#শুকতারা (পর্ব-১৯)
#হালিমা রহমান
অলস বিকাল পালাই পালাই করছে। আম গাছের সবচেয়ে নিচু ডালের পাতাটা নিচে পড়ার ফুরসত পেল না।লিলি সযত্নে কুড়িয়ে নিলো।পুতুল খেলায় কাজে লাগবে।পুতুল বউয়ের কাঁথার অভাব।এই হতচ্ছাড়া শীতে লিলি নিজেই কেঁপে কেঁপে অস্থির হয়ে যায়। পুতুল বৌয়েরও নিশ্চয়ই ঠান্ডা লাগে।পুতুল বৌকে কোলের মাঝে নিয়ে ঘুমাতে চায় লিলি।কিন্তু মা দেয় না। কাঁথার মাঝে নিলেই বকে। চোখ পাকিয়ে বলেঃ” লিলি,আমি এক্ষনি ফালায়া দিমু এইটারে।তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ কর।”
এই পাতাটা পুতুলের বাক্সে রেখে দেবে লিলি।পুরোনো কাপড় থেকে একটু-আধটু কাপড় কাটতে দেয় না মা।কাটলেই বকা দেয়।এই পাতাটা কাঁথার কাজ করবে। রাতের বেলা ঘুমানোর আগে চুপিচুপি পুতুলের গায়ের উপর মেলে দিবে। পুতুল বৌ লম্বায় এই পাতার চেয়ে ছোট।দিব্বি ঢেকে রাখা যাবে।
” লিলি, এইবার তুই দম দিবি। আমি তোগো গোয়ালঘর পর্যন্ত দৌড়ায়া আসছি।এবার তোর পালা।দেখি একদমে কতখানি দৌড়াইতে পারোছ।”
হাঁটুতে হাত রেখে একদমে কথা বলে রনি।কথার শেষে দম নেয়। একদমে লিলিদের গোয়ালঘর অবধি ঘুরে এসেছে।চাট্টিখানি কথা নয়। বছর দুয়েকের পুরোনো সোয়েটারটা খুলে করমচা গাছের সাথে বেঁধে রাখে।গরম লাগছে খুব।
” কিরে লিলি,দৌড় দে।”
মাথা নাড়ে লিলি। উঠোনে অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ” ভালো লাগছে না, রনি মামা।আজ আর খেলব না।”
রনি রাগ করে।গাল ফুলিয়ে বলেঃ” তাইলে তুই আমারে খাটাইলি ক্যান? তুই যে একটু আগে কইলি খেলবি।”
” এখন আর ভালো লাগছে না।সূচি ফুপি আসে না কেন? আজকে না ফুপির আসার কথা?”
রনি সূর্যের দিকে তাকায়। বিশাল আকাশ থেকে সূর্য অদৃশ্য হওয়ার পায়তারা করছে।বেলা বেশি নেই।রনি কিছুটা ভেবে বলেঃ” হ আইব।একটু পরেই আইব।”
” সন্ধ্যা বেলা আসবে?”
” জানি না।মনি আপা বলছে আজকেই আসব।”
লিলি খুশি হয়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেঃ” আমরা বৌচি খেলব তখন,ঠিকাছে?”
” সূচি আপা খেলব এখন?”
” খেলবে না কেন? একশবার খেলবে।আমি ফুপাকে বলব,ফুপাও খেলবে।আমি আর ফুপা একদলে,তুমি আর ফুপি একদলে। দর্জি বাড়ির সালমাও খেলতে চায়।ওকে কিন্তু খেলায় নিব না মামা।ও অনেক খারাপ।ওইদিন আমার মাটির হাঁড়িটা ভেঙে ফেলেছে।ফাজিল একটা মেয়ে।”
লিলি ও রনি উঠোন জুড়ে হাঁটে। তাদের জন্য সূচি অনেক কিছু।রনির আজগুবি গল্পের শ্রোতা,লিলির পুতুল খেলার সঙ্গী,রনি-লিলির ঝগড়ার সর্বশেষ বিচারক– সবই সূচি।এরা তাই সূচির কদর করতে জানে। সূচি এবাড়ি থেকে গেছে মোটে দু-দিন, এর মাঝেই বাড়ির আনন্দ যেন একদম শুকিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বাড়ির প্রাণটুকু একদম ছেকে নিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। সূচি যাওয়ার পর থেকে এখন আর বৌচি খেলা হয় না। সূচি না থাকলে খেলায় অনেক ঠকবাজি করে রনি।লিলি পেরেই উঠে না ওর সাথে।তাই খেলাধুলা সব বন্ধ।সূচির একনিষ্ঠ ভক্ত এই দু-জন। লিলি-রনি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত চলে আসে।সদর দরজা কোনো শক্ত-পোক্ত স্টিলের দরজা না, সুপারি গাছে ঘেরা একটুখান মেঠো পথ।উঁচুনিচু কাঁচা মাটি।পথের শেষে সাইনবোর্ডের মতো বুড়ো খেজুর গাছ।জৌলুশহীন বুড়ো গাছ মাথা ঝুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সরু রাস্তার শেষপ্রান্তে।এটাই এ বাড়ির সদর দরজা। রনি খেজুর গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।লিলি চোখ পেতে রাখে হাতের ডান পাশের রাস্তায়।এখান থেকে দর্জিদের বাড়ি দেখা যায়।ওদের ঘাট ভাঙা পুকুরটাও স্পষ্ট দেখা যায়।সেখানে সালমা দাঁড়িয়ে ছিল।লিলির বয়সী মেয়েটা।লিলিকে দেখে হাত নাড়ে। চেঁচিয়ে প্রশ্ন করেঃ” আজকে খেলবি না লিলি?”
” না,আজকে সূচি ফুপি আসবে।”
” আয় একটু খেলি।”
লিলি মাথা নাড়ে। শক্ত গলায় বলেঃ” আজকে কিছুতেই খেলা হবে না।”
সালমা মুখ ভেঙায়। নাক ফুলিয়ে বাড়ির পথ ধরে।লিলির সাথে তার অদৃশ্য এক মতভেদ চলে।এই বয়সেই অনেক ভাব মেয়েটার।
সূর্য ডুবার পথে। সোনা রঙা সূর্যের আলোয় পুরো আকাশ সোনালী রঙে ছেয়ে আছে। পশ্চিমের আকাশটুকু আলোয় রাঙা। শেষ বিকেলের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে বুড়ো খেজুর গাছের পাতায়। খেজুর গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালে মনিদের বাগানটা দেখা যায়।ঘন গাছের আড়ালে ঘুপটি মেরে আছে ক্ষীণ কুয়াশা।সূর্য ডোবার সাথে সাথেই এখানে কুয়াশারা ভীড় করে।অন্ধকারের সাথে ঘন কুয়াশা মাখামাখি হয়ে যায় একদম।
জয়া,মনি, চম্পা উঠোনে হাঁটাহাঁটি করছে।মনিদের পুকুরের কাছে অলস পায়ে হাঁটছে।মনি গলা বাড়িয়ে রনিকে দেখে।উঁচু গলায় প্রশ্ন করেঃ” রনি,অটো দেখা যায়।”
” না আপা।”
তিনজনে আবারো হাঁটে।হাঁটতে হাঁটতে এটা-ওটা বলে।
সাহিদা বেগমের রান্নাঘরে অনেক কাজ।দুপুর থেকে রাঁধছেন।নতুন জামাই আসবে আজ।নানান পদের নাস্তা বানানো শেষ।রাতের খাবারটাও চাপিয়ে দিয়েছেন চুলায়। কাজকর্ম এখনি সেড়ে রাখছেন।মেয়েটা এলে যাতে কাজ ফেলে নিরালায় দু-দন্ড কথা বলা যায়, সেই ব্যবস্থাই করে রাখছেন এখন থেকে।মেয়েটা মোটে দু-দিন নেই বাড়িতে।অথচ সাহিদা বেগমের মনে হয় কতকাল সূচির কন্ঠ শোনেননি।কতকাল একবার চোখে দেখেননি।আঁচলে চোখ মুছে ভাজির কড়াই ঢেকে দিলেন।জ্বলন্ত উনুনের মুখে দুটো কাঠ গুজে দিয়ে, পা চালিয়ে ঘরের সামনে এলেন। এখান থেকে মনিদেরকে দেখা যাচ্ছে।সাহিদা বেগম দুয়ারে দাঁড়িয়ে চম্পাকে ডাক দেন।
” চম্পা,সূচিগোরে দেখা যায়?”
” না,কাকি।”
সাহিদা বেগম চিন্তিত মুখে ঘরে ফিরে আসেন।রান্নাঘরের ক্ষুদ্র জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকান।সন্ধ্যা হয়ে আসছে।সূচি নতুন বউ।সেজেগুজে নতুন শাড়ি-টারি পরে আসবে।সন্ধ্যার মুখে নতুন বউকে নিয়ে আসার কোনো মানে আছে? লোকগুলোর কোনো জ্ঞান নেই। গতবার হিন্দু বাড়ির নতুন বউ নিরুপমাকে নিয়ে আসার সময় কত কান্ড হলো।সন্ধ্যাবেলা নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো যতীন। তখন ঘোর বর্ষা ছিল।কাঁচা রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি,কাদার ছড়াছড়ি।রিকশা আসে না এদিকে।উত্তরের বিল দিয়ে তাই হেঁটেই বাড়ি ফিরতে হলো।সন্ধ্যাটা কোনোরকমে কেটেছে।বিপত্তি হলো রাতে।নিরুপমা ঘুমায় না,কথা বলে না,হাসে না।ল্যাট মেরে বসে থাকে এক জায়গায়।পুরো সিঁথি সিঁদুরে রাঙিয়ে, হাত-পা এক করে সন্যাসীর মতো ধ্যান করে।এই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে, আবার হি হি করে হাসে। যতীনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়।
নিরুপমাকে পেত্নী ধরেছে—- এইরকম একটা খবর রটে গেল গ্রামে।গ্রামবাসীরা ভীর করে নিরুপমাকে দেখতে গিয়েছিল।সাহিদা বানুও সন্ধ্যার পর দেখতে গিয়েছিলেন।হিন্দু বাড়িটা কাছেই। আদিকাল থেকেই উত্তরের বিলটার বদনাম আছে।শোনা যায়, বিলের যেই কোনায় প্রাচীন কেওড়া গাছ আছে, আগে নাকি শ্মশান ছিল সেখানে। রাতদুপুরে বহু মড়া পোড়ানো হতো।সময়ের বিবর্তনে শ্মশান এখন নেই। তবুও সচরাচর জায়গাটা কেউ মারাতে চায় না। উত্তরের বিল ঘেষেই গিয়াসদের বাড়ি।সে বাড়ির মেয়েদের মুখে অবশ্য মুখরোচক গল্প শোনা যায়। এখনো নাকি মাঝরাতে বিলের দিকে তাকালে জ্বলন্ত চিতা দেখা যায়।ধান সিদ্ধের গন্ধ আসে মাঝে মাঝে। অমাবস্যার কথা না বললেই নয়।একটু রাত হতেই ভূতের দল নৃত্য জুড়ে দেয় একদম।
এসব গল্পকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন সাহিদা বেগম। ভূত-প্রেত,জ্বিন-পরীতে তার অগাধ বিশ্বাস।যুক্তি-তর্কের ধার ধারেন না।সবকিছু যুক্তি-তর্কে বাঁধা যায় না,এই তার বড় যুক্তি।ভাজি নাড়তে নাড়তে মনে পড়লো,আসার পথে সূচিদেরকেও উত্তরের বিল পাড়ি দিয়েই আসতে হবে।এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে আসছে।সাহিদা বেগমের বুক ঢিপঢিপ করে। মেয়ে,মেয়ের জামাইয়ের জন্য চিন্তা হয়। নতুন বউ, নবজাতকের উপরে ওসব জিনিসের নজর বেশি থাকে। মনে মনে শঙ্কিত না হয়ে পারেন না সাহিদা বেগম।চোখ বন্ধ করে খোদার কাছে প্রার্থনা করেন।আল্লাহ যেন মেয়েটাকে সকল বদনজর থেকে বাঁচায়,এই দোয়া করেন মনে মনে।
দু-দিন ধরে শীত পড়ছে বেশি।বেলায় বেলায় খবরে বলছে, দেশে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। উত্তরের বাতাসে চামড়ার মাঝে লুকানো হাঁড়গুলো অবধি কেঁপে উঠে। গায়ে সোয়েটার না থাকায় একটু পরপর কেঁপে উঠছে রনি।শীতের বাতাসে ভেসে আসছে খেজুর রসের তীব্র ঘ্রাণ।দর্জি বাড়িতে খেজুর রস জ্বাল দেয় প্রতি বিকালে। ওরা খেজুর রস বিক্রি করে। মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব। মাগরিবের আযান হচ্ছে। সবে শুরু হয়েছে আযান।এমন সময়,লাল রঙা অটো বিশ্রি শব্দ করে ব্রেক কষলো বাড়ির সামনে।চকচক করে উঠলো রনি-লিলির চোখ।তড়িঘড়ি করে দৌড়ে গেল অটোর কাছে। ঝর্ণার পানি যেমন তীব্র গতিতে নিচে নামে,তেমনি সূচিও অটো থেকে নামলো।চঞ্চল পায়ে, তীব্র গতিতে। ফয়সালও নামলো পিছনে।এমন সময়ে দৌড়ে এসে সূচির গায়ে হুমড়ি খেয়ে পডলো লিলি।ছোট ছোট দুটো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো সূচিকে।সামলাতে না পেরে সূচি একটু হেলে পড়লো ফয়সালের উপর।ফয়সাল পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল।বিরক্ত গলায় বললোঃ” আস্তে।”
সূচি ফয়সালের কথায় কান না দিয়ে লিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। প্রসন্ন গলায় বললোঃ” কিরে,কী খবর? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছিস এখানে?”
” অনেক্ষণ।আমার পা ব্যাথা হয়ে গেছে ফুপি।তোমাকে আর কোথাও যেতে দেব না।”
রনি লিলির মাথায় টোকা দেয়। সূচির একহাত জড়িয়ে বলেঃ” লিলি, ছাড় সূচি আপারে।মনি আপারা দাঁড়ায়া আছে ওইখানে।”
সূচি উৎসুক চোখে বাড়ির ভিতরে তাকায়।তিনটি মানুষ প্রবল আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে।সূচির চোখ ভিজে আসে।মনে হয় যেন কত বছর পরে দেখলো।লিলিও ততোক্ষণে সূচিকে ছেড়ে দিয়েছে।বাড়ির ভিতরে ছুটে গেল সূচি।পিছনে রনি,তার পিছনে লিলি।মমিন শেখের সাথে হাতে হাতে পান,মিষ্টি, দই,লাগেজ নামাচ্ছিলো ফয়সাল।আঁড়চোখে একবার বউকে দেখলো। বাড়ির সীমানায় পা রাখতেই মেয়েটা যেন বদলে গেল।এতোটা চপলতা এই দু’দিন দেখেনি। এই প্রথম ফয়সালের মনে হলো, সূচি কেবল হাতে-পায়েই বড় হয়েছে। চামড়ার আবরণের মাঝে লুকিয়ে থাকা প্রাণটার একটুও বয়স হয়নি।জন্মের পর থেকে বছরের পর বছর চলে গেছে,কিন্তু পরিপক্বতা এখনো ভিতর অবধি পোঁছাতে পারেনি।
সূচি চম্পাকে জড়িয়ে ধরলো,জয়ার গলা জড়িয়ে হেসে কুশলাদি বিনিময় করলো,উঠোনে দাঁড়িয়ে মনির গলা ধরে কথা বলতে বলতে হাসলো।কিন্তু মাকে দেখে আর হাসি ফুটলো না মুখে।সন্ধ্যার অন্ধকারেও মায়ের চিররুগ্ন শরীরের অবসন্নতা নজর এড়ালো না সূচির। লম্বা-চওড়া শরীরের জৌলুশ হারিয়ে গেছে এই দু’দিনেই।মনে হয় যেন মায়ের বয়স আরো দশ বছর বেড়ে গেছে। মায়ের দৃষ্টিতে হাহাকার।সূচির অন্তরাত্মা পর্যন্ত হু হু করে কেঁদে উঠলো। দৌড়ে যেয়ে মায়ের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।মায়ের শরীরে কাঁচা মাংস,আদা-রসুন,পিঁয়াজের কড়া গন্ধ।সূচি প্রাণভরে শ্বাস নেয়।মুখ লুকিয়ে বলেঃ” তোমার এই অবস্থা কেন আম্মা? আমি ভাল আছি তো,অনেক ভালো আছি।”
শেষের দিকে কন্ঠে বিকৃতি আসে সূচির।সাহিদা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। চোখের পানিতে সূচির বোরকার কাঁধটুকু ভিজে গেছে। নিজেকে ধাতস্ত করে প্রশ্ন করেনঃ” তোর গলা ভাঙলো ক্যামনে? এই দুইদিনেই ঠান্ডা লাগায়া ফেললি!”
সূচির উত্তর দেওয়ার সময় হয় না।মমিন শেখ,রতন পাটোয়ারী,লতিফ, ফয়সাল পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।পিছন থেকে সালাম দেয় সে।
” আসসালামু আলাইকুম, আম্মা।”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম।ভালো আছো বাবা?”
” জ্বি আম্মা। আপনি ভালো আছেন?”
” এইতো বাবা।”
সূচির কাঁধ জড়িয়ে ঘরের পথে পা বাড়ান সাহিদা বেগম।আযান পড়ে গেছে। ঘরের সামনে লাগেজসহ দই-মিষ্ট পৌঁছে দিয়ে ঘরে ঢুকলো না ফয়সাল।নামাজের জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
__________________________
হরেক রকম নাস্তা গিলে, সাহিদা বেগমকে ও বাড়ির খবরা-খবর বলে,পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে ঘন্টা-দুয়েক খোশ গল্প করে সূচি যখন নিজের ঘরে ঢুকলো,ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা বাজে। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে ফয়সাল তখন সূচির খাটে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আজ সারাদিনে দুটো পা এক করার সময় হয়নি।বৌভাতের ঝামেলা ছিল।এ বাড়ি থেকে দশ-বারোজন মেহমান ও নিজেদের পক্ষের বিশ-পঁচিশ জনের জন্য মোটামুটি ভালোই আয়োজন করতে হয়েছে।সূচির বিছানাটা পরিপাটি। দেখলেই গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।বালিশে হেলান দিয়ে ফোন ঘাটাঘাটি করছে ফয়সাল।আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে সূচি চুলে বিনুনি করছে। মেয়েটার পিঠ ভাসানো কালো মেঘের মতো এক গোছা চুল আছে।কোমড় ছুঁয়ে যাওয়া চুলগুলো যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করে।তবে ফয়সালের নজর পড়লো না এদিকে।সে ফেসবুকে ঘুরছে।এঞ্জেল শ্রাবনী একটা চকচকে ছবি দিয়েছে প্রোফাইলে।সেই ছবিটাকেই ছোট-বড় করে,মুগ্ধ চোখে দেখছে ফয়সাল। অনলাইনের এই বান্ধবীটি বড়ই সুন্দরী।
” আপনার কী কিছু লাগবে?”
প্রথমবার সূচির কথা শুনলো না ফয়সাল।সে শ্রাবনীতে ব্যস্ত।সূচি আবারো ডাকলো।ফয়সালের কাছে যেয়ে বললোঃ” শুনছেন,আপনার কিছু দরকার?”
কাজে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত চোখে সূচির দিকে তাকালো ফয়সাল।মেয়েটা বিরক্তির উল্টোপিঠ।খসখসে গলায় উত্তর দিলোঃ” লাগলে আমি তোমাকে বলতাম না?”
চিনচিনে রাগে ছেয়ে গেল সূচির সবটুকু।এই লোকের মেজাজ এমন কেন? ভালো-খারাপ কিছু বললেই ছ্যাৎ করে ওঠে।আগুন গরম তেলে পানি পড়লেও বোধহয় এমন হয় না। সূচি জ্বিভ শক্ত করে কিছু বলার আগেই, দরজার বাইরে থেকে শোনা গেল রনির কন্ঠ।
” সূচি আপা,তোমারে মনি আপা যাইতে বলছে।ওইখানে সবাই জলপাই ভর্তা খায়।তুমি খাইবা না?”
ফয়সালকে শক্ত-পোক্ত জবাব দেওয়ার আগেই থেমে গেল সূচি। রনিকে উদ্দেশ্য করে বললোঃ” যা তুই। আমি আসছি।”
” তাড়াতাড়ি আসো।”
উল্টোদিকে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল রনি।রাগটুকু গিলে নেওয়ার চেষ্টা করলো সূচি।হলো না।মুখ দিয়ে গড়গড় করে বেরিয়ে পড়লোঃ” আপনি একটা খাটাশ।কথায় কথায় এমন ছ্যাৎ ছ্যাৎ করেন কেন? কখনো মুখে মধু দেয় নাই কেউ? আজব।”
ফয়সালের হতবিহ্বল চোখের সামনে দিয়ে থপথপ করে হেঁটে বাইরে চলে গেল সূচি।ফয়সাল বিস্মিত। একরাশ বিস্ময়ের ভীড়ে রাগ করার সুযোগ পেল না। সূচি এরকম শক্ত কথা বলতে পারে,এ কথাটাই সহসা বিশ্বাস হলো না ফয়সালের।
কারেন্ট গেছে একটু আগে।বিছানার পাশের টেবিলে জ্বলছে ছোট্ট কুপি। পুরো ঘরে আলোর অভাব।পাতলা কাঁথায় কোমড় অবধি ঢেকে এই ক্ষুদ্র আলোকে আশ্রয় করে আড্ডা জমেছে মনির ঘরে।হাতে জলপাই ভর্তার প্লেট নিয়ে মনি উৎসুক গলায় প্রশ্ন করেঃ” তারপর সূচি বিবি,ক্যামন কাটে আপনের দিনকাল?”
প্রশ্নের শেষে মুখ টিপে হাসলো মনি। চম্পা কাঁধ দিয়ে সূচির কাঁধে ধাক্কা দেয়। ফিঁচেল গলায় ফিসফিসিয়ে বলেঃ” আমগোরে না কইলে কারে কবি?”
সুন্দর প্রশ্ন।এরা ছাড়া সূচির এতো আপন আর কে আছে? তবে বলার মতো তো কিছুই নেই।সূচি উদাসীন হয়।এই দু’দিন কী হয়েছে? অতীত হাতড়ে দেখে সূচি।কিছুই হয়নি।বিয়ের উপহার হিসেবে ফয়সালের কাছ থেকে বেলায় বেলায় পেয়েছে চোখ রাঙানী আর কিছু শক্ত কথা। বিয়ের রাতে ফয়সাল ক্লান্ত ছিল বলে দুজনের মাঝে কোনো কথা হয়নি।কালকেও হয়নি,কাল রাতেও হয়নি।এমনকি ভালো-মন্দ দুটো স্বাভাবিক কথাও না।ফয়সাল নিয়ম করে রাতে ঘরে এলো,সূচিকে উপেক্ষা করলো, দাম্ভিক স্বরে ঘোষণা করলো,সে কাঁথা-কম্বল শেয়ার করতে পারবে না।সেই প্রথম রাতের মতো সূচি আবারো অভিমান করে পাশে শুয়ে ছিল।শাড়ি ভিন্ন গায়ের উপর ছিল না আরেকটা কাপড়।এ কি মানুষের মাঝে বলার মতো কথা? সূচি আনমনা হয়।মান বাঁচাতে মিথ্যা বলে।
” উনি অনেক ভালো ভাবি। তবে একটু চুপচাপ।সহজে সবার সাথে মিশতে পারে না।”
জয়া অভয় দেয়। সূচির কাঁধে হাত বুলিয়ে বলেঃ” আরে মুখচোরা মাইনষে বউরে বেশি ভালোবাসে।ফয়সালরে কিন্তু আমার দারুন লাগে।”
মনি পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটে।জলপাই মুখে বিজ্ঞের মতো বলেঃ” শোন সূচি,মাচার লাউ আর ঘরের জামাই একইরকম। দুইটাই কখনো বুড়া হয় না,পুরান হয় না।ফয়সালের কদর করবি তুই। মুখে মধু মাখায়া কথা কবি।বুঝছোছ?”
সূচি বুঝেছে কি না বোঝা গেল না। সূচির উত্তরের আগেই ও-পাশ থেকে চম্পা উত্তর দিলো।মনির কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বললোঃ” না সূচি,ওতো আহ্লাদ করবি না। আমার কাছে কী মনে হয় জানোছ?”
” কী?”
” জামাইগো লগে ওতো তুনুতুনু করা উচিত না।এরা হইলো বান্দরের মতোন।তুই একটু লাই দিবি,ওমনেই মাথায় চইড়া বসব। মাথা থেকা নামাইতে তখন ঝামেলা।তোর রায়হান ভাইরে দেখছ না? আমি সুন্দর কইরা কথা কইলে কানে নেয় না।আর ঝাড়ি মাইরা কথা কইলে ঠিকই শোনে।তুই কী করবি জানোছ?”
সূচি কৌতুহলী হয়ে উঠলো।মনির কথা পছন্দ না হলেও চম্পার কথা বেশ পছন্দ হয়েছে।ফয়সাল ভালোভাবে কথা বলে যে সূচি মধুমাখা কথা বলবে? সূচি আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করেঃ” কী করব?”
” ফয়সাল তোর লগে কী কী করে তা পাই টু পাই হিসাব রাখবি।ওমনেই ওর লগে আচরণ করবি।ধর ফয়সাল যদি ভালো ব্যবহার করে তাইলে তুইও আদর-আহ্লাদ কইরা কথা কবি।আর যদি ধর একটু তিড়িংবিড়িং করে তাইলে তুইও তিড়িংবিড়িং করবি।বুঝোছ নাই? যে যেমন তার লগে তেমন।বুঝছোছ?”
জয়া,মনি খিকখিক করে হাসলো। তবে সূচি হাসলো না।মাথায় গেঁথে নিলো কথাগুলো।মনে মনে নেড়েচেড়ে দেখলো,চম্পার কথা তার বেশ পছন্দ হয়েছে।চম্পার কথা ঠিক কতটুকু প্রভাব ফেলেছে তা বোঝা গেল রাতের খাবারের পরেই।
মেয়ের জামাই ও মেয়েকে খাবার খাওয়ানোর পর সাহিদা বেগম ও মমিন শেখ শুয়ে পড়লেন।সারাদিনের পরিশ্রমে বুড়ো হাঁড়গুলো হাঁপিয়ে উঠেছে একদম।ঘরে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। বিছানা-বালিশ গোছানোর পর মশারির ভিতরে বসে কম্বল ঠিক করছে সূচি।তার মুখটা কঠিন।রাতের অন্ধকারের মতোই কালো হয়ে আছে সূচির মুখখানি।ফয়সাল দেখলো না সূচির থমথমে মুখ।দেখলে নিশ্চিত অবাক হতো।টিনের ঘর।ফাঁক-ফোকড় দিয়ে বাতাস আসছে দস্যুর মতো।ফয়সালকে কাবু করে ফেলেছে ।লাইট নিভিয়ে এক লাফে খাটে চলে এলো ফয়সাল। ঘর অন্ধকার,আশেপাশে কোনো সাড়া-শব্দ নেই।ফয়সাল কম্বলে হাত দেওয়ার আগেই তা টেনে নিজের দিকে নিয়ে নিলো সূচি।প্রথমবারেই ঘটনাটা ঠিক বুঝলো না ফয়সাল।তাই আবারো ধরতে গেল।আবারো একই কাজ করলো সূচি।দুই-তিনবার একই কান্ড ঘটায় অবাক না হয়ে পারলো না ফয়সাল।ফোনের আলো জ্বেলে বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলোঃ” কী করছো তুমি?”
” আপনার হাত থেকে কম্বল রক্ষা করছি।”— থমথমে মুখে উত্তর দিলো সূচি।
” মানে?”
” মানে খুব সাধারণ। আমি কারো সাথে কাঁথা-কম্বল শেয়ার করতে পারি না।আপনি ওই পাতলা কাঁথাটা গায়ে দিবেন প্লিজ।”
ফয়সালের কথাটাই ফিরিয়ে দিলো সূচি।এতোক্ষণে পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হলো।তেঁতে উঠলো ফয়সাল।আঙুল নাচিয়ে বললোঃ” ত্যাদড়ামি করবা না।তোমার সাহস তো কম না।”
গম্ভীর মুখটাকে আরো গম্ভীর করে ফেললো সূচি। খসখসে গলায় বললোঃ” সাহস আমার বরাবর বেশি।শুধু আপনি এতোদিন জানতে পারেননি।”
আগাগোড়া কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো সূচি।ফয়সাল ক্ষুব্ধ, রাগান্বিত। রাগে সূচির গা ঘেষে বসে শক্ত গলায় বললোঃ” তুমি কি চাও আমি আব্বা-আম্মার কাছে বিচার দেই? আমি কি যাব ওনাদের কাছে?”
” আপনার ইচ্ছা।যেয়ে কী বলবেন? বউ আপনাকে কম্বল দিচ্ছে না? বলতে পারবেন? আচ্ছা বলুন।আপনার কান্ডকারখানাও তো আমি কম দেখিনি।ওসবের কথা তোলাই থাক।”— বিশেষ ভাবান্তর দেখা গেল না সূচির মাঝে। ফয়সাল আরো রেগে গেল।জ্বলে উঠে বললোঃ” বাড়াবাড়ি করছো সূচি।”
” আপনার থেকে শিখেছি।”
” আমার রাগ উঠে যাচ্ছে কিন্তু।”
” আচ্ছা উঠুক।”
কাট কাট উত্তর।রাগে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে ফয়সালের।হাত বাড়িয়ে কম্বলের এক প্রান্ত ধরে টানাটানি করলো কিছুক্ষণ। কিন্তু না, কাজ হলো না।সূচি পেট-পিঠের নিচে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে আছে।একাংশও এলো না ফয়সালের হাতে।এদিকে টিনের ফাঁক দিয়ে আসা বাতাসে প্রাণ যায় যায়। ওদিকে সূচির কোনো হেলদোল নেই। ফয়সাল জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইলো সূচির দিকে।কাল ভেবেছিল সূচির তেজ নেই।নিস্তেজ একটা মেয়ে।কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওর মতো একরোখা গোঁয়ার মেয়ে পৃথিবীতে আরেকটা নেই।
চলবে…..