শুকতারা পর্ব-১৮

0
980

#শুকতারা (পর্ব-১৮)
#হালিমা রহমান

পূব আকাশে সূর্য উঠেছে একটু আগে।সূর্যের তাপের দাপট নেই। শীতের হাওয়ার সামনে টিকতে পারে না।দাপুটে হাওয়ারা উড়ে বেড়ায়,সূর্যকে চোখ রাঙায়। সকাল হয়েছে ঠিক তবে খুব বেলা হয়নি।টিকটিক করে ঘড়ির কাটা জানান দেয় সকাল পৌনে সাতটা। টেবিলের ও-পাশের জানলার একটা পাল্লা খোলা। জানলার পর্দা টেনে দেওয়া।পর্দা মানে না শীতের বাতাস।হু হু করে ঘরে ঢুকে সূচিকে কাঁপিয়ে তুলে।ঘুম ভেঙে যায় সূচির। কুঁজো হয়ে শুয়েছিল।মাথাটা অবহেলায় পড়েছিল বালিশের উপর।শীতের বাতাসে ঘুম ভাঙে সূচির।মাথা তুলে উঠে বসে।মাথাটা এখনো ভারী।ঔষধ না খেলে কমবে না বোধহয়।
মাথার ঘোমটা পড়ে গেছে।টকটকে লাল বেনারসীর কুঁচিগুলো এলোমেলো। আঁচলটাও এলোমেলো হয়ে আছে।এসব কুঁজো হয়ে শুয়ে থাকার ফল।কাল রাতে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়েছে মনে নেই সূচির।শুধু মনে আছে ,ফয়সাল বলার পরেও লাইট না নিভিয়ে ঠায় বসেছিলো। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর পা মেলে বালিশে মাথা দিয়েছিলো। চিরকাল সূচির অভিমান বেশি।ড্রয়ার থেকে পাতলা কাঁথা নেয়নি।তাছাড়া পাকা ঘর,দরজা-জানলা বন্ধ থাকলে বাতাস কম ঢুকে।ভারী বেনারসী গায়ে থাকায় ওতো ঠান্ডা লাগেনি। শোয়ার পরেই চোখ লেগে এসেছে হয়তো।রাতে আর কিছুই বলতে পারে না সূচি। বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি তাই ঘুম ভাঙেনি। মরার মতো ঘুমিয়েছে সূচি।সেই ঘুমের দন্ড পেতে হচ্ছে এখন। এলোমেলোভাবে ঘুমিয়েছে বলেই হাঁটু দুটো ব্যাথা করছে।বাম কানের দুলটার নিচের অংশ ছুঁচালো। গলার সাথে মিশেছলো।জায়গাটা ব্যাথা করছে,লাল হয়ে আছে বোধহয়। চুড়ি পরার অভ্যাস নেই। সারারাত খোলা হয়নি।হাতদুটো চুলকাচ্ছে খুব। জায়গায় জায়গায় লাল হয়ে গেছে। সূচির কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস।কান না ঢাকলে ঠান্ডায় কান ব্যাথা করে।কাল রাতের গোয়ার্তুমির ফল ভুগতে হবে।কান-গলার ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। গলা বসে গেলেই এখন সর্বনাশের চূড়ান্ত হবে।
সূচি উঠে বসে।ঘুম জড়ানো চোখে পুরো রুমে চোখ বুলায়। ফয়সাল নেই।খাটের ওধারে কেউ নেই,রুমেও কেউ নেই।জানলার পাল্লা খোলা।সূচি নিশ্চিত হয় ফয়সাল বেরিয়ে গেছে রুম থেকে।গায়ের উপরে খয়েরী রঙা কম্বল দেখে অবাক হয়।এটা গায়ের উপর কী করে এলো? ফয়সাল দিয়েছে? নাকি ঠান্ডা লাগছে বলে ঘুমের মাঝে নিজেই গায়ের উপর টেনে নিয়েছে? মনে পড়ে না সূচির।খাটের উপর চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে ঘুম তাড়ায়।থম মেরে বসে থেকে নিজেকে ধাতস্ত করে। সূচি হাত-পা টানটান করে উঠে দাঁড়ায়।ফ্লোরে পা রাখতে ঘৃণা হয় সূচির।বালিতে চিকচিক করছে ফ্লোর। শাড়ির পিনগুলো খুঁজে খুঁজে খুলে ফেলে সূচি। শাড়ির দিকে চেয়ে কষ্ট হয়। শাড়ির অবস্থা সূচির চাইতে বেশি খারাপ।বিয়ের শাড়িটা কুঁচকে নষ্ট হয়ে গেছে একদম।সূচি জানলার কাছে এসে জানলার পাল্লা খুলে দেয়। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আতিপাতি করে মানুষ খোঁজে। একজন মানুষ খুব দরকার এখন। সূচি লাগেজটা দেখতে পাচ্ছে না।গোসল করা দরকার। পেটের নাড়ী-ভুরি উল্টে আসছে।পেটে কিছু না গেলে সূচি এখন মরেই যাবে হয়তো।

ঘুম থেকে উঠে পশ্চিমের পুকুরে যাচ্ছিলো হুমায়রা।হাত-মুখে পানি দিতে হবে। বিয়ের ঝামেলা শেষ করে সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।এখনো কেউ উঠেনি।হুমায়রাও উঠতো না। মানিকের ডাকাডাকিতে উঠতে হলো।বেচারার ক্ষুধা পেয়েছিলো হয়তো। খাবার দেওয়ার পরেই শান্ত হয়েছে। কাঁঠাল গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পা আঁটকে যায় হুমায়রার। সূচির গলা কানে আসছে।হুমায়রা ফয়সালের জানলার দিকে তাকায়।ওই তো সূচি দাঁড়িয়ে আছে।

” বড় ভাবি,বড় ভাবি।”

হুমায়রা অবাক হয়। দ্রুত পা চালিয়ে ফয়সালের জানলার কাছে আসে।

” কী হইছে সূচি?”

” আমার ঘরে একটু আসবেন ভাবি?”— ইতস্ততভাবে প্রশ্ন করে সূচি।

” ফয়সাল নাই ঘরে?”

” দেখছি না।”

” আচ্ছা আসতাছি আমি।যদি গেট খোলা থাকে তাইলে আসতে পারুম।”

হুমায়রা চোখের আড়াল হতেই খাটে এসে বসে সূচি। আগে গোসল করবে,তারপরে কিছু মুখে দেবে। ঘরের সাথেই লাগোয়া বাথরুম আছে।সূচি স্বস্তি পায়।গোসলের জন্য বাইরে যেতে হবে না।
পাঁচ মিনিটের মাথায় হুমায়রা এলো। ঘরের সামনে এসে অকারণেই মাথায় আঁচল টেনে দিয়ে প্রশ্ন করেঃ” আসুম সূচি?”

” হ্যাঁ, ভাবি।”– শাড়ি সামলে উঠে দাঁড়ায় সূচি।

” কোনোকিছু দরকার?”

” হ্যাঁ, শাড়ি দরকার আমার।গোসল করলে ভালো হতো।”

হুমায়রা পূর্ণ দৃষ্টি দেয় সূচির দিকে। কালকের সাজসজ্জা এখনো আছে।এমনকি বিয়ের ওড়নাটাও পাশে পড়ে আছে।সূচি-ফয়সালের ঘটনা হুমায়রা জানে।ফয়সালের অনাগ্রহ হুমায়রার অজানা নয়। কাল রাতে কি হয়েছে তা জানে না হুমায়রা।তবে সূচির চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যায়, মেয়েটা ভারী ক্লান্ত। কাল যতটা প্রানবন্ত দেখাচ্ছিলো, আজ তেমন লাগছে না। চোখ ফুলে আছে,শাড়িটা এলোমেলো,চেহারাটাও একটু ফুলে আছে যেন।সূচির মুখের দিকে চেয়ে সহসা মন খারাপ হয়ে গেল হুমায়রার।মেয়েটাকে অকারণেই খুব ভালো লাগে।

” তোমার লাগেজের জামা-কাপড় সব ড্রয়ারে।”

” ওহ,জানতাম না আমি।”

” তোমার দরকারি সবকিছু উপরের দুইটা ড্রয়ারেই পাইবা।গোসল কইরা ফালাও।”

সূচি ঘাড় নেড়ে আমতা আমতা করে। হুমায়রা স্নিগ্ধ গলায় বলেঃ” আর কিছু কইবা?”

” হ্যাঁ।মানে.. আমি শাড়ি পরতে জানি না।যদি আপনি একটু..

হুমায়রা হাসে।তার হাসিতে হতভাগ্য মেয়েটার জন্য স্নেহ ঝরে পড়ে।

” আচ্ছা, আমি বসছি এইখানে।তুমি গোসলে যাও।তাড়াতাড়ি কইরো।”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সূচি।শাড়ি পরার অভ্যাস নেই।এই প্যাঁচের পোশাকটা পরতে পারে না।শাড়ি পরতে পারলে রাতেই বিয়ের শাড়িটা পাল্টে ফেলতো।

গায়ে নামমাত্র পানি ঢাললো সূচি।এ ঘরের সবকিছু নোংরা।বাথরুমটা আরো নোংরা। এটা আদোও কেউ কখনো পরিষ্কার করেছে কিনা সন্দেহ।ফ্লোর নোংরা,বালতি নোংরা,মগটা কালো হয়ে আছে,এমনকি বদনাটার অবস্থা দেখলেও নাড়ী-ভুরি মোচড় দেয়।সবকিছুর অবস্থা দেখে সূচি বমি করেনি এই অনেক। চোখ-মুখ বুজে কোনোমতে গোসল শেষ করলো সূচি। মাথায় গামছা পেঁচিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। এই ঘরে মানুষ থাকে কী করে?

” কুঁচিটা এমনে দিবা।এই হাতের মধ্যে এমনে প্যাঁচায়া,এমনে ভালো কইরা গুইজা দিবা।বুঝছো?”

হুমায়রা শাড়ি পরাতে পরাতে সূচিকে শেখায়।সূচি মনোযোগ দিয়ে দেখে। খুবই ঝামেলার পোশাক। খালি প্যাঁচ আর প্যাঁচ।

” ফয়সাল কই গেছে?”

প্রশ্নের উত্তর নেই সূচির কাছে। তবে নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করে না। নিচু গলায় বলেঃ” ভোরে উঠে খামারে গেছে।”

” ওহ।রাইতে ঘুমাইতে কষ্ট হয় নাই তো তোমার?”

” না।ক্লান্ত ছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছি।”

” ভালো করছো।”

কালো খয়েরী রঙের শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে দেয় হুমায়রা।সূচি ছোট মানুষ,শাড়ি সামলাতে পারবে না।তাই জায়গায় জায়গায় পিন আঁটকে দিলো। সূচি মনোযোগ দিয়ে দেখে।পরেরবার থেকে নিজেই চেষ্টা করবে।

শাড়ি পরানো শেষ হলেও চলে গেল না হুমায়রা। খাটের নিচ থেকে ঝাড়ু নিয়ে বিছানা ঝারে। কাঁথা-বালিশ গুছিয়ে দেয়।নেতিয়ে যাওয়া ফুলগুলোকে নিচে ফেলে দেয়।
সূচি চুল মুছে গামছাতে। চুলের পানিতে ব্লাউজ ভিজে যাচ্ছে। গামছা দিয়ে মুছে মুছে চুলের পানিকে একদম নিঃশেষ করে ফেলে।

” তোমগো বাসায় ফোন দিছিলা?”

” না। কালকে আসার পর থেকে আর ফোন দেওয়া হয়নি।”

” ফয়সাল আসলে ফোন দিও। খালাম্মার অবস্থা দেখছিলাম খারাপ।”

মায়ের কথা মনে আসতেই চোখ ঘোলা হয়ে আসে সূচির। কালকে আসার পর থেকে ফোন দেওয়া হয়নি। অবশ্য কার ফোন দিয়ে কল করতো বাড়িতে? ফয়সালের সাথে দেখা হয়েছে রাতে। সূচিই ঠিকমতো কথা বলতে পারলো না,আবার বাড়িতে ফোন দেওয়া।হাতে একটা ফোন থাকলে বেশ হতো।

” সূচি, আমার তো আর কোনো দরকার নাই।আমি তাইলে যাই এখন।”

সূচি মুখ ম্লান হয়।কিছু পেটে দেওয়া দরকার।কাল রাতে নামমাত্র পোলাও খেয়েছে সূচি। মিষ্টি খাওয়ার পর ক্ষুধা ছিল না পেটে।তাছাড়া পোলাও,মাংস সূচি খেতে পারে না। এখন ক্ষুধায় পেট মোচড় দিচ্ছে। পোলাও,মাংস না; দু-চারটে ভাত-ডাল হলে এ বেলার মতো বেঁচে যেতো সূচি।
সূচির মলিন মুখ নজরে এলো হুমায়রার। সে হয়তো বুঝলো। শান্ত গলায় বললোঃ” তোমার ক্ষুধা লাগছে, সূচি?”

সূচি কিছুই বললো না।মাথা নিচু করে বোকার মতো হাসলো কেবল।অপরাধী লাগছে নিজেকে।সূচিকে হয়তো এরা খুব বেহায়া ভাববে।এ বাড়িতে খাবার চাওয়াটাও যেন মস্ত অপরাধ।

“আম্মা তো উঠে নাই এখনো। তুমি বসো।আমি দেখি পোলাও-টোলাও থাকলে তোমারে দিতাছি।”

হুমায়রা পা বাড়ানোর আগেই ব্যস্ত কন্ঠে তাকে থামিয়ে দেয় সূচি।

” ভাবি,পোলাও আমি খেতেই পারব না।যদি একটু ভাত হতো,তবে..

” ভাত মনে হয় নাই।এখনো সকালের রান্না করা হয় নাই।”

” আচ্ছা থাক তাহলে।”

হুমায়রার খারাপ লাগে। মেয়েটাকে ক্ষুধায় কষ্ট দিতে ইচ্ছা হয় না।নরম গলায় বলেঃ” আমি কালকে রাইতে ভাত আর আলু ভর্তা করছিলাম।পোলাও খাইতে আমারো ইচ্ছা করে না।ওইখান থেকাই কিছুটা বাইচ্চা আছে। ভর্তা মনে হয় ভালো আছে।কিন্তু সব বাসি।তুমি খাইবা?”

” বাসি-টাসি কিছু একটা হলেই চলবে।”

সূচির কথায় কিছুই ছিল না।তবুও হুট করেই মন খারাপ হয়ে গেল হুমায়রার।গলা ভিজে এলো।মেয়েটার মন ভারী নরম।পা চালাতে চালাতে বলেঃ” তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি এক্ষুনি আইতাছি।যামু আর আসুম।”

________________________

ফজরের পরপরই ফয়সাল উঠেছে।সারাদিনের পরিশ্রম শেষে বেশ ভালো একটা ঘুম হয়েছে। নামাজ পড়ার অভ্যাস আছে।নামাজের সময়েই ঘুম ভেঙে গেল।আজ সকালে চোখ মেলেই সূচিকে দেখেছে। টুকটুকে লাল শাড়ি জড়িয়ে কুঁজো হয়ে শুয়ে আছে পাশে। লাইট জ্বালানো ছিল। শীতে জবুথবু অবস্থা।প্রত্যেকটা পশম যেন দাঁড়িয়ে আছে। রাতে ভালো ঘুম হওয়ায় সকালের দিকে মনটা ভালো ছিল ফয়সালে।হিংসা বিদ্বেষ, ক্ষোভ,রাগ কিছুই ছিল না। সূচির দিকে চেয়ে খারাপ লাগলো।মেয়েটার উপর রাগ করা বৃথা।তার তো কোনো দোষ নেই।এই কথাটাই নিজেকে বুঝিয়ে বলেছে বার কয়েক।গায়ের কম্বলটা সূচির গায়ের উপর টেনে দিলো। দরজা-জানলা বন্ধ থাকায় ভ্যাপসা গন্ধ হয়েছিল ঘরে।জানলার একটা পাল্লা খুলে দিয়ে মসজিদে চলে গিয়েছিলো ফয়সাল।নামাজ শেষে বাড়ি ফিরেনি।খামারে গেছে।গরুগুলোকে খাবার দিয়েছে।পুকুরের পাড়ে সারি সারি পেঁপে গাছ।কিছু পেঁপে বড় হয়েছে। অকারণেই ঘুরে ঘুরে পুরো খামার দেখেছে ফয়সাল।বাড়ি যেতে ইচ্ছা হয়নি। হেঁটে হেঁটে পেঁপে গুনেছে।ভালোই বাঁধাকপি হয়েছে এবার।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁধাকপির গায়ের রঙ দেখেছে।মাটিতে লেপ্টে বসে লাল শাকের চারাগুলোকে আদর করেছে।মাচায় ঝুলে থাকা লাউগুলোকে ছুঁয়ে দিয়েছে।খামারের সহকারী, আকাশ ঘুমিয়ে ছিল।আকাশের কাজগুলো আজ ফয়সাল নিজেই করেছে।
সূচির সাথে রাগ করা বৃথা— এ কথা বেশ বুঝতে পারে ফয়সাল।কিন্তু মনকে বুঝাতে পারে না।মেয়েটা চোখের সামনে এলেই কি যেন হয় তার।পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে। সূচির দিকে তাকানোর আগেই চোখের দৃষ্টি পাষাণ হয়ে যায়।কথা বলার আগেই গলার স্বর শক্ত হয়ে আসে।ফয়সালের মাঝে আরেকটা সত্ত্বা কাজ করে।একটা চিনচিনে রাগ ভর করে মাথায়।ভিতর থেকে কে যেন বলিষ্ঠ স্বরে ঘোষণা দেয়ঃ” ওই মেয়েটাই খারাপ।সব ওর দোষ।কবুল বললেই হাসিমুখে সংসার করতে হবে? মানুষের রাগ-ক্ষোভ বলতে কিছু নেই পৃথিবীতে?”

সত্যিকার অর্থে সূচির কোনো দোষ খুঁজে পায় না ফয়সাল। মেয়েটার কোনো দোষ নেই,একথা দিনের আলোর মতো সত্য।দোষ যদি কারো থেকেই থাকে তবে তা মায়ের। একমাত্র তার স্বেচ্ছাচারীতার ফল সব।ফয়সাল বুঝেও না বুঝার ভান করে। মায়ের সাথে রাগ দেখানোর কোনো রাস্তা নেই।এমনকি নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা খুলে বলার সাহস নেই। জমানো রাগটুকু তাই হতভাগা সূচির উপর বর্তায়।কর্তৃত্বরেখা সবসময় নিচের দিকে নামে। রোমেলা বানু রাগ দেখান ফয়সালের উপর,ফয়সাল রাগ দেখায় সূচির উপর। মানুষ নিজের চেয়ে দুর্বল মানুষের উপর জোর খাটায়। ফয়সালের হয়েছে সেই দশা।এই চব্বিশ বছরের জীবনে অধিকার ফলানোর মতো, রাগ দেখানোর মতো,শাসন করার মতো সুযোগ কখনো তার হয়নি।ছোটবেলায় আফজালের সাথে মাঝে মাঝে মারামারি হতো।সবসময় বিজয় হতো আফজালের।একটু বড় হওয়ার পর থেকেই জীবনের প্রতিটা সিদ্ধান্ত মা নেয়।কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হয়নি।জামা-কাপড় থেকে শুরু করে পড়াশোনার বিষয়ে— রোমেলা বানু যা বলেছেন তাই মাথা পেতে মেনে নিয়েছে।মায়ের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত সবসময় পছন্দ হতো না।মাঝে মাঝে রাগ হতো।রাগ দেখানোর জায়গা ছিল না ফয়সালের।নিজের মাঝেই পুষে রাখতো।আজ এতোকাল পরে সূচিকে দেখার পরে নিজের মাঝে এক ধরনের পরিবর্তন দেখতে পায় ফয়সাল। কাল থেকে এক ধরণের কর্তৃত্ববোধ জেগে উঠেছে তার মাঝে।সূচিকে দেখলে আদর-আহ্লাদ আসে না।আনন্দও হয় না।শুধু মনে হয়,ওখানে শুধু কর্তৃত্ব চলবে।ফয়সাল জোর-জবরদস্তি করবে,সূচি মাথা নিচু করে মেনে চলবে।শোষন চলবে,শাসন চলবে। সূচির ভালো না লাগলেও মেনে নিবে,যেমনটা এতোকাল ফয়সাল মেনে নিয়েছে। এখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নয়।এই অনিচ্ছার বিয়েতে কেবল দুটো পক্ষ হয়েছে,কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি।কোনো সত্যিকার বন্ধন সৃষ্টি হয়নি। ঊর্ধ্বতন-অধস্তনের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে কেবল।সুতরাং ফয়সাল যা কিছু করুক না কেন,সূচিকে মেনে নিতেই হবে।

সকালের খাবারের পর আর কোনো কাজ ছিল না।খামারে কাজ নেই।মায়ের কড়া আদেশ বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না।বাড়িতে মেহমান আছে,তাদের সাথে কথা-বার্তা বলতে হবে।ফয়সাল মিশুক না।আলাপ জমাতে পারে না। ভাত খাওয়ার পর বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো।সূচি জানলার কাছে দাঁড়ানো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উঠোন দেখছে।ফয়সাল একবার চেয়ে দেখলো মাত্র।তারপর বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো।

আলস্যে ঘুম চলে এসেছিলো ফয়সালের। নারী কন্ঠে ঘুম ভেঙে গেল। সূচি পাশে এসে বসেছে।নিচু স্বরে ডাকছে তাকে।

” শুনছেন,আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?”

ফয়সাল বিরক্ত হলো।চোখ মেলে বললোঃ” কী চাই?”

” আপনার ফোনটা।বাড়িতে একটু কথা বলা দরকার ছিল।”

” তুমি দেখেছো আমি ঘুমিয়ে গেছি।পরে ডাকলে চলতো না? ঘুমের মানুষকে ডাকতে হয়? সেন্স নাই তোমার? এক ঘন্টা পরে ডাকলে কী হতো?”

অনাকাঙ্ক্ষিত খারাপ ব্যবহারে চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে গেল সূচির।বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো ফয়সালের দিকে। তার দোষ কোথায়? পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কেউ ঘুমিয়ে পড়তে পারে,তা তো জানতো না সে।

” যত্তসব।”— ফোন দিলো না ফয়সাল।কাঁথা মুড়ি দিয়ে আবার ঘুমের ভান ধরলো।মনে মনে ভাবলো,মেয়েটা ভালোই আছে।কোনো তেজ নেই।এর গলা টিপে ধরলেও রা কাড়বে না।

সূচি থম মেরে বসে রইলো ফয়সালের পাশে। গত রাতের মতো এবার আর চোখ দিয়ে পানি পড়লো না।কেবল রাগে কপালের দু-পাশের রগ স্পষ্ট হয়ে উঠলো।রাগ উঠলে সূচি চিৎকার-চেঁচামেচি করে না,কাঁদে না,জিনিসপত্র ভাঙে না।কেবল বৃষ্টির আগের গুমোট আকাশের মতো থম মেরে বসে থাকে।ফয়সালকে সে ভালবাসতো,এখনো ভালোবাসে।এই বিয়েতে সে আনন্দিত।তবে আনন্দের নদীতে ভাটা পড়েছে যেন।কল্পনার ফয়সালের সাথে বাস্তবের ফয়সালকে মিলাতে পারে না সূচি। এতোদিন ভালোবাসার আতিশয্য অনুভব করেছে নিজের মাঝে।কিন্তু এই দুই বেলাতেই আতিশয্য কমে এসেছে। প্রত্যাশিত পুরুষকে কাছে পাওয়ার আনন্দ ফিকে হয়ে এসেছে।ফয়সালের নিরাসক্ত ভাব সূচিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, এখানে কিছু একটা ঠিক নেই।কিছু একটা ভীষণ গোলমেলে।
সূচি থম মেরে বসে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ফয়সালের দিকে।রাগে পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। ফয়সালের অনাগ্রহ খুঁচিয়ে ঘা করছে যেন।

” একটু অপেক্ষা করুন।বিয়ে করেছেন বেলায় বেলায় চোখ রাঙানোর জন্য? আপনার এই নিরাসক্ত বৈরাগীর ভাব যদি আমি ঝেঁটিয়ে বিদায় না করেছি তো, আমার নাম সূচি না। আমাকে আপনি চিনতে পারেননি এখনো।আরেকটু সবুর করুন। ”

মনে মনে কথাগুলো বলে নিজেকে ঠান্ডা করে সূচি।এখানে রাগ দেখানো যাবে না।সময় হয়নি এখনো। তাই মনে মনে এটা-ওটা ভেবে নিজেকে শান্ত করে সূচি। অন্যায়ের বিপরীতে ঘা মারতে বেশ ভালোই জানে মেয়েটা।এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here