়াক থামায় না ভূমিকে।মন ভরে কাঁদতে দেয়।গুমোট আকাশের চেয়ে ঝুম বৃষ্টি ভালো।প্রথমটাতে স্বস্তি নেই,পরেরটাতে আকাশসম স্বস্তি।

” খাটের একপাশে আম্মা-আব্বা ঘুমাতো, আরেকপাশে আমি আর সূচি ঘুমাতাম।নয় বছর বয়সে আমার বিছানা আলাদা হলো।সূচির বয়স তখন মাত্র তিন বছর। ও আম্মার সাথে ঘুমাতো,আর আমি আমার রুমে। প্রথমদিন আলাদা ঘুমানোর সময় মোটেও ঘুম এলো না।সূচিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর অভ্যাস। কোলবালিশ জড়িয়ে ধরলাম তবুই ঘুম এলো না।শেষরাতে একটু চোখ লেগে এসেছিল।সকালে উঠে দেখি সূচি ঠিক আমার শরীরের উপর।একদম লেপ্টে শুয়ে আছে।ওর হাত-পা ছড়িয়ে শোয়ার অভ্যাস। কোলবালিশ ফেলে আমার হাতের মাঝে এসে শুয়ে আছে।সেদিন থেকে ওর বিছানাও আলাদা হলো।আর কোনোদিন আম্মার সাথে ঘুমায়নি। আম্মা কত মারতো! তবুও ঘুমাতো না। রোজ আমার সাথে লেপ্টে শুয়ে থাকতো।”

ইশতিয়াক চোখের পানি মুছে দেয়।আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে ঃ” তারপর?”

তারপর? তারপরে আরো অনেক কথা মনে পড়ে ভূমির।এই মাঝরাতে পুরোনো ঘটনাগুলো সব চোখের সামনে স্পষ্ট হচ্ছে। থরে থরে সাজানো সব স্মৃতি।ভূমি অবাক হয়ে যায়। এতোদিন এগুলো মনে পড়তো না কেন? আজ সব মনে পড়ছে।সূচির দাঁত উঠা,প্রথম হাঁটা,প্রথম কথা বলা,প্রথম স্কুলে যাওয়া—সব। সেই একটুখানি সূচি এখন কোনো এক ঘরের বউ! আজ তার সারা শরীরে গাঁদাফুলের গয়না জড়ানো।কানে দুল,হাতে বালা,গলায় মালা।হয়তো ফুলগুলো এখন নেতিয়ে গেছে।হলুদ-সবুজ শাড়িটা এলোমেলো হয়ে গেছে।পুরোনো রুমটাতেই হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। বড় আপার কথা মনে পড়ছে সূচির? কে জানে! সূচির বিয়ে অথচ দূর থেকে কেঁদে ভাসাচ্ছে ভূমি।এই মাঝরাতে সূচিকে দেখার ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

” আচ্ছা ইশতি,শ্বশুড়বাড়ি থেকে সূচি আর লুকিয়ে-চুরিয়ে আসতে পারবে?”

” জানি না তো।”

” আসতে পারবে না।দেখো ওরা মোটেও আসতে দেবে না।আমি বোধহয় আর কখনো সূচিকে দেখতে পারব না,তাই না?”

কঠিন প্রশ্ন।উত্তর ইশতিয়াকেরও জানা নেই।সূচি না আসার সম্ভাবনা বেশি।কিন্তু এই সম্ভাবনার কথাই ভূমির সামনে বলা যাবে না।ইশতিয়াক ভূমির চাদর ঠিক করে দেয়।ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলেঃ” চলো ঘুমাই। আর কাঁদতে হবে না।সূচিকে নিয়ে তো আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাবে।তুমি বিকাল থেকে উঠোনে বসে থেকো।এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় এক নজর দেখো।”

ভূমি উঠে না।ঠায় বসে থাকে চেয়ারে। ঘোলা চোখের উপর কেবল সূচি ভাসে।ও-বাড়ি থেকে যদি একবার কেউ বলতো,শুধু একবার।ভূমি হয়তো এই রাতেই এই অসুস্থ শরীরে ছুটে চলে যেতো।

__________________________

সূচির রুম ছোট।একটা খাট,একটা ছোট টেবিল,একটা কাঠের আলনা রাখার পর ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই।টিনের সাথে লাগোয়া খাটে শুয়ে ঘুম আসে না সূচির।টিনের ওপাড়েই বাবা-মায়ের ঘর।ও ঘর থেকে নাক ডাকার শব্দ আসছে।বাবার নাক ডাকার অভ্যাস আছে।শোয়ার পরেই সাইরেন বাজা শুরু করে।
অন্ধকার রুমে ঘুম আসে না সূচির।ঘুম কোথায় পালিয়েছে কে জানে। সূচি এপাশ-ওপাশ করে।হলুদের শাড়িটা বিছানার চাদরের মতোই এলোমেলো হয়ে আছে।হাতে, গলায় গাঁদা ফুলের মালা।ফুল নেই,ছিঁড়ে-ছুঁড়ে একাকার।সাদা রশিগুলো ঝুলে আছে কেবল। গা থেকে কাঁচা হলুদের ঘ্রাণ আসছে।এই গভীর রাতে হলুদের ঘ্রাণ সহ্য হয় না সূচির।হাত দিয়ে ঘসে গালের হলুদ মুছে ফেলে।একটু আগে হলুদের অনুষ্ঠান হলো।সবাই মিলে ইচ্ছামতো হলুদ দিয়েছে। রনি,লিলি,রত্না– এরা এক ধাপ এগিয়ে।নিষেধ করলেও শোনে না। আলেয়া দাদি গুনগুন করে আগের মতো গীত গেয়েছে। পুরুষেরা উঠে যাওয়ার পর জয়া ভাবি,মনি ভাবি খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নাচলো কিছুক্ষণ। বহুদিন পর অনুষ্ঠান হচ্ছে বাড়িতে। পুরোনো প্রতিভারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যেন।
উঠোনের পূর্ব পাশের করমচা গাছের নিচে প্যান্ডেল হয়েছে। সাদা কাপড়ে মোড়ানো ছোট একটা মঞ্চের মতো।সেখানেই পাটি পেতে বসেছিল সূচি।ওর আশেপাশে লিলি,রনি,রত্না,চম্পা ভাবি।সবাই গোল হয়ে বসেছিল। সামনেই চার-পাঁচ পদের ফল,মিষ্টি।যে হলুদ লাগায় সেই একটা করে মিষ্টি গুজে দেয় মুখে।মিষ্টি খেতে খেতে জ্বিভে জং ধরে গেছে আজ। তেঁতুল গাছের নিচে খাবারের আয়োজন চলছিলো।বিরিয়ানীর ঘ্রাণে চারপাশ মুখরিত। কিন্তু সূচি খেতে পারেনি।হলুদের অনুষ্ঠান শেষে ঘরে ফিরে আলুভর্তা,ডাল দিয়ে গপগপ করে ভাত খেয়েছে।অতিরিক্ত তেল-চর্বির খাবার একদম সহ্য হয় না সূচির।
শুয়ে শুয়ে সূচির মনে পড়ে যায় এতোদিনের কথা।সেই সাদামাটা বিয়ের পরে কতগুলো দিন চলে গেল! প্রায় সাতদিন।এই সাতটা দিন সাত বছরের মতো লেগেছে সূচির কাছে।দিন যেন কাটতোই না।চব্বিশ ঘন্টা সময়কে অনেক দীর্ঘ মনে হতো। বাবা বিয়ের কেনাকাটায় ব্যস্ত,মা ঘরর কাজে ব্যস্ত,ভাবিরা মায়ের সাথে ব্যস্ত,রত্নাও কেনাকাটায় ব্যস্ত। শুধু অলস পড়েছিল সূচি। বিয়েতে কবুল বলা ছাড়া বিয়ের কনের আর কোনো কাজ নেই। বাকি কাজ অন্যদের। এই কয়েকটা দিন সাহিদা বেগম খুব চোখে চোখে রেখেছেন মেয়েকে।কলতলায় বেশি সময় কাটালেই ডাক পড়তো, ” সূচি আর পানি ঢালিছ না।ঠান্ডা লাগব।”
বৌচি খেলায় বড় দম দেওয়ার সময় ডাক পড়তো,” সূচি চিল্লাবি না।মাইনষে খারাপ কইব।”

লিলির পুতুল বৌয়ের বিয়ে হচ্ছে না সূচির বিয়ের চক্করে।এক দুপুরে লিলি এসে খুব অনুরোধ করল।যেভাবেই হোক আজ বিয়ে দিতেই হবে।বেচারি চানাচুর,বিস্কিট,চিপস সব কিনে রেখেছে।শুধু লোকবলের অভাবে বিয়েটা আঁটকে আছে।বিকালবেলা সূচি বিয়ে দিতে গেল,ওমনি সাহিদা বেগমের ডাক পড়লো।

” সূচি,মানুষ হইলি না।পুতুল খেলার বয়স আছে তোর?”

অগত্যা ঘরে চলে আসতে হলো।দাড়িয়াবান্দা খেলাও হয়নি এতোদিন।দৌড়াদৌড়ি করা যেত না।কিছু হলেই মায়ের ডাক পড়তো।সূচির বসে বসেই দিন কেটেছে। সারাদিন ঘরে বসে থাকতো।কখনো চুলার কাছে মাকে সাহায্য করতো।বিকালটা ভাবি মহলের সাথে কাটিয়ে সন্ধ্যায় আবার হাত-পা খোটা খুটি। শোয়ার আগে নতুন বছরের ক্যালেন্ডারে দাগ কেটে রাখতো।একদিন গেলে তারিখের উপর কালো কলমের একটা দাগ পড়তো।আজকেও দাগ দিয়েছে সূচি।ছয় তারিখের উপর গাঢ় করে দাগ দিয়ে রেখেছে।
সূচি এপাশ-ওপাশ করে।ঘুম আসে না।মশারি থেকে হাত বের করে খাটের উপরের জানলা খুলে।মুহূর্তেই একরাশ বাতাস এসে ছুঁয়ে দিলো সূচিকে।বাইরে নজর দেয় সূচি।পঁচিশ ওয়াটের একটা লাইট জ্বলছে উঠোনে।তেঁতুল গাছের নিচে ছাইয়ের ছড়াছড়ি।স্টেজটা নষ্ট হয়ে গেছে। স্টেজের উপরে ফুল,কাগজ,এটা-ওটা ছড়িয়ে আছে।সূচি জানলা বন্ধ করে দেয়। গা থেকে কাঁথা সরিয়ে উঠে বসে। এলোমেলো শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নেয়।শাড়ির পিনগুলো খুলে রেখেছে সূচি। তাই শরীরে শাড়ি থাকে না।কোনো রকমে শাড়ি ঠিক করে মশারির বাইরে বেরিয়ে আসে।গলা শুকিয়ে কাঠ।একটু পানির খুব দরকার।

অন্ধকার ঘরের কোনে এক চিলতে আলো।রান্নাঘরে মিটমিট করে আলো জ্বলছে।আশেপাশে ঘোর নিস্তব্ধতা। জ্বলন্ত চুলার সামনে সাহিদা বেগম বসা।চুলায় পাতিল চাপানো।সেখানে কী রান্না হচ্ছে তা জানা নেই। গনগনে আগুনের সামনে বোবা হয়ে মা বসে আছে।মাথায় ঘোমটা নেই।পাতলা কয়েক গাছা চুল খোঁপায় বাঁধা।এলোমেলো চুলের খোঁপা দেখে অকারণেই ভয় হয় সূচির।পিছন থেকে মাকে ডাকে,” আম্মা ঘুমাওনি?”

সাহিদা বেগম চমকে পিছু ফিরেন। সূচিকে এখন আশা করেননি। রুটির মতো ফুলে উঠা চোখ দুটো দেখে আঁতকে উঠে সূচি।রক্তজবার মতো টকটকে লাল দুটো চোখ।মনে পড়লো, অনেক কান্নাকাটি করলে মায়ের চোখ ফুলে যায়।সূচি দৌড়ে যায় মায়ের কাছে।মায়ের পায়ের কাছে লেপ্টে বসে পড়ে।

” ওঠ,এইখানে বসিছ না।ঠান্ডা লাগব।”

মায়ের কন্ঠ ভাঙা। সূচি উঠে না। কাতর কন্ঠে প্রশ্ন করেঃ” কাঁদছো কেন?”

” কই কান্দি? তুই চোখে পানি দেখছোছ?”

” আমি ছোট না আম্মা।”

” না,তুই তো অনেক বড়।যা ফ্যাচফ্যাচ না কইরা ঘুমা। কালকে সকালে উঠতে হইব।”

হুট করেই এক অভাবনীয় কাজ করলো সূচি।দু-পা এগিয়ে মায়ের গা ঘেষে বসে।হুট করেই মায়ের বুকে মুখ গুজে দিলো। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে হু হু করে কেঁদে উঠলো।
সাহিদা বেগম দু-হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। মেয়ের অর্ধেক খুলে যাওয়া খোঁপাটা গুছিয়ে দেন। রক্তজবা থেকে আবারো পানি গড়িয়ে পড়লো সূচির মাথার উপর। মায়ের তপ্ত নিঃশ্বাস সূচির গায়ে লাগে।মনে হচ্ছে সূর্যের তীব্র তাপ।সূচি পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।মাকে আরেকটু গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে সূচি। মা-বাবার প্রতি আহামরি ভক্তি -শ্রদ্ধা কোনোদিন ছিল না।তবুও আজ কেমন যেন লাগছে।অজানা কিছু অনুভূতি।সূচি সংজ্ঞায়িত করতে পারে না।কেমন খালি খালি লাগছে সবকিছু।মনে হচ্ছে কোথাও কেউ নেই।এই বিস্তীর্ণ পৃথিবীতে আশপাশ থেকে সবাই হারিয়ে যাচ্ছে।মহাসমারোহে সূচিকে পর করে দিচ্ছে সবাই।স্বস্তির দালান-কোঠা থেকে নির্বাসন দিয়ে দায়িত্বের সংসারে ফেলে দিচ্ছে।মহাসমুদ্রের মতো উত্তাল দায়িত্ব,সূচি থই পায় না।ছোটবেলার মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে কাঁদতে বলেঃ” আমি যাব না,আম্মা।এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না।”

সাহিদা বেগমের চোখে বেয়ে রাতের শিশির ঝরে।ভাঙা কন্ঠে মেয়েকে ধমক দেন।

” এইসব কইতে হয় না।একদিন সবারই যাইতে হয়।”

” আমি কেন যাব? তোমাদের জামাই এসে থাকতে পারে না এবাড়িতে?”

মেয়ের নির্বুদ্ধিতায় ক্ষুব্ধ হন না সাহিদা বেগম।দু-আঙুলে চোখের পানি মুছে ফেলেন।

” এই বাড়িতে যেমন চলোছ,ওই বাড়িতে ওমনে চলবি না সূচি। পরের বাড়ি নিজের করতে সময় লাগব।তবুও একটু সামলায়া চলবি মা।তোর ঠোঁট চলে বেশি।ওইখানে মুখটারে বন্ধ রাখবি।সবার মন যোগায়া চলবি।ঘরে-বাইরে মানুষ মাত্র তিনজন।কখনো ওগোরে অভিযোগ করার সুযোগ দিবি না।যেমনে চলতে কয় ওমনেই চলবি। শ্বাশুড়ির কথা শুনবি।যেকোনো কাজ করার আগে তারে সামনে রাখবি।বুড়া মানুষ মাথার উপরের বট গাছ।তারা মাথার উপরে ছায়া দেয়।কখনো অবহেলা করবি না। সেবা-যত্ন করবি।বুঝছোছ?”

সূচি বুঝলো কি বুঝলো না, তা বুঝা গেল না। গুজে রাখা মুখটা দেখার সুযোগ পেলেন না সাহিদা বেগম। সেখান থেকে শুধু ফুপানোর শব্দ আসছে।সাহিদা বেগমের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে।মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে দূরে দূরে থাকতেন তিনি। ঘরে-দুয়ারে এই একটাই মেয়ে তার। নাড়ী ছেঁড়া ধন,খারাপ লাগার শুরু সেই তখন থেকেই। সারাদিন মেয়ের সাথে চিৎকার করতে করতে অভ্যাস হয়ে গেছে এখন। সূচিকে না দেখলে ভালো লাগে না।তাই আগে থেকেই একা থাকার অভ্যাস করছিলেন তিনি। সারাদিনের দৈনন্দিন কাজের সাথে সূচিও অভ্যাস হয়ে গেছে। একা থাকা দায় হবে। সূচির বিয়ের পর আদোও ভালো থাকবেন কিনা সেটাও দেখার বিষয়। সাহিদা বেগমের মনে পড়ে যায় অনেক আগের কথা।যখন মেয়ে দুটো ছোট ছিল।তিনি রান্না করতেন, মেয়েরা পাটিতে লেপ্টে বসে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতো।পিঠা-পুলির দিনে আনন্দ বেশি হতো। মেয়েরা তৃপ্তি নিয়ে পিঠা খেতো,সাহিদা বেগম তৃপ্তি নিয়ে তৈরি করতেন। তার জীবনটাই কেটে গেল রান্নাঘরে। তবুও দুটো মেয়ে যখন ছিল তখন রান্নাবান্নায় আনন্দ বেশি হতো। ভূমিটা সবসময় চেটেপুটে খেতো।বহুদিন পরে ভূমির কথা মনে করে চোখের পানি ফেললেন সাহিদা বেগম।এ গ্রামেই মেয়েটার বাড়ি।অথচ,মা-মেয়ের মাঝে হাজার মাইলের দূরত্ব। কাল থেকে ঘরটা আরো খালি হয়ে যাবে। সাহিদা বেগম কী করে থাকবেন তখন?

” সূচি,যা ঘুমা।”

” আমার ঘুম আসছে না।”

” ঘরে যা, আমি আসতাছি।”

” উঁহু,আমি এখানে থাকব।”

মেয়ের মুখ তুলে চোখ মুছে দেন সাহিদা বেগম।সামনের চুলগুলো গুছিয়ে দেন।কপালে ছোট্ট একটা চুমু এঁকে দেন।

” যা,আমি আসতাছি।এখানে থাকলে ঠান্ডা লাগব।”

” তুমি আমার সাথে ঘুমাবে?”

” হ,যা। আমি কাজগুলি গোছায়া আইতাছি।”

শাড়ি গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায় সূচি।ধীর পায়ে হেঁটে চলে ঘরের দিকে।পানি খাওয়া আর হলো না। রাত হাঁটছে ভোরের দিকে। সূচির মনের ভিন্ন দশা।সময় গড়াচ্ছে দ্রুত।সূচির মনে হচ্ছে বিয়েটা না হলেই বেশ হতো।আজন্ম পরিচিত পরিবেশকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে পা বাড়াতে ভয় হয় সূচির। কে জানে ওখানের মানুষগুলো কেমন।বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাও অপরিচিত। আগে কখনো মন খুলে কথা হয়নি।মনের মিল যদি না হয়! গভীর রাতে আঁতকে উঠে সূচি। এ বাড়ির প্রত্যেকটা কিনারা মনের মাঝে এঁকে নেয়।পূর্বের করমচা গাছ,তেঁতুল গাছ।মনির ঘরের পিছনের সারি সারি কচুগাছ। বেঁটে সুপারি গাছের নিচে সযত্নে আঁকা দাড়িয়াবান্ধার কোর্ট। জয়া ভাবির বড় লাল মুরগীটা সবসময় কোর্টের মাটি তুলে নষ্ট করে।চম্পা ভাবির ঘরের সামনের বৌচির ঘর। ওধারের ঘাট ভাঙা পুকুর,পুকুরের দুই পাশের পাটিগাছ। ঘরের পিছনের সুপারি বাগান।সারি সারি সুপারি গাছের পাশে শ্যাওলা জমা কলতলা। মনির ঘরের পিছনের ছোট বাঁশ ঝারের ছবিও মনে এঁকে নেয় সূচি।চিরল বাঁশপাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদটাকে দেখলে বড় সুন্দর দেখায়। অথবা শুকনো মাটির উপরে হলুদ রঙা জংলী ফুল।ঘ্রাণহীন ছোট ফুলগুলো খুব পছন্দ সূচির।বিশাল বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘর। ঘাসবিহীন পরিপাটি উঠোন। রাতের অন্ধকারে পুরো বাড়ির ছবি মনের মাঝে এঁকে নেয় সূচি।উঠোনের মাঝের শিমুল তুলা গাছটাও বাদ যায় না। গাছে সুন্দর টকটকে লাল ফুল ফুটে।
বহু পথ পাড়ি দিয়ে সূচি ঘরে ফিরে।আলো জ্বেলে আলনার নিচ থেকে পলিথিনে মোড়ানো চটি জুতোজোড়া বের করে।রঙচটা এক জোড়া চটি।এগুলো ভূমির।ভূমি চলে যাওয়ার পর সবকিছু সযত্নে রেখেছে সূচি। ভূমির কাপড়গুলো খাটের নিচে ব্যাগে ভরে রাখা। বইগুলো টেবিলের একপাশে গোছানো। সূচি একফোঁটা ধুলো পড়তে দেয় না।প্রতিদিন মুছে মুছে রাখে। মায়ের বুকে মাথা গুজে একচোট কাঁদার পরেও সূচির খালি খালি লাগে।এই অনুভূতিটা চেনে সূচি। মনের একপাশ ভূমির জন্য বরাদ্দ।ওপাশ কোনোভাবেই পূর্ণ হবে না। আবার কবে বড় আপার সাথে দেখা হবে? উত্তর পায় না সূচি। ও বাড়ি থেকে কোনোভাবে বড় আপার বাড়ি যাওয়া যাবে নাকি তাও জানে না। বড় আপাকে খুব মনে পড়ছে সূচির।সেই ভারী শরীরের গোলগাল চেহারা,স্নেহপূর্ণ হাসি, শাসনের সুর– সব মনে পড়ছে। বড় আপা হয়তো এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।কিন্তু সূচির ঘুম আসে না।গভীর রাতে বোনের চটিজুতো হাতে নিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। একে একে মেলে ধরে হাজার স্মৃতির পসরা।রাত বলে রক্ষা।এখন দিন হলে সূচি ছুটে বেড়িয়ে যেতো।শেষবারের মতো বাবার নিষেধ অমান্য করতো বোনের বুকে মাথা গুজে কাঁদার জন্যে। ওই বাড়িটার অপর নাম স্বস্তি।ওখানে সূচির বড় আপা থাকে।রাতের অন্ধকারে ভূমিকে মনে পড়ে সূচির।অশান্ত মন ভূতের মতো ওই ছোট বাড়ির চারদিকে হেঁটে বেড়ায়। ও বাড়িতে মহামূল্য রত্ন আছে।আছে সূচির স্বস্তির জায়গা। বড় আপা তো স্বস্তির উল্টোপিঠ।আজ যদি সে এখানে থাকতো! সূচি হয়তো রাত কাটিয়ে দিতো কাঁদতে কাঁদতে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here