শুকতারা পর্ব-১

0
5038

শীতের দুপুরে টিউবওয়েলের পানি হাত-মুখে ছোঁয়াতেই পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো সূচির।মুখে দু-একবার নামমাত্র পানির ঝাপটা দিয়ে তড়িঘড়ি করে ঘরে চলে এলো। হাত ও মুখ থেকে পানির অসংখ্য বিন্দু অপসারণ করে বালিশের উপর ভেজা তোয়ালে রাখতেই রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলো ভূমি।মেয়েটার হাতে স্টিলের সস্তা খুন্তি। সেখান থেকে তেল চুইয়ে পড়ছে। বামহাতে তোয়ালে সরাতে সরাতে বিরক্ত গলায় বললোঃ” ভদ্রতা শিখলি না, সূচি। বালিশটা ভিজে গেলে কেমন হবে?”

সূচি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এই এক কারণে বোনের বাসায় আসতে তার মোটেও ইচ্ছে করে।ধপ করে খাটের কোনে বসে বললোঃ” একারণেই আসতে ভালো লাগে না আমার। এতো দোষ ধরো কেন তুমি?”

_” তর্ক করবি না, তুই ভুল করেছিস।”__টিনের দরজার উপর তোয়ালে মেলে দিলো ভূমি।

__” আচ্ছা করব না। পিঠার বক্স ধুয়ে দাও, আমি বাড়ি চলে যাই। আব্বা বাড়ি ফিরে আমাকে না দেখলেই খুঁজতে বেরোবে।”

একটু যেন নরম হলো ভূমির কন্ঠ।নরম গলায় বোনকে বললোঃ ” দুপুরে খেয়ে যা। কৈ মাছ ভুনা করছি তোর জন্য। ঝাল করে একটু কলমি শাক ভেজেছি।খাওয়ার পরে বাড়ি যাস।”

_” না আপা,আব্বাকে তো চিনোই। যদি জানতে পারে আমি এখানে তবে পিঠের ছাল তুলবে আমার।”

_” আব্বা তোকে এখনো মারে?”

_” সবসময় না মাঝে মাঝে। সেদিন পরীক্ষার পরে একটু দেরি করে বাড়ি ফিরেছি বলে একটা চড় মেরেছে।”

_” আম্মা কিছু বলে না?”

সূচি মুখ বাঁকিয়ে হাসে। হতাশ গলায় বলেঃ” আম্মাকে তুমি চেনো না? আম্মা কখনো আব্বার মুখের উপর কিছু বলে?”

ভূমির চোখ ভিজে আসে।তার ভুলের মাশুল দিচ্ছে আদরের ছোট বোনটা। আগে আব্বা-আম্মা এমন ছিল না।ফুলের টোকাও লাগতে দেয়নি ওদের দু-বোনের গায়ে।অথচ এখন? ভূমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এই জের আরো কতদিন টানতে হয় আল্লাহ মালুম।

_” তুমি চিন্তা করো না, আপা।আব্বা আমাকে এমনিতে অনেক আদর করে।শুধু একা একা খুব একটা বাইরে যেতে দেয় না আর একটু বেশি সন্দেহ করে।এছাড়া আর সবদিক ঠিক আছে।”

_” এখানে কি বলে এলি?”

_” রত্নাদের বাড়ির নাম দিয়ে।ওদের বাড়িতে গেলে কিছু বলে না আব্বা।রত্নার বাবা বন্ধু মানুষ না।বিকালেও তো আমি ওখানেই যাই। আব্বাও কিছু বলে না,আম্মাও কিছু বলে না।”

_” রত্না আসে নাকি আমাদের বাড়ি?”

_” হুম,প্রতি বিকালেই আসে।তারপর ওর সাথেই ওদের বাড়ি যাই।”

_” তুই একটু বস।আমি আসছি।”

সূচিকে বসিয়ে রেখে আবারো রান্নাঘরে ছুটে গেল ভুমি।কড়াইয়ের মাছগুলো উল্টে দিলো।একটা মাছকে খুন্তি দিয়ে চেপে চেপে ভালোমতো ভেজে নিলো হালকা তাপে।

সূচি এদিক-ওদিক সাবধানী নজর বুলিয়ে টেবিলের উপর থেকে ছোঁ মেরে ভূমির মোবাইলটা হাতে নেয়।আধ-পুরানো টিনের দরজার ওপাশে একবার সাবধানী নজর বুলিয়ে ফোনের লক খোলে।প্রফুল্লচিত্তে ফেসবুক অপশনে ক্লিক করে কাঙ্ক্ষিত নাম লেখে সূচি।
কাজী ফয়সাল লিখে সার্চ দিতেই সবার উপরেই চলে আসে সূচির প্রত্যাশিত আইডিটা।আরেকবার দরজার দিকে নজর দেয়।না,ভূমি আসেনি এখনো।একটুখানি লাজুক হেসে আইডিতে ঢুকে পড়ে সূচি।

” কাজী ফয়সাল (পিন্টু)”
বায়োতে লেখা __ডোন্ট জাজ মি বাই মাই প্রোফাইল পিক।
এর আরেকটু নিচে চোখে পড়ে বাংলায় লেখা একটা লাইন।
“আমাকে দেখতে এসো না মেয়ে,নিজেকেই হারিয়ে ফেলবে।”

হায় রাব্বা! বুকের বাম পাশে হাত দেয় সূচি।দু-কানের কাছে বিখ্যাত “কুছ কুছ হোতা হে ” লাইনটা বাজছে। বায়ো নয় যেন সতর্ক বার্তা ঝুলিয়ে দিয়েছে ফয়সাল।এটা নিশ্চিত সূচিকে উদ্দেশ্য করেই লেখা।

আরেকটু নিচে যায় সূচি। আরো অনেক কিছু লেখা।ওয়ার্কস এট রিয়েক্টর,ওয়ার্কস এট ফেসবুক,স্টাডিড এট বরিশাল বি.এম কলেজ, হাবিজাবি আরো অনেক কিছু লেখা।ভি.আই.পি প্রোফাইল__ বাক্যটাও চোখে পড়ে সূচির।সূচি হেসেই কুটিকুটি। ফেসবুক কি মিথ্যা কথা লেখার কারখানা নাকি?বি.এম কলেজ জীবনে চোখে দেখেছে ফয়সাল?

আরেকটু নিচে যায় সূচি। কাল রাতেই একটা ছবি পোস্ট করেছে ফয়সাল।তার ক্যাপশনে লেখা _” শত দুঃখেও আমি হাসতে জানি,তারপর দুটো হাসির ইমোজি।
ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সূচি।মাথায় একঝাঁক কোকড়া চুল,গলায় কটকটে নীল রঙের মাফলার,গায়ে কালো রঙের জ্যাকেট।জ্যাকেটের চেইন খোলা, ভিতরে কালো রঙের টি-শার্ট দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটের কোনে সূচিকে পাগল করা মুচকি হাসি আর স্থির দৃষ্টি ক্যামেরার দিকে।সূচি শেষ,একদম শেষ।আরেকবার দরজার দিকে চেয়ে হুট করেই এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসে সূচি।ঠোঁটের কাছে ফোনটা এনে ছবির উপর চুমু দেয়। একটা,এরপর আরেকটা। চোখ বন্ধ করে চুপিচুপি প্রার্থনা করেঃ ” মানুষটাকে আমার করে দেও খোদা।আর কিছু চাই না। এইচএসসিতেও পাশ মার্ক চাই না।শুধু স্বামী হিসেবে এই মানুষটাকে আমায় দান করো।”

_” কিরে ওখানে কি করছিস, সূচি?”

ভূমির কন্ঠে আত্মা শুকিয়ে আসে সূচির। ভূমি যদি ফয়সালের ছবি দেখে তবে এক চড়েই দাঁত ফেলে দেবে সূচির।

_” তোমাদের বিয়ের ছবিগুলো দেখছিলাম আপা।”

_” এক ছবি আর কতবার দেখবি “__ টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে হাতে থাকা ভাতের থালা টেবিলে রাখে ভূমি।চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলেঃ” ফোন রাখ।আয় তোকে খাইয়ে দেই।ওই চেয়ারে বস।”

_” আরে দেরি করলে আব্বা মারবে।খাব না আমি, তুমি পিঠার বক্স ধুয়ে দাও।”

_” দেরি হবে না, চুপচাপ বস। মাছ ভুনা করতে পারলাম না আর।আজকে মাছ ভাজা দিয়ে খা।”

_” ধুর, কি যে করো না তুমি।”__ পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসে পড়ে সূচি।
বোনের হাত থেকে ছোট ছোট লোকমা মুখে নিতে নিতে অতি সন্তোর্পণে সার্চ হিস্ট্রি থেকে ফয়সালের নামটা ডিলেট করে দিলো।এতোক্ষণে প্রাণভরে শ্বাস নেয় সূচি।এতোক্ষন যেন প্রাণটা গলার কাছে আটকে ছিল।

_” হ্যাঁ রে সূচি,তোর পরীক্ষা ভালো হয়েছে?”

_” হুম।”

_” তোর হুমেও তো ভেজাল আছে।এসএসসিতে পেয়েছিলি এ মাইনাস,এবার কি করবি? পাশ করবি তো?”

মুখে ভাতটুকু গিলে নিয়ে সূচি বেশ বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয়।

_” ভবিষ্যতের কথা মানেই ভাগ্যের কথা।যারা ওসবে নাক গলায়,তারা ইঁচড়েপাকা পোলাপান। আমি ওসব ছেলে-মেয়েদের কাতারের নই।”

_” তবুও একটা আইডিয়া তো থাকে।আমি ইন্টারে পরীক্ষা দিয়ে বলেছিলাম, যুক্তিবিদ্যায় আমি আশির উপরে পাব।ঠিক তাই হয়েছে।”

_” আহ,ফ্যাচফ্যাচ করো না।ভাত দাও।পৃথিবীতে গল্প করার মতো আরো অনেক বিষয় আছে।আমি অযথা পড়াশোনা নিয়ে গল্প করে মুড খারাপ করব কেন?”

_” আমি না থাকায় খুব বেশি উড়ছিস।আম্মা আমার সম্পর্কে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে? ”

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝায় সূচি। ঝলমল করে উঠে ভূমির গোলগাল ভারী মুখটা।আগ্রহ নিয়ে প্রিশ্ন করেঃ” কি জিজ্ঞেস করে?”

_” আমাকে না চম্পা ভাবিকে তোমার শরীর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। ইশতি ভাই নাকি রায়হান ভাইয়ার ফার্মেসী থেকে তোমার জন্য ঔষধ নেয়।সেদিন চম্পা ভাবি আমাকে বললো, তোমার সুস্থ হতে আরো ছয়মাস বাকি।”

_” ওগুলো বাদ দে।আম্মা চম্পা ভাবিকে কি জিজ্ঞেস করে সেটা বল? তুই নিজের কানে শুনেছিস?”

_” হুম।ওই তুমি ভালো আছো নাকি,অসুস্থ হয়ে যাও নাকি,আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয়েছে নাকি এসব।”

_” এসব চম্পা ভাবি জানবে কিভাবে? তুই মিথ্যা বলছিস সূচি?”

ভূমির সন্দেহী চোখের সামনে সংকুচিত হয়ে পড়ে সূচি। তবে খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়।ছোট-খাটো মিথ্যা বলায় সে বেশ পটু।নিজেকে বাঁচানোর জন্য অথবা বোনকে খুশি করার জন্য সে অনেক সময় মিথ্যা বলে। একটু পানি খেয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললোঃ” আরে সত্যি বলছি।রায়হান ভাইয়ার দোকান থেকে ঔষধ নেয় তো ইশতি ভাইয়া।তখন হয়তো কথা হয় তাদের মাঝে।আর রায়হান ভাইয়া বাড়ি যেয়ে চম্পা ভাবির সাথে বলে।”

ভূমি কিছুই বললো না।তবে তার মুখের কোনে লেগে রইলো তৃপ্তির হাসি। সূচির চোখ জুড়িয়ে যায়।ইশ! মা যদি একবার ভূমি আপার খোঁজ নিতো। অসুস্থ মানুষটার কি মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে না?

***

ভাত খেয়ে, বোরকা পরে তৈরি হতে হতে তিনটা বেজে গেল। উঠোনে দাঁড়িয়ে বোনের কাছ থেকে বিদায় নিতেই ফস করে সূচির হাতে এক হাজার টাকার একটা নতুন নোট গুজে দিলো ভূমি।সূচি তড়িঘড়ি করে টাকাটা ফেরত দিতেই ধমক দিলো ভূমি।শক্ত গলায় বললোঃ” নিজের কাছে রাখ।সামনে শীতের মেলা বসবে রত্নাকে দিয়ে কিছু আনিয়ে নিস।”

_” আব্বা জবাই দিবে জানতে পারলে।”

_” এসব ছোট-খাটো বিষয় আব্বা জানবে কেন? আর বেশি ভয় করলে রত্নার কাছে জমা রাখিস।”

প্রথমে না করলেও পরে ঠিকই নোটটা ব্যাগের ভিতর রাখলো সূচি। বোনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে বললোঃ” আসছি আপা।ভালো থেকো।আর কখনো শরীর খুব বেশি খারাপ হলে আমাকে একটা খবর দিও।যেভাবেই হোক আসব আমি।”

_” আচ্ছা। সাবধানে যাবি।আর ভালো থাকিস।আবার কবে আসবি?”

উত্তর দিতে যেয়ে গলা ধরে আসে সূচির।তিন মাস পরে আজ সুযোগ পেয়ে এসেছে।আবার কবে সুযোগ পাবে আল্লাহ জানে।বোনের কথাকে কৌশলে এড়িয়ে যায় সূচি। সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলেঃ” তুমি ঘরে চলে যাও।আর আসা লাগবে না। ”

আর পিছু ফিরে তাকায় না সূচি।ভূমির চোখে পানি দেখেছে।এই একটা জায়গায় সূচির সবচেয়ে বড় দূর্বলতা।

সুনসান রাস্তায় একা একা হাঁটছে সূচি।মাটির রাস্তার দু-ধারে সুপারি গাছ।ভূমি আক্তার ও সূচনা আক্তার সূচি দুই বোন। দুজনের মাঝে কোনো মিল নেই।না চেহারায়,না মেধায়,না কথা-বার্তা, আচার-আচরণে।তবে দুজনের মাঝে আত্মার মিল ষোলো আনা। বয়সের পার্থক্য প্রায় ছয় বছর হলেও সম্পর্কটা ঠিক বন্ধুর মতো। দুই বোন ছিল বাবা-মায়ের চোখের মনি।তবে বিপত্তি বাধলো কয়েক বছর আগে।এইচএসসি পরীক্ষার পর ভূমির বিয়ে ঠিক হলো।কৃষক মমিন শেখের মনে হলো বড় মেয়ে খুব বেশি শিক্ষিত হয়ে গেছে।আর দরকার নেই।তার বংশের কোনো মেয়ে হাইস্কুল দেখেনি ,সেখানে ভূমি কলেজ অবধি ঘুরে এসেছে।ব্যস! আর কি দরকার? এবার বিয়ে-শাদির প্রয়োজন।যেই ভাবা সেই কাজ।ভূমির জন্য পাত্র খোঁজার কাজে নেমে গেলেন মমিন শেখ।তার বড় মেয়ে দেখতে সুন্দর,শিক্ষিত,বেশ ভালো আদব-কায়দা জানে,ঘরের কাজেও পটু। দেখা গেলো গ্রাম জুড়ে ভূমির পাত্রের অভাব নেই। এদিক-ওদিক থেকে শুধু সম্বন্ধ আসছে।সেখান থেকেই বেছে-বুছে কানাডা ফেরত এক পাত্র ঠিক করলেন মমিন শেখ।পাশের গ্রামের ছেলে। কানাডায় কি এক উচ্চ মানের কাজ করে,পরিবারও বেশ বনেদী পরিবার।মমিন শেখ আর ভাবলেন না।পাকা কথা দিয়ে তবে বাড়ি ফিরলেন।
এই খবর ভূমির কানে পৌঁছানোর পর ঝামেলা হলো।সে এই ছেলেকে বিয়ে করবে না।ইশতিয়াকের সাথে ভূমির তখন কঠিন প্রেম চলছে।একদম জীবন-মরণ প্রেম। ইশতিয়াক এ গ্রামের ছেলে,আশা এনজিওতে কোনো এক সাধারণ পদে চাকরি করে। বেতন মাত্র দশ হাজার টাকা। নিজেদের কিছু জমি আছে গ্রামে, ওগুলো বর্গা দিয়ে কিছু বাড়তি ফসল পায়। বাড়ি-ঘরও পুরোনো, ঘরে বৃদ্ধ মা ছাড়া কেউ নেই।মমিন শেখের কানে ভূমির প্রেমের খবর গেলো।ইশ! তারপর যা মার খেয়েছে ভূমি। উঠোনে ফেলে চ্যালাকাঠ দিয়ে মেরেছে মমিন শেখ।শেষে ভূমি যখন বমি করে দিলো, তখন থামলো।কত জায়গা দিয়ে রক্ত পড়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। মমিন শেখের এক কথা,মেয়েকে ইশতিয়াকের কাছে কিছুতেই বিয়ে দেবেন না।
ভূমিও চুপ মেরে গেলো।হয়তো ভেবেছিল এখানে বিদ্রোহ করে লাভ নেই। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক থাকলেও বিপদ হয় বিয়ের দিন সকালে। ফজরের পর থেকে ভূমির খোঁজ নেই।নেই মানে একদম নেই।এবাড়ি-ওবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলো সবাই।ইশতিয়াকের বাড়িতেও খুঁজলো। ইশতিয়াকও বাড়িতে নেই। দুয়ে-দুয়ে চার মেলাতে কষ্ট হয় না।সারা গ্রামে খবর রটে গেলো,মমিন শেখের মেয়ে পালিয়ে গেছে।সূচিও গিয়েছিল ইশতিয়াকের বাড়ি।ভেবেছিল বাবা হয়তো ইশতিয়াক ভাইয়ের মায়ের সাথে ঝামেলা করবে।কিন্তু না,ওসব কিছুই হলো না।মমিন শেখ বাড়ি ফিরে এলেন।উঠোনে রান্নার জন্য বিশাল বিশাল পাতিল রাখা ছিল।সেগুলো এক লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন। স্ত্রী এবং সূচিকে ঘরে ডেকে বললেনঃ” ওই পাপ আবার ফিরা আইব। এই গেরামেই আইব।আমার ঘর থেকা একটা মানুষ যদি ওর লগে দেখা করতে যায়,তাইলে আল্লাহর কসম আমি হেরে জবাই দিয়া মেঘনায় ভাসামু। কথাডা মাথায় থাকে যেন।”

এরপর কত বছর এলো-গেলো। ভূমি গ্রামে ফিরে এলো।অবশ্য না এসেও উপায় নেই। ইশতিয়াকের চাকরি এই গ্রামে,মা এই গ্রামে, জায়গা-জমি এই গ্রামে। ভূমি -ইশতিয়াক কতোদিন সূচিদের বাড়ি এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল! শুধু একবার বাবা-মায়ের পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। কিন্তু কাজ হয়নি। মমিন শেখ তার কথা রেখেছেন।এক কালের আদরের মেয়ের মুখ নিজেও দেখেন না,স্ত্রীকেও দেখতে দেন না।তবে সূচির কথা ভিন্ন।সে যখনই সুযোগ পায়,তখনই বাবা-মায়ের চোখ বাঁচিয়ে বোনের বাড়ি ঘুরে আসে।আগেই বলেছি সূচির প্রধান দূর্বলতাই ভূমি।ভূমির শ্বাশুড়িও গত হয়েছেন দুই বছর আগে।একা বাড়িতে বোনটা থাকে,সূচি বোনের চিন্তায় মরে যায়।বাড়িতে একটু ভালো খাবার,একটু পিঠাপুলি তৈরি হলেই, বক্স ভরে বোনের বাড়ি দিয়ে আসে সূচি।রত্নাদের বাড়ির কাছেই ভূমির বাড়ি।দশ মিনিটের রাস্তা বড়জোর। সূচির বেশ সুবিধা হয়।ইশতিয়াকের প্রমোশন হয়েছে,বেতন বেড়েছে,ভূমির সংসারের উন্নতি হয়েছে।তবুও বাড়ি থেকে লুকিয়ে নেওয়া একটুখানি খাবার যখন সে চেটেপুটে খায়, তখন সূচির কেন যেন পৃথিবী অন্ধকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। সে যদি পারতো তবে তিনবেলায় নিজের ভাগের খাবারটুকু বোনকে দিয়ে যেত। বড় আপা এমন তৃপ্তি নিয়ে খায় কি করে? বড় আপাকে ছাড়া সূচি তো খেতে পারে না।

রত্নাদের বাড়িতে ঢুকে রত্নাকে ডাক দিলো সূচি।রত্না হয়তো জেগেই ছিল।ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠোনে আসতেই খালি বক্স রত্নার হাতে ধরিয়ে দিলো সূচি।

_” আন্টি যা রান্না করেছে তার থেকে একটু তরকারী দে।”

_” শিম আর নতুন আলুর তরকারী। এগুলা নিবি?”

_” হুম নেব, তাড়াতাড়ি দে।”

রত্না রান্নাঘর থেকে এক বক্স তরকারী এনে দেয়।সূচির হাতে বক্স দিতে দিতে বলেঃ” ভূমি আপার বাসায় গেসিলি?”

_” হুম।আজ বিকালে আর আমাদের বাসায় যাবি না।আম্মা সন্দেহ করবে।”

_” কিন্তু আমি যে ভাবলাম বিকালেই ফয়সাল ভাইয়ের খামারে একটা টিকটক করমু। রাতুল নাকি আমার সাথে একটা ডুয়েট ভিডিও বানাইব।”

ফয়সালের নাম শুনে পেটের ভিতর মোচড় দেয় সূচির।তবে সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলেঃ” তোর টকটক কালকে করিস,আজকে না।আর খবরদার আম্মার কানে যদি ভূমি আপার খবর যায়,তবে আন্টির কানে আমি তোর সৌদিয়ান প্রেমিকের কথা দিয়ে দেব।তখন তোর টকটক ডুয়েট আন্টি তোর …. হু হু ”

সূচি ইশারায় কি বুঝিয়েছে তা বেশ বুঝতে পেরেছে রত্না।বেছে বেছে একশটা গালি দিলো মনে মনে।ভেবেছিল ব্ল্যাকমেইল করে সূচিকে বাড়ি থেকে বের করবে,কিন্তু তার আগেই মেয়েটা মুখ বন্ধ করে দিলো।সূচিকে ছাড়া রত্নার চলে না।লো বাজেটের টিকটকে ক্যামেরাম্যানের কাজ করে সূচি।
সূচির গমন পথের দিকে অগ্নিচোখে চেয়ে রইলো রত্না।মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটার সাথে জ্বিন-ভূত কিছু আছে।নাহয় রত্নার গতিবিধি এতো সুক্ষ্মভাবে কি করে ধরে ফেলে বেয়াদবটা?

***

সূচি বাড়ি ফিরলো সাড়ে তিনটায়।উঠোনের মাঝখানে থাকা বিশাল শিমুল তুলা গাছের নিচে রোদ পোহাচ্ছেন আলেয়া খাতুন।এ বাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন ব্যক্তি।মমিন শেখের আপন চাচী।সূচি দু-চোখে দেখতে পারে না এই মুরুব্বিকে।মায়ের কাছে শুনেছে এককালে বউদের বিরুদ্ধে কূট-কাচালীতে তিনিই ছিলেন সেরা। বউদের হাড়-মাংস এক করে জ্বালিয়েছে।
সূচিকে দেখে হাতের ইশারায় ডাক দিলেন আলেয়া খাতুন।

_” কি রে, কই গেসিলি? বড় বুড়ির কাছে?”

সূচি মনে মনে হাসে। ওর পেট থেকে কথা বের করার ধান্দা। সূচিও বোরকা তুলে বসে পড়ে দাদীর পাশে।চুপিচুপি বলেঃ” তোমাকে বলছি, আর কাউকে বলবে না কিন্তু।”

_” আচ্ছা ক।আমি কাউরে কমু না।বড় বুড়ি নাকি পোয়াতি? শরীর ক্যামন তার?”

_” তোমার বড় বুড়ির খবর আমি জানি না।রত্নাদের বাড়ি গেছিলাম।ওদের হিজল গাছে নাকি প্রতি দুপুরে দাদাকে দেখা যায়। বউয়ের শোকে পা ঝুলিয়ে কাঁদে আর গান গায়।তুমি যাবে নাকি দাদার কাছে? আর কতো দুনিয়ার মায়া করবে?এবার দাদার কথাটাও ভাবো।তারও তো একটা সঙ্গী দরকার।”

মুহূর্তেই পায়ের ছেঁড়া জুতো উড়িয়ে মারেন আলেয়া বানু।বিরবির করে একগাদা গালি দিলেন।সূচি ইচ্ছে করে দাঁত বের করা হাসি দিয়ে আলেয়া বানুর রাগের পারদ আরো বাড়িয়ে দিলো।এসব গালি-গালাজ সে থোড়াই কেয়ার করে।

সূচির মা, সাহিদা বেগম মেয়ের আশায় বসে ছিলেন।মেয়ে ঘরে ফিরতেই গর্জে উঠলেন তিনি।

_” এতো দুপুরে মাইনষের বাড়িতে কি তোর? অনেক বাড় বাড়ছোছ সূচি।কবে জানি তোরে মাইরা আধমরা করি।”

বোরকা খুলে বক্সটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলো সূচি।

_” রত্নার মা তোমার জন্য তরকারী পাঠিয়েছে।খেয়ে নিও।আর ওসব মার-টারের ভয় দেখায়ো না। ওসব আর গায়ে লাগে না এখন। তোমরা এমনিতেও মারো,ওমনিতেও মারো।আমি কিছু করলেও মারো, কিছু না করলেও মারো।”

দড়ি থেকে গামছা নিয়ে কল-তলার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সূচি।মাহমুদা বেগম পিছন থেকে বললেনঃ” তোর আব্বা আসুক আজকে। তোর একদিন কি আমার একদিন।এতো বেয়াদবি কই শিখলি,ওইটাই দেখুম।”

_” বাঁশের কঞ্চির চাইতে চ্যালাকাঠের মারে ব্যাথা বেশি লাগে,আগেই বলে দিলাম।আর এর চাইতে বেশি মারতে চাইলে দা নিয়ে সোজা গলায় একটা কোপ দিয়ো।ব্যাস! কেচ্ছা খতম।”

মাহমুদা বেগমের ছোট-খাটো শরীরটা রাগে কেঁপে উঠলো।সূচি আর দাঁড়ালো না।কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে বেড়িয়ে গেল দরজা দিয়ে।সূচি নামের মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত বেয়াদব।

চলবে…

#শুকতারা (পর্ব-১)

  • #হালিমা রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here