শুকতারা পর্ব-২৬

0
1003

#শুকতারা (পর্ব-২৬)
#হালিমা রহমান

প্রিয় সূচি,

তোমাকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি না।দু-একদিনের পরিচয়ে আর কতটুকুই বা চেনা যায়? তোমার দশাও ঠিক আমার মতোই।অল্প পরিচয়ের খাতিরেই আজ দারুন এক কাজ করতে বসেছি। তোমাকে বিশাল এক চিঠি লিখছি।কষ্ট করে পুরোটা পড়বে।স্বল্প পরিচয়ের দোহাই দিয়ে লেখাগুলোকে অবহেলা কর না।

ছোটবেলায় আফজাল ভাইকে দেখে খুব অবাক হতাম।এতো বাধ্য ছেলে আমি কখনো দেখিনি।বড় হওয়ার পরেও চাচিমার কথা ছাড়া সে এক পা নড়তো না।আমার কেবল মনে হতো এই ভক্তির কতটুকু কৃত্রিম, আর কতটুকু আসল।কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে একদিন প্রশ্ন করেই ফেললাম।মেজ ভাই মুচকি হেসে উত্তর দিলো,” আমার মা জীবনে খুব কষ্ট করেছেরে অন্তু।নিজেদের ঘরেও কখনো শান্তি পায়নি।দাদীর জীবদ্দশায়ও খুব একটা শান্তি পায়নি।দাদী যে বছর মারা গেল সেইবার একটা ঘটনা ঘটেছিল।আমাদের বাড়িতে মেহমান আসবে। মা সারাদিন রান্না করলো।সন্ধ্যার দিকে বসলো পিঠা বানাতে।সারাদিনের পরিশ্রমে ঘুম ভর করেছিল চোখে।ঘুম ঘুম চোখে পিঠা বানাতে যেয়ে পিঠা ফেললো পুড়িয়ে।এটুকু সহ্য হলো না দাদীর।ঘর ভর্তি মানুষের সামনে চুলের মুঠি ধরে মাকে মারলো।মা আমার ছোট-খাট মানুষ।নিজেকে রক্ষা করার সাধ্য নেই।মেহমানের মতো বাবাও দাঁড়িয়ে ছিলো দরজায়। চুপচাপ মায়ের মার খাওয়া দেখে দরজা থেকে সরে গেল।তবে যাওয়ার আগে এক ফোঁটা পানি পড়তে দেখেছিলাম বাবার চোখ থেকে।”
আমি শ্বাস রোধ করে শুনলাম।মেজ ভাইকে থামার সুযোগ না দিয়ে বললামঃ” তারপর?”

” খুব ছোটবেলা থেকেই বাবাকে আমার কাপুরুষ মনে হতো।সেদিন বুঝলাম,আমার বাবা সত্যিই কাপুরষ। বাবা-মায়ের জন্য যে ভালোবাসাটুকু বরাদ্দ ছিল তার সবটুকু মায়ের উপরেই ঢেলে দিলাম।মায়ের কথা মতো চলতাম।একসময় অভ্যাস হয়ে গেল।এটুকু কর্তৃত্ব খাটিয়ে মা যদি খুশি হয়,তবে তাই হোক।”

আফজাল ভাইয়ের কথা শোনার পর থেকে দাদির উপর থেকে আমার ভক্তি চলে গেল।তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে হতো।এমনিতেও দাদিকে খুব বেশি একটা দেখিনি। মৃত মানুষটাকেই ঘৃণা করতাম খুব। কোনোদিন সময় পেলে মেজ ভাবির কাছ থেকে আমাদের বংশের ইতিহাস শুনে নিও।অনেককিছু জানতে পারবে।
মানুষ দুইভাবে শিখে।দেখে শিখে অথবা ঠেকে শিখে।চাচি আমার এমন ছিল না। সে দেখেই শিখেছে সূচি। এ আমি একদম হলফ করে বলতে পারি। যে মানুষটা চাচিমাকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে,তার থেকেই শিখেছে।হয়তো ভেবেছে,কর্তৃত্ববাদ সকল সুখের মূল।নিজের মুঠিতে এই ক্ষমতা থাকলে আর কিছু লাগে না।নিজেকে তখন রাজা রাজা মনে হয়।যাকে যেভাবে বলবে,সে সেভাবেই ঘুরবে।উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে।ব্যাপারটা লোভনীয় না?কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এক অদৃশ্য বিষ। আমার চাচিমা কর্তৃত্ববাদে জড়ানো। তার একটু-আধটু ফল তোমাকে তো ভোগ করতে হবেই।
জানো, আমি মানুষের মুখ পড়তে জানি।বিশ্বাস করলে না? সত্যি বলছি।উচ্চমাধ্যমিক থেকে হলে থাকি।নানা ধরনের মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। তাই কে সুখী, কে দুঃখী তা মুখ দেখেই একটু একটু বুঝতে পারি। ঘরের পরিস্থিতি দেখেই বুঝেছি,তুমি ভালো নেই সূচি।রক্ত-মাংসের শরীরটা হয়তো এখনো ভালো আছে কিন্তু মনটা নেতিয়ে পড়েছে আরো আগেই। বাসি বকুল ফুলের মতো।
পৃথিবীটা যদি আমাদের মনমতো চলতো তবে দারুন হতো,তাই না? কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা কখনোই সম্ভব না।এখানে হাজার রকমের মানুষ,হাজারটা মন,হাজারটা যন্ত্রণা।তোমাকে এসব সাথে নিয়েই চলতে হবে।ভালো থাকতে হবে।ভালো থাকা এবং বেঁচে থাকা এক কথা না।নির্দিষ্ট আয়ু পর্যন্ত সবাই বেঁচে থাকে কিন্তু ভালো থাকতে পারে কয়জন? তোমার ভালো থাকা উচিৎ সূচি। একদম অনিবার্যভাবে ভালো থাকা দরকার।ভালো না থাকলে কী হবে জানো? সময়ের পরিক্রমায় যখন তুমি চাচিমার জায়গায় থাকবে,তখন তুমিও চাচিমার পথ ধরবে। আরেকটা রোমেলা হবে।তখন কেবল মনে হবে, জীবনে সুখ পাওনি।আরেকজনের উপরে জোর খাটিয়ে এখন সুখ আদায় করতে হবে।তুমি যেভাবে চলেছো,আরেকজনকেও ঠিক সেভাবেই চলতে হবে।চাচিমার রোগটা সংক্রামক।দাদির থেকে চাচি পেয়েছে,চাচির থেকে তুমি পাবে।খুবই সহজ হিসাব।তাই বলছি,এই রোগটাকে সমূলে বিনাশ করার জন্য হলেও তোমাকে ভালো থাকতে হবে।আমাদের বংশটা জর্জরিত হয়ে গেল এই বিশ্রী রোগে।
এখন কথা হচ্ছে তুমি ভালো থাকবে কী করে? নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগবে,এতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কী করে ভালো থাকে মানুষ? এও কি সম্ভব? আমি বলব, অবশ্যই সম্ভব।স্রোতের প্রতিকূলেও নৌকা চলে।তীরে পৌঁছাতে পারে।তুমি কেন পারবে না? সবার ভালো থাকার পদ্ধতি ভিন্ন। তোমারটাও ভিন্ন।নিজের ভালো থাকার পদ্ধতিটা নিজেই খুঁজে নাও। সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেবে নাকি সবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে তা তোমার খুশি। মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলবে নাকি মাথা উঁচু করে মানুষের মতো বাঁচবে,তা তুমি জানো। সহ্য করবে নাকি উপদ্রবের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে,তাও তুমিই জানো।জীবন তোমার,সিদ্ধান্তও একান্ত তোমার। যদি সিদ্ধান্তগুলো নিজের বুদ্ধিতে না নিতে পারো,তবে এক কাজ কর।যে তোমাকে সবচেয়ে বেশি বোঝে,তাকে জিজ্ঞেস কর।তার থেকে বুদ্ধি নাও।তাকে সব খুলে বলো।
এবার ফয়সালের সম্পর্কে কিছু কথা বলি।আমাদের মাঝে সবচেয়ে সুদর্শন,সবচেয়ে অনুগত,বাধ্যগত,ভদ্র, গো-বেচারা ছেলে সে।চাচিমা ওকে উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে।জীবনের চব্বিশটা বছর ও চাচিমার উপরে নির্ভর করে এসেছে। এ অবধি নিজ থেকে একটা সিদ্ধান্তও নেয়নি।এমনকি কোথায় যাওয়ার আগে কী পরবে সেই সিদ্ধান্তটাও চাচিমা নেয়।একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই।মেজ ভাবিকে ওর বেজায় পছন্দ।নিজের মুখে আমাকে বলেছে ও।অথচ দেখো,চাচিমা নিষেধ করেছে বলে এক বাড়িতে থেকেও মুখ চাওয়া-চাওয়ি নেই।ঝগড়ার পর থেকে আফজাল ভাইয়ের সাথে কথা বলে না।কারণ চাচিমা নিষেধ করেছে।অথচ,ভাইয়ের প্রতি ও সবচেয়ে দুর্বল।চিন্তা করতে পারো কিছু?আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওর মেরুদন্ডটাই এখনো পুরোপুরি হয়নি।তোমাদের গোয়ালের গরুটার যেমন কোনো নিজস্বতা নেই,তেমনি আমাদের ফয়সালেরও কোনো স্বকীয়তা নেই।আমি নিশ্চিত গরুগুলো ওকে দেখলে হিংসা করে।ওদের জায়গা হলো গোয়ালে অথচ ওদের সমগোত্রীয় আরেকটা জীবের জায়গা হলো দালানে।এটা হিংসা করার মতোই একটা বিষয়।যদি পারো তো গরুটাকে একটু মানুষ কর।স্বকীয়তা বলতেও একটা শব্দ আছে তা শিখিয়ে দিয়ো।তোমার বরের নামে এতো দুর্নাম করার কারণ একটাই।তোমাকে একটু ধারণা দিলাম। তুমি যদি ভেবে থাক সিনেমার নায়কদের মতো মা-বউ দুজনকেই ব্যালেন্স করে সে চলতে পারবে,তবে তুমি বোকার রাজ্যে আছ।সেই ক্ষমতা তার নেই,সাহসও নেই। দুই জায়গা ব্যালেন্স তো করতে পারবেই না উল্টো সব গুলিয়ে ফেলবে।
অতএব, নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব একমাত্র তোমার।তোমার, তোমার এবং তোমার। আমরা প্রত্যেকেই শুকতারার মতো,নিজ মহিমায় জ্বলজ্বল করার ক্ষমতা আমাদের প্রত্যেকের আছে।কিন্তু সমস্যা হলো আমরা আমাদের ক্ষমতা ভুলে যাই।পৃথিবীতে পাঠানোর আগে আমাদের অন্তরে সৃষ্টিকর্তা কী লুকিয়ে দিয়ে দিয়েছেন,তা আমরা খুঁজে বের করতে পারি না। অন্ধের মতো চোখ বুজে চলি। তোমাকে বলব, চোখ খোল। নিজের দায়িত্ব নিজে বুঝে নাও।তুমিই যদি তোমাকে ভালো না রাখতে পারো,তবে আরেকজন কী করে পারবে?
একটা কথা মনে রাখবে সূচি,মানুষ হিসাবে আল্লাহ আমাদেরকে অনেক অধিকার দিয়েছেন।কিন্তু কারো উপর জুলুম করার অধিকার দেননি।যেই অধিকার স্বয়ং আল্লাহ দেননি,সেই অধিকার আরেকজনকে তুমি কেন দেবে? জুলুম করা এতোই সহজ? তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার মা-বাবাকে কেউ কটু কথা বলবে আর তুমি চুপচাপ ঘাড় নেড়ে শুনবে? আরেকজনের মুখের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে থাকবে? নালিশ করবে? গলা শক্ত করে প্রতিবাদ করতে পারবে না? বলতে পারবে না,আপনি আর একটাও বাজে কথা বলবেন না। এটুকু সাহসও তোমার নেই? তুমি এতোই দুর্বল?

অনেক কথা বলে ফেললাম।তুমি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারছো। আমি কি অনধিকার চর্চা করে ফেললাম সূচি? তুমি আমার ছাত্রীদের বয়সী।এই কয়েকদিন তোমাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি।মনে হলো ধরণীর মতো সব মেনে নিচ্ছ আর ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছ।মৃত্যুপথযাত্রীর জন্যে সবকিছু করা যায়।তাই তোমাকে বাঁচানোর জন্য এটুকুও বলাই যায়।
কিন্তু একটা কথা মনে রেখ সূচি,প্রতিবাদ ও বেয়াদবি ভিন্ন দুটো শব্দ।ভালো থাকা এবং সার্থপর হওয়া দুটো ভিন্ন শব্দ।দুটোর মাঝে গুলিয়ে ফেলো না কিন্তু। প্রথম শব্দগুলো গ্রহণ করার বদলে দ্বিতীয়গুলো গ্রহণ করে ফেলো না আবার।মন-মাথা খুলে কাজ কর। আরেকটা কথা, নিত্যদিনের সংসারের বাইরে মাঝে মাঝে একটু ভিন্ন পথেও হেঁটো দুজনে। একটু এদিক-ওদিক ঘুরতে যেয়ো।ভালো লাগবে।এক ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠবে না। আমার ভাগাভাগির ঘরেও তোমাদের নিমন্ত্রণ রইলো।একদিন সময় করে ঘুরে যেয়ো।চাচিমা, মেজ ভাবীকেও নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, আসার সময় আমার জন্য সন্দেশ বানিয়ে নিয়ে আসবে। সেদিন বানিয়েছিলে, দারুন হয়েছিলো।আরেকটু থাকলে আমি আরেকটু খেতাম। তোমার সন্দেশটা একদম ফার্স্ট ক্লাস হয়।

আজ আর লিখব না।অনেক লেকচার দিয়ে ফেললাম।এখন ঘুম পাচ্ছে,ঘুমাব।শেষ করার আগে আরেকটু বলি,একটা জিনিস খেয়াল করেছো? চিঠির শুরুতে আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসা জানাইনি। গতানুগতিক ধারায় লিখিনি,পত্রের শুরুতে ভালোবাসা নিও।ভুলটা ইচ্ছাকৃত।যেদিন সত্যিকার অর্থে ভালো থাকবে, সেদিন আমাকে জানিয়ো।প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়ে তোমাকে আরেকটি চিঠি লিখব।তার শুরুটা হবে এরকমঃ” প্রথমেই এক আকাশ ভালোবাসা নিও সূচি।”

এবার ইতি টানছি।তোমার জন্য শুভকামনা ও দোয়া রইলো।ভালো থাকতে শিখে যাও তাড়াতাড়ি। দোয়া করি,একটি হাসি-খুশি সূচি হও।কিন্তু আরেকটা রোমেলা হয়ো না।

ইতি
অন্তু।

ড্রয়ার গোছানোর সময় জামা-কাপড়ের ভাঁজের নিচ থেকে চিঠিটা উঁকি দিচ্ছিলো।হাতে তুলে পুরোটা এক শ্বাসে পড়ে ফেললো সূচি। সেই কতদিন আগে চিঠিটা দিয়েছিলো অন্তু।শীতের শেষে বেড়াতে এসেছিল। যাওয়ার দিন হুমায়রার কাছে চিঠিটা দিয়ে গেছে।সূচির হাতে দেয়নি।পরে সু্যোগ বুঝে হুমায়রাই চিঠিটা দিলো।দুই পৃষ্ঠার একটা চিঠি।পরিষ্কার হাতের লেখা।পড়তে বেশ লাগে।নিজেকে খুব বড় মানুষ মনে হয়।মনে হয়, সত্যিই সূচির অনেক ক্ষমতা।চাইলেই অনেককিছু করতে পারে।
সূচি চিঠিটা ভাঁজ করে আবার জামা-কাপড়ের নিচে রেখে দিলো। এটা ফয়সালকে দেখায়নি। চিঠিটা দেখলে নিশ্চয়ই ফয়সাল খুশি হবে না।
ইদানীং খুব গরম পড়ে।দিনের তাতানো গরমে রুটি ভাজার তাওয়ার মতো আগুন গরম হয়ে উঠে পৃথিবী। সূর্য ডোবার পরেও গরম কমে না।রাতের অবসরে পৃথিবী ক্লান্তির উষ্ণ নিঃশ্বাস ছাড়ে।গরম আরো বেড়ে যায়।
মাথার উপরে বিশ্রী ক্যাটক্যাটে শব্দ করে ঘুরছে ফ্যান।এই ফ্যানটার বাতাস কম।ঘামে শরীর ভিজে আছে ।ড্রয়ারের কাপড়গুলো গোছাতে যেয়ে আনমনা হয় সূচি।মাঝে মাঝে অন্তুর কথা তার ভারী মনে পড়ে।অন্তু এখানে থাকতেই রেজাল্ট দিয়েছিলো।এবারেও এ মাইনাস এসেছে। সূচি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।পাশ তো এসেছে।বাঁচা গেল।অন্তু খুব হেসেছিলো তাকে নিয়ে।দিনভর ক্ষেপানোর পর রাতের বেলা গম্ভীরভাবে বললোঃ” পড়াশনা আর করবে না?”

” পড়াশোনা দিয়ে আর কী হবে?আমি তো চাকরি করব না।”

” চাকরি না করলে পড়াশোনা করা যায় না? পড়া ছেড়ে দিয়ো না।কাছেই তো ডিগ্রি কলেজ।ভর্তি হয়ে যেয়ো।আজ মনে হচ্ছে পড়াশোনা কোনো কাজে লাগে না।কিন্তু ভবিষ্যতে এমন মনে হবে না।পড়ালেখা যে কখন, কোথায় কাজে লেগে যায়,তা কেউ বলতে পারে না।”

লোকটা এভাবেই কথা বলতো।এই হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকতো,আবার এই ভারী ভারী কথা বলতো।ঠিক বুদ্ধিজীবীদের মতো।এই চিঠির কথাই ধরা যাক।কত কঠিন কঠিন কথা লিখে ফেললো।যদি রোমেলা বানু অথবা ফয়সালের হাতে চিঠিটা পড়তো! কেমন হতো তখন?

এই চিঠিটা পড়ার পর বেশ কিছুদিন আচ্ছন্ন ছিল সূচি।কথাগুলো শুধু মাথায় ঘুরতো।মনে হতো,ঠিকই তো।সূচি কি মানুষ না? যার মন চায় সেই জুলুম করবে? তার কি মেরুদন্ড নেই?প্রতিবাদ করা এতোই কঠিন?

সহজ-কঠিনের মিমাংসাটা হয়ে গেছে কিছুদিন আগে।পনেরো-বিশদিন আগের কথা বোধহয়। ম্যাড়ম্যাড়ে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে।রাত-দিন খাটতে খাটতে, কথা শুনতে শুনতে,অপমান-গালি গালাজ,তাচ্ছিল্য সহ্য করতে করতে সূচি জর্জরিত।সেই আগের মতোই।তবে নিজের মাঝে একটু পরিবর্তন অনুভব করতে পারছিলো সে। শ্বাশুড়ির প্রতি আগের সেই ভয়টা এখন আর কাজ করে না।তাচ্ছিল্য-অপমানের বিরুদ্ধে কঠিন গলায় কিছু না বললেও চোখ পাকিয়ে চেয়ে থাকে।একদৃষ্টিতে পাথর কঠিন চোখ দিয়ে মেপে দেখে শ্বাশুড়িকে।নিরালা দুপুরে ফয়সালের পাশে বসে কপাল কুঁচকে বলেঃ” আপনি আম্মার সাথে একটু কথা বলুন।”

ফয়সাল অবাক হয়।বালিশে হেলান দিয়ে প্রশ্ন করেঃ” কী ব্যাপারে?”

” আম্মা আমাকে এতো গালাগালি করে কেন? কাজে ভুল হলে ভুল ধরিয়ে দিতে পারে।কখনো কখনো বকাবকিও করতে পারে।বাড়িতে থাকতেও আমি আম্মার কাছে বকা শুনতাম।বকা শোনার অভ্যাস আমার আছে।কিন্তু আম্মা তো আমাকে রীতিমতো গালি দেয়।অশ্রাব্য গালি।শুধু আমাকে না,আমার আব্বা-আম্মাকে জড়িয়েও গালি দেয়।তাদের কী দোষ?”

” আম্মার মুখ একটু খারাপ।একটু কষ্ট করে সামলে নাও।”

” একটু! একটু খারাপ! আমার জন্ম নিয়ে অবধি আপনার আম্মা বাজে কথা বলে।বলে… ছিঃ ওই শব্দটা আমি কিছুতেই মুখে উচ্চারণ করতে পারব না।”— সূচির কন্ঠে বিকৃতি আসে।

” বুড়ো মানুষরা একটু বলেই।আম্মা আমাকেই জানোয়ার ছাড়া কথা বলে না।তুমি তো বাইরের মেয়ে।তাছাড় আম্মা এমনি এমনি বলে? তোমার একটুও দোষ নেই? একহাতে কি তালি বাজে?”

ছলছল চোখে অপলক চেয়ে থাকে সূচি।নিজেকে ধাতস্থ করে বলেঃ”ঠিকই একহাতেই তালি বাজে না। আমার দোষ কী জানেন? আমি যে চুপ করে থাকি,মুখ বুজে সব সহ্য করি তাই আমার সাথেই পারে।আমাকেই চাপে উপর থেকে।আম্মার কথার সাথে আমিও টক্কর দিলে আর পারতো না।দুনিয়াতে দুর্বলরাই চড়-লাথি খাবে এটা তো একদম ধরা কথা।আর আমার বাবা-মায়ের দোষ কী জানেন? তাদের সবচেয়ে বড় দোষ,তারা মেয়ের অভিভাবক। আর দ্বিতীয় দোষ, তারা মেয়েকে কাজ শিখিয়ে পাঠায়নি।অথচ,বিয়ের আগে আপনার মামাই বলেছিলো তার মেয়েও কাজ জানে না।আজ যদি আমার জায়গায় আপনার মামাতো বোনটা থাকতো,তখনও আম্মা এমন করতো? আমি তো বিয়ের আগেই বলেছিলাম, মোটামুটি কাজ জানি।সব করতে পারি না।তবুও শুরু থেকে আনাড়ি হাতে করিনি সব? বলুন, কখনো ফাঁকি দিয়েছি? শিখার চেষ্টা করছি না?”

অভিমানে জড়ানো অভিযোগ। বোকা ফয়সাল অভিমানটুকু ধরতে পারলো না।উঠে বসে বিস্মিত কন্ঠে বললোঃ” এসব আমাকে বলার কী মানে? তুমি কি আমার কাছে আম্মার নামে নালিশ করছো?”

মনে মনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সূচি।আঁচলের কোনে চোখ দুটো ভালো করে মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বললোঃ” না,নালিশ করছি না।দাসী-বাদীদের ওসব বিলাসিতা নেই।আপনি থাকুন।রাত ছাড়া তো আমাকে আপনার কখনোই দরকার পড়ে না।এখন একা থাকতে পারবেন।আসছি আমি।”

এলোমেলো পায়ে ঘর ছাড়ে সূচি।হৃদয়ের গভীর অবধি হাতড়ে হাতড়েও আগের সেই বিধ্বংসী প্রেমের খোঁজ পায় না।সব ফিকে হয়ে গেছে।মাঝে মাঝে নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে।মানুষের মতো দেখতে এই কলাগাছটার প্রেমে ও কী করে পড়লো?

অন্তুর চিঠির প্ররোচনায় পড়ে আরেকটু দুঃসাহস দেখিয়েছিলো সূচি।দশ-বারোদিন আগের কথা।সন্ধ্যার আগে হাঁস-মুরগী খোপে ঢোকানোর দু-সেকেন্ডের মাঝেই আযান দিয়ে দিলো।উঠোন ঝাঁট দেওয়ার সুযোগ হলো না। সন্ধ্যার পর রাতের রান্নার চাপে মনেও ছিল না সূচির।এই ভুলটুকুই চোখে পড়লো রোমেলা বানুর।পুঁথি পাঠ শুরু হল।যেমনটা তিনি সবসময় করেন।সূচির বর্তমানসহ বিগত চৌদ্দ পুরুষ ধরে টান মারলেন।মা-মাসি এক করে ফেললেন একদম। সূচির চোখ-কান লাল হয়ে গেল।সেদিন আর সহ্য হলো না।রান্নাঘরে বসে সবজি কাটছিলো।গালাগালির এক পর্যায়ে বটিটা ফট করে ছুড়ে মারলো একদিকে।রাগে অন্ধ হয়ে শ্বাশুড়ির ঘরে গেল।দরজার সামনে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বললোঃ” কী হয়েছে আম্মা? আপনি কিছু বলছেন?”

রোমেলা বানু অবাক হলেন।একটু ঘাবড়েও গেলেন।মানুষের ভাব-ভঙ্গি বোঝার ক্ষমতা তার আছে।হয়তো মনে মনে একটু থমকেও গেলেন।সূচির বড় বড় চোখগুলো ছিল রক্তজবার মতো লাল টকটকে।তবে দমে গেলেন না।নিজেকে যথাসাধ্য গম্ভীর করে বললেনঃ” উঠান ঝাড়ু দেও নাই ক্যান?”

” আজকে সময় হয়নি তাই দেইনি।কোনো সমস্যা হওয়ার তো কথা না।আমি তো একটা মানুষ।দুইটা হাত।সবদিক সামলে সময় পাইনি।”— সূচির কন্ঠ অবিচল।

” এগুলি কইলে হইব? আমরা কইরা খাই নাই?”

” আমিও তো করেই খাচ্ছি।আর বিকালবেলা আপনিও তো একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারেন।ডায়বেটিস হলে হাঁটতে হয়।হাঁটতে হাঁটতে হাঁস-মুরগিগুলো তুলতে পারেন।”

” তুমি থাকতে আমি করুম?”

” আমি কি এই বাড়ির বউ নাকি বাঁধা দাসী? আপনার সংসারের একটু কাজ আপনি করবেন তাতে আমি থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? আর বলেছি বলেই যে করতে হবে তা তো না।আপনার মন না চাইলে করবেন না।কিন্তু যখন-তখন আমাকে এভাবে গালাগাল করবেন না।আমার আব্বা-আম্মাকে তো একদমই না।তারা এই বাড়িতে এখনো একবেলা ভাতও খায়নি যে তাদেরকে এভাবে বলতে হবে। আমার আব্বা-আম্মার আরেকটু বদনামও আমি সহ্য করব না আম্মা।”

কথার শেষে আর দাঁড়ালো না সূচি।মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল।ভেবেছিল বিশ্ব জয় করে ফেলেছে।রোমেলা বানু এবার কী করবে? একদম উচিত শিক্ষা হয়েছে।

কিন্তু গল্পের শেষটুকু তখনো বাকি ছিল।সূচির ধারনার বাইরের সমাপ্তি।রাতে ফয়সাল এলো।রোমেলা বানু কেঁদে-কেটে পড়লেন।সূচির কথাগুলোতে রং-চং মেখে একগাদা নালিশ করলেন।কপাল চাপড়ে বললেনঃ” তুই কালকেই আমারে তোর মামার বাড়ি দিয়া আসবি।আমার কি কেউ নাই? আমি থাকুম না তোর সাথে।তোর বউ আমারে একলা ঘরে মারতে আসে,হুমকি দেয়।বাবারে বাবা!বান্দির ঝিয়ের কত সাহস! ওর বিচার না করলে আমি একটু দানাও মুখে দিমু না।”

সূচির ডাক পড়লো।ফয়সাল শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলোঃ” সত্যি?”

” আপনার কী মনে হয়? ”

” ত্যাড়া জবাব দিবা না।যা জিজ্ঞেস করছি তাই বলো।”

” আম্মা আবারো বাজে কথা বলছিলো তাই আমি নিষেধ করেছি। আব্বা-আম্মাকে নিয়ে এতো কথা বলার কী আছে? তাছাড়া একদিন বিকালে উঠোন ঝাঁট না দিলে কী হয়? সকালে তো দেই।”

” একটু বকেছে বলে মারার হুমকি দেবে?”

সূচি আকাশ থেকে পড়লো।বিস্মিত কন্ঠে বললোঃ” কী বলছেন এগুলো? মারার হুমকি! আমি!”

” আম্মা মিথ্যা বলছে?”

” তাহলে কি আমি মিথ্যা বলছি?”

কঠিন প্রশ্ন।ভুল-সঠিক নির্ণয় করার ক্ষমতা ফয়সালের নেই।অতএব ফোন গেল সূচির বাবার কাছে।ফয়সাল ভীষণ দুঃখীর মতো বললোঃ” আপনার মেয়েকে নিয়ে আমার সংসার আর চলছে না আব্বা।একটু শান্তি নেই।সকাল-সন্ধ্যা ঝামেলা লেগেই আছে।আম্মা বুড়ো মানুষ। ওনার একটু কথা সহ্য হয় না আপনার মেয়ের।আমার কাছে নালিশ করে,আম্মার মুখে-মুখে তর্ক করে,ধমকি দেয়।আপনারা আসুন।ওর সাথে কথা বলে দেখুন, ও কী চায়।ও কি আলাদা থাকতে চায় আমাকে নিয়ে? এরকম হলে তো আমার পক্ষে সংসার করা সম্ভব না।মাকে ছাড়া আমি এক পা কোথাও নড়ব না।”

মাতৃভক্ত ফয়সালের করুণ বানী এড়াতে পারেননি মমিন শেখ।রতন পাটোয়ারীকে নিয়ে সেই রাতেই ছুটে এলেন বেয়াইবাড়ি। বসার ঘরে নিজের মেয়ের বিচার করতে বসলেন।চারজন বিচারকের সামনে হতবিহ্বল হয়ে পড়লো সূচি।নিজের চোখ-কানকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না।কোথাকার পানি কোথায় যেয়ে গড়ালো!

রোমেলা বানুর ততোক্ষণে জোর হয়েছে।খাটের উপর পায়ের উপর পা তুলে মমিন শেখকে বললেনঃ” ওয় আমার ঘরে বউ। ওরে আমি বকুম,মারুম,কাটুম।ওয় টু শব্দ করব ক্যান? খাওয়া-পরায় কোনো কষ্ট দিতাছি না।আমার সোনার টুকরা পোলা।মাইনষের জামাইরা কিছু থেকা কিছু হইলে বউ মারে।আমার পোলার ঐ বদঅভ্যাসও নাই।
ফুলের টোক্কাও লাগতে দেয় নাই বউয়ের গায়ে।তবুও আপনার মেয়ের হাজারটা অভিযোগ, হাজারটা চাহিদা। ভুল করলে আমার দুইটা কথাও গায়ে সয় না।কুইদ্দা আমারে মারতে আসে।”

সূচি আর্তনাদ করে উঠে।বিস্মিত গলায় বলেঃ” কী বলছেন…

” সূচি।”— মমিন শেখের কঠিন কন্ঠের কাছে থই পায় না সূচি।রোমেলা বানু হামলে উঠেন।নড়েচড়ে বসে বলেনঃ” দেখছেন ভাই? আপনের মাইয়ার অবস্থা দেখেন।আমারে মিথ্যাবাদী কয়।”

সে’রাতে অভিনয়ের পালা সাঙ্গ হলো রাত দশটায়।সমাপ্তিটা নাটকীয়,সূচির ধারণার বাইরে।চারজন বিচারকের রায়ে ভরা মজলিসে শ্বাশুড়ির পায়ের কাছে বসতে হল।দু-হাতে পা আঁকড়ে কেঁদে-কেঁদে বলতে হলোঃ” আমাকে মাফ করে দিন আম্মা।আমি আর কখনো করব না।”

অবাধ্য মেয়েকে বাধ্য করা অপরিহার্য।মেয়ের কোনো কথায় কান দিলেন না মমিন শেখ।যাওয়ার আগে মেয়েকে একলা ডেকে বললেনঃ” ভাবিছ না বিয়া হইছে বইলা তোরে আমি মারতে পারুম না।আমার লাঠি এখনো পড়ে নাই।আরেকদিন যদি আমার কাছে বিচার যায়,তাইলে দেখিছ কী হয়।তোরে কাইট্টা যদি মেঘনায় না ভাসাইছি তো আমার নাম মমিন না।দুইটা অমানুষের জন্ম হইছে আমার ঘরে।আমার মুখ পোড়ানোর লেগাই জন্মাইছোছ তোরা।একটায় করল আকাম,আরেকটায় তিন জনের সংসারেই খাইতে পারে না।অলক্ষ্মী কতগুলা।”

পুরোটা সময় বিমূঢ়ের মতো চেয়ে ছিল সূচি।শুধু একটা কথাই মাথায় ঘুরেছে।নিজের মেরুদন্ডটা কি ঠিকঠাকমতো তৈরি হয়েছে?

কাপড়ের ভাঁজের নিচ থেকে চিঠিটা বের করে আরেকবার পড়লো সূচি।পড়া শেষে একটু হাসলো।সেইদিনের পর থেকে এখন আর খুব একটা উচ্চ-বাচ্য করে না।ইদানিং রোমেলা বানুর মুখ ছুটে দ্বিগুণ তেজে।তার আর দোষ কী?নিজের দিকের মানুষরাই তো বোঝে না।তারাই তো সুযোগ দিয়েছে।
সুযোগের সদ্ব্যবহার কে না করে?

অবহেলায় চিঠিটাকে আবারো জায়গা মতো রেখে দিলো সূচি।অন্তু ভাই কথাগুলো লিখেছিলেন রাতের আঁধারে।তাই এতো সহজে লিখতে পেরেছেন।বলার সময় তো কতকিছুই বলা যায়।চামড়ার মুখ দিয়ে বের করা কথাগুলো কাজে করে দেখানো কি এতোই সহজ? পৃথিবী কি ঝামেলাহীন?

ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ।বদ্ধ ঘরে কাজ করতে করতে শ্বাস নেয় সূচি।একদলা গরম বাতাস টেনে নেয় নিজের মাঝে।বাতাস স্বস্তি দেয় না।উষ্ণ বাতাস চোখ-মুখ পুড়িয়ে দেয় অগ্নি শিখার মতো।সূচির স্বস্তি মিলে না।অস্বস্তি মেশানো অশান্তিতে জড়িয়ে যায় সর্বাঙ্গ।এ বাতাসে সুখ নেই,একটুও সুখ নেই।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here